বাড়ি সেরা লেখা পুরস্কার ‘শুদ্ধস্বর-বাংলাদেশের শিক্ষা’ ত্রৈমাসিক সেরা লেখা পুরস্কার: এপ্রিল-জুন ২০১৩ প্রান্তিকের সেরা লেখা- ‘একটি...

‘শুদ্ধস্বর-বাংলাদেশের শিক্ষা’ ত্রৈমাসিক সেরা লেখা পুরস্কার: এপ্রিল-জুন ২০১৩ প্রান্তিকের সেরা লেখা- ‘একটি কুলীন শিক্ষাব্যবস্থা’

বাংলাদেশের শিক্ষা

প্রিয় পাঠক, আমরা আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি যে, ২০১৩ সালের এপ্রিল-জুন পর্যন্ত যেসব লেখা ‘বাংলাদেশের শিক্ষা’ ওয়েব সাইটে প্রকাশিত হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে ‘একটি কুলীন শিক্ষাব্যবস্থা’ লেখাটি ত্রৈমাসিক সেরা লেখা পুরস্কার হিসেবে বিচারকের কাছে সেরা লেখা হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে। লেখাটি তৈরি করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক নাসরীন সুলতানা মিতু। আর এপ্রিল-জুন ২০১৩ প্রান্তিকের বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ-এর বিভাগীয় শিক্ষা সমন্বয়ক আকলিমা শরমিন। লেখাটি মূল্যায়ন করতে গিয়ে তিনি বলেছেন:

এই প্রান্তিকে আমরা পেয়েছি অনেকগুলো সময়োপযোগী এবং বিষয়-সংশ্লিষ্ট লেখা, যেগুলো আমাদের চিন্তার খোরাক জোগায়। লেখাগুলো শিক্ষার বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা থেকে শুরু করে বাজেট, প্রযুক্তি, বিজ্ঞান শিক্ষা, মাল্টিমিডিয়া প্রেজেন্টেশন, মোবাইল লার্নিং ইত্যাদি নানা বিষয় উঠে এসেছে লেখাগুলোতে। প্রতিটি লেখায় আমরা বাংলাদেশের শিক্ষার নানামুখী দিকের আলোচনা দেখতে পাই। এই লেখাগুলো থেকে মানসম্মত লেখা নির্বাচন করা দুরুহ কাজ ছিলো। সবগুলো লেখা পড়ার পর ত্রৈমাসিক সেরা লেখা পুরস্কার হিসেবে নির্বাচিত করছি নাসরিন সুলতানা মিতুর লেখা ‘একটি কুলীন শিক্ষাব্যবস্থা’ লেখাটিকে। লেখককে আন্তরিক অভিনন্দন জানাচ্ছি।

এই লেখাটির মূল বক্তব্য যদি আমি আমার দৃষ্টিতে সংক্ষেপে উল্লেখ করতে চাই তাহলে পাবো, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ও সমাজব্যবস্থার দুটি বড় অসামাঞ্জস্যতা। যেহেতু শিক্ষাব্যবস্থা আর সমাজব্যবস্থা অঙ্গাঅঙ্গিকভাবে জড়িত, তাই একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটির কথা আমরা আলোচনা করতে পারি না। এই দুটি দিক হলো- চাকরিসর্বস্ব লেখাপড়া বা শিক্ষাব্যবস্থা এবং বিভেদগ্রস্থ শিক্ষাব্যবস্থা যার পরিপ্রেক্ষিতে তৈরি হচ্ছে সামাজিক বিভেদ। এটিকে আবার এমনভাবেও বলা যায়, সামাজিক বিভেদই আমাদেরকে ঠেলে দিচ্ছে বিভেদগ্রস্থ শিক্ষাব্যবস্থার দিকে।

