করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট বৈশ্বিক দুর্যোগ গোটা বিশ্বের শিক্ষাব্যবস্থাকে চরমভাবে ধাক্কা দিয়েছে। বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ঐক্যপরিষদের সভাপতি ইকবাল বাহার চৌধুরী বলেছেন, “করোনার ক্রান্তিলগ্নে আমরা প্রায় ষাট হাজার প্রতিষ্ঠানের সাথে সংশ্লিষ্ট বিশ লাখ শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী পরিবার মানবেতর জীবনযাপন করছি। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় আমরা কোনো টিউশন ফি আদায় করতে পারিনি। তাই শিক্ষক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন পরিশোধ করা সম্ভব হয়নি”।
কিন্ডারগার্টেন : কীভাবে পরিচালিত হয়?
আমরা জানি, কিন্ডারগার্টেন বা এ-ধরনের বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানই ভাড়াবাড়িতে পরিচালিত হয়। শিক্ষক নেতারাও বলেছেন যে, ৯৯ শতাংশ প্রতিষ্ঠানই ভাড়া বাড়িতে অবস্থিত। একটু স্বচ্ছল অথচ বেকার ছেলে বা মেয়ে নিজের বাসার একটি বা দুটো রুমে হয়তো এ-জাতীয় প্রতিষ্ঠান চালু করেন। করোনাকালীন দীর্ঘ এই বন্ধেও প্রতিষ্ঠানগুলোর বাড়িভাড়া ঠিকই দিতে হচ্ছে; যদিও শিক্ষার্থী বেতন নেই দুইমাসের অধিককাল যাবত। অথচ এসব প্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থী বেতনের ওপরই পুরোপুরি নির্ভরশীল। অন্যান্য বিলও প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাণিজ্যিক হারে পরিশোধ করতে হয় যা এখনও অব্যাহত আছে।
কিন্ডারগার্টেন ও প্রাইভেট বিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক প্রতিষ্ঠান থেকে নামমাত্র বেতন পান। তাঁরা নির্ভর করেন মূলত প্রাইভেট টিউশনির ওপর। করোনাকালে দীর্ঘ ও অনিশ্চিত এই বন্ধে তাদের টিউশনি বন্ধ রয়েছে। অনিশ্চিত হয়েছে তাদের উপার্জন। তারা না পাচ্ছেন প্রতিষ্ঠান থেকে বেতন, না পাচ্ছেন প্রাইভেট পড়ানো থেকে বেতন। কাজেই জীবন চালানো, সংসার চালানো তাদের জন্য হয়েছে দুরূহ। গত ১ ৭মার্চ থেকে বন্ধ শুরু হয়েছে এবং কয়েক দফায় বাড়িয়ে তা রোজা, ঈদসহ ৬ জুন পর্যন্ত নেয়া হয়েছে। ঈদের পরও প্রতিষ্ঠান খোলার সম্ভাবনা নেই।
করোনাকালীন বন্ধে বেসরকারি অথচ এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষকগণ বেতন পাচ্ছেন। কিন্তু নিজস্ব আয়ে চলা বেসরকারি এসব কিন্ডারগার্টেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের দিন কীভাবে কাটছে তা কি আমরা ভেবে দেখেছি কখনও? দেশে কিন্ডারগার্টেনের সংখ্যা চল্লিশ থেকে ষাট হাজার। সরকারের স্বীকৃত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অথচ নন-এমপিওভুক্ত এরকম প্রতিষ্ঠান রয়েছে পাঁচ হাজার ২৪২টি। এগুলোতে শিক্ষক কর্মচারী ৭৫ থেকে ৮০ হাজার। এছাড়াও সরকারি স্বীকৃতির বাইরে আরও দুই হাজারের বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। তার মানে, আমাদের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাক্ষেত্রের বিরাট এক অংশ জুড়ে আছে এ-ধরনের প্রতিষ্ঠান। এগুলোর অস্তিত্ব আমরা কোনোভাবেই অবজ্ঞা করতে পারি না।
কবে খুলবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান?
