সারাদিন অফিস করে জিমে গেলাম স্বাস্থ্য উদ্ধার করতে। বাসায় আসতে আসতে মাথা ঘুরছিলো। বাসায় ফিরতেই মেঘের জোরালো হুকুম— বিদ্যালয়ের পাঠ্যবইয়ে কিছু প্রশ্ন আছে সেগুলোর উত্তর লিখে দিতে হবে। ও বই গুছিয়ে ঘুমোতে যাবে। বই খুলে আমি দিশেহারা। ডাচ শিক্ষাব্যবস্থা অনুসারে ডাচ উচ্চবিদ্যালয়ে আঁকা, গান, নাচ কিংবা অভিনয় এই চারটি বিষয়ের মধ্যে থেকে তিনটিতে প্রথম তিন বছর অনুশীলন করতে হবে। তারপর যেকোন একটি নিতেই হবে; চাইলে এর বেশিও চাইলে নেয়া যাবে। সেই সিলেবাস অনুযায়ী মেঘদের ভাগে এবার পরেছে শেক্সপিয়ারের ‘রোমিও জুলিয়েট’ নাটকটি। নাটকটি তাদের পড়তে ও অভিনয় করতে হবে। বাবা-মায়েদের আগেই দাওয়াত পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে অভিনয় দেখতে যাওয়ার জন্যে।
এখন বইতে দুটো আলাদা এঙ্কেট দেয়া আছে— একটি বাবা–মা পূরণ করবে, আরেকটি সন্তান পূরণ করবে কিন্তু কেউ কারোরটা আগে থেকে দেখবে না। তারপর একসাথে সবাই মিলে দেখবে উত্তরগুলো, আলোচনা করবে কিংবা দেখবে দুজনের উত্তরগুলো মিলে গেলো কিনা। আমাকে প্রশ্ন করা হলো— সন্তানের ভবিষ্যত সঙ্গীর মধ্যে আমি কী কী গুণ দেখতে চাই? কেন আমি সেসব গুণ দেখতে চাই? তার সঙ্গী নির্বাচনে আমার কোনো শর্ত বা চাহিদা আছে কিনা? আমি আমার উত্তর লিখলাম। বই ফেরত দেওয়ার পর পাতা উলটে মেঘও লিখলো। মেঘের জন্যে আবার একটি প্রশ্ন বেশি— বাবা-মায়ের পছন্দ তার কাছে যৌক্তিক মনে হয় কিনা। আমি হাত-মুখ ধুয়ে এসে মেঘকে বললাম— আয় উত্তর দেখি। মেঘ মোচড়ামুচড়ি করে, সে তার উত্তর দেখাবে না। আমি বারবার বললাম, বিদ্যালয় থেকে তো বলে দিয়েছে দেখাতে, তাহলে দেখাবি না কেন? তারপরও দেখায় না; ভয় দেখালাম— এরপর বিদ্যালয় থেকে কিছু লিখতে বললে কিন্তু লিখে দেবো না। মেঘও উলটো ভয় দেখায়—তুমি দিও না, পাপা দেবে!
এবার পাপা বকা লাগাতে সে দিলো বইটা লজ্জায় লাল-বেগুনী হয়ে। মেঘের উত্তর দেখে বোঝা গেলো— বিদ্যালয়ে এ নিয়ে অনেক আলোচনা আগেই হয়েছে। স্বাভাবিকভাবে সে প্রস্তুত ছিলো, তার সঙ্গী নিয়ে সে বিস্তারিত লিখেছে। মায়ের মতো এক কথায় প্রকাশ করেনি যদিও; সে শেষ প্রশ্নে মায়ের সাথে একমত হয়েছে, মায়ের পছন্দকে তার যৌক্তিক মনে হয়েছে। এ নিয়ে একটু গল্প করার চেষ্টা করলাম মেঘের সাথে। মেঘ প্রথমে অনেক আড়ষ্ট থাকলেও পরে একটু স্বাভাবিক হলো। ‘রোমিও জুলিয়েট’ দেখতে যাবো— মেঘ মোচড়ায়, গাঁইগুই করে, বলে— দেখতে যাওয়ার দরকার নেই, তুমি কত ব্যস্ত, শুধু শুধু তোমার সময় নষ্ট। আমি বললাম, কত সময় নষ্ট করলাম তোমার পেছনে আর একটা ঘণ্টাতে কী যাবে আসবে?
