যুগের চাহিদার সাথে তাল মিলাতে গিয়ে দেশের আনাচে-কানাচে গজিয়ে উঠেছে ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়। ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়ের ব্যাপ্তি ঘটেছে রাজধানী শহর ঢাকা থেকে থানাশহর এমনকি গ্রাম পর্যন্ত। আর এ ধরনের বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সাথে জড়িয়ে পড়ছে প্রকৃত বিদ্যানুরাগী থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী এবং বেকার ছেলেমেয়েরা পর্যন্ত। ফলে শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে ব্যহত। শিক্ষার মান নিয়ন্ত্রণের নেই কোনো ব্যবস্থা। সিলেবাস প্রণয়নের মধ্যে লক্ষ্য করা যাচ্ছে সমন্বয়হীনতা। এ অবস্থায় ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়গুলোর উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা সময়ের দাবি।
লন্ডন এবং ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালযের অধীনে আমদের দেশে যেসব ইংরেজি মাধ্যম স্কুল ”ও” এবং ”এ” লেভেল প্রদান করে থাকে, এ ধরনের সব স্কুলকে সাধারণ শিক্ষাবোর্ডে এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে নিবন্ধন করতে বলা হয়েছে। দেশের সকল কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলোকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদপ্তরে নিবন্ধন করতে বলা হয়েছে। বিষয়টি নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে। অন্তত এটুকু বলতে পারি যে, এসব স্কুলগুলোর লাগামহীন গতির উপর সরকারের কিছুটা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হবে এ নীতির ফলে। আবার ভয়ও হচ্ছে অনেক- কারণ সরকারি নিয়ন্ত্রণ মানে খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি, শিক্ষার মান টাকায় মাপা আর দুর্নীতির ছড়াছড়ি। আমরা সরকারি চিন্তাভারনাকে সাধুবাদ জানাই। ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়গুলোতে সরকারি নিয়ন্ত্রণের পূর্বে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতার ব্যবস্থা করতে হবে। পুরো ব্যাপার ছাত্র, শিক্ষক, অভিভাবক এবং সর্বোপরি দেশবাসীর নিকট স্পষ্ট হতে হবে। সরকারি নীতি-নির্ধারণীতে এবং পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচেছ স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব এবং লাগামহীন দুর্নীতি। এ অবস্থা যেন এসব স্কুলগুলোতে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে দেখা না দেয়।
আমাদের কেন এত ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়? বিশ্বায়নের প্রভাবে দুনিয়াব্যাপী ইংরেজি ভাষার গুরুত্ব বেড়ে চলেছে। গোটা দুনিয়া এখন পরিচিত ’গ্লোবাল ভিলেজ’ নামে। গোটা দুনিয়ার মানুষ এখন বাস করছে একই প্রতিবেশীর মতো। একে অপরের ক্ষেত্রে যোগাযোগের কমন ভাষা হচ্ছে ইংরেজি। ইংরেজি জানলে চাকুরি পাওয়ার ক্ষেত্রে পাওয়া যায় অগ্রাধিকার। এসব কারণে অধিকাংশ অভিভাবক ছুটছে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের পেছনে। আর সেই সুবাদে কিছু ব্যবসায়ী ও বেকার লোকজন ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের পসরা সাজিয়ে বসেছে।
আরও একটি কারণে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। সেটি হচ্ছে- দেশী মাধ্যমে উপযুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অপ্রতুলতা। অনেক অভিভাবক বাধ্য হয়েই তাদের বাচ্চাদের এসব স্কুলে পাঠান। মানসম্মত বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয়ের সংখ্যা জনসংখ্যা অনুপাতে নিতান্তই কম, এ সংখ্যা বাড়াতে হবে। এগিয়ে আসতে হবে সমাজের বিদ্যুৎসাহী, বিত্তবান লোকজন এবং সরকারকে।
