বাড়ি নেতৃত্ব ও দক্ষতা শারীরিক শাস্তি বা শাসন : শিক্ষকের হাতের বেতই কি তবে সমাধান?

শারীরিক শাস্তি বা শাসন : শিক্ষকের হাতের বেতই কি তবে সমাধান?

শারীরিক শাস্তি বা শাসনের পরিবর্তে মনোবৈজ্ঞানিক পদ্ধতি এবং নৈতিক শিক্ষার ওপর জোর দেওয়াই হলো আজকের সমাজের জন্য জরুরি সমাধান। ছবিসূত্র: উইকিমিডিয়া কমন্স
শারীরিক শাস্তি বা শাসনের পরিবর্তে মনোবৈজ্ঞানিক পদ্ধতি এবং নৈতিক শিক্ষার ওপর জোর দেওয়াই হলো আজকের সমাজের জন্য জরুরি সমাধান। ছবিসূত্র: উইকিমিডিয়া কমন্স

দেশের তরুণ সমাজের বিপথে পরিচালিত হবার পেছনে একটি বড় কারণ হিসেবে দেশের একটি বড় অংশ মানুষ শিক্ষকের শ্রেণিকক্ষে বেতের ব্যবহার তথা শারীরিক শাস্তি বা শিক্ষকের হাতে বেতের অভাবকেই দায়ী করেন।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হরহামেশাই দেখা যায় শিক্ষার্থী কর্তৃক সংঘটিত নানারকম কিশোর অপরাধের খবর। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এসব অপরাধগুলোর মধ্যে অপমান, মারধর, শারীরিক লাঞ্ছনা থেকে শুরু করে ক্ষেত্রবিশেষে হত্যাকাণ্ড পর্যন্তও ঘটতে দেখা যায়। দেশের তরুণ সমাজের বিপথগামীতা কিংবা অপরাধপ্রবণতার পেছনে শারীরিক শাস্তির অভাবই একমাত্র কারণ? নাকি এর পেছনে আরো কিছু রয়েছে?

শিক্ষকের সম্মান একাল-সেকাল

একটা সময় ছিলো যখন রাস্তা দিয়ে শিক্ষক হেঁটে গেলে আশেপাশের মানুষজন সম্মানার্থে সাবধান হয়ে যেতো। কোনো আচার-আচরণে শিক্ষক যেন কষ্ট না পান, বা তাঁকে যেন কোনো ধরনের অসম্মান করা না হয় তা নিয়ে তার শিক্ষার্থীরা তটস্থ থাকতেন।

শিক্ষকের সামনে দিয়ে সাইকেল চড়ে গেলে নেমে তাকে সালাম/আদাব বলে শ্রদ্ধা জানিয়ে তারপর শিক্ষার্থী তাঁর সামনে থেকে নিজ গন্তব্যে ছুটতেন। বলা বাহুল্য, যেকোনো সামাজিক প্রেক্ষাপটে নির্ভরযোগ্য পরামর্শ কিংবা মতামতের জন্য সমাজের আস্থাভাজন ব্যক্তি ছিলেন “শিক্ষক”।

শিক্ষাগত যোগ্যতা হয়তো আজকের দিনের তুলনায় একেবারেই নগণ্যই বলা যেতে পারে কিন্তু তখনকার সময়ে তাঁরা ছিলেন যথেষ্ট। শিক্ষককে তাঁর শিক্ষার্থীরা প্রচণ্ড পরিমাণ ভয় পেতেন, সাথে প্রচণ্ড শ্রদ্ধাও করতেন। ভয় ও শ্রদ্ধার মিশেলে শিক্ষক ছিলেন সমাজের অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ মানুষ। 

তবে দিন বদলেছে। সময়ের পরিক্রমায় শিক্ষকের মর্যাদা বেড়েছে নাকি কমেছে কিংবা কতটুকু বেড়েছে বা কমেছে তা সঠিকভাবে নিরূপণে গবেষণার দাবিদার। তবে, খোলা চোখে দেখতে গেলে শিক্ষকের সম্মান মর্যাদা যে আর সেই আগের মাত্রায় নেই তা বললে হয়তো খুব বেশি ভুল হবে না।

পত্রিকায় পাতায় চোখ বুলালে কিংবা হালের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নজর রাখলে হরহামেশাই শিক্ষকদের হেনস্তার খবর লাঞ্ছনার খবরের দেখা মেলে। বেশ কয়েক বছর আগে দেশের স্বনামধন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রথিতযশা এবং সর্বজন শ্রদ্বেয় অধ্যাপককে নিজের জমিজমা-সংক্রান্ত জটিলতায় অসহায়ের মতো আচরণ করতে দেখেছি। এটি নিশ্চয়ই আমাদের জন্য লজ্জার।