বয়োসন্ধিতে ছেলেমেয়ের মন মানসিকতায় পরিবর্তন আসে। এ-সময় প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মেই ছেলেমেয়েরা কাছাকাছি আসে। এটি নিয়ে অনেক সময় অনেক পরিবারে দূরত্ব তৈরি হয়, মনোমালিন্য হয়। পড়াশোনা করিয়ে পরীক্ষা নেয়াই বিদ্যালয়ের একমাত্র দায়িত্ব নয়। সমাজকে সুনাগরিক, সুখী নাগরিক উপহার দেয়াও বিদ্যালয়ের সামাজিক দায়িত্ব। এ প্রসঙ্গ নিয়ে পরিবারের মাঝে আলোচনা হলে বাবা-মায়ের মানসিক প্রস্তুতি থাকলে, দু-পক্ষের মধ্যে যেন আচমকা ধাক্কা না লেগে সহনশীলতা থাকে তার মানসিক প্রস্তুতি দেয়াও বিদ্যালয় নিজের দায়িত্বের মধ্যেই ধরে। মতবিরোধ হতেই পারে কিন্তু যুক্তি হারানো যাবে না। মেঘ ঘুমোতে চলে গেলে পুরোটা সন্ধ্যে আমি নিশ্চুপ আর নিঃশব্দ বসে ভাবছিলাম আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থার কথা যেখানে প্রধানমন্ত্রী বাণী দিয়েছেন, প্রশ্ন সবসময়ই ফাঁস হতো, কম আর বেশি। দায়িত্বহীন এ সমাজ নিয়ে কান্না করার মতো কান্নাও আর আমার নেই। মেঘের ছোটবেলা বলা কথাটাই আমি ভাবি— এই দুটো দেশ কী করে এক প্ল্যানেটে হবে মা? এরা কতো অন্যরকম!
শৈশব থেকে কৈশোরে উত্তরণের পথে ব্যক্তির শারীরিক কিছু পরিবর্তন ঘটে। বয়োসন্ধিকালে হাইপোথ্যালামাস থেকে গোনাডোট্রপিং রিলিজিং হরমোন (GnRH) নিঃসরণ হয়, যা পিটুইটারি থেকে ফলিকুলার স্টিমুলেটিং হরমোন (FSH) এবং লুটেনাইজিং হরমোন (LH) এর নিঃসরণ ঘটায়। এই হরমোন দুটো তখন পুরুষের ক্ষেত্রে টেস্টিস থেকে টেস্টোস্টেরন এবং নারীদের ক্ষেত্রে ওভারি থেকে ইস্ট্রোজেন আর প্রজেস্টেরনের নিঃসরণ ঘটায় এবং বয়োসন্ধিকালের পরিবর্তনগুলো ঘটিয়ে থাকে। এদের প্রভাবে চুল, ত্বক, হাড়, বিভিন্ন অঙ্গ ও মাংসপেশিতে পরিবর্তন দেখা দেয়। একে বলে বয়ঃসন্ধি বা বয়ঃপ্রাপ্তি। এ সময় ছেলে-মেয়েদের যৌনতার বিকাশ ঘটে। মেয়েদের পরিবর্তন শুরু হয় ছেলেদের চেয়ে এক বছর আগে। এ সময় ব্যক্তি-জীবনটা থাকে বড়ই আবেগপ্রবণ; কারণ শরীর খুব দ্রুত বদলাতে থাকে। তাল সামলানো কঠিন হয় বা প্রায়ই পারা যায় না। হরমোন বৃদ্ধির কারণে মেয়েদের শরীর থেকে মেয়েলী গন্ধ এবং ছেলেদের শরীর থেকে পুরুষালী গন্ধ প্রকটভাবে ছড়াতে থাকে। উভয়ের নরম চামড়া ভেদ করে, বিশেষ করে, মুখে ফুসকুড়ি বা ব্রণ উঠতে থাকে। পুরো বয়ঃসন্ধিকালেই এ পরিবর্তন ঘটতে থাকে। মনোবিজ্ঞানী ও শরীরবিজ্ঞানীরা এ সময়টাকে মানবজীবনের সবচেয়ে ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধকাল (storm & stress) বলে গণ্য করেন।
অনুমান করতে কষ্ট হয় না, পরিবারের জীবনধারণের বা জীবনচর্চার প্রভাব ওই শিশু ও কিশোরটির ব্যক্তিত্ব ও ভবিষ্যত জীবনের ওপর সর্বাধিক ও দীর্ঘস্থায়ী হবে। প্রতিটি পরিবারের জীবনচর্চা ভিন্ন ধরনের, ফলে তারা কিশোর-কিশোরদের কোন কোন কাজে উৎসাহিত করবে বা কোন কোন কাজকে বাধা দেবে এ ব্যাপারে যথেষ্ট তফাত ঘটে। এ সময় বুদ্ধিবৃত্তি পূর্ণ হয়, চিন্তাশক্তি ও যুক্তিশক্তির বিকাশ ঘটে। বিমূর্ত ভাববস্তুর উপলব্ধি এবং চিন্তন ও অনুমিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা বর্জন করার মানসিক শক্তিও বয়ঃসন্ধিকালে অর্জিত হয়। এ-সময় নিজেকে বোঝা ও মূল্যায়ন করার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। বয়ঃসন্ধিকালের