বাড়ি শিক্ষার নীতি

জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০৯: কিছু আলোচনা

বাংলাদেশের শিক্ষা
বাংলাদেশের শিক্ষা

শাহরিয়ার শফিক লিখেছেন জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০৯ প্রসঙ্গে

গত ৭ সেপ্টেম্বর জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটি প্রধানমন্ত্রীর নিকট জাতীয় শিক্ষনীতি ২০০৯-এর চূড়ান্ত খসড়া প্রতিবেদন পেশ করে। একইসাথে তা ওয়েব সাইটের মাধ্যমে সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয় এ বিষয়ে তাদের সুচিন্তিত মতামত ও পরামর্শ প্রদানের জন্য। এরপর থেকে বিষয়টি জন-আগ্রহের বিষয়ে পরিণত হয়েছে এবং নানা মতামত ও পরামর্শ পাওয়া যাচ্ছে। এই সচেতনতা অবশ্যই সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু এর সাথে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীগত স্বার্থচিন্তা যুক্ত হয়ে পড়ায় নানা বিতর্কের জন্ম হচ্ছে। যে যেই দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখুন না কেন, শিক্ষাবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী হিসেবে আমরা একে ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে দেখছি।

শিক্ষার মৌলিক সংস্কারের মাধ্যমে একটি যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের যে দাবি বহুদিন ধরে উত্থাপিত হচ্ছিল, সেই প্রেক্ষাপট থেকে কমিটি শিক্ষার গুণগত ও কাঠামোগত সংস্কারের সুপারিশ সম্বলিত একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন পেশ করে। কাঠামোগত সংস্কারের অংশ হিসেবে সাধারণ ও মাদ্রাসা উভয় শিক্ষাব্যবস্থার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে। পাশাপাশি সুপারিশ করা হয়েছে মাদ্রাসা শিক্ষার আধুনিকায়নের। ফলে সাধারণ ও মাদ্রাসা উভয় শিক্ষা ধারায় প্রাথমিক শিক্ষা (১ম থেকে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত) মৌলিক শিক্ষার স্তর হিসেবে বিবেচিত হবে এবং অভিন্ন পাঠ্যসূচী অনুসৃত হবে। মাধ্যমিক পর্যায়েও (৯ম থেকে ১২শ শ্রেণী পর্যন্ত) মাদ্রাসা শিক্ষাকে সাধারণ শিক্ষার সমান্তরালে নিয়ে আসার জন্য পাঠ্যক্রমের সংস্কারসহ মানবিক ও বিজ্ঞান শাখার পাশাপাশি ব্যবসায় শিক্ষা শাখা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। শিক্ষাকে পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করে এবং দেশের জনসংখ্যাকে জনসম্পদে রূপান্তরের লক্ষ্যে শিক্ষানীতিতে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে বিজ্ঞান ও প্রায়োগিক শিক্ষার ওপর। এর অংশ হিসেবে প্রাথমিক স্তর থেকেই কম্পিউটার ও তথ্যপ্রযুক্তিকে অন্তর্ভুক্তকরণসহ কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার ওপর বিশেষ জোর দেয়া হয়েছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্য দূর করে পারস্পরিক শ্রদ্ধাশীল ও সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রাথমিক স্তর থেকেই ভিন্ন ভিন্ন ধরনের বিদ্যালয় ব্যবস্থা সংকোচন করে সমমর্যাদাভুক্ত বা একীভূত শিক্ষা ব্যবস্থা ( ইনক্লুসিভ এডুকেশন সিস্টেম) চালুর কথা বলা হয়েছে। পাশাপাশি প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার ভিত্তিকে দৃঢ়করণ এবং শিক্ষামূলক নির্দেশনা বোধগম্য উপায়ে শিক্ষার্থীদের কাছে উপস্থাপনের লক্ষ্যে একবছর মেয়াদী প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা ও আদিবাসীসহ সকল ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বার জন্য স্ব স্ব মাতৃভাষায় শিক্ষণ -শিখনের (Teaching-Learning) ব্যবস্থা করার সুপারিশ করা হয়েছে।

