বাড়ি উচ্চশিক্ষা বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার ইতিহাস ও বর্তমান অবস্থা

বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার ইতিহাস ও বর্তমান অবস্থা

উচ্চশিক্ষার ইতিহাস : আইন বিভাগ রয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও
উচ্চশিক্ষার ইতিহাস : আইন বিভাগ রয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও

বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার ইতিহাস জানতে ও বুঝতে গেলে গোড়ার দিককার উচ্চশিক্ষার ইতিহাস জানা প্রয়োজন। কারণ আজকের এই শিক্ষাব্যবস্থা একদিনেই গড়ে ওঠেনি।

সভ্যতার শুরু থেকে শিক্ষার নানা ধরণ, প্রকরণ ও স্তর বেয়ে রূপান্তরিত হতে হতে আজকের এই শিক্ষাব্যবস্থা চূড়ান্ত অবস্থা লাভ করেছে। এর পেছনে রয়েছে নানা শাসকগোষ্ঠি, দল, ব্যক্তির যুগপৎ প্রচেষ্টা। রয়েছে বিদেশি শিক্ষার প্রবেশ ও অনুপ্রবেশ।

প্রাচীন শিক্ষাব্যবস্থা

প্রাচীন ভারতীয় বা বৈদিক শিক্ষাব্যবস্থা ছিল মূলত পাঠশালা বা গুরুগৃহকেন্দ্রিক। গুরুগৃহেই সম্পন্ন হতো শিশুর শিক্ষা। গুরুই শিক্ষক, গুরুই বিদ্যালয়, গুরুই শিক্ষার শুরু ও শেষ কথা।

প্রথম দিকে শিক্ষাব্যবস্থা ছিল ধর্মভিত্তিক। আর্যরা বেদ নিয়ে এলে বেদ-নির্ভর পড়াশোনার প্রচলন হয়। বয়সের ভিত্তিতে বেদের চারটি ভাগের শিক্ষা দিতেন গুরুরা। ব্রাহ্মণরাই সাধারণত হতেন শিক্ষক, কিংবা উচ্চশিক্ষিতরাই হতেন ব্রাহ্মণ।

শিশু-বয়স থেকে গুরুগৃহে শুরু হতো আবাসিক শিক্ষা, বর্তমানে যা উচ্চশিক্ষা, মাধ্যমিক পর্যায়, এমনকি প্রাথমিক পর্যায়েও দেখা যায়। সাধারণত ৩/৪ বছর বয়স থেকে ২৪/২৬ বছর বয়স পর্যন্ত শিক্ষাদান চলতো।

এসব পাঠশালায় উঁচু ক্লাসের বা বয়সী শিক্ষার্থীরা অনেক সময় গুরুর আদেশে শিশুদের শিক্ষাদান করত, যা বর্তমান যুগে বিভিন্ন দেশে উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থায় হরহামেশাই দেখা যায়।

জ্ঞানের ব্যপ্তি বাড়তে থাকলে পর্যায়ক্রমে প্রাচীন ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থায় একক গুরুকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা থেকে বহুজন গুরুকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তিত হতে থাকে। এর ফলে গড়ে ওঠে বিশ্ববিদ্যালয় বা উচ্চশিক্ষার জ্ঞানালয়।

বৈদিক যুগের শেষ ভাগে যখন জাতপ্রথা চরমে ওঠে এবং শিক্ষায় জনসাধারণের প্রবেশাধিকার সীমিত হয়ে আসে, তখন স্বভাবতই এ-অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে আর্যদের হিন্দু ধর্ম সংস্কার ও পরিবর্তনের মাধ্যমে আসে বৌদ্ধ ধর্ম।

বৌদ্ধ ধর্ম প্রবর্তিত হওয়ার পর থেকে প্রাচীন ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থা লাভ করে গতিশীল রূপ।

বৌদ্ধ যুগে একটি সাম্যবাদী শিক্ষাব্যবস্থার দিকে ধাবিত হয় প্রাচীন ভারত। বৌদ্ধ রাজাদের আনুকূল্যে প্রাচীন ভারতে গড়ে ওঠে অনেক উচ্চশিক্ষাকেন্দ্র, যেমন, বাংলা অঞ্চলের সোমপুর বিহার, পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার, জগদ্বিখ্যাত নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় প্রমূখ উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