ঈদের পরও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না খোলার ইঙ্গিত আমরা পেয়েছি। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব বলেছেন, “৩০ মের পর যদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে যাওয়ার কথা কেউ প্রচার করে, তাহলে পুরোটাই গুজব। কারণ এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে হয়নি। আগামী ৩০ মে পর্যন্ত সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর কাছাকাছি সময়ে গিয়ে পরিস্থিতি বিবেচনা করে আমরা পরবর্তী সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিব”।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহপরিচালক বলেছেন, “সাধারণ ছুটির সঙ্গে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে রোজা ও ঈদের ছুটিও চলছে। এরপর গ্রীষ্মকালীন ছুটিসহ আগামী ৬ জুন পর্যন্ত স্কুল বন্ধ থাকবে। এর আগেই পরিস্থিতি বিবেচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়া হবে। তবে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত কোনভাবেই স্কুল খোলার সম্ভাবনা নেই”।
আর প্রধানমন্ত্রী তো আগেই বলেছেন, “যখন করোনার প্রকোপ থাকবে না, তখনই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হবে। আমরা এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলব না। অন্তত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত স্কুল-কলেজ সবই বন্ধ থাকবে, যদি করোনাভাইরাস অব্যাহত থাকে”।
কীভাবে বেতন পাবেন শিক্ষকরা?
পরিস্থিতির বিবেচনায় সিদ্ধান্ত এমনই হতে বাধ্য। কিন্তু লক্ষ লক্ষ শিক্ষক-কর্মচারী যারা শিক্ষা প্রদান করছেন আমাদের সন্তানদের অথচ তারা রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে কোনো বেতন ভাতা পান না তাদের কী হবে? এ ব্যাপারে মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, “বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পুরোটাই টিউশন ফি-নির্ভর। আমি অভিভাবকদের অনুরোধ করব, এখন তাদের খরচও একটু কম। তাই তারা যেন টিউশন ফির ব্যাপারটা বিবেচনা করেন। তবে যারা সমস্যায় আছেন তাদের কথা ভিন্ন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষকেও বলব, প্রয়োজনে কিছুটা ফি কম নেওয়া বা কিস্তিতে ফি নেওয়ার ব্যবস্থাও করা যেতে পারে। যার মধ্য দিয়ে অভিভাবকরাও কিছুটা স্বস্তি পেলেন, স্কুল শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দিতে পারল, বড় আকারের কোনো সমস্যায় পড়ল না। কিন্তু এখন সরকারের পক্ষ থেকে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে বলার সুযোগ নেই যে তোমরা ফি নিবে না”। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী অবশ্য এর মাধ্যমে এক ধরনের সমাধান দিয়েই দিয়েছেন। অর্থাৎ অভিভাবক ও বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ—দুই পক্ষকেই একটু ছাড় দিতে হবে। তাহলে এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষক ও কর্মচারীদের জীবন বেঁচে যাবে।
দু’একটি প্রতিষ্ঠান হয়তো নিজেদের ফান্ড থেকে শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতনভাতা পরিশোধ করছেন বা করতে পারছেন। কিন্তু বিশাল সংখ্যক বিদ্যালয়ের কী হাল হবে? ঢাকা শিক্ষাবোর্ড থেকে এক আদেশে টিউশন ফি আাদায়ে চাপ প্রয়োগ না করার জন্য প্রতিষ্ঠান প্রধানদের অনুরোধ জানানো হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দিলে বা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এলে বকেয়াসহ মাসিক বেতন আদায়ের অনুরোধ জানানো হয় আদেশে।
অভিভাবকদের বেতন দিতে বলবে কর্তৃপক্ষ?