উচ্চ শিক্ষায় অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে অপচয় রোধ (আর্থিক ও আসন সংখ্যাগত) এবং এ স্তরের শিক্ষাকে আরো ফলপ্রসূ করার লক্ষ্যে মেডিকেল কলেজ গুলোর অনুরূপ সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থী ভর্তির পাশাপাশি এ পর্যায়ের শিক্ষায় গবেষণাকর্মে উৎসাহিতকরণ ও প্রাতিষ্ঠানিক কনসালটেন্ট ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণের কথা বলা হয়েছে। প্রস্তাব করা হয়েছে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও বেসরকারি কলেজ পর্যায়ের শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য শিক্ষক নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি ও প্রশিক্ষণের জন্য স্বতন্ত্র শিক্ষক নির্বাচন ও উন্নয়ন কমিশন গঠনের। একইভাবে প্রশাসনিক ও ব্যবস্থাপনা দক্ষতার উন্নয়নের লক্ষ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ শিক্ষা প্রশাসনের বিভিন্ন অঙ্গসংস্থার পুনর্বিন্যাসের ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। সর্বোপরি জাতীয় শিক্ষার উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় নীতি নির্ধারণ ও তা বাস্তবায়নের ধারাবাহিকতা রক্ষার্থে একটি স্থায়ী জাতীয় শিক্ষা কমিশন গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে।

নানা ইতিবাচক দিক সত্ত্বেও এই প্রতিবেদনের বিষয়বস্তু সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। এদেশের শিক্ষায় বিদ্যমান বৈষম্য দূর করে একই ধারার গণমুখী শিক্ষা পদ্ধতি চালুর লক্ষ্যে সাধারণ শিক্ষা ও মাদ্রাসা শিক্ষার মধ্যে সমন্বয় সাধনের প্রস্তাব করা হলেও শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য সৃষ্টিকারী অন্য একটি ধারা ইংরেজি মাধ্যমকে সম্পূর্ণরূপে সংস্কার প্রস্তাবের বাইরে রাখা হয়েছে। যা এই প্রতিবেদন প্রণেতাদের আন্তরিকতা ও নিরপেক্ষতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে এবং বিরোধীদের সমালোচনায় রসদ যুগিয়েছে। তারা খুব সহজেই প্রচার করতে পারছে যে, সরকার মাদ্রাসা তথা ধর্মশিক্ষা সংকোচনের কৌশল হিসেবেই শিক্ষানীতি সংস্কার করেছে। ফলে এর ইতিবাচক দিকগুলো চাপা পড়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে শিক্ষার কাঠামোগত সংস্কারের ফলে নতুন দুটি সমস্যার সৃষ্টি হবে। এর একটি হলো কাঠামোগত সমস্যা আর অন্যটি হলো লোকবল সংকটজনিত সমস্যা। প্রতিবেদনে যত সহজে এর সমাধান দেখানো হয়েছে, ব্যবহারিক ক্ষেত্রে এর সমাধান যথেষ্ট জটিল ও ব্যয়সাপেক্ষ হয়ে পড়বে, যা শিক্ষাক্ষেত্রে নতুন সংকটের জন্ম দিতে পারে।

কিন্তু তা সত্ত্বেও শিক্ষানীতি ২০০৯ বিষয়ে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপসমূহ আশাব্যঞ্জক। বিশেষ করে প্রতিবেদন পেশের পর তা পর্যালোচনা ও বাস্তবায়ন কৌশল নিয়ে শিক্ষা বিশেষজ্ঞদের (আইইআর) দ্বারস্থ হওয়া এবং আইইআর শিক্ষা বিশেষজ্ঞগণ কর্তৃক পর্যালোচনা ও যাচাই-বাছাইয়ের পর তাঁদের মতামতসহ সরকারের কাছে পেশ করা বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম পদক্ষেপ। এই পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে প্রতিবেদনকে আরো বস্তুনিষ্ঠ ও প্রায়োগিক করে তুলবে। কিন্তু শিক্ষানীতি প্রণয়নই শেষ কথা নয়, প্রয়োজন এর বাস্তবায়ন। বাংলাদেশে এর আগেও অনেকগুলো শিক্ষা কমিশন বা কমিটি তাদের প্রতিবেদন পেশ করেছে কিন্তু অধিকাংশ সুপারিশই বাস্তবায়িত হয় নি। আমরা আশা করি, সরকার এ প্রতিবেদনের ইতিবাচক সুপারিশসমূহ বাস্তবায়নে আন্তরিক হবেন। তবেই শিক্ষা জাতির ভাগ্য পরিবর্তনের হাতিযার হিসেবে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, সামাজিক বিজ্ঞান বিভাগ, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

কোন মন্তব্য নেই

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Exit mobile version