প্রক্ষোভমূলক আচরণ লক্ষণীয়। এ-সময় ভালোবাসা, স্নেহ, ঘৃণা, রাগ, ভয় ও দুশ্চিন্তার ভাব প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আত্মপ্রকাশ করে। দৈহিক পরিবর্তনের কারণে কিশোর-কিশোরীরা কখনো লজ্জিত বা কখনো আনন্দিত থাকে। এ-বয়সের কিশোর-কিশোরীরা কখনো আক্রমণাত্মক, কখনো মনমরা হয়ে থাকে। এসব আবেগ কখনো কখনো সংঘাতের রূপ নেয়। দৈহিক ও মানসিক পরিবর্তনের ফলে কিশোর-কিশোরীরা অনেক সময় অসহায় বোধ করে। কোনো কোনো সময় পরিবারের সদস্যদের বকাবকি ও নিপীড়নমূলক আচরণের কারণে এরা বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। হঠাৎ করে এরা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। অনেক সময় মা-বাবার আদেশ-উপদেশকেও গ্রাহ্য করতে চায় না। ফ্যাশন সচেতন হয়ে ওঠে। হঠাৎ করে রেগে যায়।
কখনো কখনো হতাশা কাটাতে মাদকদ্রব্য, ফেসবুক, ইন্টারনেট ও পর্নো ছবিতে আসক্ত হয়ে পড়ে। শুধু তাই না, এদের অনেকেই অনিরাপদ দৈহিক সম্পর্কেও জড়িয়ে পড়ে। ফলে পড়ালেখার চরম অবনতির পাশাপাশি পুরো জীবনটাই সমস্যাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। নানা কারণে আত্মহননের পথও বেছে নেয় কিশোর-কিশোরীরা। ডাব্লিউএইচও-র প্রতিবেদন অনুযায়ী, বয়ঃসন্ধিকালে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর কারণ প্রসবকালীন জটিলতা, আর তারপরই রয়েছে আত্মহত্যা। ভেঙে যায় একটি পরিবারের স্বপ্ন। ধ্বংস হয়ে যায় সম্ভাবনাময় একটি জীবন। ওদের সঙ্গে খবরদারি ও অহেতুক নজরদারি পরিহার করা দরকার। ওদের মতামতের গুরুত্ব দেয়া দরকার। জোর করে কোনোকিছু চাপিয়ে ভালো ফল আশা করা যায় না। অতিরিক্ত আদর ও শাসন দুটোই ক্ষতির কারণ।
জীবনের এতো গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায় ডাচ শিক্ষাব্যবস্থা কী করে এড়িয়ে যেতে পারে? তাই এরা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকম কর্মশালার আয়োজন করে। কখনো শুধু বাবা-মায়েদের জন্যে, কখন শুধু শিক্ষার্থীদের জন্যে; আবার কখনও একসাথে দু-পক্ষের জন্যেই। বিভিন্ন পারিবারিক, সামাজিক, মানসিক সমস্যায় সাহায্য দেয়ার জন্যে বিদ্যালয়ের মধ্যেই আলাদা বিভাগ আছে। সেই সাহায্য যথেষ্ট না হলে বিদ্যালয় থেকেই বিশেষজ্ঞের কাছে যাওয়া হয় এবং সাহায্য নেয়া হয়। একটি পরিপূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থা ঢালাওভাবে সাজাতে এবং দাঁড় করাতে গেলে যে কতো জিনিস হিসেবে রাখতে হয়, তা এদের দেখে শেখা যায়। গবেষণা আর উন্নতি এদের কর্মের প্রধান অংশ জুড়ে থাকে। আমি জানি, এ শিক্ষাব্যবস্থা এক দিনে এই জায়গায় এসে পৌঁছায়নি। ধীরে ধীরে সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে, সেগুলোকে না এড়িয়ে, অন্যের ঘাড়ের ওপর চাপিয়ে না দিয়ে, অন্যকে দোষারোপ না করে নিজে এর সমাধান নিয়ে ভেবে আজকে এ অবস্থানে এসে পৌঁছেছে। যদিও এখানেই এদের পথ চলা শেষ নয়। যত দিন যাবে, শেখানোর ধরন, কর্মশালা, পদ্ধতি এসব পাল্টাবে। আরও যুগোপযোগী আরও ফলপ্রসূ কী করে করা যায় সে চেষ্টা যত দিন পৃথিবী থাকবে, এদেরও থাকবে।
লেখক পরিচিতি
তানবীরা হোসেন শিক্ষা ও সমসাময়িক প্রসঙ্গ নিয়ে নিয়মিত লেখালেখি করছেন।