বাড়ি উদ্যোগ

পলান সরকার : একজন আলোর ফেরিওয়ালা

পলান সরকার
পলান সরকার

বইপ্রেমী পলান সরকার যেভাবে ‘আলোর ফেরিওয়ালা’ হয়ে ওঠেছেন সেই গল্পটা যেমন অনুপ্রেরণাদায়ক, তেমনি তাঁর নামকরণের পেছনের ঘটনাটিও বেশ মজার।

পলান সরকার : জন্ম ও বেড়ে ওঠা

পলান সরকারের জন্ম হয় ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে (বাংলা ১৩২৯ সন) নাটোর জেলার বাগাতিপাড়া উপজেলার নূরপুর মালঞ্চি গ্রামে দাদা ছমির সরকারের বাড়িতে। পলান সরকারের জন্মের আগেও তাঁর বাবা-মায়ের কয়েকটি সন্তান মারা যায়। তবে পলান সরকারের জন্মের পর তিনি টিকে যান।

তাই তাঁর মা মইফুন নেসা নাম রাখেন ‘পলানী’, মানে যে পালিয়ে যায়নি। ‘পলানি’ নামটিই মানুষের মুখে মুখে একসময় ‘পলান’ হয়ে যায়।

তাই তাঁর মা মইফুন নেসা নাম রাখেন ‘পলানী’, মানে যে পালিয়ে যায়নি। ‘পলানি’ নামটিই মানুষের মুখে মুখে একসময় ‘পলান’ হয়ে যায়। তাঁর আসল নাম হারেজ উদ্দিন সরকার। পিতৃপ্রদত্ত ‘হারেজ উদ্দিন’ নামটি হারিয়ে গিয়ে ‘পলান সরকার’ বিখ্যাত হয়ে ওঠেন এই সাদা মনের মানুষটি।

মৃত্যু থেকে ‘পলানী’ এই মানুষটি শুধু মৃত্যুর হাত থেকেই বাঁচেননি, চরম দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ করে বেড়ে উঠতে হয়েছিল তাকে। জন্মের পর পৃথিবী, আলো, বাতাস, পাখি, ফুল, ফল চেনার আগেই দারিদ্র্যের কশাঘাতকে চিনেছেন পলান সরকার।

শিক্ষা

ছোটবেলায় তিনি চরম অভাবের মধ্যে বেড়ে উঠেছেন। মাত্র পাঁচ মাস বয়েসে তিনি হরিয়েছেন বাবা হায়াত উল্লাহ সরকারকে। নূরপুর মালঞ্চি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পলান সরকারের শিক্ষায় হাতেখড়ি। কিন্তু অভিভাবকহীন এই বালকের চতুর্থ শ্রেণিতে ওঠার পর বই কেনার ব্যবস্থা হয়নি।

চাচাতো ভাইয়ের সঙ্গে একই ক্লাসে পড়তেন। তাই পরিবারের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল দুই বছর একই ক্লাসে থাকতে হবে। তাহলে পরের বছর চাচাতো ভাইয়ের পুরোনো বই নিয়ে পলান সরকার পড়তে পারবেন। দারিদ্রক্লিষ্ট এই মানুষটি যখন মাইনর (চতুর্থ শ্রেণি) পরীক্ষা দিচ্ছিলেন, তখন পরীক্ষা দিতে যাওয়ার সময় তাঁর নিজের জুতা ছিল না। প্রতিবেশীর একটি রাবারের জুতা ধার নিয়ে পরীক্ষা দিতে যেতে হয়েছিল।

চতুর্থ শ্রেণিতে পড়া শেষে মায়ের সঙ্গে নানার বাড়ি রাজশাহী জেলার বাঘা উপজেলার বাউসা গ্রামে চলে যান তিনি। সেখানে তিনি একটি বিদ্যালয়ে ভর্তি হন যেখানে ষষ্ঠ শ্রেণির পর লেখাপড়ার সুযোগ ছিল না। ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করে বাধ্য হয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ইতি টানতে হয় তাকে।

কিন্তু পড়ার ইচ্ছে ছিল তাঁর। অদম্য ইচ্ছা থাকার পরও পড়া ছেড়ে দেওয়ার কী জ্বালা শিশু বয়সেই তিনি খুব ভালো করে বুঝেছিলেন। তাই হয়তো বই পড়ার অভ্যাসটা আজীবন থেকে গিয়েছিল পলান সরকারের।

