গত ৭ সেপ্টেম্বর এনসিটিবি উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীর কম্পিউটার সিলেবাসে কিছু পরিবর্তন আনে। পরিবর্তিত সিলেবাসটি তাদের ওয়েব সাইটে প্রকাশ করে। বিভিন্ন পত্রপত্রিকার মাধ্যমে আমরা এ সংক্রান্ত খবর দেখতে পাই। এ খবরের নানান ধরনের আলোচনা ও সমালোচনা বিভিন্ন মিডিয়ায় দেখতে পাওয়া যায়। পরিবর্তিত সিলেবাসটি কবে থেকে কার্যকর করা হবে, কিভাবে কার্যকর করা হবে তার কোন দিক নির্দেশনা ওয়েব সাইটটিতে দেওয়া হয়নি। বছরের মাঝামাঝি সময়ে সিলেবাসটি পরিবর্তনের কারণে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবক মহলে কিছুটা সোরগোল পড়ে যাওয়া স্বাভাবিক। বিশেষ করে যে সমস্ত শিক্ষার্থী বিষয়টি ঐচ্ছিক অথবা আবশ্যিক বিষয় হিসেবে নিয়েছে তাদের করণীয় সম্পর্কে কোন দিক নির্দেশনা না থাকায় তারা বিশেষ ভাবনায় পড়ে যায়। একজন শিক্ষা বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী হিসেবে বিষয়টি আমার নজরে আসে। বিষয়টি সম্পর্কে একটি স্বচ্ছ ধারণা লাভের জন্য আমি সিলেবাসটি পাঠ করি। নতুন এই সিলেবাসের সাথে আমি বর্তমানে বিদ্যমান উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের সিলেবাসটি মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করি। এই দুটোকে মিলিয়ে দেখার সময় কিছু কিছু বিষয় আমার নজরে আসে।
বর্তমানে বিদ্যমান সিলেবাসটিতে অর্থাৎ ২০১০-২০১১ শিক্ষাবর্ষের সিলেবাসে কম্পিউটার শিক্ষা নিয়ে যে সমস্ত বিষয় শেখানো হয় তা হলো-
কম্পিউটার শিক্ষা প্রথম পত্র
অধ্যায় ১- কম্পিউটারের ধারনা ও সংখ্যা পদ্ধতি, অধ্যায় ২-অপারেটিং সিস্টেম, অধ্যায় ৩-ডকুমেন্ট প্রসেসিং ও পেজ মেকার, অধ্যায় ৪-ডিজিটাল লজিক, অধ্যায় ৫-সিপিইউ ও মেমরি, অধ্যায় ৬-কম্পিউটার আর্কিটেকচার, অধ্যায় ৭-ইনপুট ও আউটপুট ডিভাইস, অধ্যায় ৮-প্রোগ্রাম ডিজাইন, অধ্যায় ৯-কিউবেসিক
কম্পিউটার শিক্ষা দ্বিতীয় পত্র
অধ্যায় ১- ডাটা প্রসেসিং ও সিস্টেম এনালাইসিস, অধ্যায় ২- ডাটা স্ট্রাকচার ও এলগরিদম, অধ্যায় ৩- স্প্রেডশিট এনালাইসিস,অধ্যায় ৪- ফাইল এবং ফাইল প্রসেসিং, অধ্যায় ৫- ডেটাবেস, অধ্যায় ৬- ডাটাবেজ ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম এবং প্রোগ্রামিং, অধ্যায় ৭- ডেটা কমিউনিকেশন ও কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, অধ্যায় ৮- তথ্য প্রযুক্তি অধ্যায় ৯- মাল্টিমিডিয়া অধ্যায় ১০- কম্পিউটার রক্ষনাবেক্ষণ
সিলেবাসে যে সমস্ত বইয়ের লিস্ট দেয়া হয়েছে সেই বইগুলোতে অধ্যায় ভিত্তিক কি আলোচনা করা হবে তার উল্লেখ আছে। নতুন সিলেবাস ও বর্তমানে বিদ্যমান সিলেবাস দুটো দেখলে দেখা যায় নতুন সিলেবাসে-
অফিস অটোমেশনে মাইক্রোসফট অফিসের পাশাপাশি ওপেনঅফিস-রাইটার, ক্যালক, বেস ও ইমপ্রেস ইত্যাদির কথা বলা হয়েছে। মাল্টমিডিয়া প্রেজেনটেশন সফটওয়্যারে ইমেজ এডিটিং এর সফটওয়্যার হিসেবে গিম্প (GIMP) অথবা পেইন্ট এর কথা বলা হয়েছে। তথ্য প্রযুক্তি অধ্যায়ের স্থলে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির কথা বলা হয়েছে। সিলেবাসটি একটু খেয়াল করলে দেখা যায়, বর্তমান সময়ে আলোচিত ওপেন সোর্স সফটওয়্যায় ও ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার অন্যতম হাতিয়ার তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির কথা এই সিলেবাসে চলে এসেছে।
বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। আর প্রযুক্তির অধিকাংশ যন্ত্রপাতি ব্যবহারের খরচ অনেক বেশি। তাই অধিকাংশ মানুষই তা ব্যবহার করতে পারে না। এর উপর যদি লাইসেন্সকৃত সফটওয়্যার ব্যবহার করতে হয় তবে তার জন্য যে অতিরিক্ত খরচ বেড়ে যাবে তা বহন করা আমাদের মত দেশের অধিকাংশ লোকের জন্য কষ্টসাধ্য হয়ে যাবে। এই অবস্থায় একটি টেকসই আইসিটি নির্ভর সমাজ বিনির্মাণে ওপেন সোর্স সফটওয়্যার ও অপারেটিং সিস্টেমের ভুমিকা অপরিসীম। ওপেন সোর্স সফটওয়্যার ও অপারেটিং সিস্টেম আমাদের নিজেদের ভাষায় অনুবাদকৃত ও তা বিনামূল্যে পাওয়া যায়। এগুলোর নানান ধরনের সুযোগ সুবিধা বিদ্যমান থাকে। লাইসেন্সের ঝামেলা না থাকায় তা কম্পিউটার ব্যবহারকারীদের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হতে পারে।
এনসিটিবি কর্তৃক প্রণীত নতুন সিলেবাসে দেখা যায় এখানে লাইসেন্সকৃত সফটওয়্যারের (মাইক্রোসফট এর সফটওয়্যার) পাশাপাশি ওপেন সোর্স সফটওয়্যার (ওপেন অফিস, গিম্প) ও অপারেটিং সিস্টেমের কথাও বলা হয়েছে। যা ওপেনসোর্স সফটওয়্যারের আন্দোলনকে প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে স্বীকৃতি দিয়ে আরো একধাপ এগিয়ে নিতে সহায়তা করবে। এছাড়া নতুন সিলেবাসে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়টি যুক্ত করা হয়েছে। বর্তমান সিলেবাসে তথ্য প্রযুক্তি নিয়ে একটি অধ্যায় বিদ্যমান ছিল। বর্তমানে তথ্য প্রযুক্তির সাথে যোগাযোগ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বর্তমান সরকারের ঘোষণা ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনে তথ্য প্রযুক্তির সাথে যোগাযোগের ভুমিকা গুরুত্বপূর্ণ। তাই এই অধ্যায়টি পরিবর্তন করা যুগোপযোগী হয়েছে।
সদ্য প্রণীত সিলেবাস থেকে দেখতে পাই, এই সিলেবাস দ্বারা একজন শিক্ষার্থী সহজেই বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী কম্পিউটারের অপারেটিং সিস্টেম সম্পর্কে জানতে পারবে, তথা ইউনিক্স, লিনাক্স সম্পর্কে জানতে পারবে, তারা ওপেন সোর্স সম্পর্কে জানতে পারবে ও এতে করে তারা ঐসব ব্যবহারে আগ্রহী হবে। শিক্ষার্থীরা ওপেন সোর্সে অভ্যস্ত হতে পারলে অপরকে শেখাতে পারবে। এতে করে আমরা ওপেন সোর্স ব্যবহারকারী একটি সম্প্রদায় পাবো। ফলে আমাদের দেশ সফটওয়্যার পাইরেসির দুর্নাম থেকে রেহাই পাবে, প্রযুক্তি পণ্য ব্যবহার সাশ্রয়ী হবে, এছাড়া মাইক্রোসফটের বেঁধে দেয়া সময়সীমা নিয়ে অহেতুক চিন্তা করার হাত থেকেও দেশ মুক্ত হবে।
বছরের মাঝামাঝি একটি সিলেবাস পরিবর্তন করা হলে তা যাদের উপর প্রথম প্রয়োগ করা হয় তাদের কিছুটা অসুবিধার সৃষ্টি করে। বিশেষ করে শিক্ষক, শিক্ষার্থীদের জন্য পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য সমস্যার সৃষ্টি করে। এতে করে পরিবর্তনের সঠিক ফল পাওয়া যায়না। এই দিকে এনসিটিবির নজর দেয়া উচিত। এমন কিছু করা যেতে পারে যাতে করে পরিবর্তনের সঠিক ফল লাভও করা যায় আবার শিক্ষার্থীদের কোন অসুবিধায় পড়তে না হয়। যেমন পরিবর্তনটি করা যেতে পারে শিক্ষা বর্ষের শুরুতে, যাতে করে শিক্ষার্থীরা সহজেই এই পরিবর্তনের সাথে অভ্যস্ত হতে পারে। তা না হলে হিতে বিপরীত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থেকেই যায়।
লেখক পরিচিতি
মুশফিকুর রহমান
মুশফিকুর রহমান বাংলাদেশের শিক্ষা ওয়েবসাইটের একজন সহ-সম্পাদক।