বাড়ি উপানুষ্ঠানিক

টেলিভিশন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিজ্ঞান শিক্ষা জনপ্রিয়করণ: একটি প্রস্তাব

টেলিভিশন ও বিজ্ঞান শিক্ষা; ছবি: india today
টেলিভিশন ও বিজ্ঞান শিক্ষা; ছবি: india today

মানব মস্তিষ্কের ধর্মই এমন। আনুষ্ঠানিক পদ্ধতির চেয়ে অনানুষ্ঠানিক উপায়ে শিক্ষাটা হয় বেশি, বিশেষত বিজ্ঞান শিক্ষা। বিজ্ঞানীরা বলেন, আমরা স্কুলের শ্রেণীকক্ষে যতোটা না শিখি, তার চেয়ে ঢের বেশি শিখি মাঠে-ঘাটে, বাসার ড্রয়িংরুমে। যে পরিস্থিতিতে মস্তিষ্ক আরাম পায়, সে পরিস্থিতিতে তার সক্রিয়তা ও ক্ষমতাও বৃদ্ধি পায়। ফলে শিখনও হয় বেশি।

মনে পড়ে, ছোটবেলায় মা রিকশায় স্কুলে নিয়ে যেতেন। আনা-নেয়ার পথে বাংলা বাক্য ধরিয়ে দিয়ে ইংরেজি করতে বলতেন। তখন খুব বিরক্ত লাগতো। কিন্তু এখন বুঝি স্কুলের ইংরেজি ক্লাসে কিংবা চৌধুরী-হোসেনের গ্রামার বইয়ের থেকে বেশি ইংরেজি শিখেছি মায়ের কাছ থেকে, ঐ রিকশায় বসে।

দেশে বিজ্ঞান শিক্ষার হাল-হকিকত খুব খারাপ। বিজ্ঞান পড়তে শিক্ষার্থীরা ভয় পায়, বিজ্ঞান পড়ে ক্যারিয়ার খারাপ হয়। অন্যদিকে ব্যবসায় শিক্ষা পড়ে বড় এক্সিকিউটিভ হওয়া যায়, লিবারেল আর্টসের বিষয়ে পড়লে বিসিএসের জন্য প্রস্তুতিটা ভালো করে নেয়া যায়। খামোখা বিজ্ঞান পড়ে কী হবে? প্রকৌশলী হয়ে সৃজনশীলতার সুযোগ নেই, সুযোগ আছে শুধু যন্ত্রপাতি রক্ষণাবেক্ষণের। চিকিৎসক হয়ে প্রতিষ্ঠিত হতে হতে নাতির মেডিকেলে পড়ার বয়স হয়ে যায়। আর বিজ্ঞান বলতে ওই মেডিকেল আর ইঞ্জিনিয়ারিং, পদার্থ-রসায়ন-প্রাণীবিদ্যা কোন ছাড়! ওসবে ক্যারিয়ার আছে নাকি?

দেশে বিজ্ঞান বিষয়ে গবেষণার বড্ড অভাব– এটি একখানা পুরনো কথা। অর্থ নেই দেখে গবেষণা নেই, গবেষণা নেই দেখে আবিষ্কার নেই, আবিষ্কার নেই দেখে অর্থ নেই। এ এক ভয়ানক দুষ্ট চক্র! এ পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে বিজ্ঞান সেক্টরে মেধাবীদের প্রয়োজন, প্রয়োজন বিনিয়োগের। তবে সবচেয়ে আগে প্রয়োজন বিজ্ঞানের প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহ, কৌতুহল এবং ভালোবাসা। আর শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানের জন্য নাচার করতে হলে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে বিজ্ঞান শিক্ষাটাও হতে হবে খাসা।


বিজ্ঞান পড়তে শিক্ষার্থীরা ভয় পায়, বিজ্ঞান পড়ে ক্যারিয়ার খারাপ হয়। অন্যদিকে ব্যবসায় শিক্ষা পড়ে বড় এক্সিকিউটিভ হওয়া যায়, লিবারেল আর্টসের বিষয়ে পড়লে বিসিএসের জন্য প্রস্তুতিটা ভালো করে নেয়া যায়। খামোখা বিজ্ঞান পড়ে কী হবে?


