বাড়ি উচ্চশিক্ষা গুচ্ছ পদ্ধতির ভর্তি পরীক্ষা কেন?

গুচ্ছ পদ্ধতির ভর্তি পরীক্ষা কেন?

উচ্চশিক্ষার ইতিহাস : আইন বিভাগ রয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও
উচ্চশিক্ষার ইতিহাস : আইন বিভাগ রয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও

সমীর রঞ্জন নাথ লিখেছেন গুচ্ছ পদ্ধতির ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির মৌসুমে ভর্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ লাখো শিক্ষার্থীর হয়রানির প্রসঙ্গ প্রতি বছরের কমন আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সমস্যাটি এ রকম—একজন শিক্ষার্থী যে কোনো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র একটি বিষয়ে ভর্তি হয়। অথচ তাকে অনিশ্চয়তা মাথায় নিয়ে দেশময় ঘুরে বেড়াতে হয় এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরেক বিশ্ববিদ্যালয়ে। এতে অর্থ ও সময় তো নষ্ট হয়ই, অনিশ্চয়তা মাথায় নিয়ে ছোটাছুটির কষ্ট করতে হয় তার চেয়েও বেশি। সবচেয়ে জনপ্রিয় যে সমাধানটি গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে আলোচনায় এসেছে তা হলো, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি গুচ্ছ পদ্ধতির ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি চালু করা। এ সমাধানের প্রবক্তারা উদাহরণ হিসেবে মেডিকেল কলেজগুলোর ভর্তি পরীক্ষার কথা বলেন। ইদানীং কারও আলোচনায় প্রাক্তন বিআইটির উদাহরণও আসছে। তারা প্রশ্ন করছেন,

ওরা পারলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পারবে না কেন? সবিনয়ে বলতে চাই, প্রশ্নটি পারা না-পারার নয়।

সম্ভবত এরই ধারাবাহিকতায় রাষ্ট্রপতির এক ভাষণের দোহাই দিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্প্রতি এক সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, আগামী বছর থেকে গুচ্ছ পদ্ধতিতে পরীক্ষা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হবে। ইতিমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারপারসনের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে মধ্য ফেব্রুয়ারির মধ্যে এ সংক্রান্ত কার্যপত্র তৈরি করতে বলা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে এ ব্যাপারে রাজি করাতে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে উপাচার্যদের সভা অনুষ্ঠানের আয়োজন হচ্ছে বলে খবরে প্রকাশ। এ ধরনের প্রচেষ্টা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্বাতন্ত্র্য ক্ষুণ্ণ করবে, যা কোনোভাবেই উচ্চশিক্ষার ধারণার সঙ্গে মেলে না।

এক সময় আমাদের দেশে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি বিভাগে আলাদা ভর্তি পরীক্ষা হতো। তখন অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল মাত্র ছয়টি। তখনও কোনো শিক্ষার্থী তার পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়ের সবক’টি বিভাগে ভর্তি পরীক্ষা দিত না। শিক্ষার্থীরা পছন্দের দু-তিনটি বিষয়ে এক বা দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতো। শিক্ষার্থী সংখ্যা তুলনামূলক কম থাকায় তখন বিষয়টি অতটা চোখে পড়ত না। এখন বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষার্থী উভয়ই সংখ্যায় বেড়েছে; তাই শিক্ষার্থীদের হয়রানির বিষয়টি প্রকটভাবে ধরা পড়ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়ার কারণে শিক্ষার্থীরা এখন আগের তুলনায় বেশি সংখ্যায় পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে- এটিও চোখে পড়ার আরেকটি কারণ।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থী ভর্তির ক্ষেত্রে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ওপর যেমন নির্ভর করে, পাশাপাশি আবার নিজস্ব পরীক্ষা গ্রহণের মাধ্যমেও যাচাই করে। বর্তমান পদ্ধতিতে ১৩১টি সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী নির্বাচনের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা ভোগ করছে। সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি চালু হলে এই স্বাধীনতা খর্ব হবে। কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন বিভাগ কোন ধরনের শিক্ষার্থী চায়, তা তার নিজস্ব বিষয় হওয়া উচিত। সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতির নামে কোনো মহাবোর্ড দ্বারা নির্বাচিত শিক্ষার্থীদের পড়াতে বাধ্য করা কোনোভাবেই বিশ্ববিদ্যালয় ধারণার সঙ্গে মানানসই নয়। আর মহাবোর্ড করার তো দরকার নেই; শিক্ষা বোর্ডগুলোর মাধ্যমে প্রাপ্ত মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলের ওপর ভিত্তি করেই তো শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচন করে দেওয়া যায়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর যদি বোর্ডের পরীক্ষার ব্যাপারে কোনো আপত্তি থাকে, তাহলে উভয়পক্ষ বসে তা মিটমাট করে নিতে পারে। উভয়ই একই মন্ত্রণালয়ের অধীন বলে এটি করা অসম্ভব নয়। এতে অর্থ ও সময় যেমন বেঁচে যাবে, দেশময় ছোটাছুটিও থাকবে না।

সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি সর্বত্র সমভাবে প্রয়োগ করা উচিত কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন তোলা যায়। আমাদের এখানে নানা জায়গায় ইতিমধ্যে তা চালু আছে। মেডিকেলের কথা তো আগেই বলা হলো। ঢাকা মহানগরীর সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোয় প্রথম শ্রেণিতে ভর্তির ক্ষেত্রেও একই পদ্ধতি প্রবর্তিত হয়েছে বেশ ক’বছর আগেই। যদিও সেখানে কোনো ধরনের পরীক্ষা না নিয়ে লটারির মাধ্যমে শিক্ষার্থী নির্বাচন করা হয়। বিদ্যালয়ে এটি সম্ভব; কারণ এই বিদ্যালয়গুলো একই শিক্ষাক্রম অনুসরণ করে একই ব্যবস্থাপনার অধীনে পরিচালিত হয়। মেডিকেলের ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। এরা পরিচালিত হয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীনে, শিক্ষাক্রমও একই। ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা ও রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় যখন বিআইটি ছিল, তখন সেগুলো একই সংস্থার অধীনে একই শিক্ষাক্রম অনুসরণ করে পরিচালিত হতো। এখন স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হওয়ায় এদের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য তৈরি হওয়ার কথা। তা না হলে বুঝতে হবে, এগুলো বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ে ওঠেনি। মূল কথা হলো, একই পরিচালন প্রতিষ্ঠানের অধীনে একই শিক্ষাক্রম অনুসরণকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো কেবল সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি চালু হতে পারে।

অন্যদিকে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হয়। দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো একটি বিষয়ের শিক্ষাক্রম হুবহু এক রকম নয়। আসলে এক রকম হওয়া উচিতও নয় বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে তাদের স্বাতন্ত্র্য রক্ষার তাগিদ থেকেই। একই রকম হওয়া বিদ্যালয় বা কলেজের ধারণার সঙ্গে যতটা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণার সঙ্গে মোটেও যায় না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে অনুষদ অনুযায়ী ভর্তি পরীক্ষা হয় তা-ও ঠিক হচ্ছে না, অনুষদভুক্ত বিভাগগুলোর চাহিদার ভিন্নতার কারণেই। একই ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে কোনো অনুষদের সব বিভাগের জন্য শিক্ষার্থী নির্বাচন করায় বিষয়ভিত্তিক চাহিদা হারিয়ে যাচ্ছে। বিভাগগুলো তার চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষার্থী নির্বাচন করার সুযোগ না পেয়ে দৈব নির্বাচনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। দীর্ঘদিন ধরে অনুষদভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি চালু থাকায় শিক্ষার্থীদেরও নির্দিষ্ট বিষয়ের প্রতি আগ্রহ তৈরিতে বাধার সৃষ্টি হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষায় পড়ার বিষয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে বিভাগভিত্তিক চিন্তা না করে অনুষদভিত্তিক চিন্তায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। এ ধরনের চর্চা মানসম্মত উচ্চশিক্ষার অন্তরায়। আমাদের বোঝা দরকার, ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্য’ নিয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করা আর ‘ভাষাবিজ্ঞান‘ পড়া এক কথা নয়। অর্থনীতির মতো বিষয়ও হতে পারে বিবিধ রকমের- অতিমাত্রায় সংখ্যাতাত্ত্বিক, লিবারেল আর্টস ধরনের, মার্কসীয় কিংবা বাজারনির্ভর। একেক বিশ্ববিদ্যালয় হয়তো অর্থশাস্ত্রকে একেকভাবে অধ্যয়ন করবে।