স্বাধীনতার ৪০ বছর পরও আমরা পারিনি বৈষম্যহীন একটি একক শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে। যে শিক্ষাব্যবস্থা আমাদেরকে নিয়ে যাবে এক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের দিকে, আমাদের মধ্যে প্রজ্জ্বলিত করতে পারবে একরকম দেশাত্ববোধ, একরকম স্বাধীন চেতনা- যে চেতনা আমাদেরকে শুধু অতীতের স্মৃতি রোমন্থন না করিয়ে উৎসাহিত করবে সবাইকে নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার। উন্নয়নের ভাষায় আমরা যতোই বলি না কেন- শিক্ষা আমাদের অধিকার; কিন্তু বাস্তবিক চিত্র হলো শিক্ষা আজ পণ্য। যার আর্থিক সামর্থ্য যতো বেশি সে ততো ভালো পণ্য কিনতে পারবে। লেখকের লেখনীতে আমরা এই বৈষম্যের চিত্র অতি প্রকটভাবে উপলব্ধি করতে পারি। লেখকের প্রশ্ন “ভালো স্কুলের সংজ্ঞা কী?” এটি আজকে লেখকের মতো অনেকের কাছেই একটি বড় প্রশ্ন। ভালো স্কুল কি শুধু আমাদের ভালো চাকরি পেতে শেখানোর জন্য? বা সমাজের অন্য শ্রেণিকে অবেহেলার চোখে দেখার জন্য? বা নিজেদেরকে সমাজের অন্য সবার চেয়ে আলাদা করে উপস্থাপনের জন্য? এই বাস্তব দিকের প্রতি আমাদের দৃষ্টিপাত করতে হবে এখনই। লেখক খুব সুন্দরভাবে এই দিকগুলোর প্রতি নির্দেশ করছেন। আক্ষরিক অর্থেও এই বিভেদ আমাদের জন্য কোনো শুভ ফল বয়ে আনবে না। এই লেখার এই দিকটি অন্যতম বিবেচ্য একটি দিক।

লেখক বলেছেন, “একটি দেশের সার্বিক সমাজব্যবস্থায় অনেকগুলা সম্প্রদায় থাকে,অনেকগুলি ইউনিট থাকে; প্রত্যেকটা অংশের পারষ্পরিক মিথষ্ক্রিয়াতেই সমাজ এগিয়ে যায়। এখন আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার দিকে একটু তাকাই। শিক্ষা মানুষের সামাজিকীকরণের একটি বড় মাধ্যম। মানুষকে সমাজের উপযুক্ত করে গড়ে তোলা শিক্ষার একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। শৈশব থেকে যদি শুরু করি, সমাজের একটি অংশ হিসেবে তাকে গড়ে তুলতে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা কতটুকু কার্যকর? আমাদের দেশে একসময় স্কুলের স্বল্পতা থাকলেও এখন অন্তত শহরাঞ্চলে স্কুল আর দুষ্প্রাপ্য নয়। বরং ক্ষেত্রবিশেষে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি; মানের ব্যাপারে প্রশ্ন থাকলেও। এখন এমনকি আবাসিক এলাকাতেও বাচ্চাদের স্কুল দু-একটা থাকেই; তারপরেও কোনো এক রহস্যজনক কারণে আগের দিনের মতোই দুই-তিন ক্রোশ পথ পাড়ি দিয়ে পুরো শহরে যানযট বাঁধিয়ে বিশাল গন্ধমাদনের ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে স্কুলে যায় স্কুল্গামী শিশুরা। কারণ একটাই- ভালো স্কুলে পড়া! ”

দ্বিতীয়ত, এই লেখার যে দিকের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করবো তা হলো, শিক্ষাব্যবস্থার পৃথকীকরণ বা শিক্ষাব্যবস্থার প্রকারভেদ। এই প্রকারভেদ যে কতোটা প্রকট তা সাম্প্রতিক কালের কিছু ঘটনা থেকেই অনুধাবন করতে পারি। শিক্ষাব্যবস্থার দরুন আমাদের সমাজের সামাজিক বিভেদ কতটা জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছে তার স্পষ্ট বর্ণনা আমরা লেখকের বর্ণনাতেও পাই। আমাদের জীবনের সাথে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা অঙ্গাঅঙ্গিকভাবে জড়িত। এটা অতি সত্য কথা হলেও আমরা আমাদের আমি-কেন্দ্রিক চিন্তার বাইরে এসে ভাবতে পারছি না, পারছি না আমাদের সমামনা বা সমসাময়িক জনগোষ্ঠী ছাড়া অন্যান্য সবার কথা ভাবতে।