বৌদ্ধ যুগে একটি সাম্যবাদী শিক্ষাব্যবস্থার দিকে ধাবিত হয় প্রাচীন ভারত। বৌদ্ধ রাজাদের আনুকূল্যে প্রাচীন ভারতে গড়ে ওঠে অনেক উচ্চশিক্ষাকেন্দ্র, যেমন, বাংলা অঞ্চলের সোমপুর বিহার, পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার, জগদ্বিখ্যাত নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় প্রমূখ উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

মধ্যযুগীয় শিক্ষাব্যবস্থা

ভারতবর্ষে মুসলিমদের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় মধ্যযুগ। মধ্যযুগে এসে শিক্ষাব্যবস্থারও ধরন বদলে যায়। হিন্দু বা বৌদ্ধ শিক্ষার বদলে শুরু হয় ফারসি ও আরবি শিক্ষার ধরন। মুসলিম শাসকদের আনুকূল্যে এসময় গড়ে ওঠে অনেক ইসলামিক শিক্ষার চর্চাকেন্দ্র।

মুসলিম যুগে টোল বা মক্তবেই হতো শিশুর শিক্ষার হাতেখড়ি। এ-সময়েও ধর্মভিত্তিক শিক্ষার প্রচলন দেখা যায়। উচ্চশিক্ষার চর্চাকেন্দ্র ছিল মাদ্রাসাগুলো, যা ঐতিহাসিকভাবে এখনও উপমহাদেশে বিদ্যমান। এসব মাদ্রাসায় হাদিস, কুরআন, ফিকাহ, চিকিৎসা প্রভৃতি শিক্ষা দেয়া হতো।

ইংরেজ প্রবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থা

পলাশীর প্রান্তরে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের মাধ্যমে বাংলা তথা ভূ-ভারত চলে যায় ইংরেজদের ঔপনিবেশিক শাসনের করতলে।

ইংরেজ শাসকরা উপনিবেশ টিকিয়ে রাখার নাম করে প্রাচীন বা মধ্যযুগের ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থার শেকড় তুলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সরকার ও পরে ব্রিটিশ রাজ সরকার প্রবর্তন করে তথাকথিত আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা।

এই শিক্ষাব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয়দের শাসনে সহায়তা করাতে ও ব্রিটিশদের খেদমতের জন্য কম-মাইনেতে ইংরেজি-শিক্ষিত কেরানির দল। ১৭৮১ সালে ওয়ারেন হেস্টিংস কলকাতা মাদ্রাসা (অধুনা আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়) চালু করেন। ১৭৯১ সালে জোনাথান ডানকান বারানসিতে একটি সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন।

১৮০০ সালে লর্ড ওয়েলেসলি ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারিদের দেশীয় ভাষা ও আদবকায়দা শেখানোর উদ্দেশ্য নিয়ে কলকাতায় চালু করেন ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ। ১৮১৩ সালের চার্টার আইনে ভারতে শিক্ষাবিস্তারে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দায়িত্বের কথা প্রথম স্বীকার করা হয়।

এই আইন মোতাবেক ১৮১৭ সালে ডেভিড হিউম কলকাতা হিন্দু কলেজ, অধুনা প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেন। ১৮৩৫ সালে ইংরেজি ভাষাকে ভারতের উচ্চশিক্ষার একমাত্র মাধ্যম হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

ব্রিটিশ ভারতে শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার ও পুনর্গঠনের সর্বপ্রথম উদ্যোগ সূচিত হয় ১৮৫৪ সালের উডের শিক্ষা ডেসপ্যাচের মাধ্যমে। ব্রিটিশ হাউজ অব কমন্সের সিলেক্ট কমিটি কর্তৃক ভারতে শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কিত সমীক্ষার ফলই হলো উড-এর শিক্ষা প্রস্তাব।

চার্লস উডের এই ‘ডেসপ্যাচ’কেই ব্রিটিশ ভারতে শিক্ষার ম্যাগনা কার্টা আখ্যা দেওয়া হয়। তিনিই প্রথম প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চস্তর পর্যন্ত শিক্ষার একটি যুক্তিসঙ্গত পাঠক্রম নথি আকারে প্রকাশ করেন।

