বাড়ি দক্ষতা ও উন্নয়ন শিক্ষকদের পেশাগত উন্নয়নে আত্ম-অবলোকন বা সেল্ফ-মনিটরিং

শিক্ষকদের পেশাগত উন্নয়নে আত্ম-অবলোকন বা সেল্ফ-মনিটরিং

বাংলাদেশের শিক্ষা
বাংলাদেশের শিক্ষা

একজন পেশাদার শিক্ষক জানতে চান বা জানার ইচ্ছে প্রকাশ করেন যে, তিনি কোন ধরনের শিক্ষাদানে কতটা পারদর্শী, কতটা ফলপ্রসু তার শিক্ষাদান এবং পেশাগত জীবনে তিনি কতটা সফল-একজন শিক্ষক এটি কিভাবে জানতে পারেন? আমরা সাধারণত কর্তৃপক্ষের মতামত বা মূল্যায়ন এবং শিক্ষার্থীদের মতামত ইত্যাদির মাধ্যমে বিষয়টি জেনে থাকি। এগুলো ছাড়া আরেকটি শক্তিশালী উৎস বা মাধ্যম হচ্ছে নিজ ক্লাসের পাঠদান পর্যবেক্ষণ। একজন শিক্ষকের পেশাগত উন্নয়নে আত্ম-অবলোকন, ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ এবং মনিটরিং উল্লেখযোগ্য ভুমিকা পালন করে থাকে যেটি আমরা সাধারণত করি না বা করার কোনো প্রবণতাও লক্ষ্য করা যায় না শিক্ষক সমাজের মাঝে।

ব্যক্তিগত মনিটরিং বা অবলোকন কী?

ব্যক্তিগত মনিটরিং বা আত্ম-অবলোকন হচ্ছে এক ধরনের কাঠামোগত পর্যবেক্ষণ পদ্ধতি। ব্যক্তিগত আচরণের ব্যবস্থাপনা আরও সুন্দর এবং নিজের আচরণের ওপর কিভাবে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা যায়, তা ব্যক্তিগত মনিটরিংয়ের মাধ্যমে নির্ধারণ করা যায়। ভাষা শিক্ষার ক্লাসে ব্যক্তিগত মনিটরিং দ্বারা আমরা বুঝি একজন শিক্ষকের পাঠসংক্রান্ত তথ্যাদি লিপিবদ্ধ করা। এই তথ্যসংগ্রহ হতে পারে লিখিত,বা ভিডিও বা অডিও আকারে এবং পরিচালিত পাঠদানের ওপর ফিডব্যাক নেয়ার নিমিত্তে এই তথ্য সংগ্রহ করা হয়। ব্যাক্তিগত মনিটরিং শিক্ষক মূল্যায়নের একটি সম্পুরক পদ্ধতি। অর্থাৎ শিক্ষার্থী, সহকর্মী এবং তত্ত্বাধায়কের নিকট থেকে ফিডব্যাক নেয়া হবে এবং তার সাথে সেল্ফ মনিটরিং এক নতুন মাত্রা যোগ করবে।

আত্ম-মনিটরিং বা আত্ম-অবলোকন কেন?

১. একজন শিক্ষক যে দীর্ঘকাল শিক্ষকতায় নিয়োজিত থাকেন সে অনুপাতে তার প্রশিক্ষণ খুব কম হয়।আমরা মনে করি একজন শিক্ষক প্রশিক্ষণ পেলেই তার পেশাগত উন্নয়ন ঘটে তাকে তারপর তেমন আর কিছু করতে হবে না। আসলে শিক্ষক প্রশিক্ষণ পেশাগত উন্নয়নের শুরু- শেষ নয়। শিক্ষকতা জীবন চলাকালীন পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য কী কী করা দরকার তা তার জানতে হবে। তার পাঠদান ফলপ্রসু হচেছ কিনা, শিক্ষার্থীগণ সন্তষ্ট কিনা এ বিষয়গুলো একদিন কিংবা একটি বা দুটি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নির্ণয় করা যায় না। এটি দীর্ঘমেয়াদী কিংবা পুরো পেশাগত জীবনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

২. আত্ম-মনিটরিং শিক্ষককে তার পাঠদান মূল্যায়নে সমালোচনামূলক ও বিশ্লেষণধর্মী সুযোগ প্রদান করে। শিক্ষক উন্নয়নের ক্ষেত্রে রিফ্লেকশন এবং মূল্যায়ন একটি প্রধান চাবিকাঠি। অবিরত শিক্ষক উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে আত্ম-জিজ্ঞাসা এবং বিশ্লেষণধর্মী ও সমালোচনামূলক চিন্তাধারা। এই মনিটরিং তাদেরকে রুটিনমাফিক ও প্রচলিত পদ্ধতির বাইরে নিয়ে যায় যেখানে সমালোচনামূলক চিন্তা-ভাবনার দ্বারা পরিচলিত হয় তার শিক্ষা।

