একটি জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে যে বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির কোনো বিকল্প নেই, তা ইতিহাস আমাদের বারবার শিক্ষা দিয়েছে। পৃথিবীকে বসবাসের উপযুক্ত করে তুলতে আমাদের চারপাশের পরিবেশ নিয়ে কৌতুহলের শুরু তো বহু দিন আগেই। এই কৌতুহল থেকেই জন্ম নিয়েছে প্রযুক্তি, যা আজ আমরা ব্যবহার করছি। এই প্রযুক্তিই পেরেছে পুরো বিশ্বকে একত্রিত করতে। যদিও ইতিহাস সাক্ষী যে, সকল প্রযুক্তির ফলাফল ইতিবাচক হয়নি মানব জাতির জন্য। কিন্তু এই নেতিবাচক ফলাফলকে উল্টোরথে ঘুরিয়ে ইতিবাচক দিকেই পরিচালিত করার প্রয়াস করা যেতে পারে। একই সাথে একটি জাতিকে বৈজ্ঞানিকভাবে সাক্ষর করে তুললে ভবিষ্যতের প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে টিকে থাকার ক্ষেত্রেও একটা সহজ সুযোগ তৈরি করতে পারে একটি জাতি।
যে জাতি বিজ্ঞান শিক্ষাকে গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করতে শেখে, সে জাতিই ভবিষ্যতের দিক পরিচালনার ক্ষেত্রে অগ্রগামী ভূমিকা রাখে। কিন্তু বিজ্ঞান শিক্ষণ সহজ কাজ নয়। একজন সার্থক বিজ্ঞান-শিক্ষক শিক্ষণের ক্ষেত্রে দুটি দিক স্পষ্ট করেন। এক, বিজ্ঞান শিখনের ক্ষেত্রে প্রেষণা প্রদান। দুই, বিজ্ঞানের জটিল বিষয়কে সহজভাবে উপস্থাপন। এই দুটি বিষয় একটি অপরটির সঙ্গে জড়িত। বিজ্ঞানের জটিল বিষয়কে সহজভাবে উপস্থাপন করতে না পারলে শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞান শিক্ষণের ক্ষেত্রে প্রেষনা অনুভব করবে না। আবার বিজ্ঞান শিক্ষণের ক্ষেত্রে প্রেষণা প্রদান না করলে বিজ্ঞান শিখনের প্রতি আগ্রহ তৈরি হবে না। এই সমস্যার সমাধান হলো, বিজ্ঞান শিক্ষণের কৌশল সম্পর্কে জানা অর্থাৎ আর্ট অফ সাইন্স টিচিং সম্পর্কে ধারণা লাভ করা।
একেক জন শিক্ষার্থী একেকভাবে শেখে। দেখে, শুনে, অনুভব করে। প্রকৃতপক্ষে আমরা সকলেই শিখনের ক্ষেত্রে আমাদের সেন্স অর্গান ব্যবহার করি। কোন সেন্স আর্গান কার জন্য বেশি কার্যকর হবে সেটা নির্ভর করে ব্যক্তিবিশেষের ওপর। কিন্তু এমন যদি হয় যে, যে বিষয়টি সম্পর্কে আমরা জানব সেটা এত ক্ষুদ্র যে চোখে দেখা যায় না, এত ক্ষীণ যে যার শব্দ আমাদের কান পর্যন্ত পৌঁছায় না, আর এত দূরে যে আমরা স্পর্শ করতে পারি না- সেক্ষেত্রে কী করা যেতে পারে? এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের কল্পনাশক্তিকে জাগ্রত করতে হবে। এ কাজটি একজন ভালো বিজ্ঞান-শিক্ষক সার্থকভাবে করতে পারেন। একজন শিক্ষক যখন একটি জটিল বিষয়কে শিক্ষার্থীদের সম্মুখে উপস্থাপন করেন, তখন শিক্ষার্থীরা তাদের কল্পনায় এর একটি মডেল তৈরি করে। এই মডেলটি কতো সার্থকভাবে তৈরি হবে তা নির্ভর করবে শিক্ষকের শিক্ষণ পদ্ধতি এবং শিক্ষার্থীর কল্পনাশক্তির ওপর। এটা কিন্তু সত্যি যে, একটি ফোর ডাইমেনশনকে শিক্ষার্থীর সামনে উপস্থাপন করা খুব সহজ কাজ নয়। তারপরও একজন ভালো বিজ্ঞান শিক্ষক সবসময়ই একজন শিক্ষার্থীর বোধগম্যতার কাছাকাছি যেতে চেষ্টা করেন।
বিজ্ঞান শেখানোটা একটি ম্যাজিকের মতন। এটি ঠিক মতো দেখাতে পারলে শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞানশিক্ষা সম্পর্কে রোমাঞ্চিত হয়। শিক্ষার্থীদের মনে প্রশ্ন তৈরি হয়, কেন, কী জন্য এমনটি হলো? এই কৌতুহল তৈরির কাজটি করেন একজন শিক্ষক। আর এটিই হলো বিজ্ঞান- কোনো ঘটনা সম্পর্কে কৌতুহলী করে তোলা এবং অজানা প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য সঠিক পদ্ধতির অনুসন্ধান। ধরা যাক, আমরা magnetism সম্পর্কে জানাতে চাই। সেক্ষেত্রে ফ্রিজের দরজা একটি ভালো উদাহরন হতে পারে শুরু করার জন্য। আসলে বাস্তব জীবনের সঙ্গে জ্ঞানের সম্পৃক্ততা দেখাতে না পারলে শিক্ষার্থীদের দিয়ে বিষয়টি আত্মস্থ করানো মুশকিল। বিজ্ঞানের বিষয়গুলোকে যদি ম্যাজিকের মতো উপস্থাপন করানো যায়, তবে শিক্ষার্থীরা স্বতঃস্ফূর্ত হয়েই এর ব্যাখ্যা জানতে চাইবে। বিজ্ঞানকে মজা করে চমক সৃষ্টির মাধ্যমে উপস্থাপন করতে হবে। তবেই শিক্ষার্থীর শিখন বাস্তব এবং প্রয়োগমুখী হয়ে উঠবে।
