বাড়ি পরীক্ষা ও মূল্যায়ন ব্যবস্থা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের স্ব-মূল্যায়ন, প্রাথমিকেও হোক

মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের স্ব-মূল্যায়ন, প্রাথমিকেও হোক

স্ব-মূল্যায়ন ধারণাটি বাংলাদেশে নতুন; ছবিসূত্র: কালের কণ্ঠ
স্ব-মূল্যায়ন ধারণাটি বাংলাদেশে নতুন; ছবিসূত্র: কালের কণ্ঠ

মাহফুজুর রহমান মানিক লিখেছেন মাধ্যমিকে স্ব-মূল্যায়ন নিয়ে

সম্প্রতি দেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর স্ব-মূল্যায়ন প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সরকার। বাংলাদেশে এ ধরনের মূল্যায়ন নতুন হলেও বিশ্বব্যাপি বেশ পুরনো। এ নিয়ে যুক্তরাজ্যের কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘পিটার রাড এবং ডেভোরা ডেভিস’ নামে দুই ভদ্রলোকের গবেষণা প্রকাশ হয় ২০০০ সালে। তারা মূল্যায়নের শুরু হিসেবে ১৯৯০ সালকে আবিষ্কার করেছেন। এর প্রাথমিক উদ্দেশ্য হলো শিক্ষার গুনগত মান উন্নয়ন। উন্নত বিশ্বে, বিশেষ করে ইংল্যান্ডে শিক্ষার স্থানীয় কর্তৃপক্ষ (local education authority) কর্তৃক এ মূল্যায়ন পরিচালনা করা হয়। বাংলাদেশে শিক্ষার এরকম স্থানীয় কর্তৃপক্ষ নেই বলে কেন্দ্রীয়ভাবে এই মূল্যায়ন করা হয়েছে।

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর-এর সেকেন্ডারি এডুকেশন সেক্টর ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টের (এসইএসডিপি) আওতায় ১৭ হাজার ৮৭৩টি বিদ্যালয়ের মধ্যে এ মূল্যায়ন হয়। ব্যানবেইজের সর্বশেষ ২০০৯-এর তথ্যানুসারে বাংলাদেশে সরকারি এবং বেসরকারি মিলিয়ে মোট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ১৯ হাজার ৮৩। মূল্যায়ন বিষয়ে বিস্তর আলোচনার সুবিধার্থে মূল বিষয়গুলো জানা যাক। ‘১৪ শতাংশ বিদ্যালয়ের শিক্ষামান উন্নত’ শিরোনামে ১০ অক্টোবর পত্রিকাগুলো প্রতিবেদন প্রকাশ করে। যা বলছে ‘পারফরম্যান্স বেজড ম্যানেজমেন্ট (পিবিএম)’ পদ্ধতিতে বিদ্যালয়গুলোর মান যাচাই এবং ক্রমোন্নতি পরিমাপের জন্য সাতটি সূচকের অধীনে মোট ৪৫টি উপ-সূচকের ভিত্তিতে এ মূল্যায়ন করা হয় ।

সাতটি সূচক হলো: শিখন-শেখানোর পরিবেশ, প্রতিষ্ঠান প্রধানের নেতৃত্ব, ব্যবস্থাপনা কমিটির কার্যকারিতা, শিক্ষকদের পেশাদারিত্ব, শিক্ষার্থীদের কৃতিত্ব, সহ-শিক্ষাক্রমিক কর্মসূচি ও শিক্ষক-অভিভাবক সম্পর্ক। এ মূল্যায়নের মান ১০০ ধরে- ৯০ হতে ১০০ নম্বরের ক্যাটাগরিকে ‘এ’ (অতি উত্তম) বলা হয়, ১৭ হাজার ৮৭৩টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে এই ক্যাটাগরির বিদ্যালয় হলো ২ হাজার ৪৫৫টি, যা মোট সংখ্যার ১৪ শতাংশ। ৮০ হতে ৮৯.৯ নম্বরে ক্যাটাগরি ‘বি’ (ভালো), বিদ্যালয় সংখ্যা ৮ হাজার ৮৯৭টি, এটা মোট সংখ্যার ৫০ শতাংশ। ৭০ হতে ৭৯.৯ নম্বর ক্যাটাগরি ‘সি’ (মধ্যম), এতে বিদ্যালয় রয়েছে ৪ হাজার ৭৪৯টি, যা শতাংশে ২৭ ভাগ। ৫০ হতে ৬৯.৯ নম্বর ‘ডি’ (দুর্বল) ক্যাটাগরি, বিদ্যালয় সংখ্যা ১ হাজার ৬১৯টি, শতাংশে মোট সংখ্যার ৮ ভাগ। এবং ২০ হতে ৪৯.৯ নম্বরকে ‘ই’ (অকার্যকর) ক্যাটাগরি ধরা হয়েছে, যা মোট বিদ্যালয়ের ১ শতাংশ, বিদ্যালয় সংখ্যা ১৫৩।

এ মূল্যায়নের মাধ্যমে আমাদের মাধ্যমিক শিক্ষার অবস্থা খুব ভালোভাবেই দেখা যাচ্ছে। যদিও এখানে একটা ভালো অবস্থানই দেখাচ্ছে। বিশেষ করে ‘এ’ এবং ‘বি’ ক্যাটাগরিতে ৬৪ শতাংশ বিদ্যালয় আছে বলা হচ্ছে। বাস্তবতা অবশ্য ভিন্ন। এখানে যে সাতটি সুচকে হয়েছে প্রত্যেকটা ধরে পর্যালোচনা করলেই এ মূল্যায়নের অসারতা প্রমাণ হবে। বাংলাদেশে সরকারি বিদ্যালয় সংখ্যা মাত্র ৩১৭ টি। আর সবই বেসরকারি। যে বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক সংকট সারা বছরই লেগে থাকে। শিক্ষকরা ক্লাস নিতে নিতে ক্লান্ত। অনেক বিদ্যালয়েই নেই প্রধান শিক্ষক, সহপাঠ্যক্রমিক কার্যক্রম দায়সারা গোছের।