৩. আত্ম-মনিটরিং একজন শিক্ষকের কল্পিত দৃষ্টিভঙ্গি এবং বাস্তবতার মাঝখানের ব্যবধান কমিয়ে আনতে সহায়তা করে। একজন শিক্ষক হয়ত আত্মতুষ্টিতে ভুগেন যে তার ক্লাসে তিনি যথেষ্ট পরিমাণে কার্যাবলী বা প্রাকটিস শিক্ষার্থীদের করাচ্ছেন, তিনি তার ক্লাসে ফলপ্রসূ শিক্ষাদান করছেন এবং তিনি নিজেই নিজকে সার্টিফিকেট দিচ্ছেন যে তিনি একজন সফল শিক্ষক। বাস্তবে খুব গভীর ও নিগুঢ় দৃষ্টিতে দেখলে মনে হবে একই ধরনের কিংবা এমন কিছু অ্যাকটিভিটি তিনি করাচ্ছেন যা শিক্ষার্থীদের তেমন একটা কাজে লাগছে না বা তারা উৎসাহ পাচ্ছেনা কিংবা শ্রেণীকক্ষের কার্যাবলী সব শিক্ষার্থীদের কাজে উদ্বুদ্ধ করতে কিংবা অংশগ্রহণ করাতে পারছে না। এটি সেল্ফ মনিটরিং-এর মাধ্যমে নির্ণয় করা যায়।

৪. বাহ্যিক একটি দৃষ্টি এখানে কাজ করছে বলে শিক্ষক বুঝাতে পারেন তার কোন কোন্ বিষয় বা আচরণ বা কার্যাবলী ক্লাসে কাজে লাগছে এবং কোন্গুলো লাগছে না।

আত্ম-অবলোকন বা আত্ম-মনিটরিং-এর মাধ্যমে একজন শিক্ষক কি শিখতে পারেন ?

শিক্ষাবিদ লাফট কী বলছেন আমরা লক্ষ্য করি। Luft(1969) categorizes four types of information about teacher behavior that teachers can examine through self-assessment : information concerning the open-self, the secret-self, the blind-self and the undiscovered/hidden self.

একজন শিক্ষকের আচরণ তিনি নিজে জানেন এবং অন্যেরাও জানে সেটি হচেছ উন্মুক্ত দিক বা ওপেন সেলফ। এই দিকটি একজন শিক্ষক অন্যের সাথে আলোচনা করতে পারেন। গোপন দিক হচ্ছে সেটি যা শিক্ষক নিজে জানেন কিন্তু অন্যেরা জানে না। যেমন কোন বিষয়ে তাকে পাঠদান করতে হবে সবার সামনে, অনেক অজানা বিষয় এখানে রয়েছে অথচ তিনি তা জনসমক্ষে প্রকাশ করতে পারছেন না। ব্যাপারটি তিনি অন্যদের জানাতে চান না পাছে তারা তাকে অযোগ্য কিংবা নিম্নমানের শিক্ষক মনে করেন।

দ্যা ব্লাউন্ড সেলফ বা অন্ধকার দিক হচ্ছে যে বিষয়গুলো একজন শিক্ষক নিজে বুঝতে পারছেন বা তার অজান্তেই ঘটে যাচ্ছে। অন্যের চোখ তিনি এড়াতে পারছেন না অথচ নিজে বুঝতেও পারছেন না। যেমন কোন আপত্তিকর বেমানান শব্দ বার বার ক্লাসেই বলে যাচ্ছেন, নিজে বুঝতে পারছেন না।

দ্যা হিডেন বা আনডিসকভারড বা লুক্কায়িত দিক: এমন একটি দিক বা বিষয় যা একজন শিক্ষকের ক্ষেত্রে ঘটে যা শিক্ষক নিজেও জানেন না বা বিদ্যালয়ের অন্যরাও জানেন না বা বুঝতে পারেন না। জীবনব্যাপি তার এই অজানা দিকটি থেকেই যায়। আত্ম-মনিটরিংয়ের মাধ্যমে সেটি আবিষ্কার করা যেতে পারে ।

আত্ম-অবলোকন কিভাবে করা যায়?