এই নথিতে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষাস্তরে কীভাবে কী পড়ানো হবে তার বিভাগ করে দেন তিনি। উচ্চশিক্ষার মাধ্যম হিসাবে ইংরেজি এবং প্রাথমিক শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে স্থানীয় ভাষাকে গ্রহণ করা হয়। এরই প্রেক্ষিতে ১৮৫৭ সালে কলকাতা, বোম্বাই ও মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়।

এরপর ব্রিটিশ-ভারতের ভাইসরয় লর্ড রিপন ১৮৮২ সালে উইলিয়ম হান্টারকে চেয়ারম্যান করে প্রথম ইন্ডিয়ান এডুকেশন কমিশন বা হান্টার কমিশন গঠন করেন। এই হান্টার কমিশন ভারতীয় উচ্চশিক্ষায় প্রভূত পরিবর্তন আনে।

১৯০১ সালে সিমলায় অনুষ্ঠিত ইন্ডিয়ান কনফারেন্সের পর লর্ড কার্জন একটি সরকারি সিদ্ধান্তের আদলে ১৯০৪ সালে তাঁর শিক্ষানীতি প্রকাশ করেন। এই শিক্ষানীতির ফলে পূর্ববঙ্গের জন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হয়।

এর ফলে ১৯২১ সালে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় প্রাচ্যের অক্সফোর্ড-খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এছাড়াও ব্রিটিশ ভারতের শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার ও নিয়ন্ত্রণের জন্য ১৯২৭ সালের হার্টগ কমিটিও গঠন করা হয়।

পাকিস্তান পর্ব

১৯৪৭ সালে লর্ড মাউন্টব্যাটেনের পেন্সিলের খোঁচায় উপমহাদেশ হয়ে যায় বিভক্ত। ধর্মের ভিত্তিতে জন্ম নেয় ভারত ও পাকিস্থান।

ব্রিটিশদের নিজস্ব প্রয়োজনে ও ভারতীয় কিছু শিক্ষানুরাগীর কারণে পূর্ব পাকিস্তানে থেকে যায় কিছু উচ্চশিক্ষার জন্য ঐতিহাসিক কলেজ। যেমন, রাজশাহী কলেজ, কারমাইকেল কলেজ, বিএল কলেজ, ঢাকা কলেজ প্রভৃতি।

ভারত বিভাগের পর পাকিস্তানেও শিক্ষাক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা দানের প্রয়াস চালানো হয়। গঠন করা হয় বেশ কয়েকটি কমিটি ও কমিশন। উপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার পুনর্মূল্যায়ন ও জাতীয় ভাবাদর্শের নিরিখে প্রচলিত ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাসের লক্ষ্যে ১৯৪৭ সালে করাচিতে প্রথম শিক্ষা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।

এ সম্মেলনের পর ১৯৪৯ সালে পাকিস্তানে প্রথম শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়। কমিটির প্রধান ছিলেন মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ এবং এই কমিটি ‘আকরম খাঁ কমিটি অন এডুকেশন’ বা ‘আকরম খাঁ কমিটি বা কমিশন’ নামে পরিচিত। এই কমিশন প্রতিবেদন দেয় ১৯৫২ সালে।

এরপর ১৯৫৩ সালে উচ্চশিক্ষার দিগন্ত প্রসারিত করতে রাজশাহী অঞ্চলের জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। পূর্ব পাকিস্তান সরকার প্রদেশে শিক্ষার সার্বিক সংস্কার সুপারিশের জন্য ১৯৫৭ সালের জানুয়ারি মাসে আতাউর রহমান খানকে চেয়ারম্যান করে একটি শিক্ষা কমিশন নিয়োগ করে।

এই কমিশন প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা স্তরে কতিপয় সংস্কারের সুপারিশসহ ১৯৫৭ সালে প্রতিবেদন পেশ করে। উচ্চ শিক্ষাক্ষেত্রে কমিশন ইন্টারমিডিয়েট কোর্স বিলোপ করে তিন বছর মেয়াদি ডিগ্রি কোর্স চালুর সুপারিশ করে।

