সিলেটের শিক্ষার অনগ্রসরতার কারণ নিয়ে গবেষণা করেছেন: সমীর রঞ্জন নাথ, মো. মাহবুবুল কবির, কাজী সালেহ্ আহমেদ, গৌতম রায়, আওলাদ হোসেন, এস. এম. নূরুল আলম, ফজলুল করিম চৌধুরী, আমিনা মাহবুব
ক. ভূমিকা
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের নানা ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বেশ অগ্রগতি লাভ করেছে। জনসাধারণের সার্বিক কর্মোদ্যোগ, সরকারি প্রচেষ্টা আর উন্নয়ন সহযোগীদের সম্মিলিত কর্মপ্রয়াসে এই অগ্রগতি লাভ করা সম্ভব হয়েছে। তা সত্ত্বেও,স্বাধীনতার চার দশক পর ব্যাপক সংখ্যক মানুষের দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস এবং সুযোগ ও সম্পদের অসমবণ্টন বাংলাদেশের জন্য একটি বাস্তবতা।
উন্নয়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় শিক্ষা প্রধান ভূমিকা পালন করে। শিক্ষা উন্নয়নের বিবিধ দিকেও বাংলাদেশের সার্বিক অগ্রগতি ব্যাপক ও আশাব্যঞ্জক। সবচেয়ে বেশি অগ্রগতি লক্ষ করা গেছে বিগত দুই দশকে। সার্বিক অগ্রগতি সত্ত্বেও দুঃখজনক ব্যাপার হলো, শিক্ষার নানা ক্ষেত্রে অসমতার উপস্থিতি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ধরন, উপব্যবস্থা (সাধারণ/মাদ্রাসা), ভৌগোলিক অবস্থান এবং আর্থ-সামাজিক অবস্থার নিরিখে এই অসমতা সর্বত্র বিরাজমান। উন্নয়নের সাথে অসমতার সহাবস্থান বাংলাদেশের সংবিধান এবং জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ কোনোটির সঙ্গেই মানানসই নয়। বাংলাদেশের শিক্ষাক্ষেত্রে অসমতার বিলোপ সাধন করা প্রয়োজন। এজন্য দরকার অসমতার ধরন, প্রকৃতি ও কারণসমূহ অনুসন্ধানে গভীর পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা। তারপর দরকার গবেষণার ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে সমতাভিত্তিক যথাযথ নীতি প্রণয়ন এবং এই নীতির সুষ্ঠু বাস্তবায়ন।
ভৌগোলিকভাবে শিক্ষাক্ষেত্রে সিলেট একটি অনগ্রসর বিভাগ। এডুকেশন ওয়াচ-এর এই গবেষণায় শিক্ষাক্ষেত্রে সিলেট বিভাগের অনগ্রসরতার কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা করা হয়েছে। বাংলাদেশের শিক্ষাক্ষেত্রে অঞ্চলভিত্তিক যে বঞ্চনা রয়েছে তারই প্রেক্ষাপটে সিলেটের অনগ্রসরতার কারণ বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
খ. সিলেট বিভাগ
সিলেট বিভাগের অবস্থান বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব কোণে। এর মোট এলাকা ১২,৫৬৯ বর্গ কিলোমিটার আর জনসংখ্যা প্রায় নব্বই লক্ষ। সিলেটের আকার বাংলাদেশের মোট আকারের ৮.৫%। জনসংখ্যার ৬.৪% সিলেটে বসবাস করে। যদিও বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ২৩% শহরে বাস করে কিন্তু এই হার সিলেট বিভাগের ক্ষেত্রে মাত্র ১২.৫%। সামাজিক, অর্থনৈতিক আর ভৌগোলিক দিক থেকে সিলেট বেশ বৈচিত্র্যপূর্ণ; এর বৈশিষ্ট্যাবলী বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকা থেকে ভিন্নতর। সিলেটের মোট ভূমির ৫৭.৫% সমতল, ৩০.২% হাওর অঞ্চল আর ১২.৫% চা-বাগান, বনভূমি, পাহাড় ইত্যাদি নিয়ে গঠিত।
প্রাকৃতিক সম্পদ আর জনসাধারণের সাধারণ অর্থনৈতিক সামর্থ্যরে নিরিখে সিলেট বেশ সমৃদ্ধিশালী হলেও সামাজিক সাফল্যের নিরিখে এর অবস্থান তত ভালো নয়। যেখানে বাংলাদেশের দুই-পঞ্চমাংশ লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে এই হার সিলেটের ক্ষেত্রে ৩৩.৮%। মানব উন্নয়ন সূচকের নিরিখে এই বিভাগের অবস্থান দেশের অন্য বিভাগগুলোর তুলনায় সর্বনিম্নে। স্বাস্থ্য সূচকের নিরিখেও একই ধরনের চিত্র পাওয়া যায়। শিশুমৃত্যু ও প্রজনন হার এই বিভাগে সর্বাধিক আর শিশুদের টিকা প্রাপ্তির হার সর্বনিম্ন। ঐতিহাসিকভাবে সিলেট বিভাগের অনেক লোক বিদেশে বসবাস করে। এখানকার প্রায় ৫% খানা প্রধানত বৈদেশিক আয়ের ওপর নির্ভরশীল।