স্কুলে বিজ্ঞানের ভালো শিক্ষক নেই। এক্সপেরিমেন্টের জন্য ল্যাব নেই, ল্যাব থাকলেও ল্যাবে যন্ত্রপাতি নেই, যন্ত্রপাতি থাকলেও কয়েকশ ছাত্রের জন্য তা অপ্রতুল। শিক্ষক মশাই বই ধরে পড়ান, অধিকাংশ শিক্ষার্থীই F সমান ma না বুঝে এসএসসি পাশ করে আর E সমান mc স্কোয়ার না বুঝে পাশ করে এইচএসসি। অত বুঝতে গেলে পাশও হবে না, এ প্লাসও আসবে না।

অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল তাঁর একটি বইয়ে বলেছিলেন,  এক কিশোর তার কাছে জানতে চেয়েছিল যে পদার্থবিজ্ঞান বইতে সে পড়েছে বাহ্যিক কোনো বল প্রয়োগ না করলে স্থির বস্তু চিরকাল স্থির এবং গতিশীল বস্তু চিরকাল একই গতিতে একই দিকে গতিশীল থাকবে। কিন্তু বাস্তবে তা দেখা যায় না কেন? গাড়ি চলতে তেল কেন লাগে? একবার ঠ্যালা দিলেই তো হয়। এরপর গন্তব্যে পৌঁছে ব্রেক কষলেই হলো। অধ্যাপক ইকবাল ছেলেটির প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন যে, পদার্থবিজ্ঞানের এ সূত্রটি (নিউটনের গতির প্রথম সূত্র) খাটবে শুধু একটি বায়ুশূন্য, ঘর্ষণবিহীন এবং অভিকর্ষ বলহীন স্থানে। অভিকর্ষ বল এবং ঘর্ষণ বল না থাকলে একটি মালবাহী ট্রাককেও একজন মানুষ হাত দিয়ে ঠেলে সরিয়ে দিতে পারতো।

সত্যি কথা বলতে কি বিজ্ঞানের বিষয়গুলো অনেক উদাহরণ এবং আলোচনার মধ্যে দিয়ে শিখতে হয়। শুধু বই পড়ে তা শেখা দুষ্কর। যেকোনো বিষয়ের ক্ষেত্রেই অবশ্য কথাটি প্রযোজ্য। এত বাস্তব উদাহরণ আর আলোচনার সময় কি ক্লাসে আছে? না নেই। সেজন্যই বিজ্ঞান শিক্ষার একটি বড় অংশ হতে হবে উপানুষ্ঠানিক উপায়ে। শুধু শ্রেণীকক্ষে বিজ্ঞানের প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহী করে তোলার জন্য যথেষ্ঠ সময় পাওয়া যায় না।

সেজন্য উপানুষ্ঠানিক উপায়ে বিজ্ঞান শিক্ষার প্রতি শিশু-কিশোরদের আগ্রহী করে তোলার মোক্ষম উপায় হতে পারে টেলিভিশন অনুষ্ঠান। এমনিতেই ছেলেমেয়েরা টিভি দেখতে পছন্দ করে। টিভিতে যদি মজার কোনো বিজ্ঞান শিক্ষা-বিষয়ক অনুষ্ঠান হয়, তাহলে হলফ করে বলা যায় যে ছেলেমেয়েরা অত্যন্ত আগ্রহ করেই তা দেখবে। দেশের সরকারি টিভি চ্যানেল বিটিভিতেই বিজ্ঞান নিয়ে শিক্ষাধর্মী অনুষ্ঠান হতে পারে। সে অনুষ্ঠানে ছোটদের উপযোগী মজার এক্সপেরিমেন্ট দেখানো যেতে পারে। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে।