এ নিয়ে উভয় সংকটে পড়েছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ। অভিভাবকদের কাছে এই দুর্দিনে বেতন চাইলে সেটি অমানবিকতার পর্যায়ে পড়ে। আর বেশিরভাগ অভিভাবকও এই মূহূর্তে বেতন দিতে রাজি নন। তবে প্রতিষ্ঠানগুলো বেতন আদায় না করলে শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতনও দিতে পারছে না। আর এই মুহূর্তে শিক্ষকদের বেতন-বোনাস বাকি পড়লে সেটি আরেক ধরনের অমানিবকতা। ফলে অনেক প্রতিষ্ঠানই মানবিক আবেদনের মাধ্যমে অভিভাবকদের এসএমএস পাঠিয়ে বেতন চাচ্ছে ,আবার কেউ কেউ কী করবেন ভেবে পাচ্ছে না।
শিক্ষক-কর্মচারীদের পক্ষ থেকে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের ওপর চাপ দেয়া হচ্ছে অনেক জায়গায়। তাই, এই প্রতিষ্ঠানগুলো সম্পর্কে একটি সিদ্ধান্তে আসা উচিত। হতে পারে, অভিভাবকদের ৭০ শতাংশ বেতন দিতে হবে, বাকিটা মওকুফ করা হবে। এই ৩০ শতাংশ বেতন বিদ্যালয় থেকে শিক্ষক-কর্মচারীদের বহন করতে হবে। যেসব প্রতিষ্ঠানের অর্থিক অবস্থা ভালো, তারা শিক্ষকদের এখনই এই বেতন দিয়ে দিবে। বাকিরা পরবর্তী সময়ে ধীরে ধীরে দিবে। তবে, কোনোভাবেই শিক্ষক-কর্মচারীদের ঠকানো যাবে না। কিন্তু সিদ্ধান্তটি কে নেবে? স্কুল কমিটি, শিক্ষা বিভাগের স্থানীয় সরকারি কর্মকর্তা, অভিভাবক প্রতিনিধি সমন্বয়ে এ-ধরনের একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হতে পারে যেখানে মন্ত্রণালয় সায় দিবে। স্কুল কমিটিগুলো এখন কোথায়? স্থানীয় সরকারী শিক্ষা কর্মকর্তাদের এক্ষেত্রে ভূমিকা কী? তাদের ভূমিকা এই দুর্যোগপূর্ণ মূহূর্তে আমরা দেখতে চাই।
কিন্ডারগার্টেন : সংখ্যায় কতো?
এখানে রয়েছে বিরাট এক সমস্যা। প্রতিটি উপজেলা, জেলা এবং বিভাগীয় শহরে, রাজধানীতে কোথায় কতটি কিন্ডারগার্টেন বিদ্যালয় রয়েছে তার হিসাব কি আছে? উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার, উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার, জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার, জেলা শিক্ষার আফিসারদের কাছে আছে? নেই। রাষ্ট্রীয় তরফেও এর সঠিক পরিসংখ্যান নেই। শিক্ষক নেতাদের কেউ কেউ বলেন, দেশে ৪০ হাজার কিন্ডারগার্টেন রয়েছে আর এর সাথে জড়িত শিক্ষক-কর্মকর্তার সংখ্যা দুই লাখ।
আবার অন্য এক সংগঠনের শিক্ষক নেতারা বলছেন, এই সংখ্যা ৬০ হাজার। এর সাথে জড়িত শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী, উপকারভোগীর সংখ্যা ২০ লাখ। তার মানে হচ্ছে, সরকারী খাতায় এগুলোর সঠিক পরিসংখ্যান নেই। আর এ থেকে সহজেই বুঝা যায় যে, এসব প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর রাষ্ট্রীয় অবজ্ঞা কতোখানি। এসব প্রতিষ্ঠানে কতজন শিক্ষক আছেন, তারা কী ধরনের বেতন পান এ-ধরনের তথ্য উপজেলা কিংবা জেলা শিক্ষা অফিসারদের কাছে নিশ্চয়ই নেই।
মনে প্রশ্ন জাগে, তাদের কি কোনোদিন সময় হয়েছে এসব বিদ্যালয় পেশাগতভাবে পরিদর্শন করার? খুব সম্ভব হয়নি। কারণ, তাদের অন্য কাজ আছে। তারা শিক্ষকদের বদলি নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। বদলি একটি বাণিজ্য। বিদ্যালয়ের হাল-চাল দেখা কিংবা একাডেমিক বিষয় দেখায় সেরকম বাণিজ্য নেই। কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষক নেতৃবৃন্দ সরকারের কাছে অর্থিক সহায়তার দাবি জানিয়ে আসছেন। সরকার সহায়তা করতে চাইলেও কার মাধ্যমে এবং কীভাবে তা করবে?
সহায়তা
শিক্ষক নেতৃবৃন্দের এক অংশ সরকারের কাছে ৫০ কোটি টাকা চেয়েছেন। অন্য একটি অংশ চেয়েছেন ৫০০ কোটি টাকা। সাধারণ মানুষদের ত্রাণ দেয়ার ক্ষেত্রে আমরা বহু অনিয়মের কথা শুনেছি। কারণ স্থানীয় তথাকথিত নেতা কিংবা প্রভাবশালী লোকদের মাধ্যমে ত্রাণ বিতরণ করতে গিয়ে প্রকৃত অভাবীরা ত্রাণ পাননি। কিন্ডারগার্টেনের ক্ষেত্রে কাদের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় অর্থ প্রদান করা হবে? আর সংখ্যার ক্ষেত্রে কোন পরিসংখ্যানটি গ্রহনযোগ্য বলে ধরা হবে? ৪০ হাজার কিন্ডারগার্টেন এবং তারসাথে দুই লাখ শিক্ষক-কর্মচারী, নাকি ৬০ হাজার কিন্ডারগার্টেন ও এগুলোর সাথে বিশ লাখ শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও উপকারভোগী?