একজন শিক্ষকের আরেকটি দায়িত্ব হলো শিক্ষার্থীদের বৈজ্ঞানিকভাবে সাক্ষর করে তোলা। বৈজ্ঞানিকভাবে সাক্ষর একজন ব্যক্তি তার চারপাশের প্রকৃতি ও পরিবেশকে বুঝতে বা জানতে আগ্রহী হবেন; অন্য কারো দাবি করা বিষয়/বক্তব্য খোলামনে শোনেন, তার সম্পর্কে প্রশ্ন করেন এবং যাচাই করার পরে তা গ্রহণ বা বর্জন করেন; তার চারপাশের পরিবেশ নিজের ও পরিবারের সদস্যের স্বাস্থ্য ও ভালো-মন্দের ব্যাপারে সচেতন/জ্ঞাত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন; বিজ্ঞান-সম্পর্কিত ইস্যু বা বিষয়ে আলোচনায় অংশ নিতে সক্ষম হবেন; কোনো একটি সমস্যা শনাক্ত করে অনুসন্ধানের মাধ্যমে ত্য-প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নেন।
বিজ্ঞানের বিষয়বস্তু উপস্থাপনে শিক্ষকে current events-এর প্রতি গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। এর ফলে শিক্ষার্থীরা দুটো সুবিধা পাবে। এক, পাঠ্য বইয়ের সাথে বাস্তব জীবনের সম্পৃক্ততা। দুই, এটি তাদের বৈজ্ঞানিকভাবে সাক্ষর করে তুলতে সাহায্য করবে যার ফলে তারা কোনো ঘটানাকে ব্যাখ্যা করার যোগ্যতা অর্জন করবে।
বিজ্ঞান শিক্ষা দেয়া সহজ নয়। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে আরও বেশি কঠিন। এখানে বিজ্ঞান বিষয় পড়ানোর জন্য বিজ্ঞান শিক্ষায় ডিগ্রি অর্জনধারীর সন্ধান পাওয়া কঠিন। এছাড়াও অনেক শিক্ষকই সঠিকভাবে বিজ্ঞান শিক্ষা দিতে পারেন না। আমাদের দেশে শিক্ষকবৃন্দ বিএড এবং এমএড ডিগ্রি নিতে আগ্রহী হন প্রমোশনের খাতিরে। অন্ততপক্ষে বেশিরভাগ শিক্ষকই তেমনটিই করেন। এই ধরনের ধারণা থেকে বেরিয়ে আসা প্রয়োজন। শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে একটি ন্যূন্তম মুল্যবোধ গঠন না করতে পারলে শিক্ষক হওয়া থেকে বিরত থাকাই ভালো। যার নাই কোনো গতি, তাই করি শিক্ষকতা আর মেয়েদের জন্য এটা নিরাপদ চাকুরি- এসব ভেবে শিক্ষক না হওয়াই ভালো। এরা শিক্ষার্থীদের জীবন নষ্ট তো করেনই, জাতির উন্নয়নকেও স্লথ করে দেন। কাজেই দেশের কথা ভাবুন। মনে রাখবেন, আপনারই মতো হয়তো বা এমনই একজন শিক্ষক আপনার নিজের সন্তানকে শিক্ষা দিচ্ছে। নিজেরাই নিজেদের ভালো ভবিষ্যতের কথা ভেবে এগিয়ে না আসলে সামনে এগিয়ে গিয়ে দেখতে হবে অনুজ্জল ধু ধু প্রান্তর। আর বিজ্ঞান শিক্ষা একটি জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যাবার একটা মাধ্যম। এই মাধ্যমকে এত খেলো করে দেখলে চলে কি? নীতির কথা আমরা সবাই জানি। কিন্তু এগুলো মানি ক’জন? এই মানাটাই তো চাই। আপনারাসহ আরও সব শিক্ষকদের সহযোগিতা পেলে আমাদের এই খোঁড়া দেশটির মধ্যে যে সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে তা বের করে নিয়ে আশা কি খুব কঠিন? উন্নয়নশীল শব্দটাকে চলুন সকলে মিলে হটিয়ে দেই। চলুন একটা সুশিক্ষত আদর্শ বৈজ্ঞানিকভাবে সাক্ষর জাতি গড়ে তুলি।
লেখক পরিচিতি
ফারহানা মান্নান লেখক, শিল্পী, শিক্ষা-গবেষক। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাগবেষণায় স্নাতকোত্তর পর্যায়ে অধ্যয়নরত।