বাড়ি শিক্ষাব্যবস্থা

শিক্ষাব্যবস্থার বর্তমান জীর্ণদশার দায়ভার কার?

প্রাইভেট ও কোচিং ব্যবস্থার দৌরাত্ম্য শিক্ষাব্যবস্থার বর্তমান এক করুণ চিত্র তুলে ধরে: ছবিসূত্র: ময়মনসিংহ প্রতিদিন
প্রাইভেট ও কোচিং ব্যবস্থার দৌরাত্ম্য শিক্ষাব্যবস্থার বর্তমান এক করুণ চিত্র তুলে ধরে: ছবিসূত্র: ময়মনসিংহ প্রতিদিন

বহু চড়াই-উতরাই পার হয়ে আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থার বর্তমান অবস্থা আমরা দেখছি। তবে বহু কাঠ-খড় পুড়িয়েও বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার গুণগত তেমন কোন উন্নয়ন সাধন করা সম্ভব হয় নি। এখন প্রশ্ন হল, কেন সেটি সম্ভব হয় নি? আসলে কোন দেশের গোটা শিক্ষাব্যবস্থা হুট করে পালটে দেয়া সম্ভব নয়। শিক্ষা একটি রাষ্ট্রের বিশাল সেক্টর। বহু আন্দোলন-সংগ্রাম, অর্থ এবং বহু মানুষের সদিচ্ছা এবং পরিশ্রম ব্যয় করে জাতিকে একটি যুগোপযোগী শিক্ষা কাঠামো উপহার দেয়া সম্ভব হয়। দীর্ঘ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন এবং তারই ধারাবাহিকতায় আগত পাকিস্তানের নিপীড়ন সর্বস্ব শাসন ও শোষনমূলক শিক্ষাব্যবস্থা বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থাকে বহুলাংশে পীড়িত করে যাচ্ছে আজ অবধি। স্বাধীনতার ৪০ তম বছরেও ঔপনিবেশিক আমলের শিক্ষাব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারারও সুনির্দিষ্ট কিছু কারণ বিদ্যমান।

শিক্ষিত জনগোষ্ঠী ব্যতীত কোন রাষ্ট্রের উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই দেশে যুগোপযোগী ও উন্নত শিক্ষাব্যবস্থা চালু হলে জাতি হিসেবে আমরা শিক্ষিত হয়ে যাই তাহলে আমাদেরকে যারা শোষন করে তাদের বিরাট অসুবিধা হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে, আমরা শুধুমাত্র রাষ্ট্রযন্ত্র দ্বারা শোষিত নই, বরং রাষ্ট্রযন্ত্রের সুবিধাভোগী একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠী দ্বারাও নিপীড়িত। সরকারি ক্ষমতাশালী আমলা থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী মহল কর্তৃক শোষিত এ দেশের জনগণ। সেই কারণে দেশে শিক্ষা আজ ব্যবসার পণ্যে পরিণত হয়েছে। আমাদের মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী শিক্ষা নিয়ে ব্যবসা করতে যতই নিষেধ করুন না কেন শিক্ষা বানিজ্য আজ খুব লাভজনক আয়ের পথ। প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা থেকে আরম্ভ করে উচ্চ শিক্ষা পর্যন্ত শিক্ষাবাণিজ্যের হাত প্রসারিত।  প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হলে আজ মোটা অঙ্কের অর্থ ব্যয় করে কোচিং করতে হয়। তথাকথিত নামজাদা বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হলেও অনুদান বাবদ গুণতে হয় বিপুল পরিমাণ টাকা। অনুদান বলি আর কোচিং ফি যাই বলি না কেন মা-বাবাকে দায়গ্রস্তের মত সন্তানের শিক্ষার পেছনে অনেক টাকা ঢালতে হয়। পাছে যদি ছেলে বা মেয়ে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে ব্যর্থ হয়? গোটা শিক্ষাওব্যবস্থা এক অসুস্থ প্রতিযোগিতার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে।