সিলেটের প্রাথমিক শিক্ষালাভের উপযুক্ত বয়সী শিশুদের ৮০.৫% আর মাধ্যমিক শিক্ষালাভের উপযুক্ত বয়সী শিশুদের ৬৪.২% স্কুলে ভর্তি হয়। দুটি হারই এ সংক্রান্ত জাতীয় গড় হারের তুলনায় অনেক নিচে। জাতীয় গড় হারসমূহ যথাক্রমে ৮৬.৪% ও ৭৭.৭%। অনুরূপভাবে, স্কুলে পড়ালেখা করেছিল এমন জনসংখ্যার হার কিংবা প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষালাভকারী জনসাধারণের হারের নিরিখেও সিলেট বিভাগের অবস্থান দেশের গড় অবস্থানের তুলনায় পেছনে। সাক্ষরতার হারের দিক থেকে সিলেটের অবস্থান সবার নিচে। সাত বছর কিংবা তদূর্ধ্ব বয়সী সিলেটবাসীর মধ্যে সাক্ষরতার হার ৪০.৭% আর এখানে বয়স্ক সাক্ষরতার হার ৪৪.৪%। এই হারগুলোর জাতীয় গড় যথাক্রমে ৪৮.৫% ও ৫২.১%। সিলেট বিভাগের ৩০.৪% খানায় একজনও সাক্ষর লোক নেই, যা পুরো দেশের ক্ষেত্রে ২১.৫%।
সিলেট বিভাগের উপর্যুক্ত বর্ণনা আপাতদৃষ্টিতে স্ববিরোধী মনে হলেও সত্য বর্জিত নয়। গড় অর্থনৈতিক অবস্থার নিরিখে মোটামুুটি ভালো কিন্তু সামাজিক উন্নয়নের সূচকের নিরিখে অনুন্নত- এই হলো সিলেটের সার্বিক অবস্থা। এডুকেশন ওয়াচ-এর পূর্ববর্তী গবেষণাসমূহে যদিও এই চিত্র উঠে এসেছে কিন্তু যথাযথ গবেষণা পদ্ধতি প্রয়োগ না করার কারণে ঐ গবেষণাসমূহে উপর্যুক্ত স্ববিরোধিতার কারণ অনুসন্ধান করা সম্ভব হয়নি। এই পশ্চাৎপদ অবস্থা সিলেটের জনসাধারণের জন্য আশঙ্কার কারণ এবং এর পরিত্রাণের উপায় খুঁজে বের করার দিকে বিশেষ নজর দেওয়া দরকার। এ কারণেই এডুকেশন ওয়াচ এই গবেষণাটি হাতে নিয়েছে, যার উদ্দেশ্য শিক্ষাক্ষেত্রে সিলেট বিভাগের পশ্চাৎপদতার কারণ অনুসন্ধান করা।
গ. গবেষণার উদ্দেশ্য ও পদ্ধতি
এই গবেষণায় প্রধানত যে প্রশ্নটির উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে তা হলো, শিক্ষার বিভিন্ন সূচকে সিলেট বিভাগ কেন দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে পিছিয়ে রয়েছে? সামাজিক, অর্থনৈতিক, আঞ্চলিক, পরিবেশগত, অভিগমন ও বিশ্বাসসংক্রান্ত অনুসঙ্গসমূহের কোনগুলো সিলেটের অগ্রগতির পথে বাধাস্বরূপ? এই বাধাসমূহ কেন বিরাজ করছে এবং কীভাবে এগুলো দূর করা যাবে?
উপর্যুক্ত প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার জন্য গুণগত ও পরিমাণগত উভয় ধরনের গবেষণা পদ্ধতিই ব্যবহার করা হয়েছে। পরিমাণগত তথ্যের বেশিরভাগই এসেছে তিন ধরনের জরিপ থেকে। এগুলো হলো খানা জরিপ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জরিপ এবং কমিউনিটি জরিপ। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক উভয় ধরনের প্রতিষ্ঠানই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জরিপের আওতায় আনা হয়েছে। গবেষণার গুণগত অংশে বিভিন্ন ধরনের চারটি কমিউনিটি নির্বাচন করা হয়েছে এবং এগুলোতে শিক্ষাসংক্রান্ত নানা বিষয়ে গভীর অনুসন্ধান পরিচালনা করা হয়েছে। এছাড়াও, প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে নানা ধরনের সরকারি পরিসংখ্যান ব্যবহার করা হয়েছে।
পরিমাণগত গবেষণার নমুনায়ন এমনভাবে করা হয়েছে যেন সিলেট বিভাগের চারটি জেলার গ্রামীণ এলাকাসমূহের এবং শহর এলাকার জন্য আলাদাভাবে তথ্য বিন্যাস করা যায়। একই সঙ্গে সমতল ভূমি, হাওর এলাকা এবং চা-বাগান/বনভূমি/পাহাড়-এর জন্যও আলাদা তথ্য বিশ্লেষণের সুযোগ রাখা হয়েছে। গবেষণার প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে দৈবচয়নের ভিত্তিতে নির্বাচিত ৩৪৪টি কমিউনিটি, ৭,৪৯৮টি খানা এবং ২৫৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর কমিউনিটি সিরিজ, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো প্রণীত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তালিকা নমুনা ফ্রেম হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। গুণগত গবেষণার তথ্য সংগ্রহের জন্য ৫৬টি সুগভীর সাক্ষাৎকার, ১২টি দলীয় আলোচনা, ৬৪টি কেইস স্টাডি এবং ৮টি পর্যবেক্ষণের সাহায্য নেওয়া হয়েছে। এজন্য ১৫টি বিভিন্ন ধরনের চেকলিস্ট ব্যবহার করা হয়েছে। এই গবেষণার সমুদয় তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে ২০১০ সালের মার্চ ও এপ্রিল মাসে।
ঘ. প্রধান ফলাফলসমূহ