রাস্তাঘাটে দেখা হলেও শিক্ষক ঠিক আগের মতো সামাজিক মর্যাদার অধিকারী হন কি না তা হয়তো পাঠক অস্বীকার করতে পারবেন না। ক্লাসে শিক্ষককে শারীরিক-মানসিক লাঞ্ছনা, এমনকি শিক্ষার্থীর হাতে খুন হওয়ার মতো ঘটনাও ঘটে চলছে হরহামেশাই।

আর সমাজের আগের দিনের মতো পরামর্শ কিংবা মতামতের জন্য হোক কিংবা অন্য কিছু হোক, তিনি যে আর আগের মতো শ্রদ্ধার পাত্র নন তা পাঠকমাত্রই স্বীকার করবেন।

শিক্ষক কাঠগড়ায়ে দাঁড় করানো

বর্তমান সময়ে যেকোনো সময়ের চেয়ে যে পুরো বিশ্বে অরাজকতা, অস্থিতিশীলতা বেড়ে গেছে সেটা বললে হয়তে খুব বেশি ভুল হবে না। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, ইন্টারনেট এবং ডিভাইসের সহজলভ্যতাও নানানধরনের অপরাধের সৃষ্টি করছে। বাড়ছে কিশোর অপরাধ, নৈতিকতা স্খলনসহ নানাবিধ সমস্যার।

বলা হয়ে থাকে, শিক্ষক সমাজ যদি তার শিক্ষার্থীদের মধ্যে নৈতিকতার পরিপূর্ণ শিক্ষা দিতে পারতেন, তাহলেই কিন্তু দেশের দুর্নীতি, অনাচার উল্লেখযোগ্য হারে কমে যেতো। কিন্তু, সামাজিক বিশৃঙ্খলা কিংবা নৈরাজ্যের পেছনের মূল জায়গাগুলোকে কি আমরা উপলব্ধি করতে পেরেছি?

উত্তর হচ্ছে, ‘না’! সমাজের এরূপ অবস্থার জন্য শিক্ষকের শারীরিক শাস্তি বা এরকম কোনো বিষয়কে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর পূর্বে বেশকিছু আলোচনা জরুরি। এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা জন্য দেখতে পারেন: মানুষের দুর্নীতিবাজ হওয়ার পেছনে শিক্ষকের দায় কতটা?

যেকোনো সমাজিক বিশৃঙ্খলার দায়ে শিক্ষককে কিংবা শিক্ষকের হাত থেকে বেত কেড়ে নেওয়াকে বা শারীরিক শাস্তির অভাবকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর আগে মূল কারণগুলো অন্বেষণ করতে হবে। শ্রেণিকক্ষে বেতের ব্যবহার বা শারীরিক শাস্তির ব্যবস্থা থাকলেই যে সকল সমস্যার সমাধান হয়ে যেতো, সেটি ভাবলে নিতান্তই ছেলেমানুষী হবে।

সমাজের বিপথগামীতা রোধে কিংবা বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্য রোধে আসলে পুরো সমাজটারই সংস্কারের প্রয়োজন। প্রয়োজন সমাজের বিভিন্ন নিয়মনীতিকে ঢেলে সাজিয়ে নতুন সমাজ বিনির্মাণের। সামাজিক সংস্কার সাধন না করে শিক্ষকের হাতে বেত কেন, তলোয়ার কিংবা কামান তুলে দিলেও যে সমস্যার সমাধান হবে না সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।

সমাজে কিশোর অপরাধ কেন বাড়ছে? তাতে শিক্ষাব্যবস্থা কি দায় এড়াতে পারে?