পশ্চিম পাকিস্তানের শিক্ষাসচিব এস এম শরীফকে চেয়ারম্যান এবং দশজন শিক্ষাবিদকে সদস্য করে পাকিস্তান সরকার ১৯৫৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একটি কমিশন গঠন করে, যা ‘শরীফ কমিশন’ নামে পরিচিত। এই কমিশন ১৯৫৯ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রতিবেদন পেশ করে।

এই প্রতিবেদনে উচ্চশিক্ষার জন্য সুপারিশগুলো হলো: ইন্টারমিডিয়েট কোর্স পরিচালনার দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবর্তে মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের ওপর ন্যস্ত করতে হবে, ডিগ্রি কোর্স তিন বছর মেয়াদি করা, প্রাথমিক স্তর থেকে শিক্ষার সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের জন্য সমন্বিত বৃত্তি প্রদান কর্মসূচি গ্রহণ ইত্যাদি।

কিছু সবল দিক থাকলেও স্বৈরাচারী মনোভাবের কারণে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রসমাজ শরীফ কমিশনের প্রতিবেদনকে সরাসরি প্রত্যাখান করে। তারা প্রতিবেদনের গোটা বক্তব্যকে গণবিরোধী, প্রতিক্রিয়াশীল এবং বাঙালিদের জাতীয় স্বার্থবিরোধী বলে চিহ্নিত করে।

কিছু সবল দিক থাকলেও স্বৈরাচারী মনোভাবের কারণে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রসমাজ শরীফ কমিশনের প্রতিবেদনকে সরাসরি প্রত্যাখান করে। তারা প্রতিবেদনের গোটা বক্তব্যকে গণবিরোধী, প্রতিক্রিয়াশীল এবং বাঙালিদের জাতীয় স্বার্থবিরোধী বলে চিহ্নিত করে।

১৯৬৪ সালে যখন ছাত্র-আন্দোলন প্রকট রূপ নেয়, তখন সরকার একটি সমঝোতায় এসে তাৎক্ষণিকভাবে কমিশনের প্রতিবেদন বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া বন্ধ করার ঘোষণা দিতে বাধ্য হয়।

গণমুখী শিক্ষানীতির অনুকূলে ছাত্রসমাজ কর্তৃক শরীফ কমিশন রিপোর্ট প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর পাকিস্তান সরকার ১৯৬৪ সালে বিচারপতি হামুদুর রহমানকে প্রধান করে ছাত্র সমস্যা ও ছাত্র কল্যাণ বিষয়ে একটি নতুন কমিশন- ‘হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশন’ গঠন করে।

১৯৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৬৯ সালে তৎকালীন পাকিস্তান প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের উপায় ও করণীয় নির্ধারণের জন্য ‘এয়ার মার্শাল নূর খান কমিশন’ গঠন করে।

এই কমিশনের প্রণীত সুপারিশগুলোর একটি হলো পাকিস্থান বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন প্রতিষ্ঠা, যা বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর পরিবর্তিত হয়ে হয়ে যায় ‘বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন’। এছাড়া ১৯৭০ সালে ঢাকার উপকণ্ঠে প্রতিষ্ঠিত হয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

স্বাধীন বাংলাদেশ পর্ব

পাকিস্তানের দমন, নিপীড়ন, দ্বৈতনীতির বিরুদ্ধে দীর্ঘ আন্দোলনের পর ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর এদেশের মানুষ স্বাধীনতা লাভ করে।

স্বাধীনতা পরবর্তীতে অর্থনৈতিক, সামাজিকভাবে ভগ্নপ্রায় সদ্যোজাত রাষ্ট্রের সার্বিক উন্নয়নের জন্য বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও বিজ্ঞানী ড. কুদরাত-এ-খুদাকে চেয়ারম্যান করে ১৯৭২ সালের ২৬ জুলাই প্রথম শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয়। এটি ‘জাতীয় শিক্ষা কমিশন’ বা ‘কুদরাত-এ-খুদা কমিশন’ নামে পরিচিত।

দেশের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা এবং সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের ওপর ভিত্তি করে কমিশন ১৯৭৪ সালের ৩০ মে সরকারের নিকট প্রতিবেদন পেশ করে।