এই গবেষণায় খানা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কমিউনিটি পর্যায়ের নানা তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। শিক্ষাক্ষেত্রে সিলেট বিভাগের অনগ্রসরতার বিবিধ কারণ এই গবেষণায় উঠে এসেছে যেগুলো আবার পারস্পরিকভাবে সম্পর্কিত। কারণগুলোর বেশিরভাগই এমন নয় যে এগুলো শুধু সিলেটের জন্য প্রযোজ্য। সার্বিকভাবে বাংলাদেশের অনগ্রসর এলাকাগুলোর সঙ্গে এর সামঞ্জস্যতা রয়েছে। তবে একথা অবশ্যই বলা যায় যে, কোনো কোনো কারণের ব্যাপকতা সিলেট বিভাগে বেশি এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে এগুলোর প্রকৃতিও হয়তো আলাদা ধরনের। সিলেটের সামাজিক ও ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে এর একটা সংযোগ খুঁজে পাওয়া যাবে।
ভৌগোলিক অবস্থা
বাংলাদেশ সাধারণভাবে সমতল ভূমির দেশ। কিন্তু সিলেট বিভাগ অন্য বিভাগগুলোর তুলনায় ভৌগোলিক দিক থেকে আলাদা ধরনের। সিলেটের হাওর ও চা-বাগান এলাকা সেখানকার সমতলভূমি এবং দেশের অপরাপর এলাকাসমূহ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির। এই ভিন্নতার প্রভাব লক্ষ করা যায় সেখানকার গৃহায়ন, যাতায়াত ব্যবস্থা এবং জনমানুষের পেশাসহ বেঁচে থাকার নানা অনুসঙ্গে।
হাওর ও চা-বাগান এলাকার গৃহায়ন, যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং মানুষজনের পেশা সিলেটের অন্য এলাকা এবং দেশের বাদবাকি অঞ্চল থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এবং তা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ও নিম্নমানের। এসকল ক্ষেত্রে ঋতুভিত্তিক ভিন্নতাও পরিলক্ষিত হয়। এই গবেষণায় দেখা গেছে, সিলেটের শহরাঞ্চল (মহানগর ও পৌরসভাসমূহ) ব্যতীত পুরো জনপদেই শিশুদের বিদ্যালয়ে অভিগম্যতার হার জাতীয় পর্যায়ের গড় হারের তুলনায় কম। সুনামগঞ্জ ও মৌলভীবাজার জেলায় এবং চা-বাগান এলাকায় এই হার জাতীয় পর্যায়ের গড় হারের অনেক নিচে। সুনামগঞ্জ জেলার গ্রামাঞ্চল সার্বিকভাবে হাওর পরিবেষ্টিত আর মৌলভীবাজার জেলা চা-বাগান অধ্যুষিত।
ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য থেকে উদ্ভূত আর্থিক অনগ্রসরতা এবং সামাজিক অসমতা আর বৈষম্যের কারণে এই অঞ্চলের শিশুরা বিদ্যালয়ে ভর্তি হয় কম। যারা ভর্তি হয় তারাও একই কারণে পড়ালেখা চালিয়ে নিতে পারে না। যদিও গড় হিসেবে সিলেট বিভাগের আর্থিক অবস্থা বাংলাদেশের অন্য বিভাগগুলোর তুলনায় ভালো কিন্তু ভৌগোলিক বিভিন্নতার কারণে এখানে অসম বিন্যাসের সম্ভাবনা খুব বেশি। দেখা গেছে, যেখানে সিলেট বিভাগের ৩৮.৫% গ্রামে শুধু কাঁচা রাস্তা রয়েছে সেখানে হাওর অঞ্চলের ৫৪% গ্রামের অবস্থাই এ রকম। প্রধান শিক্ষকদের সাথে কথা বলে জানা গেল, শুকনো মৌসুমে যেখানে এক-পঞ্চমাংশ শিক্ষার্থীকে ‘খারাপ’ রাস্তাঘাট পার হয়ে বিদ্যালয়ে আসতে হয় সেখানে বর্ষা মৌসুমে প্রায় দ্বিগুণ সংখ্যক শিক্ষার্থীকে এই অবস্থায় পড়তে হয়। সার্বিকভাবে সুনামগঞ্জ জেলায় এবং হাওর অঞ্চলে এই অবস্থা বেশি বিদ্যমান। পরিবারের ভরণপোষণে সাহায্য করার জন্য কাজে অংশগ্রহণ করতে হয় বলে অনেক শিশু বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ে।
শিশুদের দেরিতে ভর্তি ও আগাম ঝরে পড়া
সাধারণভাবে, অন্যান্য অঞ্চলের শিশুদের তুলনায় সিলেট বিভাগের শিশুরা স্কুলে ভর্তি হয় দেরিতে, আবার আগাম ঝরে পড়ার হারও তাদের মধ্যে বেশি। বয়সভিত্তিক নিট ভর্তি হারের বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায়, সিলেটের প্রতিটি বয়স গ্র“পের শিশুদের নিট ভর্তি হার এ সংক্রান্ত জাতীয় গড় হারের চেয়ে কম। যেখানে বাংলাদেশের ছয় বছর বয়সী শিশুদের ৬৫% স্কুলে ভর্তি হয় সেখানে সিলেট বিভাগের একই বয়সী শিশুদের মধ্যে এই হার পাওয়া গেছে মাত্র ৫২%। অভিভাবকদের একটি অংশ বলেছেন যে, শিশুদের স্কুলে ভর্তি করানোর বয়স সম্পর্কে তারা অবহিত নন। আর একটি অংশ ভর্তি না করানোর কোনো অজুহাত দেখাতে পারেননি। অবশ্য এটাও জানা গেছে যে, উক্ত বয়সী শিশুদের একটি অংশকে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ভর্তি করায়নি, যদিও মা-বাবারা তাদের স্কুলে নিয়ে গিয়েছিলেন। শিশুর বয়স ১৫ বছর হতেই সমতল ভূমির অর্ধেক শিশু, হাওর অঞ্চলের ৬০% শিশু এবং চা-বাগান, পাহাড় ও বনভূমির ৭৩% শিশু বিদ্যালয়-বহির্ভূত শিশুতে পরিণত হয়। এ সংক্রান্ত তুলনামূলক জাতীয় হার ৪০%-এরও নিচে। ঝরে পড়া শিশুদের একটি অংশের পরিবারগুলো পড়ালেখার ব্যয়ভার বহন করতে নিতান্তই অপারগ আর অন্যরা অল্প বয়সেই আয়-উপার্জনের জন্য নানা ধরনের কাজে যোগ দেয়। বিদ্যালয়ে শিক্ষণ-শিখনের দুর্বল মান, শেখানোর ক্ষেত্রে যতেœর অভাব শিক্ষার্থীদের ঝওে পড়ার অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে উঠে এসেছে।