শিক্ষার্থীরা নবম শ্রেণিতে বিষয় নির্বাচন করার সময় পরবর্তী জীবনে কী পড়বে বা কী ধরনের পেশায় যাবে, সে সম্পর্কে এক প্রকার আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়। সন্দেহ নেই, এতে আবেগের প্রাধান্যই বেশি থাকে। অধিকাংশের ক্ষেত্রে তা বাস্তবায়িতও হয় না। তারপরও শিক্ষার অংশ হিসেবে শিশুমনে এ ধরনের আকাঙ্ক্ষা তৈরি করার প্রয়োজন আছে। পরবর্তী চার বছরে নিজের সম্পর্কে ধারণা স্পষ্ট হতে থাকে। একই সঙ্গে তাদের ভালো লাগার বিষয় সম্পর্কেও একটা ধারণা তৈরি হওয়া প্রয়োজন। বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীরা এ ধরনের ধারণা তৈরি হওয়ার মতো পরিবেশ মোটেও পায় না। তার ওপর রয়েছে বিষয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে মা-বাবা, আত্মীয়-পরিজন ও বন্ধু-বান্ধবের চাপ। সব মিলিয়ে শিক্ষার্থীরা এক দিশেহারা অবস্থায় পড়ে যায়। এরই বিষময় ফল হচ্ছে দেশময় ছোটাছুটি করে ভর্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়া।

বারো বছরের বিদ্যালয় শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীরা যেন তাদের পছন্দের বিষয় নির্বাচন করার মতো পরিবেশ পায়, সেদিকে নজর দেওয়া দরকার। নিজের জন্য পছন্দ করতে পারাটাও এক ধরনের যোগ্যতা এবং তা-ও শিখতে হয়। পছন্দের বিষয়েই যে পড়ালেখা করা উচিত, সে সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করতে হবে। একই সঙ্গে পছন্দের বিষয়ে কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে কী ধরনের ব্যবস্থা আছে, তা জানানোর ব্যবস্থা থাকা দরকার। এ জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওয়েরসাইট যথেষ্ট তথ্যসমৃদ্ধ করা প্রয়োজন। উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর শিক্ষার্থীরা যদি নিজেরাই পছন্দের বিষয়ে পছন্দমতো বিশ্ববিদ্যালয় খুঁজে পায়, তাহলে তাদের আর দেশময় ছুটে বেড়ানোর প্রয়োজন হবে না। একজন শিক্ষার্থী হয়তো দু-তিনটির বেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করবে না। ফলে শিক্ষার্থী ও বিশ্ববিদ্যালয় উভয়ই নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়ে প্রস্টম্ফুটিত হওয়ার পথ খুঁজে পাবে।

সমীর রঞ্জন নাথ: কর্মসূচি প্রধান, শিক্ষা গবেষণা ইউনিট, ব্র্যাক গবেষণা ও মূল্যায়ন বিভাগ, ব্র্যাক, ঢাকা।

1 মন্তব্য

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Exit mobile version