শিক্ষক নেতারা বলেছেন যে, শিক্ষার্থীদের মাসিক টিউশন ফির ৪০ শতাংশ বাড়ি ভাড়া, ৪০ শতাংশ শিক্ষক-শিক্ষিকা, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন, বাকি ২০ শতাংশ গ্যাস বিল, বাণিজ্যিক হারে বিদ্যুৎ ও পানির বিলসহ অন্যান্য খরচ নির্বাহ না হওযায় অনেক প্রতিষ্ঠানে ভর্তুকি দিতে হয়। এটি অনেক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেই সত্য। এমতাবস্থায় প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টিউশন ফি আদায় না হওয়ায় মার্চ মাস থেকে এই পর্যন্ত স্কুলগুলো সকল প্রকার বিলসহ বাড়ি ভাড়া, শিক্ষক-শিক্ষিকা, কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের বেতন পরিশোধ করতে পারেনি।
বাড়ির মালিক ভাড়ার জন্য চাপ দিচ্ছেন। শিক্ষক-শিক্ষিকা, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা অর্থকষ্টে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এসব প্রতিষ্ঠানের পরিচালকরা দিশেহারা। শিক্ষাক্ষেত্রের বিশাল এই সেক্টরকে টিকিয়ে রাখতে এবং অসহায় শিক্ষক-শিক্ষিকা, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য জীবন বাঁচাতে এবং এ প্রতিষ্ঠানগুলোকে টিকিয়ে রাখার জন্য শিক্ষক নেতৃবৃন্দ প্রধানমন্ত্র্রীর নিকট যে কোনো ধরনের আর্থিক সহায়তা প্রার্থনা করেন।
কিন্ডারগার্টেন ও বাস্তবতা
নেতারা বলছেন, “এ স্কুলগুলো যদি না থাকতো, তাহলে সরকারকে আরও ২৫ থেকে ৩০ হাজার বিদ্যালয় স্থাপন করে প্রতিমাসে শিক্ষক বেতন-বাবদ কোটি কোটি টাকা ব্যয় করতে হতো। সেদিক থেকে বলা চলে, আমরা সরকারের বিরাট রাজস্ব ব্যয় কমিয়ে দিয়েছি। পরোক্ষভাবে আমরা দেশের বেকার সমস্যা সমাধানেও কাজ করছি”। শিক্ষক নেতাদের এই কথাগুলো কিন্তু ফেলে দেয়ার মতো নয়। যুক্তিসঙ্গত কথা। কাজেই তাদের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে দেখা প্রয়োজন।
প্রাথমিক শিক্ষা একটি সমাজ ও জাতি গঠনের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই শিক্ষাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে একটি রাষ্ট্রকে তা পরিচালনা করতে হয়। এটি কোনোভাবেই যার তার হাতে ছেড়ে দিলে হয় না। কিন্ডারগার্টেনগুলো আমাদের দেশের প্রাথমিক শিক্ষার দুরবস্থার মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে। প্রাথমিক শিক্ষায় অর্ধেক প্রতিষ্ঠান (৬৫৫০০টি) রাষ্ট্রীয় তরফ থেকে পরিচালনা করা হয়। এটি একটি ভালো দিক। কিন্তু সেখানে শিক্ষকদের চাকরি সরকারী ছাড়া অন্য কোনো ভালো দিকের কথা আমরা শুনি না, দেখতে পাই না।
প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনীর পর একজন শিক্ষার্থীকে কিছু দক্ষতা অর্জন করতে হয়। সেখান থেকে তারা বহুদূরে অবস্থান করছে। এমনকি তারা দেখে বাংলাও পড়তে পারছে না। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে এ অবস্থা অনেকটাই ভালো। প্রতিটি কাজের ক্ষেত্রে ফিডব্যাক প্রয়োজন। এটি আমাদের সংস্কৃতিতে নেই। আমরা ফিডব্যাক মনে করি সমালোচনা। তাই উন্নয়নের সুযোগ আর থাকে না।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গু্লোতে কী হচ্ছে তা যদি সঠিকভাবে মন্ত্রণালয় কিংবা সরকারকে জানতে হয় তাহলে প্রাসঙ্গিক লোকদের কাছ থেকে ফিডব্যাক নেয়া প্রয়োজন। সেটি হয় না বলে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মান তলানিতে গিয়ে পৌঁছেছে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দুর্বলতার সুযোগেই দেশে গড়ে উঠেছে কিন্ডারগার্টেন বিদ্যালয়। এগুলো ব্যক্তি পর্যায়ে পরিচালিত হচেছ। একটি দেশের ভবিষ্যত নাগরিকদের যারতার হাতে ছেড়ে দেয়া কোনোভাবেই ঠিক নয়।