তাঁর ছেলে হায়দার আলী স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেছিলেন, শুধু বইয়ের জন্য এক বছর পড়া বন্ধ করে বসে থাকার যে ব্যথা আমার বাবা শিশু বয়সে পেয়েছিলেন, আমার মনে হয়েছে, সেই বেদনাই বাবাকে সারা জীবন বইয়ের পেছনে ছুটতে বাধ্য করেছে। বাবা বইপাগল হয়ে উঠেছিলেন।

তাঁর ছেলে হায়দার আলী স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেছিলেন, শুধু বইয়ের জন্য এক বছর পড়া বন্ধ করে বসে থাকার যে ব্যথা আমার বাবা শিশু বয়সে পেয়েছিলেন, আমার মনে হয়েছে, সেই বেদনাই বাবাকে সারা জীবন বইয়ের পেছনে ছুটতে বাধ্য করেছে। বাবা বইপাগল হয়ে উঠেছিলেন।

যৌবনে পলান সরকার

পলান সরকারের যৌবনকালটাও ছিল বৈচিত্র্যময়। তাঁর নানা ময়েন উদ্দিন সরকার বাঘার স্থানীয় ছোট জমিদার ছিলেন। যৌবনে পলান সরকার নানার জমিদারির খাজনা আদায় করতেন এবং দেশ বিভাগের পর জমিদারি ব্যবস্থা বিলুপ্ত হলে ১৯৬২ সালে বাউসা ইউনিয়নে কর আদায়কারীর চাকরি পান। নানার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে ৪০ বিঘা সম্পত্তিরও মালিক হন পলান সরকার। এতে ঘুঁচে যায় দারিদ্রের কষাঘাত। বিয়ে করে আর দশজন মানুষের মতো সংসারী হন তিনি।

ব্রিটিশ আমলে পলান সরকার যাত্রাদলে ভিড়েছিলেন। যৌবন কেটে যায় তাঁর গ্রামে গ্রামে ঘুরে ভাঁড়ের চরিত্রে অভিনয় করে। বিস্তর লোক হাসাতেন তিনি। সেকালে যারা যাত্রাপালা করত, তাদের মধ্যে লিখতে-পড়তে জানা মানুষের অভাব ছিলো। তখন না ছিল ফটোকপিয়ার, না সাইক্লোস্টাইল মেশিন। তাই যাত্রার পাণ্ডুলিপি কপি করতে হতো হাতে লিখে। পলান সরকার এ কাজ করতেন। পাশাপাশি মঞ্চের পেছন থেকে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সংলাপ বলে দেয়ার প্রম্পটও করতে হতো। এভাবেই হয়তো তাঁর বই পড়ার নেশা পেয়ে বসে।

বিভিন্ন দায়দায়িত্ব

পলান সরকার দীর্ঘদিন ধরে বাউসা হারুন অর রসিদ শাহ দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ১৯৬৫ সালে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার সময় ৫২ শতাংশ জমি দান করার পর প্রচারবিমুখ পলান সরকার স্থানীয়দের অনুরোধেই চেয়ারম্যান পদে আসীন হন।

১৯৯০ সাল থেকে বাউসা হারুন অর রসিদ শাহ দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রতিবছর যারা ১ থেকে ১০ রোল করত তিনি তাদের বই উপহার দিতেন। এরপর অন্য শিক্ষার্থীরাও তাঁর কাছে বইয়ের আবদার করতে থাকে। তখন তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে তিনি তাদেরও বই দিবেন তবে তা ফেরত দিতে হবে। এরপর গ্রামের মানুষও তাঁর কাছে বই চাইতে শুরু করে। এভাবেই শুরু হয় পলান সরকারের বই পড়ানো আন্দোলনের ভিত।

যেভাবে শুরু বই পড়ানোর কাজ

১৯৯২ সালে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ায় পলান সরকারকে হাঁটার অভ্যাস করতে হয়। তখনই তাঁর মাথায় এক অভিনব চিন্তা আসে। তিনি বিদ্যালয়কেন্দ্রিক বই বিতরণের প্রথা ভেঙে বাড়ি বাড়ি বই পৌঁছে দেয়া এবং ফেরত নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। প্রতিদিন ২৫-৩০ কিলোমিটার করে হেঁটে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বই দিয়ে আসতেন। কোনো বিয়ের অনুষ্ঠানে অন্য উপহারের পাশাপাশি তিনি বইও উপহার দেন। এছাড়া যারা তাঁর চালকলে দেনা পরিশোধ করে তাদেরও তিনি বই উপহার দেন।