কমিউনিটির সচেতনতা
বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার উপযুক্ত বয়সী শিশুদের মা-বাবাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে যে, তারা শিক্ষার গুরুত্ব বোঝেন। এমনকি দরিদ্র শ্রেণীর মা-বাবাদের ক্ষেত্রেও শিক্ষার ব্যাপারে আগ্রহের কমতি নেই। কিন্তু তারা যখন শিশুর শিক্ষালাভকে তাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের সঙ্গে তুলনা করেন তখন অনেক ক্ষেত্রেই দ্বিতীয়টি প্রাধান্য লাভ করে। এ কারণেই সিলেটের গ্রামাঞ্চলগুলোতে শিশুশ্রমের ব্যাপক প্রাধান্য লক্ষ করা গেছে। এই শিশুদেও কেউ অর্থের বিনিময়ে আবার কেউবা বিনামূল্যে শ্রমদান করে। এর সঙ্গে যোগ হয় উন্নত জীবনের প্রত্যাশায় বিদেশ যাওয়ার আকাক্সক্ষা, বিশেষ করে যুক্তরাজ্যে। এসব বিষয়গুলোকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানরা সামগ্রিকভাবে ‘অভিভাবকদের অসচেতনতা’ হিসেবেই চিহ্নিত করেছেন। যদিও তারা এ ব্যাপারে তেমন কোনো কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেননি।
শিক্ষাসংক্রান্ত সুবিধাদি
দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় সিলেট বিভাগে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কম নেই। কিন্তু এখানে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভাব রয়েছে। বাংলাদেশে বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার উপযুক্ত বয়সী শিশুদের ৬.৪% সিলেট বিভাগে বসবাস করে। দেখা গেছে, দেশের মোট প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৭.৮% আর মোট মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৩.৯% সিলেট বিভাগে অবস্থিত। উপর্যুক্ত তথ্য থেকে সিলেট বিভাগে মাধ্যমিক শিক্ষার অপ্রতুলতা সহজেই প্রতীয়মান হচ্ছে। শিক্ষাক্ষেত্রে কম বিনিয়োগ হচ্ছে বলেও ধরে নেওয়া যায়, অন্তত মাধ্যমিক শিক্ষায়।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো এবং শেখার সুযোগসুবিধা শিক্ষার্থীদের মানসম্মত শিক্ষার্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামোগত ও শেখার সুযোগসুবিধাসংক্রান্ত নানা সূচকের নিরিখে পরিষ্কারভাবে বলা যায় যে, সিলেটের প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর তুলনায় পিছিয়ে রয়েছে। অন্যদিকে, সিলেট বিভাগের মাধ্যমিক বিদ্যালয়সমূহের অবস্থা সারা দেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয়সমূহের তোই। সিলেটের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে বিদ্যুৎ, পানীয় জল, খেলার মাঠ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন দেয়াল ও মেঝে এবং ভালো মানের ব্ল্যাকবোর্ডের অভাব রয়েছে। সেখানে মাধ্যমিক স্তরে বিজ্ঞানাগারেরও অভাব রয়েছে।
শিক্ষকবৃন্দ, তাদের অনুপস্থিতি ও সময়ানুবর্তিতা
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক উভয় ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই শিক্ষকস্বল্পতা লক্ষ করা গেছে। সিলেট বিভাগের প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে গড় শিক্ষক সংখ্যা ৪.৪ জন আর মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে ১২.৮ জন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তুলনামূলক সংখ্যাগুলো হলো যথাক্রমে ৫.১ ও ১৪.৩ জন। শিক্ষাগত যোগ্যতা আর প্রশিক্ষণ প্রাপ্তির দিক থেকে সিলেট বিভাগের শিক্ষকগণ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের শিক্ষকদের একই সমতলে রয়েছেন। নারী শিক্ষকের অনুপাতে সিলেট বিভাগ এগিয়ে রয়েছে। কিন্তু দেখা গেছে, গ্রামীণ বিদ্যালয়সমূহের শিক্ষকদের
এক-চতুর্থাংশ শহর এলাকায় বসবাস করেন।
বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থাকা, কার্যদিবসে দেরিতে উপস্থিত হওয়া ও বিদ্যালয় ছুটি হওয়ার আগেই বিদ্যালয় ত্যাগ করার দিক থেকে সিলেট বিভাগের শিক্ষকরা দেশের অন্যান্য অঞ্চলের শিক্ষকদের তুলনায় এগিয়ে রয়েছেন। জরিপের দিন প্রাথমিক শিক্ষকদের ২১.৬% আর মাধ্যমিক শিক্ষকদের ১২.৪% বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত ছিলেন। উভয় হারই সারাদেশের গড় হারের তুলনায় বেশি। সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ এবং মৌলভীবাজার জেলার গ্রামীণ বিদ্যালয়সমূহের অবস্থা সবচেয়ে শোচনীয়। এসব এলাকার এক-চতুর্থাংশ শিক্ষক জরিপের দিন বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত ছিলেন। নারী শিক্ষক এবং হাওর এলাকার শিক্ষকদের মধ্যে অনুপস্থিতির হার বেশি পাওয়া গেছে।
যে শিক্ষকগণ জরিপের দিন বিদ্যালয়ে উপস্থিত ছিলেন তাদের অল্পসংখ্যকই সময়ানুবর্তিতার উদাহরণ সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন। এদের বড় একটি অংশ বিদ্যালয়ে দেরিতে উপস্থিত হয়েছিলেন অথবা ছুটি হওয়ার আগেই বিদ্যালয় ত্যাগ করেছিলেন। অনেকেই উভয়টিই করেছিলেন। বিশেষ করে প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহে এই সমস্যার ব্যাপকতা লক্ষ করা গেছে। এ কারণে একজন প্রাথমিক শিক্ষক দৈনিক গড়ে ৫৬ মিনিট এবং একজন মাধ্যমিক শিক্ষক দৈনিক গড়ে ৪৮ মিনিট শিক্ষক-শিক্ষার্থী সংযোগ সময়ের অপচয় করেছেন। সুনামগঞ্জ জেলা আর হাওর অঞ্চলে অবস্থিত প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহের শিক্ষকরা সবচেয়ে কম সময়ানুবর্তী। হাওর অঞ্চলের শিক্ষকরা গড়ে প্রতিদিন ৭৬ মিনিট আর সুনামগঞ্জ জেলার শিক্ষকরা গড়ে প্রতিদিন ৮০ মিনিট অপচয় করেছেন। সময় নষ্ট করার নিরিখে পুরুষ শিক্ষকরা নারী শিক্ষকদের তুলনায় এগিয়ে রয়েছেন। আমাদের গুণগত গবেষণাও এটা নিশ্চিত করেছে যে, খুব কম সংখ্যক শিক্ষকই বিদ্যালয়ে উপস্থিত হওয়া আর ত্যাগ করার ব্যাপারে সময়ানুবর্তী। শিক্ষক-শিক্ষার্থী সংযোগ সময়ের একটি বড় অংশই এ কারণে অপচয় হয় যা শিক্ষার্থীদের শিখন, সহপাঠক্রমিক কার্যক্রম এবং আচরণে বিরূপ প্রভাব ফেলে।
ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা
বিদ্যালয় পরিচালনার মৌলিক বিষয়সমূহ যথাযথভাবে প্রতিপালনের ব্যাপারে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি এবং উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের কর্মোদ্যোগ খুব কমই লক্ষ করা গেছে। বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গত এক বছরে একবারও পরিদর্শন করা হয়নি। আবার বেশ ক’টি মাত্র এক বা দুই বার পরিদর্শন করা হয়েছে, যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। উপজেলা রিসোর্স সেন্টার থেকে পরিদর্শনের ক্ষেত্রেও ব্যাপক দুর্বলতা পাওয়া গেছে। প্রায় ৭৩% প্রাথমিক বিদ্যালয় এক বছরে (২০০৯ সালে) একবারও পরিদর্শন করা হয়নি। বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভার বিবরণী পর্যালোচনা করে শিক্ষকদের সময়ানুবর্তিতার অভাবের বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়েছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়নি। উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের কার্যতালিকায় বিষয়টির উল্লেখ রয়েছে কিন্তু এ নিয়ে তারা কোনো কাজ করেছেন বা কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিয়েছেন বলে মনে হয়নি। বিদ্যালয় পরিদর্শন সাধারণভাবে খুবই সাধামাটাভাবে করা হয়ে থাকে। পরিদর্শনকালে যা আলোচনা হয় সেগুলো সরাসরি শিক্ষার মানোন্নয়নের সমস্যা বা সমস্যাগুলো থেকে উত্তরণের পথ অনুসন্ধানের কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। প্রয়োজনীয় সংখ্যক কর্মকর্তার অভাব একটা বড় কারণ হিসেবে বের হয়ে এসেছে।
অনাবাসী বাংলাদেশি