এতে শিক্ষার প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ-মাধ্যমিক স্তরে কিছু বড় ধরনের পরিবর্তনের সুপারিশ করা হয়। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চার বছর মেয়াদী সম্মিলিত ডিগ্রি কোর্স এবং এক বছরের মাস্টার্স কোর্স চালুর কথা বলা হয়।

জাতীয় শিক্ষা উপদেষ্টা কমিটি (১৯৭৮)

১৯৭৮ সালে সরকার কুদরাত-এ-খুদা কমিশনের প্রতিবেদন পর্যালোচনার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে এবং শিক্ষার সমস্যাবলি নতুনভাবে চিহ্নিত করার উদ্দেশ্যে একটি উপদেষ্টা কমিটি নিয়োগ দেয়। এই কমিটি ১৯৭৯ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি অন্তবর্তীকালীন শিক্ষানীতি সুপারিশ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন পেশ করে।

এই প্রতিবেদনে দেশে শিক্ষিতের হার বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয় যাতে জনগণ দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে। প্রতিবেদনে মাধ্যমিক শিক্ষার প্রচলিত কাঠামোকে তিনটি উপ-পর্যায়ে ভাগ করা হয়, যথা নিম্ন-মাধ্যমিক (৩ বছর), মাধ্যমিক (২ বছর) এবং উচ্চ-মাধ্যমিক (২ বছর)।

মজিদ খান শিক্ষা কমিশন (১৯৮৩)

১৯৮৩ সালে গঠিত মজিদ খান শিক্ষা কমিশনের প্রতিবেদন ব্যাপক প্রচারলাভ করেনি এবং এই কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের কোনো আনুষ্ঠানিক উদ্যোগও নেয়া হয়নি।

বাংলাদেশ জাতীয় শিক্ষা কমিশন (১৯৮৭)

বাংলাদেশ সরকার ১৯৮৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর মফিজউদ্দীন আহমদকে প্রধান করে একটি শিক্ষা কমিশন নিয়োগ করে। এই কমিশনকে দেশে শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার, পুনর্বিন্যাস ও উন্নয়নের উপায় সম্পর্কে সুপারিশের দায়িত্ব দেয়া হয়।

কমিশনের চেয়ারম্যানের নামানুসারে এটি মফিজউদ্দীন শিক্ষা কমিশন নামেও পরিচিতি লাভ করে। এই কমিশন ১৯৮৮ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি সরকারের নিকট প্রতিবেদন পেশ করে। কমিশন দেশে উচ্চশিক্ষার অগ্রগতি ও উৎকর্ষের ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা-সম্বলিত সুপারিশ পেশ করে।

প্রতিবেদনে তিন বছর মেয়াদী ডিগ্রি কোর্স এবং দুই বছরের মাস্টার্স কোর্স প্রবর্তন এবং ডিগ্রি কলেজগুলোর অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও শিক্ষার সুযোগ সম্প্রসারণের সুপারিশ করা হয়।

কমিশন প্রস্তাব দেয় যে, ডিগ্রি পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা তাদের পঠনীয় হিসেবে তিনটি বিষয় নির্বাচন করবে এবং তৃতীয় বর্ষে তার মধ্যে যেকোনো একটি বিষয়ে কারিগরি শিক্ষা গ্রহণ করবে।

কোনো শিক্ষার্থী ফাইনাল পরীক্ষায় এই তিনটি বিষয়ের মধ্যে যে বিষয়ে ৭০%-এর অধিক নম্বর পাবে, তাকে ওই বিষয়ে অনার্স ডিগ্রি প্রদান করা হবে।

কমিশনের অন্যান্য সুপারিশের মধ্যে ছিলো:

(ক) প্রতি বৃহত্তর জেলায়, বিভাগীয় শহরে এবং রাজধানীতে একটি করে কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীতকরণ;

(খ) দুটি অধিভুক্তি দাতা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন এবং প্রথম ডিগ্রি প্রদানকারী সকল সাধারণ কলেজকে উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় আনয়ন;

(গ) শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের জন্য নীতি ও বিধিমালা প্রণয়ন এবং কার্যকরণ;

(ঘ) সরকার কর্তৃক বেসরকারি কলেজের শিক্ষকদের পূর্ণ বেতন ও ভাতাদি প্রদান;