মান উন্নয়ন প্রয়োজন
কিন্ডারগার্টেনে যারা পড়ান তাদের প্রাতিষ্ঠনিক প্রশিক্ষণ নেই। অথচ শিশুদেরকে পড়ানোর জন্য শিশু শিক্ষা ও শিশুবিজ্ঞানের ওপর যথেষ্ট ধারণা থাকতে হয়, জানতে হয়, প্রাকটিস করতে হয়। এগুলোর ওপর শিক্ষকদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে হয়, ফিডব্যাক নিতে হয়। অথচ এগুলো সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর মতো কিন্ডারগার্টেনগুলোতেও হয় না। ব্যতিক্রম দু’চারটি রয়েছে অবশ্যই।
রাষ্ট্র এই দায়িত্ব কোনোভাবেই এড়াতে পারে না। অর্থনৈতিক সমস্যা অন্যভাবে ম্যানেজ করা যায়। শিশুদের শিক্ষা কারুর বাড়ির বারান্দায়, কারুর ভাড়া করা একটি রুমে বা দুটো রুমে, ব্যক্তিগত ইচ্ছার ওপর চলতে দেয়া যায় না। সেখানে একটি শক্তিশালী কমিশন গঠন করতে হবে যারা শিশুশিক্ষার সার্বিক নির্দেশনা প্রদান করবে। সেভাবেই গোটা দেশে একইভাবে শিশুদের আনন্দদায়ক শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত হবে। সেখানকার শিক্ষকদের যথাযথ পেশাগত উন্নয়ন সংঘটিত হবে।
কিন্ডারগার্টেন শিক্ষক, পরিচালক কিংবা মালিকদের আমরা দোষারোপ করতে পারি না। প্রাথমিক শিক্ষার দুর্বলতার কারণেই কিন্ডারগার্টেন গড়ে উঠেছে। এখন তাদের পাশে দাঁড়ানোর দায়িত্বও অভিভাবক, সমাজ ও রাষ্ট্রের। এখানকার শিক্ষকদের চাকরি অনিশ্চিত। কোনো সার্ভিস রুল নেই, সার্ভিস শেষে কোনো বেনিফিট নেই। এ-অবস্থায় তাঁরা কতোটা নিবেদিত হবেন পেশার প্রতি সেটি একটি বিরাট প্রশ্ন।
কিন্ডারগার্টেন এবং নন-এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো যাতে ভালোভাবে চলে, তার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। শিক্ষক-কর্মচারীদের সার্ভিস রুল তৈরি হয়, শিক্ষকদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ প্রদান অনুষ্ঠিত হয়, শিক্ষকদের জবাবদিহিতার মধ্যে আনা যায় এবং সর্বোপরি ভবিষ্যত নাগরিকদের এসব প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে মানসম্পন্ন ও যুগোপযোগী শিক্ষা প্রদান করা যায়, সেজন্য একটি শক্তিশালী, পেশাগত ও রাজনীতিমুক্ত কমিশন গঠন করা প্রয়োজন।
লেখক পরিচিতি
মাছুম বিল্লাহ বাংলাদেশে ইংলিশ টিচার্স অ্যাসেসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইট্যাব)-এর সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি পূর্বে ক্যাডেট কলেজ ও রাজউক কলেজের শিক্ষক হিসেবে কাজ করেছেন। কাজ করেছেন ব্র্যাকের শিক্ষা কর্মসূচিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে। তিনি ভাব বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর হিসেবেও কর্মরত রয়েছেন। তিনি নিয়মিত শিক্ষাবিষয়ে নানা প্রবন্ধ লিখছেন।