সিলেটের আয়-উপার্জনে অনাবাসী বাংলাদেশিদের বড় ভূমিকা রয়েছে। জরিপকৃত খানাগুলোর প্রায় এক-পঞ্চমাংশের কমপক্ষে একজন সদস্য অনাবাসী বাংলাদেশি। এদের অধিকাংশই গত এক বছরে তাদের আত্মীয়-পরিজনদেও কাছে টাকা পাঠিয়েছিলেন। এদের প্রেরিত অর্থের বড় অংশ ব্যয় করা হয়েছে দৈনন্দিন পারিবারিক খরচ মেটানো, ঘরবাড়ি তৈরি আর মেরামতের কাজে। প্রেরিত অর্থের একটি অংশ মাদ্রাসা, মসজিদ আর বিদ্যালয়ের উন্নয়নে দান করা হয়েছে। দান করা অর্থের খুব সামান্য অংশই সাধারণ শিক্ষার উন্নয়নে ব্যয় করা হয়েছে। দানের অর্থের পরিমাণের দিক থেকে মাদ্রাসাগুলো অগ্রাধিকার পেয়েছে। গবেষণায় আরও দেখা গেছে যে, যেসব খানায় অনাবাসী বাংলাদেশি সদস্য রয়েছে সেসব খানায় সাধারণত বিদ্যালয়ে অভিগম্যতার হার বেশি। যদিও এ ধরনের প্রবণতা প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ, মাধ্যমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে নয়। বিদেশ থেকে প্রেরিত অর্থ একদিকে যেমন পরিবারের শিশুদের শিক্ষায় আরও ভালোভাবে ব্যবহার করার সুযোগ রয়েছে, অন্যদিকে সার্বিকভাবে এলাকার শিক্ষার উন্নয়নেও এর সুষ্ঠু ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে।
স্থানান্তরিত খানা
সিলেট বিভাগ সম্পর্কিত আলোচনায় অবধারিতভাবে স্থানান্তরিত খানাসমূহের কথা চলে আসে। কিন্তু এ গবেষণায় আমরা এমন কোনো আলামত পাইনি যা থেকে বোঝা যাবে যে, সিলেটের সামাজিক ও শিক্ষাসংক্রান্ত উন্নয়ন বা অবনয়নে এদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। সিলেট বিভাগের মোট খানার ৫.৩% সিলেটের বাইরে থেকে স্থানান্তরিত হয়ে এসেছে, ৩.৬% সিলেটের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে বসতি স্থাপন করেছে আর ৯১.১% স্থায়ী বাসিন্দা। শিশুদের বিদ্যালয়ে অভিগম্যতার পরিপ্রেক্ষিতে দেখা যায়, সিলেটের বাইরে থেকে আসা খানা এবং স্থায়ী বাসিন্দাদের মধ্যে কোনো তফাৎ নেই। কিন্তু যারা সিলেট বিভাগের মধ্যেই স্থানান্তরিত হয়েছে তাদের মধ্যে অভিগম্যতার হার অন্য দুই দলের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক উভয় শিক্ষার উপযোগী বয়সী শিশুদের মাঝে একই ধরনের প্রবণতা দেখা গেছে।
মাদ্রাসার ভূমিকা
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় মাদ্রাসাগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। দেশের গড় অবস্থার তুলনায় সিলেট বিভাগের শিশুদের মধ্যে মাদ্রাসায় ভর্তি হওয়ার প্রবণতা তুলনামূলকভাবে একটু বেশি। কওমি ও খারেজি মাদ্রাসায় ভর্তির ক্ষেত্রেও সিলেট বিভাগ দেশের অন্য এলাকার তুলনায় এগিয়ে রয়েছে। ইসলাম ধর্মের সঙ্গে মাদ্রাসা শিক্ষার সম্পর্কের কারণে মা-বাবাদের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ শিশুদের মাদ্রাসায় ভর্তি করাতে পছন্দ করেন। এটি সিলেটে মাদ্রাসা শিক্ষা বিস্তারের একটি বড় কারণ। মাদ্রাসায় সাধারণ বিদ্যালয়ের তুলনায় ভালো পড়ালেখা হয় এমন ধারণা থেকে মা-বাবাদের একটি অংশ সন্তানদের মাদ্রাসায় ভর্তি করান। সিলেটের স্থায়ী বাসিন্দা, অনাবাসী খানা এবং যে মায়েদের প্রাথমিক শিক্ষা অসমাপ্ত রয়েছে তাদের ছেলেমেয়েদের মাদ্রাসায় ভর্তির প্রবণতা অন্যদের তুলনায় বেশি।
শিক্ষাক্ষেত্রে বিনিয়োগ
প্রতি এক হাজার জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে কতটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে এ ধরনের হিসাব থেকে কোনো এলাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রাপ্যতা সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়। দেখা গেছে, সিলেট বিভাগে প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রাপ্যতা দেশের অন্যান্য এলাকার মতোই। কিন্তু মাধ্যমিকের ক্ষেত্রে সিলেট অনেকটা পিছিয়ে রয়েছে। যদিও মাধ্যমিক স্তরে পড়ালেখা করার উপযোগী শিশুদের ৬.৪% সিলেট বিভাগে বসবাস করে কিন্তু দেশের মোট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মাত্র ৩.৯% সিলেট বিভাগে অবস্থিত। এই গবেষণায় আরও দেখা গেছে যে, গবেষণাভুক্ত ৪২% গ্রামে কোনো প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই। এই গ্রামগুলোর বেশিরভাগই আকারে খুব ছোট হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে এবং হয়তো গ্রামগুলোতে স্কুল চালু করার মতো পর্যাপ্ত সংখ্যক শিক্ষার্থীও নেই। দেখা গেছে, এই গ্রামগুলোর বেশিরভাগেই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জনগণ বসবাস করেন।
ঙ. নীতিসংক্রান্ত সুপারিশমালা
