শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট : শিক্ষাবিজ্ঞানের বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান

আসমা জাহান মুক্‌তা লিখেছেন শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট সম্পর্কে

এইচএসসি পরীক্ষায় ভালোভাবে উত্তীর্ণ হওয়ায় উচ্চশিক্ষা নেবার প্রত্যাশায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হলাম। ঢাল-তলোয়ার (বুদ্ধিমত্তা ও জ্ঞান) সমেত কীভাবে কীভাবে জানি আমি সেই যুদ্ধে জয়লাভ করে বিশাল তালিকার প্রথম দিকেই আমার নাম ও রোল নম্বরটি খুঁজে পেলাম। আমি এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ভাবতেই থেকে থেকে গর্বে আমার বুক ফুলে উঠছিল। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব যে যেখানে আছে ফোন করে খোঁজ নিতে শুরু করে। প্রসারিত বদনে, বিকশিত দন্তে আমার মা-বাবা খুশির সংবাদটি সবাইকে দিতে থাকেন। বিপাকে পড়লাম তখনই যখন সবাই জানতে চান আমি কী বিষয় নিয়ে পড়বো। কারণ আমার বিষয় হচ্ছে শিক্ষা যা কিনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে (আইইআর) পড়ানো হয়। ফোনের অপর প্রান্তে ছিলাম। তা না হলে নিশ্চয়ই দেখতে পেতাম ভ্রু কুঁচকে চোখ ছোট করে প্রশ্নবিদ্ধ অবস্থায় তাকিয়ে আছেন আমার শুভাকাঙ্ক্ষী। শেষ পর্যন্ত বলেই ফেললেন, শিক্ষা নিয়ে আবার পড়ার কী আছে? এটি ২০০৩ সালের ঘটনা।

প্রিয় পাঠক, বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির শুরু থেকেই আমরা যারা শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) শিক্ষার্থী তাদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে এই প্রশ্নের উত্তর দেয়া। ব্যাখার একটা পর্যায়ে শুভাকাঙ্ক্ষীর আরও একটি প্রশ্ন থাকে। আর তা হলো- এটি কি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত? এই হচ্ছে আইইআরে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের জন্য একটি তিক্ত বাস্তবতা, যা কমবেশি সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে। আমি নিশ্চিত প্রথম ব্যাচ থেকে শুরু করে চলতি ব্যাচ পর্যন্ত যখনই কয়েকজন একত্রিত হয়, তখনই তাদের একটি সাধারণ শেয়ারিং এর বিষয় থাকে এটি।

না, এ নিয়ে মন খারাপ করার কিছু নেই। আমাদের মনে রাখতে হবে শুরু থেকেই স্বকীয়তা বজায় রাখার লড়াইয়ে আমরা অভ্যস্ত। নিজেদের পরিচয় বাঙালি জাতি বরাবর নিজেরাই আদায় করে নিয়েছে। আমরা তো সেই জাতিরই ধারক-বাহক, তাই না? আইইআরের পরিচয় আমাদেরই তুলে ধরতে হবে। অবশ্যই সেই সময়টি চলে এসেছে যখন কেউ কেউ অন্তত সহাস্যে, উৎসাহভরে বলেন, “ও আইইআর!” আর আমাদের মধ্যে যারা এখনও ভেবে থাকেন শিক্ষা নিয়ে আলাদা করে পড়ার কিছু নেই তাদের উদ্দেশ্যে দু’চারটি যুক্তি (বরাবরের মতো) তুলে না ধরলেই নয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আটটি ইনস্টিটিউটের মধ্যে প্রথম হলো শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইআর) যা ১৯৫৯ সালে প্রতিষ্ঠিত। প্রথমে এখানে বিএড ও এমএড করানো হলেও তা সম্মান কোর্সের অন্তর্ভুক্ত ছিল না। পরবর্তীতে ১৯৯৪-৯৫ শিক্ষাবর্ষে বিএড (সম্মান) ও এমএড কোর্স চালু হয় যার ১৮তম ব্যাচ ভর্তি হয়েছে এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে। অনেকে মনে করে থাকেন, এখান থেকে পাশকৃত শিক্ষার্থীরা স্কুল শিক্ষক হবেন। তাদের জ্ঞাতার্থে বলি, আপনারা যদি একবার আইইআরের কোর্স ও কারিকুলাম লক্ষ্য করেন, তাহলে নিশ্চয়ই এর সমৃদ্ধি সম্পর্কে অবগত হবেন। কারণ এখানে পড়ানো হয় শিক্ষা পদ্ধতি, শিক্ষার ভিত্তি, শিক্ষা প্রশাসন, শিক্ষাক্রম, জেন্ডার এডুকেশন, শিক্ষা গবেষণা, শিক্ষা মনোবিজ্ঞান, কম্পিউটার, বাংলা ও ইংরেজি। মোটাদাগে যে বিষয়গুলো উল্লেখ করলাম তার বিস্তারিত জেনে একজন শিক্ষার্থী হয়ে ওঠেন শিক্ষা বিষয়ক বিশেষজ্ঞ। বিশেষজ্ঞ হবার বেলাতেও শিক্ষার্থীকে এরিয়া নির্ধারণ করে নিতে হয়। যেমন: ভৌত বিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান, বিশেষ শিক্ষা, ভাষা অথবা সামাজিক বিজ্ঞান। পরবর্তীতে এমএড করার সময় তারা আরও সুনির্দিষ্ট এরিয়া নিয়ে পড়তে পারে। আইইআর ব্যতিত বাইরের শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে সান্ধ্যকালীন এমএড করার সুযোগ।