মূল্যায়নের মাধ্যমে ‘এ’ ক্যাটাগরির বিদ্যালয় চিহ্নিত করার মাধ্যমে যেটা বোঝা যাচ্ছে, তা হলো এসএসসির রেজাল্টকেই প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। আর এ কারণেই রাজধানীর পরিচিত ভালো ফলাফল করে এরকম প্রতিষ্ঠানই প্রধানত এই ক্যাটাগরি দখল করে আছে। এরা স্বাভাবিকভাবেই প্রথম দিকের অবস্থানে থাকবে ঠিক আছে। তবে এর বাইরের এলাকায়ও যেসব ভালো বিদ্যালয় আছে সেগুলো কতটা গুরুত্ব পেয়েছে তা দেখার বিষয়।

মাধ্যমিক শিক্ষায় আমাদের গ্রাম-শহরের বৈষম্য প্রকট। এটা আমরা যেমন এই মুল্যায়নের মাধ্যমেও দেখছি, ঠিক তেমনি প্রতিবছর এসএসসির ফলাফলের মাধ্যমেই তা জানি। একদিকে শতভাগ পাশ, এমনকি শতভাগ জিপিএ-৫ পাওয়া প্রতিষ্ঠানও আছে, আবার অন্যদিকে আছে শতভাগ ফেল করা প্রতিষ্ঠান। গত বছরই এরকম ফেল করা প্রতিষ্ঠান ছিলো ৪৯ টি। বৈষম্যের পাশাপাশি বিদ্যালয়গুলোর বাস্তব সমস্যা এ মূল্যায়নের মাধ্যমেই উঠে আসার কথা।

যদিও এবারের মূল্যায়ন নিয়ে যথেষ্ট অভিযোগ রয়েছে। ১৪ অক্টোবর এসংক্রান্ত সংবাদের প্রতিবেদন হলো ‘১৮ হাজার স্কুলের দায়সারা স্ব-মূল্যায়ন’। প্রতিবেদনটির মাধ্যমে স্পষ্ট বিষয় হলো গবেষণা কার্যক্রমের প্রায় তিন ভাগের মধ্যে দু’ভাগই অসম্পূর্ণ রেখে তড়িঘড়ি করে প্রায় দুই লাখ টাকা ব্যয়ে কর্মশালার আয়োজন করে তা উপস্থাপন করা হয়েছে। এর জন্য প্রকল্প পরিচালকের অদক্ষতা ও স্বেচ্ছাচারিতাকে দায়ি করা হয়েছে।

এবারই প্রথম বলে এ মূল্যায়নে সমস্যা থাকাটাকে স্বাভাবিক বলে ধরে নেয়া যায়, তবে শুরু হয়েছে এটাই স্বস্তির বিষয়। অন্যদেশগুলোতে যেটা আছে, আমরা সেটা ১৫/২০ বছর পর হলেও শুরু করলাম। এটা অব্যাহত থাকা জরুরি। এরকম মূল্যায়নের শিক্ষার প্রত্যেক স্তরে হওয়া প্রয়োজন। এর আগে আমরা ইউজিসি কর্তৃক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ওপর গবেষণা হতে দেখেছি (প্রথম আলো, ২৩.০৬.২০১১)।

এ মূল্যায়ন প্রাথমিক শিক্ষায়ও দরকার। প্রাথমিক শিক্ষার মান উন্নয়নে না হলেও এ শিক্ষার অবস্থা দেখার জন্য মূল্যায়ন আবশ্যক। বিশেষ করে কতটা শোচনীয় অবস্থা আমাদের প্রাথমিক শিক্ষার তা স্ব-মূল্যায়ন ছাড়া পরিমাপ করা সম্ভব নয়। বাংলাদেশে মোট প্রাথমিক বিদ্যালয় সংখ্যা ৮১ হাজার ৫০৮ টি (ব্যনবেইজ ২০০৯)। এর মধ্যে সরকারি ৩৭ হাজার ৬৭২টি। রাষ্ট্র যেহেতু প্রাথমিকের দায়িত্ব নিয়েছে, তা কতটা ঠিক মতো হচ্ছে তার জন্য গবেষণার, মূল্যায়নের আবশ্যকতা রয়েছে।

আমাদের এরকম ভালো ভালো উদ্যোগ খুব কম নেয়া হচ্ছে তা নয়, কিন্তু সকল উদ্যোগই ভেস্তে যায় বা সফলতার মুখ দেখতে পারে না সরকারের গাফলতি, দুর্নীতি, অদক্ষতা ইত্যাদি নানা কারণে। যে অভিযোগটা এ মূল্যায়নকেও ছাড়েনি। ভবিষ্যতে মাধ্যমিকের মত প্রাথমিক স্তরেও স্বচ্ছভাবে এ মূল্যায়ন হবে, এ আশা সবাই করতেই পারে।

লেখক: শিক্ষার্থী, শিক্ষাও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা, বাংলাদেশ।

লেখক পরিচিতি

সম্পাদক বাংলাদেশের শিক্ষা

এই লেখাটি সম্পাদক কর্তৃক প্রকাশিত। মূল লেখার পরিচিত লেখার নিচে দেওয়া হয়েছে।

কোন মন্তব্য নেই

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Exit mobile version