শিক্ষাক্ষেত্রে সিলেটের অনগ্রসরতার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে এই গবেষণায় এককভাবে তাৎপর্যপূর্ণ কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি। অনুসন্ধানে যে কারণগুলো পাওয়া গেছে তার বেশিরভাগই বাংলাদেশের শিক্ষাক্ষেত্রে অনগ্রসরতার মৌলিক কারণগুলোর প্রতিচ্ছবি মাত্র। সেজন্য সিলেটের ক্ষেত্রে সমাধান খুঁজে পেতে হবে সার্বিকভাবে জাতীয় কৌশল এবং প্রাধান্যের মধ্যে। শিক্ষার অসম বিস্তার যে বাংলাদেশের শিক্ষা উন্নয়নের পথে বড় ধরনের অন্তরায় তা এডুকেশন ওয়াচের ২০০৩/৪, ২০০৭ ও ২০০৮ সালের গবেষণাসমূহে ব্যাপকভাবে উঠে এসেছে। ঐ গবেষণা প্রতিবেদনসমূহে যে সুপারিশমালা প্রণয়ন করা হয়েছে তার বেশিরভাগই সিলেট বিভাগের জন্যও প্রাসঙ্গিক। বর্তমান শিক্ষানীতির দ্রুত বাস্তবায়ন করলে এবং কয়েকটি বিষয়ে বিশেষ নজর দিলে সিলেট বিভাগের শিক্ষার অগ্রগতিকে তরান্বিত করতে সহায়ক হবে।
• সিলেট বিভাগের বৈচিত্র্যময় ভৌগোলিক পরিবেশ এবং এর অভ্যন্তরস্থ বিভিন্নতা বিবেচনায় নিয়ে বলা যায়, শিক্ষা উন্নয়নের একটি সাধারণ নীতিমালা সম্ভবত পুরো এলাকার জন্য প্রযোজ্য নাও হতে পারে। বাস্তবতাকে স্বীকার করে নেওয়া দরকার। পাশাপাশি জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ সমতা বিধানের যে আকাক্সক্ষা ব্যক্ত করা হয়েছে তার প্রতি মনোযোগ দেওয়া দরকার। বিশেষ করে সিলেট বিভাগে বিকেন্দ্রীকৃত শিক্ষা পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার দিকে জোরালোভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার। উপজেলা পর্যায়ের শিক্ষা পরিকল্পনার অংশ হিসেবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পর্যায়ে পরিকল্পনা প্রণয়ন গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেওয়া দরকার। উভয় পর্যায়েই পরিকল্পনা প্রণয়নের ক্ষেত্রে সরকারের একটা সাধারণ দিকনির্দেশনা থাকতে পারে। চা-বাগানে শিক্ষা পরিকল্পনা প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় বাগান ব্যবস্থাপকদের অংশগ্রহণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
• হাওর অঞ্চলের বিশেষ ভৌগোলিক বাস্তবতার কারণে সেখানকার শিশুদের বিদ্যালয়ে উপস্থিত হওয়া বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। গ্রীষ্ম ও বর্ষা মৌসুমে এই এলাকার রূপ বদলে যায়, ফলে ঝুঁকির মাত্রাও পরিবর্তিত হয়। শিশুদের স্বার্থে এলাকায় যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটানো প্রয়োজন। বাস্তব কারণে পুরো হাওর এলাকায় রাস্তা নির্মাণ সম্ভব নাও হতে পারে। বর্ষা মৌসুমে পানি প্রবাহের গতিপ্রকৃতি ও শক্তি বিবেচনায় নিয়ে সম্ভাব্যক্ষেত্রে নতুন রাস্তা নির্মাণ করা দরকার। দরকার পুরাতন রাস্তাগুলোর সংস্কারসাধন করা। বর্ষা মৌসুমে হাওর এলাকায় শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের জন্য বিশেষ জলযান (ওয়াটার বাস) চালু করা যেতে পারে।
• শিক্ষা প্রসারে সরকার ও নানা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের যেসব ইতিবাচক কর্মসূচি রয়েছে সেগুলো সিলেটের কোনো কোনো অঞ্চলে বর্ধিত আকারে বি¯তৃত করা যেতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে উপবৃত্তি ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা কর্মসূচি। যেসব এলাকায় শিক্ষার্থী ভর্তির হার কম এবং আগাম ঝরে পড়ার হার বেশি সেসব এলাকায় উপবৃত্তির পরিমাণ এবং সংখ্যা উভয়ই বাড়ানো যেতে পারে। সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ জেলার বৃহৎ অংশ অর্থাৎ পুরো হাওর এলাকা এবং মৌলভীবাজার জেলার চা-বাগানসমূহকে এ ধরনের সুবিধার আওতায় আনা দরকার। এ ধরনের সুবিধা পরিবারগুলোর আর্থিক অসমর্থতা দূর করতে এবং শিশুদের বিদ্যালয়মুখী করে পড়ালেখা চালিয়ে নিতে প্রণোদনা যোগাতে সাহায্য করবে।