সমাজে কিশোর অপরাধের বৃদ্ধি এমন একটি জটিল সমস্যা, যার পেছনে নানাধরণের সামাজিক, পারিবারিক ও অর্থনৈতিক কারণ রয়েছে। তবে শিক্ষাব্যবস্থাও এর থেকে দায় এড়াতে পারে না। শিক্ষাব্যবস্থা যদি ফলাফলকেন্দ্রিক হয়ে শুধু পরীক্ষার ফলাফলের ওপর গুরুত্ব দেয় এবং শিক্ষার্থীদের নৈতিক ও সামাজিক শিক্ষা প্রদান করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে তারা সঠিক ও ভুলের পার্থক্য বুঝতে পারে না।

এছাড়া, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে যদি শুধু শারীরিক শাস্তি ব্যবহৃত হয়, তবে তা শিক্ষার্থীদের মধ্যে আক্রোশ ও বিদ্রোহের মনোভাব তৈরি করে। মনোবৈজ্ঞানিক পদ্ধতির অভাবও শিক্ষার্থীদের মধ্যে সহমর্মিতা ও দায়িত্ববোধ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়, যা কিশোর অপরাধ বৃদ্ধির একটি প্রধান কারণ হতে পারে।

তাই, শিক্ষাব্যবস্থার উচিত শুধু পাঠ্যপুস্তকের জ্ঞান নয়, বরং শিক্ষার্থীদের মধ্যে নৈতিক মূল্যবোধ, সামাজিক দায়িত্ববোধ এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের গুণাবলী গড়ে তোলা, যাতে তারা সঠিক পথে পরিচালিত হতে পারে। সমাজ ও শিক্ষাব্যবস্থার সম্মিলিত উদ্যোগের অভাব, এবং শিক্ষার্থীদের মানসিক ও সামাজিক বিকাশে যথাযথ মনোযোগ না দেওয়াই মূলত কিশোর অপরাধ বৃদ্ধির পেছনে বড় কারণ হিসেবে কাজ করছে।

শারীরিক শাস্তি : কেন ‘না’ বলা দরকার?

শারীরিক শাস্তি বা শাসনকে ‘না’ বলার পেছনে দার্শনিক ও মনোবৈজ্ঞানিক উভয় দৃষ্টিকোণ থেকেই যৌক্তিক কারণ রয়েছে। দার্শনিকভাবে, শারীরিক শাস্তি বা শাসন শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, যেখানে শিক্ষার্থীদের মধ্যে নৈতিক মূল্যবোধ, স্বাধীন চিন্তা, এবং সৃজনশীলতার বিকাশ হওয়া উচিত।

শারীরিক শাস্তি শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভীতি এবং বিদ্বেষের জন্ম দেয়, যা তাদের মনোজগতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং ব্যক্তিত্বের পূর্ণ বিকাশে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। মনোবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে, শারীরিক শাস্তি বা শাসন শিক্ষার্থীদের আত্মমর্যাদাবোধ কমিয়ে দেয়, তাদের মধ্যে আক্রোশ ও বিদ্রোহের মনোভাব সৃষ্টি করে, এবং সম্পর্কের দুর্বলতা তৈরি করে।

এসব প্রভাব শিক্ষার্থীদের আচরণে দীর্ঘমেয়াদী সমস্যা তৈরি করতে পারে, যা ভবিষ্যতে তাদের সামাজিক ও মানসিক বিকাশকে ব্যাহত করে। শারীরিক শাস্তি বা শাসন কেবল মানসিক ও ব্যক্তিত্বের বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে না, এটি শিক্ষার্থীদের শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্যও ঝুঁকিপূর্ণ। শারীরিক শাস্তি বা শাসন থেকে আঘাতের সম্ভাবনা থাকে, যা শিক্ষার্থীদের শরীরে দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতির কারণ হতে পারে।

তাই, শিক্ষকদের হাত থেকে বেত সরিয়ে নেওয়ার বদলে, শিক্ষার্থীদের সঠিক পথে পরিচালিত করতে সমাজের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব আরও বাড়ানো প্রয়োজন, যেখানে মনোবৈজ্ঞানিক পদ্ধতি এবং নৈতিক শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হবে।

শারীরিক শাস্তি ও শাসন : প্রচলিত আইন ও নীতিমালা এ নিয়ে কী বলে?

উচ্চ আদালত ২০১১ সালে শারীরিক শাস্তি ও মানসিক শাস্তিকে নিষিদ্ধ করে রায় দেন। পরে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আইনসেলও গত ২১ এপ্রিল ২০১১ তারিখে “শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র-ছাত্রীদের শারীরিক ও মানসিক শাস্তি রহিত করা সংক্রান্ত নীতিমালা-২০১১” শীর্ষক একটি পরিপত্র জারি করে।

এর মাধ্যমে প্রাথমিক, মাধ্যমিক উচ্চশিক্ষাসহ সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শারীরিক শাস্তি এবং মানসিক শাস্তি প্রদানকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়েছে এবং এধরণের অপরাধের জন্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে। পাশাপাশি ফৌজদারী আইনে মামলা দায়ের করা যাবে।