মানুষকে বই পড়ানোর নেশাটা পলান সরকারকে এমনভাবে চেপে বসেছিল যে, যাকে-তাকে বই দিয়ে পড়তে বলতেন। তাঁর ছেলে হায়দার আলী বলেন, বাবা কারও বাসায় দাওয়াত খেতে যাবেন, উপহার হিসেবে বই নিয়ে যাবেন। আমাদের চালকলে হালখাতার সময় কেউ সব বাকি শোধ করে দিলে বাবা তাঁকে একটি বই উপহার দিতেন।

একটি জাতীয় দৈনিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘আমি ভেবে দেখলাম, যারা আমার বাড়ি থেকে বই নিয়ে যায়, আমি নিজেই তো হেঁটে হেঁটে তাদের বাড়িতে গিয়ে বই পৌঁছে দিয়ে আসতে পারি। সেই থেকে শুরু। এক বাড়িতে বই দিতে গেলে তার দেখাদেখি আরেক বাড়ির লোকেরাও বই চায়। বই নিয়ে হাঁটা আস্তে আস্তে আমার নেশায় পরিণত হলো।’

মানুষকে বই পড়ানোর নেশাটা পলান সরকারকে এমনভাবে চেপে বসেছিল যে, যাকে-তাকে বই দিয়ে পড়তে বলতেন। তাঁর ছেলে হায়দার আলী বলেন, বাবা কারও বাসায় দাওয়াত খেতে যাবেন, উপহার হিসেবে বই নিয়ে যাবেন। আমাদের চালকলে হালখাতার সময় কেউ সব বাকি শোধ করে দিলে বাবা তাঁকে একটি বই উপহার দিতেন।

উপকারভোগীদের গল্প

ইন্টারনেট ঘাঁটলে পলান সরকারের গল্পই নয়, তাঁর উদ্যোগের শতশত উপকারভোগীর গল্প পাওয়া যায়। তেমনি একজন নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলার গালিমপুর গ্রামের মলি রানী কুণ্ডু। ২০১৭ সালে মলি রানী ও তাঁর ছেলে পিয়াল কুণ্ডু একসঙ্গে এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে পাশ করেছিলেন। মা ও ছেলের একসঙ্গে পরীক্ষা দিয়ে পাসের খবর শুনে পলান সরকার গিয়ে হাজির হন মলি রানীর বাড়িতে। মা ও ছেলের জন্য তিনি উপহার হিসেবে দুটি বই দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘আজ আমার বই পড়ার আন্দোলন সার্থক হলো।’

লেখাপড়ার অদম্য ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও মলি রানী সুযোগ পাননি। তাঁকে অসময়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়েছিল। বাবার সংসারে লেখাপড়ার সুযোগ না পেলেও নিজের সংসারে এসে তিনি তাঁর অপূর্ণ ইচ্ছা পূরণ করেছেন। পুরস্কার হিসেবে স্বয়ং পলান সরকারের হাত থেকে বই উপহার পেয়ে সেদিন তিনি আনন্দে কেঁদেছিলেন। পলান সরকারের সেই আশির্বাদে পুষ্ট মলি রানি ১ এপ্রিল থেকে এইচএসসি পরীক্ষা দেবেন।

একটি জাতীয় দৈনিককে মলি রানী বলেন, ‘পলান সরকার সেদিন আমাকে বলেছিলেন, “মা, তোমার আর পেছন ফিরে তাকানোর সময় নেই। তোমাকে এগিয়ে যেতে হবে।” সেই দিনই আমি ভেবে নিয়েছি, যেভাবেই হোক আমি পড়াশোনা শেষ করব।’

পলান সরকার খুঁজে বের করতেন এ রকম মায়েদের। তাঁদের হাতে বই তুলে দিতেন। তাই যে মায়েরা ছোটবেলায় পড়তে শিখেছিলেন, কিন্তু শিক্ষাজীবন শেষ করতে পারেননি, তিনি আগে সেই মায়েদের খুঁজে বের করতেন। আর মাঝেমধ্যেই নেপোলিয়নের প্রসঙ্গ টেনে মায়েদের শিক্ষিত হওয়ার কথা বলতেন। নিজে হয়ত বেশি দূর পড়তে পারেননি, কিন্তু শিক্ষিত হওয়ার তাগিদটা বেশ বুঝেছিলেন। তাই জাতিকে শিক্ষিত করার এক মহৎ আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন।