• বিশেষ করে সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার স্বল্পতার কারণে বাংলাদেশে বিদ্যালয় পরিদর্শনের মান খুবই দুর্বল। প্রতিজন কর্মকর্তাকে এত বেশি সংখ্যক বিদ্যালয়ের ভার দেওয়া থাকে যে তাদের পক্ষে কুলিয়ে ওঠা সম্ভব হয় না। সিলেটের অবস্থাও পুরো দেশের অনুরূপ। সিলেট বিভাগের গ্রামীণ উপজেলাসমূহে আরও বেশি সংখ্যক কর্মকর্তার পদ সৃষ্টি করে অনতিবিলম্বে তাদের নিয়োগ দেওয়া দরকার। বিশেষ করে দুর্গম এলাকাসমূহের জন্য এটি বেশি প্রযোজ্য। এধরনের উদ্যোগের লক্ষ্য হওয়া উচিত প্রতিজন কর্মকর্তাকে স্বল্পসংখ্যক (১২-১৫টি) বিদ্যালয়ের দায়িত্ব দেওয়া যেন তারা বিদ্যালয় পরিদর্শনের মাত্রা ও গুণগত মান উভয়ই বাড়াতে পারেন। উপজেলা রিসোর্স সেন্টার এবং বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির পক্ষ থেকে তদারকিও বাড়ানো উচিত। এর লক্ষ্য হওয়া উচিত শিক্ষকদের নিয়মিত ও সময়মতো উপস্থিতি নিশ্চিত করা এবং শ্রেণীকক্ষে শিক্ষণ-শিখনের মান বাড়ানো। এধরনের কাজে ইউনিয়ন পরিষদের সম্ভাব্য ভূমিকা কী হতে পারে তাও গুরুত্বসহকারে খতিয়ে দেখা দরকার।
• যে সকল বিদ্যালয়ে শিক্ষকস্বল্পতা রয়েছে সেখানে অনতিবিলম্বে প্রয়োজনীয়সংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া দরকার। শিক্ষকরা যেন বিদ্যালয়ের নিকটবর্তী কোনো সুবিধাজনক স্থানে বসবাস করেন সে জন্য তাদের উৎসাহ প্রদান করা দরকার। স্থানীয়ভাবে অধিকসংখ্যক অস্থায়ী শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে শিক্ষকস্বল্পতা নিরসনের একটা উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। বিশেষ করে হাওর অঞ্চলের ক্ষেত্রে এ ধরনের শিক্ষক বিশেষভাবে প্রয়োজন। হাওর, চা-বাগান ও পাহাড়ের মতো দুর্গম এলাকার বিদ্যালয়সমূহে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের জন্য বিশেষ ভাতার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। শিক্ষকদের কর্ম উদ্দীপনা বাড়ানোর জন্য মাঝে মাঝে কর্মশালার আয়োজন করা যেতে পারে। পারিতোষিক বাড়িয়ে ডাক্তারদের গ্রামে থেকে কাজ করতে উৎসাহিত করার ক্ষেত্রে থাইল্যান্ড সফলতা দেখিয়েছে।
• শিশুদের শিক্ষার প্রতি মা-বাবার দায়িত্ববোধ বাড়ানো এবং শিক্ষকদেরকে তাদের কাজের প্রতি আরও জবাবদিহি করার লক্ষ্যে নিয়মিতভাবে বিদ্যালয় পর্যায়ে অভিভাবক-শিক্ষক সভার আয়োজন করা দরকার। মা-বাবার সঙ্গে বিদ্যালয়ের যোগাযোগ বাড়ানোর ক্ষেত্রে এবং সার্বিকভাবে জবাবদিহিতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এক্ষেত্রে উপজেলা শিক্ষা অফিসের শক্ত ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে। কর্মকর্তাদেরকে কমসংখ্যক বিদ্যালয়ের দায়িত্ব দিলে, নিবিড় পরিদর্শনের মাধ্যমে তারা তা করতে পারেন।
• চা-বাগানসমূহ এবং দুর্গম হাওর এলাকায় যেখানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের স্বল্পতা রয়েছে সেখানে নতুন বিদ্যালয় স্থাপন করা দরকার। স্থায়ী ও আনুষ্ঠানিক বিদ্যালয় স্থাপন যদি সময়সাপেক্ষ হয় তবে অস্থায়ী ভিত্তিতে উপানুষ্ঠানিক বিদ্যালয় স্থাপনের কথা বিবেচনা করা যেতে পারে।
• সরকারের আর্থিক সহায়তা নিয়ে স্থানীয় ও জাতীয় স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানসমূহ এবং বেসরকারি উদ্যোক্তারা একাজ করতে পারেন। বিদ্যালয়সমূহে স্থানীয় শিক্ষকদের নিয়োগ দেওয়া উচিত। শিশুসংখ্যার অনুপাতে দেশের অন্যান্য এলাকার তুলনায় সিলেটে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা অনেক কম। বৈষম্য দূর করার লক্ষ্যে সরকারের উচিত মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপনে বেসরকারি খাতকে উৎসাহিত করা।
• সিলেটের শিক্ষা উন্নয়নে আরও বেশি অবদান রাখতে অনাবাসী বাংলাদেশিদের উৎসাহিত করতে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার। এমন ব্যবস্থা নেওয়া দরকার যেন একটা যৌথ ও সমন্বিত কর্মোদ্যোগের সৃষ্টি হয়। সরকারি উদ্যোগে সিলেট বিভাগের জন্য বিশেষ শিক্ষা তহবিল গঠন করা যেতে পারে যেখানে সরকার ও অনাবাসী বাংলাদেশিরা নিজ নিজ অবদান রাখবেন। তহবিলে সরকারের অবদান অনাবাসীদের অবদান রাখতে উৎসাহিত করবে। তহবিলের ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানের তুলনায় স্বায়ত্বশাসিত সংস্থা ভালো ভূমিকা রাখতে পারে।
সবশেষে, শিক্ষার্থীদের অভিগম্যতা ও শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে ইতোমধ্যে যে জেন্ডার সমতা অর্জিত হয়েছে তা বজায় রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
লেখক পরিচিতি
সম্পাদক বাংলাদেশের শিক্ষা
এই লেখাটি সম্পাদক কর্তৃক প্রকাশিত। মূল লেখার পরিচিত লেখার নিচে দেওয়া হয়েছে।