এ তো গেলো সরাসরি শারীরিক শাস্তি ও মানসিক শাস্তি  নিষিদ্ধ সংক্রান্ত নীতিমালা। শিশু আইন ২০১৩’র ৭০ নম্বর অনুচ্ছেদে শিশুকে আঘাত বা অবহেলাসহ মানসিক বিকৃতির শিকার হলে তাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলা হয়েছে যা লঙ্ঘিত হলে অনধিক ৫ (পাঁচ) বছরের কারাদণ্ড অথবা অনধিক ১ (এক) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড- অথবা উভয় দণ্ডের আইন রয়েছে।

আবার টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) ১৬তম অভীষ্ট “শান্তি, ন্যায়বিচার ও কার্যকর প্রতিষ্ঠান” এর ১৬.২ নম্বর লক্ষ্যে সব রাষ্ট্র অঙ্গীকার করেছে যে ২০৩০ সালের মধ্যে শিশুদের সব ধরনের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন মুক্ত একটা পরিবেশ দেব।

অন্যদিকে, জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ, ১৯৮৯’র ১৯-১ অনুযায়ী শিশুকে আঘাত বা অত্যাচার, অবহেলা বা অমনোযোগী আচরণ, দুর্ব্যবহার বা শোষণ এবং যৌন অত্যাচারসহ সব রকমের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন থেকে রক্ষার জন্য যথাযথ আইনানুগ, প্রশাসনিক, সামাজিক এবং শিক্ষাগত ব্যবস্থার দায়ভার দেওয়া হয়েছে সরকারকে।

এ বিষয়ে আরো বেশকিছু জাতীয় এবং আর্ন্তজাতিক আইন ও নীতিমালা রয়েছে যা মূলত শিশুকে সকল প্রকার নির্যাতন থেকে সুরক্ষিত রাখার কথা বলে। সুতরাং প্রচলিত আইন ও নীতিমালা অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের প্রতি শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন সুস্পষ্ট অপরাধ।

মনোবৈজ্ঞানিক শাসনের প্রচলন

শারীরিক শাসনের বদলে মনোবৈজ্ঞানিক শাস্তির প্রচলন শিক্ষার্থীদের মানসিক ও নৈতিক বিকাশে গভীরভাবে প্রভাব ফেলে। শারীরিক শাস্তি বা শাসন শিক্ষার্থীদের মধ্যে এমন একটি অবস্থার সৃষ্টি করে, যা তাদের মানসিক বিকাশকে ব্যাহত করে। এর বিপরীতে, মনোবৈজ্ঞানিক শাস্তির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের আচরণ ইতিবাচকভাবে পরিবর্তন করা যায়।

যেমন, ক্লাসে বিশৃঙ্খলা করা শিক্ষার্থীকে শাস্তি না দিয়ে, তার আচরণের নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে সচেতন করা যেতে পারে, যাতে সে নিজের ভুল বুঝতে পারে। দায়িত্ববোধ শেখাতে, অমনোযোগী শিক্ষার্থীকে একটি বিশেষ দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে, যা তাকে কাজের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে সহায়তা করে।

সহপাঠীর সাথে খারাপ আচরণের ক্ষেত্রে, তাদের একসঙ্গে বসিয়ে আলোচনা করার সুযোগ দেওয়া যেতে পারে, যা সহমর্মিতা ও সম্পর্ক উন্নয়নের দক্ষতা গড়ে তোলে। এই পদ্ধতিগুলো শিক্ষার্থীদের আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদা বৃদ্ধি করে, যা তাদের ভবিষ্যতের জন্য আরও ভালোভাবে প্রস্তুত করে এবং শিক্ষার মূল লক্ষ্য—সম্পূর্ণ ব্যক্তিত্বের বিকাশ—বাস্তবায়নে সহায়তা করে।

দায়টা তাহলে কার?