(ঙ) বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি ডিগ্রি প্রদানের ক্ষেত্রে গবেষণা পরিচালনার জন্য সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার স্থাপন ও গবেষণা কেন্দ্রের উন্নয়ন, মাস্টার্স কোর্সে গবেষণার সুযোগ, পিএইচডি কোর্সে অধ্যয়নের জন্য ছাত্রদের ফেলোশিপ প্রদান, এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি ও পিএইচডি পরবর্তী গবেষণার জন্য কোনো বিশেষ বিভাগকে ‘সেন্টার অব এক্সিলেন্স’ হিসেবে গড়ে তোলা;

(চ) বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এমপ্লয়মেন্ট ব্যুরো স্থাপন করে ছাত্রদের জন্য চাকরিলাভের সুযোগ সৃষ্টি।

শামসুল হক শিক্ষা কমিশন, ১৯৯৭ ও অন্যান্য

বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৭ সালের ১৪ জানুয়ারি জারীকৃত এক আদেশবলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর এম শামসুল হককে চেয়ারম্যান করে ৫৬ সদস্যের একটি শিক্ষা কমিশন (শামসুল হক শিক্ষা কমিশন) গঠন করে।

কমিশনের প্রতিবেদনে শিক্ষার তিনটি পর্যায়ের সুপারিশ করা হয়েছে: প্রাথমিক স্তর, মাধ্যমিক স্তর ও উচ্চশিক্ষা। প্রাথমিক শিক্ষার পরিধি পাঁচ বছরের পরিবর্তে আট বছর করার সুপারিশ করা হয়েছে।

২০০১ সালে ড. এম এ বারীর নেতৃত্বে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি (বারী কমিটি) গঠন করা হয়। এই কমিটি ২০০২ সালে প্রতিবেদন পেশ করে এবং শিক্ষাক্ষেত্রে কতিপয় সংস্কার ও পরিবর্তনের সুপারিশ করে।

এসব সুপারিশ ২০০৩ সালে মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান মিয়ার নেতৃত্বে গঠিত কমিশনের কর্তৃক বিবেচনায় আনা হয়। শিক্ষার মানোন্নয়ন এবং শিক্ষাক্ষেত্রে সংস্কার সাধনের লক্ষ্যে সরকার ২০০৩ সালে ‘জাতীয় শিক্ষা কমিশন ২০০৩’ গঠন করে।

২০০০ সালে গৃহীত ‘জাতীয় শিক্ষানীতি’কে সময়োপযোগী করার লক্ষ্যে ২০০৯ সালে জাতীয় অধ্যাপক কবির চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি ১৬ সদস্যের কমিটি গঠন করে। এই কমিটি ১৯৭৪ সালের কুদরাত-এ-খুদা কমিশন প্রতিবেদন ও ১৯৯৭ সালের শামসুল হক শিক্ষা কমিশন প্রতিবেদনের আলোকে একটি নতুন প্রতিবেদন প্রণয়ন করে।

জাতীয় শিক্ষানীতি, ২০১০

২০০০ সালে গৃহীত ‘জাতীয় শিক্ষানীতি’কে সময়োপযোগী করার লক্ষ্যে ২০০৯ সালে জাতীয় অধ্যাপক কবির চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি ১৬ সদস্যের কমিটি গঠন করে। এই কমিটি ১৯৭৪ সালের কুদরাত-এ-খুদা কমিশন প্রতিবেদন ও ১৯৯৭ সালের শামসুল হক শিক্ষা কমিশন প্রতিবেদনের আলোকে একটি নতুন প্রতিবেদন প্রণয়ন করে।

এই প্রতিবেদনের খসড়া সরকারের নিকট আনুষ্ঠানিকভাবে পেশ করা হয় ২০০৯ সালের ৭ সেপ্টেম্বর। এটি পরে ২০১০ সালে জাতীয় সংসদে জাতীয় শিক্ষানীতি হিসেবে গৃহীত হয়। উচ্চশিক্ষার ব্যাপারে কমিটির সুপারিশের মধ্যে রয়েছে, স্নাতকপূর্ব শিক্ষার প্রচলিত তিনটি পর্যায়কে দু’টি পর্যায়ে রূপান্তরকরণ।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাকিস্তান বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন নাম বদলে বাংলাদেশ মঞ্জুরী কমিশনে রূপান্তরিত হয়। এই কমিশনের কাজ হলো দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারের মধ্যস্থতা করা এবং সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান নির্ধারণ, পর্যবেক্ষণ, তত্ত্বাবধান, ও নীতিমালা প্রণয়ন করা।