ঢাকাসহ দেশের বড় বড় শহরগুলোতে কিছু প্রতিষ্ঠিত ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয় আছে। এগুলোর পাঠ্যক্রম লন্ডন ও ক্যামব্রিজ বিশববিদ্যালযের অধীনে পরিচালিত হয়ে থাকে। এ বিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থীদের অবশ্যই উঁচুমানের শিক্ষা প্রদান করে থাকে, কিন্তু এ প্রতিষ্ঠানগুলোতে পড়ানোর মত সামর্থ্য অনেকেরই নেই। এই ধরনের প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে সমাজে বিরাট ব্যবধান সৃষ্টি করে রেখেছে। মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষের জন্য এসবে পড়ালেখার সুযোগ থাকতে হবে। সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হলে এ ব্যাপারটি অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে দেখতে হবে তবে মান নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে আপোস করা যাবে না।
নামীদামী এই ইংলিশ মাধ্যম স্কুলগুলোতে অধ্যয়নরত ছাত্রছাত্রীদের মাঝে এক ধরনের সাংস্কৃতিক শুণ্যতা লক্ষ্য করা যায়। দেশীয় কৃষ্টিকালচারে এখনকার শিক্ষার্থীরা অতটা আগ্রহী হয়ে উঠে না। দেশীয় কালচারের সাথে পরিচিত হওয়ার জন্য এদেরকে উৎসাহিতও করা হয় না। বাংলা ভাষা শেখার প্রতি তারা অনীহা প্রকাশ করে থাকে। এমনকি অনেক ছেলেমেদের মাঝে অনেকটা উন্নাসিক মনোভাব পরিলক্ষিত হয়। তারা মনে করে আমরা অচিরেই বিদেশে চলে যাব। অতএব বাংলা ভাষা জানা আমাদের জন্য জরুরি নয়। তারা ভুলে যায় যে, বিদেশে গিয়ে তাদের এদেশের প্রতিনিধিত্ব করতে হবে। এটিই হচ্ছে দেশপ্রেমের ধারণা। তাদের মধ্যে এ ধারণা জন্ম দেয়ার তেমন উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায় না ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়গুলোতে।
এসব বিদ্যালয়ের উপস্হিতি সমাজে একধরনের বৈষম্য সৃষ্টি করছে। বেসরকারী বিদ্যালয় এবং মহাবিদ্যালয়গুলোর বেতন দু’শত থেকে সাতশত টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ। অপরদিকে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের বেতন এক হাজার থেকে সাড়ে চারহাজার টাকা। নিঃসন্দেহে সমাজে এটি একটি বিরাট বৈষম্যের জন্ম দিচ্ছে। স্বভাবতই এখনকার ছেলেমেয়েদেরকে একটু নাকউঁচু ভাব নিয়ে বড় হতে দেখা যায়। এতকিছুর পরেও ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়ের উপস্থিতি এবং প্রতিষ্ঠা অস্বীকার করা যাবে না। কারণ এটি যুগের চাহিদা। ইংরেজি আমাদের শিখতে হবে এবং হচ্ছে। বাংলা মাধ্যম স্কুল কিংবা কলেজে যে পদ্ধতিতে ইংরেজি শেখানো হয় বাস্তব জীবনে তা প্রয়োগ করতে ছাত্রছাত্রীরা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না অর্থাৎ তাদেরকে সেভাবে শেখানোর ব্যবস্থা নেয়া হয় না। তাছাড়া আমাদের পাশ্ববর্তী দেশ ভারত এবং পাকিস্তানেও প্রচুর এ ধরনের বিদ্যালয় আছে। অতএব আমরা এ মাধমে লেখাপডা করা বা করানো একেবারে অস্বীকার করতে পারবো না। তবে আমাদের দৃষ্টি দিতে হবে ইংরেজি মাধ্যমে লেখাপড়া করেও ছাত্রছাত্রীরা যাতে ভালো বাংলা জানে এবং দেশীয় কৃষ্টি-কালচারকে শ্রদ্ধা করতে শিখে। এ কারণেই আমরা চাইব এসব বিদ্যালয়গুলোর উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হোক। তবে সেই নিয়ন্ত্রণে যেন কিছুসংখ্যক সরকারি কর্মকর্তার উৎকোচ গ্রহণের সুযোগ না হয় এবং শিক্ষার মান নিম্নগামী হয়ে না যায়।
লেখক পরিচিতি
মাছুম বিল্লাহ বাংলাদেশে ইংলিশ টিচার্স অ্যাসেসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইট্যাব)-এর সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি পূর্বে ক্যাডেট কলেজ ও রাজউক কলেজের শিক্ষক হিসেবে কাজ করেছেন। কাজ করেছেন ব্র্যাকের শিক্ষা কর্মসূচিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে। তিনি ভাব বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর হিসেবেও কর্মরত রয়েছেন। তিনি নিয়মিত শিক্ষাবিষয়ে নানা প্রবন্ধ লিখছেন।