পলান সরকার খুঁজে বের করতেন এ রকম মায়েদের। তাঁদের হাতে বই তুলে দিতেন। তাই যে মায়েরা ছোটবেলায় পড়তে শিখেছিলেন, কিন্তু শিক্ষাজীবন শেষ করতে পারেননি, তিনি আগে সেই মায়েদের খুঁজে বের করতেন। আর মাঝেমধ্যেই নেপোলিয়নের প্রসঙ্গ টেনে মায়েদের শিক্ষিত হওয়ার কথা বলতেন। নিজে হয়ত বেশি দূর পড়তে পারেননি, কিন্তু শিক্ষিত হওয়ার তাগিদটা বেশ বুঝেছিলেন। তাই জাতিকে শিক্ষিত করার এক মহৎ আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন।

ব্যক্তিজীবনে সাধারণ জীবনযাপনকারী এই সাদা মনের মানুষটির এই মহান আন্দোলন শুধু হাজারো পাঠক তৈরিতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। তিনি তাঁর এই মহান কাজ দিয়ে অনেককেই বই পড়ানোর নিঃস্বার্থ আন্দোলনেও উদ্বুদ্ধ করেছেন। তাঁর গল্প সারা দেশে ছড়িয়ে পড়লে দেশের আনাচকানাচে বই পড়ানোর আন্দোলন গড়ে ওঠার খবর গণমাধ্যমে উঠে আসে।

পলান সরকার যেখানে আদর্শ

পলান সরকারের উদ্যোগে উদ্বুদ্ধ হয়ে নওগাঁর নিয়ামতপুরে সবুজ সরকার নামের এক কলেজশিক্ষার্থী এই কাজ শুরু করেন। রাজশাহীর চারঘাটের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘ওরা ১১ জন’ বাড়ি বাড়ি গিয়ে বই দেওয়ার কর্মসূচি চালু করে। পলান সরকারকে দেখে বাঘার জুবায়ের আল মাহমুদ স্কুলভিত্তিক বই পড়ার আন্দোলন গড়ে তোলেন। বইমেলা করেন।

রাজশাহী নগরের তেরখাদিয়া উত্তরপাড়ার সোহাগ আলী নামের এক যুবক ২০১৫ সাল থেকে ‘পলান সরকার বইপড়া আন্দোলন’ নামে একটি কর্মসূচি চালু করেছেন। কেউ ফোন করলে তিনি তার বাড়িতে পছন্দমতো বই পৌঁছে দিয়ে আসেন। পড়া শেষ হলে পুরোনো বই ফেরত নিয়ে আবার নতুন বই দিয়ে আসেন।

শহরের ৫০-৬০ জন পাঠক তাঁর কাছ থেকে নিয়মিত বই নিয়ে থাকেন। সোহাগ সম্প্রতি শহরের সেলুনে সেলুনে বই রাখছেন, যাতে সেলুনে আসা অপেক্ষমাণ লোকজন বই পড়ে সময়টা পার করতে পারেন।

সোহাগের পর ‘কেন্দ্রীয় কিশোর পাঠাগার’ নামের একটি সংগঠনের উদ্যোগেও নগরীর কয়েকটি স্থানে সেলুন পাঠাগারের উদ্বোধন করা হয়। চলতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারি এসব স্থানে ১০টি সেলুনে শেলফ স্থাপন করে তাতে রাখা হয় বই যেন চুল-দাড়ি কাটাতে এসে অপেক্ষমাণ খদ্দেররা অযথা বসে না থেকে বই পড়েন। সম্প্রতি রাজশাহী নগরীতে বই পড়ানোর এই ব্যতিক্রমি উদ্যোগ গোটা দেশের নজর কেড়েছে। এই উদ্যোগের পেছনেও পলান সরকার পরোক্ষভাবে উৎসাহ যুগিয়েছেন।

রাজশাহীর বিনোদপুর এলাকার বাসিন্দা লতিফুর রহমান বলেন, পলান সরকার যে অসামান্য কাজ করে গেছেন তার মূল্য অসীম। তিনি প্রত্যন্ত এক অঞ্চলে যে আলোর মশাল জ্বেলেছিলেন তা আজ গোটা দেশে ছড়িয়ে গেছে। তাঁর মহৎ উদ্যোগ অসংখ্য বই প্রেমিকে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে।

