অপেক্ষার পালা শেষ করে ৩১ মে প্রকাশিত হলো ২০২০ সালের এসএসসি ও সমমানের ফল প্রকাশ হলো। এসএসসির ফল প্রকাশ করা হয়েছে অনলাইনে। মে মাসের প্রথম সপ্তাহে ফল প্রকাশের কথা থাকলেও করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে তা সম্ভব হয়নি।
এসএসসির ফল প্রকাশ : বিশেষ ব্যবস্থায়
তারপরও বিশেষ ব্যবস্থায় ডাকযোগে ওএমআরশিট এনে মে মাসেই ফল প্রকাশের ব্যবস্থা করেছে শিক্ষা বোর্ডগুলো। বিকল্প ব্যবস্থায় হলেও অবশেষে শিক্ষার্থীরা বহুল আকাঙ্খিত ফল মে মাসের শেষ দিনেই জানতে পারলো। ফলে, তারা এই করোনা পরিস্থিতির মধ্যে যে মানসিক চাপের মধ্যে ছিলো, তা থেকে রেহাই পেয়েছে; চাপ দূর হয়েছে অভিভাবকদেরও।
এবার এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা ১ ফেব্রুয়ারি শুরু হওযার কথা থাকলেও সরস্বতী পূজা ও ঢাকার দুই সিটির নির্বাচনের কারণে পিছিয়ে ৩ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয়। ২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলে তত্তীয় পরীক্ষা। আর ২৯ ফেব্রুয়ারি শুরু হয়ে ৫ মার্চ শেষ হয় ব্যবহারিক পরীক্ষা। সারাদেশে দশটি বোর্ডের অধীনে ৩ হাজার ৫১২টি কেন্দ্রে মোট ২০ লাখ ২৮ হাজার ৮৮৪ জন পরীক্ষায় অংশ নেয়।
কীভাবে প্রকাশ করা হলো এসএসসির ফল?
এবার পরীক্ষাকেন্দ্রে কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোনো ফল পাঠানো হয়নি। অতএব, কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জমায়েত হয়ে শিক্ষার্থীরা যে বাধভাঙ্গা জোয়ারের মতো ঢোল-বাদ্য বাজিয়ে শিক্ষকের সাথে আনন্দ ভাগাভাগি করে নেয়, সেই দৃশ্য ছিল অনুপস্থিত। গণভবন থেকে ভিডিও কনফাররেন্সের মাধ্যমে ফলাফল প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী। তারপর মোবাইল মেসেজ ও শিক্ষা বোর্ডগুলোর ওয়েবসাইটে এ ফলাফল তুলে ধরা হচ্ছে। ১৮ মে থেকে প্রাক-নিবন্ধন কার্যক্রম শুরু হয় যাতে শিক্ষাবোর্ডগুলো সহজে শিক্ষার্থীদের ফল জানাতে পারে। শিক্ষাবোর্ডগুলোকে এজন্য ধন্যবাদ জানাই।
ফল ঘোষণার পর পরীক্ষার্থীরা নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে, সংশ্লিষ্ট বোর্ডের ওয়েবসাইটে ও এসএমএসে ফল জানতে পারছে। এসএমএসে দু’ভাবে ফল জানা যাচ্ছে। ফল প্রকাশের পর নির্ধারিত পদ্ধতিতে এসএমএস করলে ফিরতি এসএমএসে ফল চলে যাচ্ছে তাদের মোবাইলে। এছাড়া রোল ও রেজিষ্ট্রেশন নম্বর, নিবন্ধন করলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে এসএমএস ফল চলে যাচ্ছে শিক্ষার্থী কিংবা অভিভাবকদের মোবাইলে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা মেনেই শিক্ষার্থীদের ফল সংগ্রহ করতে বলা হয়েছে। কোনো অবস্থাতেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ফল প্রকাশের দিন জমায়েত হওয়া যাবে না বলে তারা জমায়েত হয়নি। এসএমএসের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ফল দেয়া হচ্ছে, আর শিক্ষা বোর্ডগুলোর ওয়েবসাইটে ফল প্রকাশ করেছে। অর্থাৎ দেশের শিক্ষা ডিজিটালাইজেশনের দিকে এগুচ্ছে। এটি যুগের চাহিদা।
এসএসসি পরীক্ষা : পাসের হার ও জিপিএ
২০২০ সালের এসএসসি পরীক্ষায় নয়টি সাধারণ বোর্ডে গড় পাস করেছে ৮৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ শিক্ষার্থী। ২০১৯ সালের এই পাসের হার ছিলো ৮২ দশমিক ৮০ শতাংশ। অর্থাৎ পাসের হার বেড়েছে। এবার ঢাকা বোর্ডে পাসের হার ৮২ দশমিক ৩৪ শতাংশ, যশোর বোর্ডে ৮৭ দশমিক ৩১ শতাংশ, কুমিল্লায় ৮৫ দশমিক ২২, চট্টগ্রামে ৮৪ দশমিক ৭৫, সিলেটে ৭৮ দশমিক ৭৯, দিনাজপুরে ৮২ দশমিক ৭৩ শতাংশ, ময়মনসিংহ বোর্ডে ৮০ দশমিক ১৩ শতাংশ, ও বরিশালে ৭৯ দশমিক ৭০শতাংশ ।