লেখকের মতে, “অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা সামাজিকভাবে মোটামুটি ‘হোমোজেনাস’,ফলে সমাজের অন্য ‘স্ট্যাটাসের’ সমবয়সীদের সান্নিধ্যে আসার সুযোগ তাদের কখনোই ঘটে না। নিজেদের ‘গোত্রের’ বাইরের কাউকে নিজের জায়গায় বসিয়ে চিন্তা করাটা তাই তাদের কাছে হয়ে দাঁড়ায় অসম্ভবের কাছাকাছি। বন্ধুর বাবাকে দেখলে সালাম দিয়ে দাঁড়িয়ে যাওয়া ভদ্র ছেলেটিও তাই একই বয়সী রিকশাওয়ালাকে নির্দ্বিধায় হাঁক দিয়ে বলে, ‘এই খালি যাবি?’ আমাদের শিক্ষা ‘অপ্রেসড’দের জন্য নয়। আমাদের শিক্ষা অর্থনৈতিক মানদণ্ডে নিচের সারির মানুষদেরকে তাদের আত্মমর্যাদার জায়গাটা দেখিয়ে দিতে ব্যর্থ; …

বাংলাদেশের নিম্নবিত্ত শ্রেণীর একটি বিশাল অংশের শিক্ষাদানের দায়িত্ব কাঁধে চাপিয়ে দেবার পরেও এই শিক্ষাব্যাবস্থার প্রতি আমাদের নীতিনির্ধাকদের যথাযথ মনোযোগ আকর্ষণ হয়নি কখনোই। বরং মধ্যযুগীয় কারিকুলামের কাঁধে ভর দিয়ে খুঁড়িয়ে চলা এই ব্যবস্থার প্রতি দেশের শিক্ষিত ‘এলিট’দের অবহেলা ও বিমাতাসুলভ সন্দেহপ্রবণ আচরণ তাদের ঠেলে দিয়েছে প্রতিদ্বন্দ্বীর ভুমিকায়। বড় বড় কথা বলা আমরা প্রগতিশীলরাও শিক্ষার এই ধারার প্রতি আন্তরিকতার প্রমাণ দিয়েছি এমন নজির বিরল। কুয়ার ব্যাং বলে প্রতিনিয়ত উপহাস করেছি কিন্তু কুয়া থেকে টেনে তোলার চেষ্টা করিনি কখনই। …

বর্তমানে দেশের রাজনীতির স্মরণকালের ভয়াবহতম টানাপোড়েনের সময় আমরা অভিযোগের তীর নির্দেশ করছি সেই জনগোষ্ঠীর প্রতি, যাদের আমরা নিয়ান্ডারথাল মানুষের থেকে বেশি সম্মান দিতে যাইনি কখনো।”

একইভাবে আমাদের সব ধরনের শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি আমরা পারি নি সমান মনযোগী হতে। লেখকের এই মতামতের সাথেও আমি সম্পূর্ণ একমত। বিমাতাসুলভ আচরণই আমরা করে এসেছি আমাদের নির্দিষ্ট কিছু শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি, এটি সর্বজনবিদিত। সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক ঘটনাবলী আমাদেরকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করবে। বর্তমান সময়ের এই পরিস্থিতি আমাদের যেমন কাম্য নয়; তেমনি আমরা এটাও আশা করি না যে, আমাদের অনাগত প্রজন্ম বিভেদগ্রস্থ শিক্ষাব্যবস্থাসম্বলিত সমাজে বড় হয়ে উঠুক। আমাদের অনাগত প্রজন্ম তার পাশের বাড়ির মাদ্রাসাপড়ুয়া ছাত্রের প্রতি সন্দেহ বা অবজ্ঞার চোখে নয়; সৌহার্দ ও সম্প্রীতির চোখে তাকাবে- এই আমাদের প্রত্যাশা। আমাদের নীতি-নির্ধারকেরা এই দুটি দিকের প্রতি আলোকপাত করবে এই আমাদের প্রত্যাশা।