সামাজিক বিশৃঙ্খলা কিংবা নৈরাজ্যের পেছনে মূলত দায়ী কে? সেটার জন্য কেবল শিক্ষককে কিংবা শিক্ষকের বেতের ব্যবহার বন্ধের ঘটনাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করালেই হবে না। বরং আমি আপনার মতো সাধারণ মানুষও এর দায় এড়াতে পারে না।

মূলত সামাজিক বিশৃঙ্খলার সাথে সামাজিক প্রতিষ্ঠান, সমাজের সকল উপাদান অতঃপ্রতঃভাবে জড়িত। তাই যদি কাউকে দায়ী করতেই হয় তাহলে সমাজের প্রতিটি উপাদানকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে।

এই ঘটনাকে  হয়তো দারুণভাবে ব্যাখ্যা করা যায় রাশিয়ান বংশোদ্ভূত মার্কিন মনোবিজ্ঞানী ব্রনফেনব্রেনারের ইকোলজিক্যাল তত্ত্বের আলোকে। সহজভাবে বলতে গেলে তিনি মূলত দেখানোর চেষ্টা করেছেন কোন একটি শিশুর বিকাশে ঠিক কী কী জিনিস ভূমিকা রাখে এবল সেটা পরিবারের গণ্ডি থেকে সমাজ, সামাজিক কাঠামো ছাপিয়ে রাষ্ট্রীয় বিশ্বাস, মূল্যবোধ, নিয়মনীতি, অর্থনৈতিক অবস্থা ইত্যাদি কিছুই বাদ পড়ে না।

তাই ওই নিরিখে দেখলে সামজিক বিশৃঙ্খলা কিংবা নৈরাজ্যের দায় কিন্তু সমাজ বা রাষ্ট্রের কোনো উপাদানই এড়াতে পারে না!

সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো দায় এড়াতে পারে?

সামাজিক প্রতিষ্ঠান বলতে সমাজের প্রয়োজনে সৃষ্টি নানাবিধ প্রতিষ্ঠান যার মধ্যে গুরুত্ব বিবেচনায় সম্ভবত বিদ্যালয়ই সবচেয়ে বড় ভূমিকায় থাকে। তবে সবচেয়ে পরিচিত এবং কার্যকরী সামাজিক সংগঠনের মধ্য পড়ে পরিবার। পরবর্তীতে আসে বিভিন্ন ক্লাব, রাজনৈতিক সংগঠন, সাংস্কৃতিক সংগঠন, ক্রীড়া সংগঠন, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান তথা সমাজের মধ্যে থাকা প্রতিষ্ঠানের নাম।

একেকটি প্রতিষ্ঠান স্ব-স্ব দায়িত্ব নিয়ে প্রতিষ্ঠিত এবং চলমান থাকে। এসব প্রতিষ্ঠানের মূল দায়িত্ব বলতে গেলে মোটাদাগে সমাজের কোনো ব্যক্তিকে ওই সমাজের নিরিখে সামাজিকীকরণ ঘটানো, সামাজিক নৈতিকতা, মূল্যবোধের বিকাশ ঘটানো।

তাই সামাজিক বিশৃঙ্খলা কিংবা নৈরাজ্যের পেছনে শিক্ষকের বেতের বাড়ির আগে সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোকেও কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পারেন!

আমাদের ভাবনার ভূলটা কোথায়?

শারীরিক শাস্তি বা শাসন নিয়ে সারাবিশ্বে নানাবিধ গবেষণা রয়েছে। আলোচনা সুবিধার্থে একটি গবেষণার ফলাফল নিয়েই এই অংশের আলোচনা শুরু করা যেতে পারে।

১৯৮৩ সালে রিচার্ড এ ডুবানোস্কি, মিশেল ইনাবা এবং কেন্ট জারকিউজ নামক গবেষকবৃন্দ বিদ্যালয়ে শারীরিক শাসনের ভ্রান্ত ধারণা, সমস্যা এবং বিকল্প শীর্ষক একটি গবেষণা করেন। উক্ত গবেষকবৃন্দ শারীরিক শাস্তি বা শাসনের ক্ষেত্রে ৩টি ফ্যাক্টর চিহ্নিত করেন। এক. শারীরিক শাস্তি বা শাসনের কার্যকারিতা সম্পর্কে মানুষ অগাধ বিশ্বাস, দুই. শারীরিক শাসনের ফলে কী কী সমস্যা হতে পারে তা নিয়ে উদাসীনতা, এবং ৩. বিদ্যালয়ের নিয়ম শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের বিকল্প উপায় সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞানের অভাব।

গবেষণাটি বেশ পুরোনা হলেও মূল লেখাটির পেছনের ঘটনাকে খুব সহজেই এই তিনটি ফ্যাক্টরের আলোকে ব্যাখা করা যায় এবং বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিংবা বিভিন্ন আলোচনায় সামাজিক বিশৃঙ্খলায় যারা কেবল শারীরিক শাসনের অভাবকেই দায়ী করেন তার কারণ ব্যাখ্যা করা যায়।