“ছোটদের মজার এক্সপেরিমেন্ট” শীর্ষক একটি বইতে পানির ওপর সূঁচ ভাসানোর একটি এক্সপেরিমেন্ট পড়েছিলাম ছোটবেলায়। বাসায় খুব সহজে সেটা করেও দেখেছিলাম। সাধারণভাবে একটি বাটিতে পানি নিয়ে তাতে একটি সূঁচ ছেড়ে দিলে তা নির্ঘাত ডুবে যাবে। কিন্তু পানির ওপর প্রথমে টিস্যু পেপার বিছিয়ে সূঁচটি তার ওপর রাখলে টিস্যুসহ তা ভেসে থাকবে। এমনকি আলতো করে সূঁচের নিচ থেকে টিস্যু পেপারটি সরিয়ে ফেললেও দেখা যাবে সূঁচটি পানিতে ভাসছে। পানির Surface Tension এর কারণে এমনটি ঘটছে। একই কারণে পানির ওপর অনেক পোকা হেঁটে বেড়াতে পারে। খুব সাধারণ এবং সস্তা একটি এক্সপেরিমেন্ট।


লক্ষ্য রাখতে হবে যেন শিশু-কিশোর-তরুণদের কাছে জনপ্রিয় কোনো বিজ্ঞান বিষয়ক ব্যক্তিত্বকে দিয়ে অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করানো হয়। আরো লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন, অনুষ্ঠানটি যেন শুধু বিজ্ঞানের চমক দেখাতেই অধিক আগ্রহী না হয়ে পড়ে; বরং চমকের পেছনের কারণ অর্থাৎ বিজ্ঞান শিক্ষার বিষয়টি যথেষ্ঠ গুরুত্ব পায়।


এরকম এক্সপেরিমেন্ট প্রদর্শনের মাধ্যমে শিশু-কিশোরদের মনে বিজ্ঞানের প্রতি ভালোবাসা জন্মানো সম্ভব, সহজেই। একই সাথে অনুষ্ঠানটিতে বিজ্ঞান বিষয়ক বিভিন্ন তথ্যচিত্র দেখানো যেতে পারে। অনুষ্ঠানের প্রতি পর্বের শেষে সৃজনশীল কুইজ প্রতিযোগিতাও থাকতে পারে। সপ্তাহে একদিন আধা ঘন্টা থেকে ৪৫ মিনিটের একটি করে পর্ব প্রচারিত হতে পারে। এমনকি সারা বছরই যে অনুষ্ঠানটি প্রচার করতে হবে ব্যাপারটি তা নয়। বছরের দুই-তিন মাস সময় গবেষণা ও তথ্য সংগ্রহের জন্য অনুষ্ঠানটি বন্ধ থাকতে পারে।

লক্ষ্য রাখতে হবে যেন শিশু-কিশোর-তরুণদের কাছে জনপ্রিয় কোনো বিজ্ঞান বিষয়ক ব্যক্তিত্বকে দিয়ে অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করানো হয়। আরো লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন, অনুষ্ঠানটি যেন শুধু বিজ্ঞানের চমক দেখাতেই অধিক আগ্রহী না হয়ে পড়ে; বরং চমকের পেছনের কারণ অর্থাৎ বিজ্ঞান শিক্ষার বিষয়টি যথেষ্ঠ গুরুত্ব পায়। অনুষ্ঠানটি তৈরি করার ক্ষেত্রে অবশ্যই বিজ্ঞান শিক্ষা নিয়ে কাজ করছেন এমন ব্যক্তিবর্গের সহায়তা গ্রহণ করতে হবে। আর ফান্ডিং এর বিষয় নিয়েও সমস্যা হওয়ার কথা না। ইউনিসেফ বা সেভ দ্য চিলড্রেনের মতো আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা এক্ষেত্রে অর্থ সহায়তা দিতে রাজি হবে বলে মনে করি।

“কীভাবে বিজ্ঞান শিক্ষা জনপ্রিয় করা যায়”- এ নিয়ে সরকারের কর্তাব্যক্তিরা যথেষ্ঠ ব্যস্ত সময় পার করছেন। মিটিং-সিটিং কম হচ্ছে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের শিক্ষকদেরও ডাক পড়ছে হরহামেশা। শিক্ষামন্ত্রী মহোদয়ও একাধিকবার বিজ্ঞান শিক্ষা নিয়ে তার টেনশনের কথা প্রকাশ করেছেন। তাই আশা করবো, উল্লেখিত প্রস্তাবখানা সরকারের নীতি-নির্ধারকগণ বিবেচনা করে দেখবেন।

কোন মন্তব্য নেই

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Exit mobile version