বিচারক আকলিমা শরমিনের নির্বাচন অনুসারে এপ্রিল-জুন ২০১৩ প্রান্তিকে সেরা লেখার জন্য পুরস্কারের দাবিদার হলেন নাসরীন সুলতানা মিতু। লেখকে অভিনন্দন! আমরা আশা করবো, ভবিষ্যতে আপনার শক্তিশালী লেখনীর মাধ্যমে বাংলাদেশের শিক্ষাক্ষেত্রের এরকম নীতিগত বিষয়গুলো তুলে ধরবেন। খুব শিগগিরই আপনার ঠিকানায় পৌঁছে যাবে শুদ্ধস্বর থেকে প্রকাশিত ও আমাদের নির্বাচিত ৫০০ টাকা সমমানের অমূল্য উপহার- বই।

আমরা একইসঙ্গে ধন্যবাদ জানাতে চাই বিচারক আকলিমা শরমিনকেও যিনি তাঁর মূল্যবনা সময় বের করে প্রতিটি লেখা পড়েছেন এবং ত্রৈমাসিক সেরা লেখা পুরস্কার প্রদানের জন্য নির্বাচন করেছেন। পাশাপাশি তিনি সেরা লেখা নির্বাচনের যে চমৎকার ব্যাখ্যা দিয়েছেন, সেটি থেকেও আমরা উপলব্ধি করতে পারি যে, লেখক যে ভাবনার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন আমাদের পাঠকদের, বিচারক সেটিকে তাঁর নিজ উপলব্ধি থেকে মিলিয়ে পুরো বক্তব্যটিকে আরও শক্তিশালী করে তুলেছেন। বিচারকের প্রতি রইলো আমাদের কৃতজ্ঞতা।

নিচে পাঠকদের সুবিধার জন্য লেখকের বিস্তারিত পরিচয় তুলে ধরা হলো।

নাসরীন সুলতানা মিতু
নাসরীন সুলতানা মিতু

নাসরীন সুলতানা মিতু পেশায় শিক্ষক। বর্তমানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে প্রভাষক হিসেব কর্মরত আছেন। চাকরিসূত্রে বাস করছেন রাজশাহী শহরে। মিতু পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে; সে

খান থেকে অর্জন করেছেন স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি। বিজ্ঞান শিক্ষায় স্নাতক পর্ব শেষ করার পর স্নাতকোত্তর পর্বে বেছে নিয়েছেন বিজ্ঞান, গণিত ও প্রযুক্তি শিক্ষা বিভাগ। ভবিষ্যতে বাংলাদেশের মাধ্যমিক পর্যায়ে বিজ্ঞান শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখতে আগ্রহী এই তরুণ। ছেলেমেয়েদের বিজ্ঞান বিষয়ে আগ্রহী করে তুলতে অনুসন্ধিৎসু বিজ্ঞানশিক্ষক আবশ্যক, সেই লক্ষ্যেও কাজ করার ইচ্ছা আছে তাঁর।

শিক্ষকতার পাশাপাশি মিতুর অন্য পরিচয়টা হলো তিনি একজন কার্টুনিস্ট। উন্মাদ পত্রিকার সাথে যুক্ত ২০০৬ সাল থেকে। এছাড়া দৈনিক পত্রিকাতেও কাজ করেছেন নিয়মিত বা অনিয়মিতভাবে। নিজের ভালোলাগার পাশাপাশি কার্টুন আঁকাটা তাঁর কাছে সামাজিক দায়বদ্ধতার একটি অংশ। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন এডুকেশনাল ম্যাটেরিয়াল ও ট্রেনিং মডিউলে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। তবে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড প্রণীত ২০১৩ সাল থেকে চালু হওয়া মাধ্যমিক পর্যায়ের পাঠ্যপুস্তকে ইলাস্ট্রেশনের কাজ করেছেন তিনি, যেটাকে তিনি তাঁর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ বলে মনে করেন।

ইআমাদের এই উদ্যোগ বা পুরস্কার সম্পর্কে আপনাদের কোনো প্রশ্ন, মতামত বা পরামর্শ থাকলে এখানে জানাতে পারেন। আশা করছি, এই উদ্যোগের প্রতিটি পর্যায়ে আপনাদেরকে আমরা সাথে পাবো। ধন্যবাদ।

কোন মন্তব্য নেই

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Exit mobile version