প্রধানত তিনটি পদ্ধতিতে এই আত্ম-মনিটরিং করা যায়। যেমন: ১. ব্যাক্তিগত রিফ্লেকশন/ প্রতিফলন দ্বারা, ২. রিপোর্টিং-এর দ্বারা এবং ৩. পাঠের অডিও ভিডিও রেকর্ডের দ্বারা।

একজন শিক্ষক পাঠদানের সময় কী কী করেছেন সেগুলো তার ডায়েরীতে লিপিবদ্ধ করবেন। এটি পাঠদান করার পরপরই লিখে ফেলতে হবে। শ্রেণীকক্ষে যা যা ঘটেছে এবং শিক্ষকের ব্যক্তিগত অনুভুতি এবং প্রতিক্রিয়া পুঙ্খানুপুঙ্খরুপে লিপিবদ্ধ করতে হবে। এক সপ্তাতের কিংবা এক মাসের কোন ক্লাসে একজন শিক্ষক কী করেছেন, শিক্ষার্থীরা ক্লাস কতটা উপভোগ করেছে, শিক্ষক তাদের সাথে কীরকম আচরণ করেছেন, কতগুলো গ্রামার ভুল করেছেন বা লিখেছেন বা বলেছেন ইত্যাদি লিপিবদ্ধ করা।

আত্ম-রিপোর্টিং: এই পদ্ধতিতে একটি ইনভেনটরি বা চেকলিস্ট ব্যবহার করতে পারেন একজন শিক্ষক। কী ধরনের শিক্ষাদান পদ্ধতি একজন শিক্ষক ব্যবহার করেছেন বিশেষ কোন পাঠদানের ক্ষেত্রে কিংবা বিশেষ সময়ের মধ্যে কোনটি কতবার ব্যবহার করা হয়েছে। এই চেকলিস্ট শিক্ষক ব্যক্তিগতভাবে কিংবা গ্রুপেও ব্যবহার করতে পারেন। একজন শিক্ষক প্রতিনিয়ত শ্রেণীকক্ষে কী করেন তা জানার জন্য একটি নিয়মিত মূল্যায়ন পদ্ধতি। একজন শিক্ষক তার ধারণা মোতাবেক শিক্ষাদান এবং বাস্তবে কিভাবে ক্লাস পরিচালনা করেছেন তার মধ্যে ব্যবধান প্রতিফলিত হয় আত্ম-রিপোর্টিং-এর মাধ্যমে।

পাঠদান রেকর্ডিং: এটি ডায়েরী এবং রিপোর্টের চেয়ে অধিকতর নির্ভরযোগ্য। তবে একথা ঠিক যে ডায়েরী লেখা এবং রিপোর্টিং-এর মাধ্যমে অনেক গভীরে প্রবেশ করা যায়। তবে মিনিট বাই মিনিট বা পুঙ্খানুপুঙ্খরুপে পাঠের বিশ্লেষণ দেখা যায় না। রিপোর্টিং-এর মাধ্যমে যেটি সম্ভব রেকর্ডিং-এর দ্বারা। শ্রেণীকক্ষে পাঠদানের সময় একইসাথে অনেক কিছু ঘটে এবং কিছু কিছু ব্যাপার বা ঘটনা স্মরণ রাখা যায় না ডায়েরী লেখা পর্যন্ত। এক্ষেত্রে রেকর্ডিং ভালো কাজ করে। একটি রেকর্ড শ্রেণীকক্ষে ঘটে যাওয়া সব কিছুই ধারন করে রাখতে পারে যা ডায়েরী কিংবা রিপোর্টিং এর মাধ্যমে সম্ভব নয়। একজন শিক্ষক শিক্ষাদানকালে অর্থাৎ ক্লাসে নিজের অজান্তে অনেক কিছুই করেন যা ডায়েরী লেখা কিংবা রিপোর্ট লেখায় প্রতিফলিত হয় না ফলে সংশোধন করার সুযোগও পান না। রেকর্ডিং এ ক্ষেত্রে বেশ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। আর তাই McLaughlin ( 1985:155-6) বলেন, Recording cites a striking example of how a teacher discovered information about her blind and hidden selves through examining a video of her class.

একজন সফল শিক্ষক ডায়েরী লেখা, রিপোর্টিং ও রেকর্ডিং-পদ্ধতি অবলম্বনের মাধ্যমে সেলফ মনিটরিং চালিয়ে যেতে পারেন। অবিরত শিক্ষক উন্নয়নের এটি একটি উল্লেখযোগ্য পদ্ধতি। একজন শিক্ষকের অজানা বিষয়গুলো সনাক্ত করা এবং সংশোধন করার ক্ষেত্রে সেল্ফ মনিটরিং নি:সন্দেহে একটি কার্যকরী পদ্ধতি।

লেখক পরিচিতি

মাছুম বিল্লাহ বাংলাদেশে ইংলিশ টিচার্স অ্যাসেসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইট্যাব)-এর সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি পূর্বে ক্যাডেট কলেজ ও রাজউক কলেজের শিক্ষক হিসেবে কাজ করেছেন। কাজ করেছেন ব্র্যাকের শিক্ষা কর্মসূচিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে। তিনি ভাব বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর হিসেবেও কর্মরত রয়েছেন। তিনি নিয়মিত শিক্ষাবিষয়ে নানা প্রবন্ধ লিখছেন।

কোন মন্তব্য নেই

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Exit mobile version