বিদ্যালয়ে ভর্তির পরও রয়েছে প্রতি বিষয়ের জন্য প্রাইভেট শিক্ষক রাখা কিংবা মোটা ব্যাগ কাঁধে নিয়ে কোচিংয়ে দৌড়ানো আজ সকালে আটা রুটি দিয়ে আলু ভাজি খাওয়ার মত স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এটি শিক্ষাব্যবস্থার বর্তমান এক করুণ চিত্র তুলে ধরছে। পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণীতে সমাপনী পরীক্ষা আশানুরূপ ফল লাভের আশায় রয়েছে বিশেষ কোচিংয়ের ঐতিহ্য। এই কোচিংয়ে নগদ অর্থের বিনিময়ে ভাল ফল লাভের নিশ্চয়তা দেয়া হয়। একই ধারাবাহিকতা দেখা যায় মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় মা-বাবার মান সম্মান রক্ষা ও ভবিষ্যতে রুটি-রুজি যোগাড়ের নিশ্চয়তার জন্য গোল্ডেন ফাইভের হাতছানি। সে লক্ষ্যে ব্যাংক একাউন্ট খালি করে মডেল টেস্ট, ক্র্যাশ প্রোগ্রাম, বিশেষ ব্যাচে ভর্তির প্রয়োজনীয়তা সৃষ্টি হয়। যে ছেলেমেয়েরা আজ কোচিং-স্যারের বাসা ছাড়া কাঙ্ক্ষিত ফল লাভ করতে ব্যর্থ হয় তাদের পিতা-মাতাই এসব ছাড়া আজ দিব্যি করে খাচ্ছে। এখান থেকে কি এরকম আশংকা করা অমূলক যে, শিক্ষা আজ বাণিজ্যের এক বিশাল সম্ভাবনাময় খাত?

উচ্চ শিক্ষার দশা তো আরও করুণ। বাজারে চাহিদা রয়েছে এমন কিছু বিষয় খুলে বসেছে গাদাখানেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। জমি বিক্রি করে সেখানে গিয়ে “শিক্ষিত” হতে হচ্ছে বর্তমান প্রজন্মকে। আকাশচুম্বি টিউশন ফি প্রদান করে সেখান থেকে উন্নত জাতের কর্মী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে তারা। এরপর বিদেশি প্রতিষ্ঠানে শ্রম বিক্রি করে করপোরেট সুখ লাভ করছে। সৃজনশীলতা, গবেষণা অচ্ছুত। সৃজনশীল উচ্চ শিক্ষার অভাবে আমাদের দেশ কোন জ্ঞান সৃষ্টি করতে পারছে না। বিদেশি জ্ঞান ধার করে এনে শিক্ষিত শ্রমিকের ন্যায় খেটে মরছে। লাভের গুড় খেয়ে নিচ্ছে ফর্মুলা আবিষ্কারকের দল। ধার করে কোনদিন মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো যায় না।

সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে একাধারে যেমন চলছে দলীয়করণ,  অনিয়ম ও দুর্নীতি অন্যদিকে তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে অমুক-তমুক উন্নয়ন ফি। টিউশন ফি অপরিবর্তিত রেখে অন্যান্য ফি বাড়িয়ে শুভংকরের ফাঁকিতে ফেলা হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। শিক্ষার্থীদের প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত না করে কীসের উন্নয়ন ফি নেয়া হয় তা আমাদের বোধগম্য নয়। হলে উঠতে হলে দলীয় রাজনীতির লেজুড়বৃত্তি করতে হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে চড়তে হয় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। এদিকে সরকার থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণাসহ অন্যান্য খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করা হচ্ছে। অতিরিক্ত সেই অর্থ কোথায় কীভাবে ব্যয় হচ্ছে তা সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের পরিষ্কার ধারণা পর্যন্ত নেই।

দেশের গোটা শিক্ষাব্যবস্থার বর্তমান এই জীর্ণদশার জন্য কাকে দায়ি করা সমীচীন হবে? এককভাবে সরকার কিংবা জনগণকে দায়ি করা ঠিক হবে না। নিজেদের প্রাপ্য অধিকার বুঝে পেতে জনগণকেই এগিয়ে আসতে হবে সৎ নেতৃত্ব সৃষ্টির মাধ্যমে। অন্যদিকে সরকারকেও জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকতে হবে। মানুষের অন্যতম মৌলিক অধিকার শিক্ষা নিশ্চিত করার দায়িত্ব যেমন রাষ্ট্রের তেমনি তা আদায় করে নেয়ার সমান দায়িত্ব জনগনেরও। শিক্ষার অভাবেই জনগণ তার ন্যায্য শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাই আর সময় নষ্ট না করে শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দিয়ে উন্নয়নের জন্য সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

কোন মন্তব্য নেই

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Exit mobile version