পদক ও স্বীকৃতি

পলান সরকারের এই মহৎ উদ্যোগের কথা প্রথমে শুধু রাজশাহীর বাঘা উপজেলার কয়েকটি গ্রামের মানুষই জানত। ২০০৬ সালের ২৯ ডিসেম্বর বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন চ্যানেল বিটিভির জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’তে পলান সরকারকে আলোকিত মানুষ হিসেবে তুলে ধরা হয়।

এই অসামান্য শিক্ষা আন্দোলনের গল্প ইত্যাদিতে প্রচারের পর তাকে নিয়ে জাতীয় পত্রিকায় প্রচ্ছদ প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে, ফিচার করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, এরপর তাকে নিয়ে নির্মিত হয় বিজ্ঞাপন, রচিত হয় নাটক, আয়োজিত হয় পলান মেলা। তার জীবনের ছায়া অবলম্বনে বিটিভির জন্য গোলাম সারোয়ার দোদুল নির্মাণ করেন ঈদের নাটক ‘অবদান’। বিনামূল্যে বই বিতরণ করে সবার মধ্যে বই পড়ার আগ্রহ সৃষ্টির করার জন্য ইউনিলিভার বাংলাদেশ তাঁকে ‘সাদা মনের মানুষ’ খেতাবে ভূষিত করে।

পলান সরকারের এই নজিরবিহীন উদ্যোগকে রাষ্ট্রও স্বীকৃতি জানায়। ২০১১ সালে তাকে একুশে পদকে ভূষিত করা হয়। ২০১৪ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ‘ইমপ্যাক্ট জার্নালিজম ডে’ উপলক্ষে সারা বিশ্বের বিভিন্ন ভাষার দৈনিকে তাঁর ওপর প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। ২০০৯ সালে রাজশাহী জেলা পরিষদ তাঁর বাড়ির আঙিনায় একটি পাঠাগারও প্রতিষ্ঠা করে দেয়।

অবাক করা ব্যাপার হলো, একুশে পদকের একটি টাকাও খরচ করেননি তিনি, সন্তানদেরও দেননি। সব টাকা ডাক বিভাগে জমা রেখেছেন এই নিঃস্বার্থ মানুষটি। প্রতি মাসে সেখান থেকে যে মুনাফা আসে, তা তাঁর পাঠাগার পরিচালনার জন্য বরাদ্দ করে গেছেন।

মৃত্যু

জ্ঞানের আলো জ্বালানো এই সূর্যপুরুষ গত ১ মার্চ নশ্বর পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। তাঁর মৃত্যুর খবর শুনে আশপাশের হাজারো মানুষ কেঁদেছিলো। তাঁকে শেষবারের মত দেখতে ছুটে এসেছিল হাজারো মানুষ। সেদিন মানুষের ভালোবাসা পেয়ে সিক্ত হয়েছিলেন ওপার পথযাত্রী পলান সরকার।

তাঁর গর্বিত সন্তান হায়দার আলী বলেন, শেষ পর্যন্ত আমাদের একটা আত্মতৃপ্তির জায়গা বাবা তৈরি করে গেলেন। যে বইয়ের জন্য একদিন বাবা কেঁদেছিলেন, সেই বই তিনি মানুষকে অকাতরে বিলিয়ে গেলেন। বইকে বাবা এত প্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছিলেন যে বই বাবাকে বিশ্বব্যাপী পরিচিত করেছে।

পলান সরকার আমাদের ছেঁড়ে চলে গেছেন দূর, বহুদূরে। আর ফিরবেন না। হয়ত এমন মানুষ আর আমরা পাবো না, এমন উজ্জ্বল নক্ষত্ররা ঘনঘন জন্মায় না। তবুও তাঁর জ্বেলে দেয়া মশালটা জ্বলতে থাকুক, শতাব্দী থেকে সহস্রাব্দে আলো ছড়িয়ে যাক। অনুপ্রেরণা যোগাক শত শত নতুন কোনো নিঃস্বার্থবাদীকে আরও কোন পলানো সরকার হয়ে উঠতে। এই পৃথিবীতে থেকে যাক ভালো মানুষের পদচিহ্ন।

লেখক পরিচিতি

কোন মন্তব্য নেই

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Exit mobile version