এখন প্রশ্ন আসতে পারে এই এডুকেশন বিশেষজ্ঞরা কাজ করবেন কোথায়? বলা যায়, কোথায় কাজ করবেন না? তাদের জন্য কাজ করার প্রচুর ক্ষেত্র রয়েছে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের মতোই তারা পিএসসি পরিচালিত সব ধরনের প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার পাশাপাশি ব্যাংকগুলোতেও যোগদান করছে। তবে শিক্ষার জন্য রয়েছে এর নিজস্ব কাজের ক্ষেত্র। যেমন: শিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষা অধিদপ্তর, উপজেলা শিক্ষা অফিসার, জেলা শিক্ষা অফিসার, উপজেলা রিসোর্স সেন্টার ইন্সট্রাক্টর, শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটসমূহ, সরকারিভাবে পরিচালিত বিভিন্ন প্রজেক্ট, শিক্ষার উন্নয়নে কর্মরত দেশি-বিদেশি এনজিওসমূহ, NCTB, NAEM, NTRCA প্রভৃতি। প্রফেশনাল কোর্স হবার কারণে শিক্ষা বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ছাড়া অন্য কারও কাজ করার কথা নয়। যদিও বাস্তবে আমরা ভিন্ন চিত্র দেখি। বাংলাদেশের অন্য অনেক কিছুর মতোই এটিও একসময় পরিবর্তিত হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করি। এছাড়াও দেশ-বিদেশে উচ্চশিক্ষা নেবার সুযোগ এখানে অনেক বেশি। অস্ট্রেলিয়া, জাপান, নরওয়ে, কোরিয়া প্রভৃতি দেশে শিক্ষা নিয়ে পড়ার জন্য পৃথক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। সেখান থেকে আইইআর এর অনেক শিক্ষার্থী ডিগ্রি নিয়ে এসেছেন এবং অনেকে পড়ছেন। কাজেই শিক্ষার শিক্ষার্থীদের কাজ নিয়ে ততোটা চিন্তা না করলেও চলে। এখন নিশ্চয়ই আইইআর থেকে পাশকৃত শিক্ষার্থী শুধু স্কুল শিক্ষক হবেন, এমন সংকীর্ণ ধারণা থেকে আমরা বের হতে পেরেছি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নামটিই বলে দেয় এর কাজ সম্পর্কে। শিক্ষা নিয়ে গবেষণা করা হয় শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে। তাই এখানকার শিক্ষার্থীরা একেকজন ক্ষুদে শিক্ষাবিদ হয়ে গড়ে ওঠে। তাত্ত্বিক জ্ঞানের পাশাপাশি বাস্তব অভিজ্ঞতা (Practicum: Micro-Teaching) তাদের করে তোলে আরও সমৃদ্ধ। সেমিস্টার পদ্ধতিতে পরিচালিত আইইআরের পড়াশোনায় একটি সেমিস্টার (৭ম সেমিস্টার) শিক্ষার্থীকে বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে হয়। এতে তার বিভিন্ন দক্ষতা অর্জনের পাশাপাশি তাৎক্ষণিক বুদ্ধিমত্তাও বৃদ্ধি পায়।

সবশেষে আসি এই ইনস্টিটিউটের ভৌত অবকাঠামোগত আলোচনায়। পর্যাপ্ত আলো-বাতাস প্রবেশ করতে পারে এমন অবকাঠামোয় গঠিত শ্রেণীকক্ষ রয়েছে আইইআরে। রয়েছে পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতিসমৃদ্ধ পদার্থ, জীব, রসায়ন ও কম্পিউটার ল্যাব। দোতলায় উঠেই পাওয়া যাবে বিশাল লাইব্রেরি যার দুইদিকে রয়েছে সবুজের সমারোহ। আর নিচতলায় রয়েছে সবচেয়ে জনপ্রিয় দুটি স্থান- ক্যান্টিন ও উন্মুক্ত মঞ্চ। আমরা যারা আইইআরের শিক্ষার্থী ছিলাম তাদের কাছে সব স্মৃতি ধূসর হয়ে গেলেও এই দুটি স্থানের হাস্যোজ্জ্বল দুষ্টুমির স্মৃতিগুলো নস্টালজিয়ায় ভোগায়। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে আইইআর বরাবরই সহশিক্ষা কার্যক্রমকে গুরুত্ব দিয়ে আসছে। তাই এখানে রয়েছে বিজ্ঞান ক্লাব, ডিবেটিং ক্লাব, ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাব, নেচার স্টাডি ক্লাব যার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা তাদের মানসিক বিকাশ ঘটাতে পারে। নিয়মিতভাবে তারা নানারকম প্রতিযোগিতামূলক ইভেন্টে অংশগ্রহণ করে যাচ্ছে।

এই হলো আমাদের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইআর)। এখান থেকে বের হওয়া শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ অবশ্যই বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে করে তুলবে আরও শক্তিশালী, আরও ফলপ্রসূ।

আসমা জাহান মুক‍্তা: শিক্ষা বিশেষজ্ঞ, অঙ্কুর আইসিটি ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন, ঢাকা, বাংলাদেশ।

জনপ্রিয় নিবন্ধ

প্রাথমিক স্তরে ভাষা শেখা : বিষয় – বাংলা

ভাষার দক্ষতা চারটি— শোনা, বলা, পড়া, লেখা। আর ভাষা...