প্রথমত, আমাদের অধিকাংশ মানুষজনই শারীরিক শাসনকে অগাধ গুরুত্বপূর্ণ বলে ভাবেন যদিও কার্যত শারীরিক শাসনের ফলে কী কী ক্ষতিকর প্রভাবের সৃষ্টি হতে পারে তা নিয়ে যথাযথ ধারণা রাখেন না এবং সর্বশেষ শারীরিক শাসনের বাইরেও যে কোনো বিকল্প উপায় আছে তা নিয়েই অধিকাংশজনের জানাশোনার সীমাবদ্ধতা রয়েছে।

ফলে সকল সমস্যার পেছনের কারণ শিক্ষকের হাতের বেত তুলে দেওয়া নয় কিংবা শিক্ষকের বেত ফিরিয়ে দিলে সকল সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে ব্যাপারটি তেমনও নয়।

দরকার সম্মিলিত প্রয়াস

সমাজে কিশোর অপরাধের বৃদ্ধি, শিক্ষাব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা, এবং শারীরিক শাসনের প্রভাবগুলো একসাথে বিবেচনা করলে বোঝা যায় যে, কেবল শিক্ষকের বেত দিয়ে সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। সমাজের প্রতিটি উপাদান, বিশেষ করে পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্মিলিত দায়িত্ব পালন জরুরি।

শারীরিক শাস্তি বা শাসনের পরিবর্তে মনোবৈজ্ঞানিক পদ্ধতি এবং নৈতিক শিক্ষার ওপর জোর দেওয়াই হলো আজকের সমাজের জন্য জরুরি সমাধান। অতি সাম্প্রতিক সময়ে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে শাসন ব্যবস্থায় পরিবর্তন এসেছে। আশা করা হচ্ছে এই পরিবর্তনের প্রভাব শিক্ষা ব্যবস্থায়ও পড়বে।

শিক্ষাব্যবস্থার এই বিনির্মাণে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হওয়া উচিত শিক্ষার্থীদের মধ্যে নৈতিক মূল্যবোধ, সামাজিক দায়িত্ববোধ এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের গুণাবলী গড়ে তোলা, যাতে তারা কিশোর অপরাধ থেকে দূরে থাকতে পারে এবং সমাজের সঠিক পথে পরিচালিত হয়।

লেখক পরিচিতি

শামস আল গালিব রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী। তিনি নিয়মিত শিক্ষার নানা প্রসঙ্গ নিয়ে লেখালেখি করেন।

1 মন্তব্য

  1. পড়ে ভালো লাগলো। সম্পূর্ণ একমত হতে পারলাম কারন প্রাথমিক শিক্ষার প্রাথমিক স্তরে থেকে অনেক কিছু উপলব্ধি করেছি যা আপনার বক্তব্যের অপূর্ণতায় আছে। চর অঞ্চলে পড়াই। গাইড সর্বস্ব শিক্ষা, অযোগ্য-অলস-নিরুৎসাহী-নির্বিকার শিক্ষক, পাস-সর্বস্ব মনোচিন্তা, হাতি-মাছ-পাখির জন্য একই পঠন, শেখন, পরীক্ষণ ও দমন নীতি এবং সময়ের অসম এবং জোরপূর্বক বন্টন। শিক্ষকরা অনেক ব্যস্ত, এত ব্যস্ত যে নিজেদের এই বাচ্চাদের রাগ, ক্ষোভ, কষ্ট, বঞ্চনা, তাদের মধ্যেকার মারামারি, রাগারাগি এগুলোর দিকে তাকানো বা বাচ্চাদের নিয়ে বসে কাউন্সেলিং করার সময় কই তাঁর? যেই বাচ্চা বাবা মায়ের আদর স্নেহ ছায়া ভালোবাসা ছাড়া, আস্থাহীন দিশাহীন নিরুপায় অসহায় হয়ে তার শৈশব ও কৈশোর কাটায় জেলসম স্কুল কলেজে, যেখানে তাকে কেউ শুধরে দেয় নি, কেউ বলে নি- “বাবা এমন করলে তো ও কষ্ট পাবে। এমন করো না। তুমি কি চাও অন্য কেউও তোমাকে এভাবে কষ্ট দিক”। খুব ছোট ছোট এমন কিছু কথার অভাবে, শিক্ষকের মর্যাদা আজ আর “শিক্ষাগুরু”র নয়। গাইড দাগানো নায়েবের। যাকে সামনে সালাম পিছনে গালি দেয়াই স্বাভাবিক।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Exit mobile version