এবার মোট জিপিএ-৫ পেয়েছে এক লক্ষ ৩৬ হাজার ৪৭ জন। গতবার পেয়েছিল এক লক্ষ ২৯ হাজার ৬৮৭ জন। জিপিএ-৫ পাওয়ার হারও বেড়েছে। রাজশাহী বোর্ডে পাসের হার ও জিপিএ-৫-এর সংখ্যা অন্যান্য বোর্ডের তুলনায় অনেক বেশি। এ বোর্ডে এবার পাসের হার ৯০.৩৭ শতাংশ আর জিপিএ-৫ পাওয়ার সংখ্যা ২৬ হাজার ১৬৭ জন। যশোর বোর্ডে জিপিএ-৫ পেয়েছে ১৩ হাজার ৭৬৪ জন, কুমিল্লা বোর্ডে জিপিএ-৫ পেয়েছে ১০ হাজার ২৪৫ জন, চট্টগ্রামে জিপিএ-৫ পেয়েছে ৯ হাজার ৮ জন, দিনাজপুর বোর্ডে জিপিএ-৫ পেয়েছে ১২ হাজার ৮৬ জন। ঢাকা বোর্ডে জিপিএ-৫ পেয়েছে ৩৬ হাজার ৪৭জন। ময়মনসিংহে জিপিএ-৫ পেয়েছে ৭ হাজার ৪৩৪ জন, বরিশাল বোর্ডে জিপিএ-৫ পেয়েছে ৪ হাজার ৪৮৩ জন। সিলেট বোর্ডে জিপিএ-৫ পেয়েছে ৪ হাজার ২৬৩ জন।
এসএসসির ফল প্রকাশ : পাস ও ফেল
এবারের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার কথা ছিলো ২০ লাখ ৪৭ হাজার ৭৭৯ জন পরীক্ষার্থীর। এর মধ্যে ছাত্র ১০ লাখ ২৪ হাজার ৩৬৩ জন এবং ছাত্রী ১০ লাখ ২৩ হাজার ৪১৬ জন। ২০ লাখ ৪৭ হাজার ৭৭৯ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে শুধু এসএসসি পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ১৪ লাখ ২২ হাজার ১৬৮ জন। এর মধ্যে পরীক্ষায় অংশ নেয় ১৪ লাখ ১৬ হাজার ৭২১ জন। এবার নয়টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ড, মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে গড়ে ৮২ দশমিক ৮৭ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছে। সব বোর্ডে পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে ২০ লাখ ৪০ হাজার ২৮ জন শিক্ষার্থী এবং পাস করেছে ১৬ লাখ ৯০ হাজার ৫২৩ জন। মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডে পাস করেছে ৮২ দশমিক ৫১ শতাংশ এবং কারিগরি শিক্ষাবোর্ডে পাস করেছে ৭২ দশমিক ৭০ শতাংশ।
এবারের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় ১০৪টি প্রতিষ্ঠান থেকে কেউ পাস করেনি। গতবছর এ সংখ্যা ছিলো ১০৭টি। আর শতভাগ পাস করেছে এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা এবার তিন হাজার ২৩টি, যা গতবছর ছিল দুই হাজার ৫৮৩টি। এ দুটোই উন্নতির সূচক। তাই বলে কিন্তু আত্মতৃপ্তির সুযোগ একেবারেই নেই। কীভাবে ১০৪টি প্রতিষ্ঠান থেকে একজন শিক্ষার্থীও পাস করতে পারলো না? এক্ষেত্রে বিদ্যালয়, কমিটি, সমাজ, শিক্ষা বিভাগ এবং সর্বোপরি রাষ্ট্রের কি কোনোই দায়দায়িত্ব নেই? প্রায় ২৯ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে মাত্র তিন হাজার ২৩টি প্রতিষ্ঠান থেকে কেউ অকৃতকার্য হয়নি। সেটিই বা কীভাবে হয়? অভিভাবকদের ব্যয়, রাষ্ট্রীয় ব্যয়, শিক্ষকদের হাজার হাজার শ্রম ঘণ্টা, শিক্ষার্থীদের লক্ষ লক্ষ ঘণ্টা ব্যয় করে যদি শতভাগ পাস করা প্রতিষ্ঠানের সংখ্য হয় মাত্র তিন হাজার, সেটিও পুরো আনন্দের সংবাদ নয়।
পাসের হার ও বিশ্লেষণ
পাসের হারে টানা অষ্টমবারের মতো শীর্ষে রয়েছে রাজশাহী বোর্ড। জিপিএ-৫ পাওয়ায় এবারও শীর্ষে রয়েছে ঢাকা বোর্ড। রাজশাহী বোর্ডে সবচেয়ে বেশি ৯০.৩৭ শতাংশ এবং সিলেট বোর্ডে সবচেয়ে কম ৭৮.৭৯ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছে। সার্বিকভাবে গতবারের চেয়ে এবার পাসের হার বেশি।
যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ফল ভালো করতে পারেনি, সেসব প্রতিষ্ঠানের খারাপ ফলের কারণ খুঁজে বের করতে হবে। এখানে প্রয়োজন পেশাগত গবেষণা। আমরা চারদিকে এতো গবেষণার কথা শুনি, কিন্তু এক্ষেত্রে কোনো গবেষণা করা এবং তা সংশ্লিষ্টদের জানানোর কোনো উদ্যোগ দেখতে পাই না। আমরা জানি, নায়েমের একটি গবেষণা বিভাগ আছে, সেখানে গবেষণা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে অনেক গবেষণা হয়। অথচ আমাদের দেশের শিক্ষাবোর্ডগুলোতে একটি থেকে আরেকটিতে প্রতি বছরই দেখা যায় ফলের বিশাল পার্থক্য।
এর সতিকারের কারণ কী তা যদি খুঁজে বের করা না হয়, তাহলে উচ্চশিক্ষায় ভর্তি, চাকরি ইত্যাদি ক্ষেত্রে একটি অসমতা পরিলক্ষিত হবে। এত ছোট একটি দেশে এতোগুলো শিক্ষা বোর্ড রয়েছে। জনসংখ্যার অনুপাতে হয়তো ঠিক আছে, কিন্তু এসব বোর্ড থেকে পাস করে শিক্ষার্থীদের ভর্তি হতে দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠনাগুলোতে একইসাথে প্রতিযোগিতায় নামতে হয়। সেখানে জিপিএ-৫ প্রাপ্তি ও নম্বর প্রাপ্তি ভর্তির স্কোরকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে। চাকরির ক্ষেত্রেও এর বিশাল প্রভাব পড়ে। এটি একটি অসমতা। অথচ একটি বোর্ডে পাসের উচ্চহার বা বেশি পরিমাণে জিপিএ-৫ প্রাপ্তির যৌক্তিক কারণ নেই। শুধু খাতা পরীক্ষণের হেরফেরের ওপরই বিষয়টি বেশি নির্ভরশীল।
উপসংহার
আমাদের মনে রাখতে হবে, পরিমাণগত বৃদ্ধি শিক্ষার মানোন্নয়নের স্মারক নয়। শিক্ষার্থীদের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলাটাই হচ্ছে মুখ্য বিষয়। তাই নৈতিকতা, সামাজিক মুল্যবোধ ও শিক্ষার্থীদের সঠিক দেশপ্রেমে উদ্ধুদ্ধ করতে হবে প্রকৃতি শিক্ষার মাধ্যমে। এগুলো যথাযথ উপায়ে করতে পারলে সমাজের নানা অনাচার ও নেতিবাচক কর্মকাণ্ড অনেকাংশেই কমে যাবে। এক্ষেত্রে পুলিশ বৃদ্ধি নয়, বৃদ্ধি করতে হবে শিক্ষার মান। জোর দিতে হবে নৈতিক শিক্ষার ওপর। শিক্ষার বিস্তৃতি অবশ্যই ঘটাতে হবে, তবে তা হতে হবে বৈশ্বিক মানের।
আামদের শিক্ষার্থীদের প্রতিযোগিতায় নামতে হচ্ছে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের সাথে। কাজেই তাদের সেই মানের শিক্ষা অর্জন করতে হবে। সকল শিক্ষার্থী যারা কৃতকার্য হয়েছ এবং যারা হতে পারোনি, সবাইকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাচ্ছি। তোমাদের অকৃতকার্যতার দায় তোমাদের একার নয়, এটি আমাদের সার্বিক ত্রুটির বহিঃপ্রকাশ। তোমাদের ভেঙ্গে পড়লে চলবে না, এটি সাময়িক একটি ব্যাপার। সাফল্য তোমাদের আগামীর দিনের দিনগুলোতে কীভাবে ধরা দেবে তা আমরা কেউ জানি না। কাজেই সাহস নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।
লেখক পরিচিতি
মাছুম বিল্লাহ বাংলাদেশে ইংলিশ টিচার্স অ্যাসেসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইট্যাব)-এর সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি পূর্বে ক্যাডেট কলেজ ও রাজউক কলেজের শিক্ষক হিসেবে কাজ করেছেন। কাজ করেছেন ব্র্যাকের শিক্ষা কর্মসূচিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে। তিনি ভাব বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর হিসেবেও কর্মরত রয়েছেন। তিনি নিয়মিত শিক্ষাবিষয়ে নানা প্রবন্ধ লিখছেন।