আগে ইংরেজি গ্রামার শিখবো, নাকি ভাষা শিখবো?

কোন ভাষার গ্রামার হলো ঐ ভাষার গঠন প্রকৃতি যার...

শিক্ষাব্যবস্থার হালচাল

অর্থনীতিবিদদের মতে, শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ সবচেয়ে লাভজনক এবং নিরাপদ রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ। অর্থনীতিবিদ এডাম স্মিথ, ডেভিড রিকার্ডো এবং মার্শালের মতে, শিক্ষা এমন একটি খাত যার কাজ হলো দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলে পুঁজির সঞ্চালন ঘটানো। শিক্ষার অর্থনীতি নিয়ে মৌলিক গবেষণায় অর্থনীতিবদ আর্থার শুল্জ ও রবার্ট সলো দেখিয়েছেন যে, প্রাথমিক শিক্ষায় বিনিয়োগ করলে সম্পদের সুফল ফেরত আসে ৩৫ শতাংশ, মাধ্যমিক শিক্ষায় ২০ শতাংশ, এবং উচ্চ শিক্ষায় ১১ শতাংশ।

আমেরিকায় উচ্চশিক্ষা : পিএইচডির পর কী?

আমেরিকায় উচ্চশিক্ষা নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হয়, আমি নিজেও এ-নিয়ে...

ক্যাডেট কলেজে ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে কিছু কথা

ক্যাডেটসমূহ বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনে এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে।...

আরও কিছু লেখা

অধিক

    টেলিভিশন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিজ্ঞান শিক্ষা জনপ্রিয়করণ: একটি প্রস্তাব

    “কীভাবে বিজ্ঞান শিক্ষা জনপ্রিয় করা যায়”- এ নিয়ে সরকারের কর্তাব্যক্তিরা যথেষ্ঠ ব্যস্ত সময় পার করছেন। মিটিং-সিটিং কম হচ্ছে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের শিক্ষকদেরও ডাক পড়ছে হরহামেশা। শিক্ষামন্ত্রী মহোদয়ও একাধিকবার বিজ্ঞান শিক্ষা নিয়ে তার টেনশনের কথা প্রকাশ করেছেন। তাই আশা করবো, উল্লেখিত প্রস্তাবখানা সরকারের নীতি-নির্ধারকগণ বিবেচনা করে দেখবেন।

    উচ্চ শিক্ষা, জ্ঞান সৃষ্টি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবিষ্যৎ

    বিশ্ববিদ্যালয় হলো সেই বিদ্যাপীঠ যেখানে নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করা...

    একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি: পছন্দসই কলেজে ভর্তি হতে পারবে শিক্ষার্থীরা?

    এসএসসি বা সমমান পর্যায়ে কৃতকার্য হওয়া শিক্ষার্থীরা এখন একাদশ...

    আধুনিক শিক্ষাভাবনা ও রবীন্দ্রনাথ

    রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর শিক্ষাচিন্তা একদিকে ভাববাদী চিন্তাধারায় প্রভাবিত, অপরদিকে প্রয়োগের সময় প্রকৃতিবাদী আদর্শে গড়া। তিনি তাঁর লেখায় কুসংস্কারাচ্ছন্ন শিক্ষা-বিবর্জিত মানুষদের জেগে ওঠার আহবান জানিয়েছেন।

    শিক্ষা ও মানুষের চাওয়া-পাওয়া

    মোঃ রেজাউল হক লিখেছেন শিক্ষা থেকে মানুষের চাওয়া-পাওয়া প্রসঙ্গে শিক্ষা...

    প্রাথমিকে প্যানেল শিক্ষক নিয়োগ: উত্তীর্ণদের কী হবে?

    প্রাথমিক শিক্ষার ভিত্তি দুর্বল হলে শিক্ষার পরবর্তী ধাপগুলো শক্তভাবে...

    মানসম্মত শিক্ষা ও বাংলাদেশ

    একুশ শতকে পৃথিবীজুড়েই শিক্ষা, বিশেষত মানসম্মত শিক্ষা, একটি কৌশলগত...

    প্রাসঙ্গিক নিবন্ধসমূহ

    নতুন লেখার খবর পান ইমেইলে
    বাংলাদেশের শিক্ষা প্রসঙ্গে নতুন লেখা প্রকাশিত হলে সেই খবর পৌঁছে যাবে আপনার ইমেইলে।