১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট

স্বাধীনতার পূর্বে প্রতিষ্ঠিত দেশের চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়) জন্য নিজস্ব আইন প্রণীত হয়, যা ‘১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট’ নামে পরিচিত।

এই অ্যাক্টের ফলে এই চারটি বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্বশাসনের মর্যাদা পায়। ১৯৭৩ সালে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নিজস্ব আইন প্রণয়ন করা হয়, যার ওপর ভিত্তি করে এই চারটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এখন পরিচালিত হয়।

দেশের বিশ্ববিদ্যালয় সংখ্যা ও ধরন

১৯৭১ সালের পরে অনেকগুলো সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সরকারি, বেসরকারি বা প্রাইভেট এবং আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়- এই তিন ধরনের বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে।

এখন পর্যন্ত দেশে ৩৮টি সরকারি বা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, ৯০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, ও দুটি আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় (ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি ও এশিয়ান উইমেন ইউনিভার্সিটি) রয়েছে।

সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে আরও কয়েকটি ধরন রয়েছে। যেমন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হলো ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, জগন্নাথ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রভৃতি।

বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয় প্রভৃতি।

এছাড়াও সরকার বর্তমানে কয়েকটি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন বিষয়ে বিভাগ ও ইনস্টিটিউট পর্যায়ে স্নাতক, স্নাতকোত্তর, পোস্ট ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করা হয়। পঠন-পাঠন ও জ্ঞান উৎপাদন তথা গবেষণাই এইসব প্রতিষ্ঠানের কাজ।

সরকারি কলেজ ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়

ব্রিটিশ আমল থেকেই সরকার ও স্থানীয় শিক্ষানুরাগীদের উদ্যোগে এদেশে অনেকগুলো কলেজ গড়ে উঠেছে। যেমন, কারমাইকেল কলেজ, বিএল কলেজ, রাজশাহী কলেজ প্রভৃতি। এসব কলেজগুলোতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পড়ানো হয়।

এছাড়াও কিছু বেসরকারি কলেজও রয়েছে। রয়েছে কিছু ডিগ্রি পাশ র্কোস পরিচালনাকারী ডিগ্রি কলেজ।

এসব কলেজের তত্বাবধান ও নীতিমালা প্রণয়নের জন্য অভিভাবক প্রতিষ্ঠান হলো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। এসব কলেজ পরিচালনার জন্য ১৯৯২ সালে গাজীপুরে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়।

উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

টেলিভিশন ও রেডিওর মাধ্যমে দূরশিক্ষণ পদ্ধতিতে ঝরে পড়া বা বয়স্ক শিক্ষার্থীদের জন্য ১৯৯২ সালে গাজীপুরে প্রতিষ্ঠিত হয় উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়।

এর কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সারা দেশে রয়েছে ১২টি আঞ্চলিক কেন্দ্র, ৮০টি কো-অর্ডিনেটিং কেন্দ্র এবং ১০০০টিরও অধিক টিউটেরিয়াল কেন্দ্রের বিশাল নেটওয়ার্ক।

বৃত্তি, পুরষ্কার ও সম্মাননা

উচ্চশিক্ষায় ক্ষেত্রে গবেষণা, ভালো ফলাফল প্রভৃতিতে অসামান্য অবদান রাখার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের নানা পুরষ্কার ও সম্মাননা প্রদান করা হয়। যেমন, প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক, ইউজিসি অ্যাওয়ার্ড প্রভৃতি।

এছাড়াও উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশে সরকার নানা শিক্ষা ও গবেষণা বৃত্তি প্রদান করে। এসব বৃত্তির আওতায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দেশি-বিদেশি শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষা গ্রহণ ও গবেষণা করে।

লেখক পরিচিতি

খুর্শিদ রাজীব রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী।

1 মন্তব্য

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Exit mobile version