শিক্ষক সহযোগিতা বলতে আমরা কী বুঝি? নিজের পেশাগত উন্নয়নে, সহকর্মীর পেশাগত উন্নয়নে, শিক্ষার্থীদের উন্নয়নে এবং সর্বোপরি প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নের জন্য একজন শিক্ষক প্রকৃত পেশাদারিত্বের মনোভাব নিয়ে যা করেন তাই শিক্ষক সহযোগিতা। শিক্ষক সহযোগিতা ছাড়া প্রকৃত ও আনন্দদায়ক শিক্ষাদান সম্ভব হয় না। শিক্ষা-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিগণ যখন শিক্ষার্থীদের উন্নয়নে, তাদের শিক্ষাগ্রহণকে আনন্দদায়ক, ফলদায়ক করার নিমিত্তে একত্রে কাজ করেন, একে-অপরকে সহযোগিতা করেন তখন সেখানে শিক্ষক সহযোগিতার ক্ষেত্রটি তৈরি হয়।
আমরা যারা শিক্ষা-সংশ্লিষ্ট বিষয়ের সাথে জড়িত, তাঁরা যদি চাই এবং আমাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য যদি হয় শিক্ষাথীদের উন্নয়ন, তাদের নতুন কিছু অর্জন করানো, তাহলে শিক্ষক সহযোগিতার যাত্রা শুরু করাটাই শ্রেয়। এটি এমন বিষয় নয় যে, একটি কাজ শেষ করার পর আগাতে হবে, এটি একটি সর্বদা পরিবর্তনশীল, সর্বদা বহমান একটি পদ্ধতি যা সামাজিক নেটওয়ার্ক এবং নতুন প্রযুক্তির ভেতরে প্রবেশের মাধ্যম সম্ভব হয়। শিক্ষক সহযোগিতার স্পষ্ট উপকারিতা দৃশ্যমান হওয়া সত্ত্বেও আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রে কার্যকরী সহযোগিতার ক্ষেত্রটি গড়ে উঠছে না। এর কারণ কী? হতে পারে কিছু শিক্ষাবিদ কিংবা শিক্ষক এর বহুমুখী উপকার সম্পর্কে ততোটা অবহিত নন; কিংবা এ-বিষয়ে খুব একটি চিন্তা করেননি বা সময় ব্যয় করেননি।
শিক্ষকগণ যখন একে-অপরের কাছে তথ্য, সম্পদ, ধারণা, অভিজ্ঞতা, জ্ঞান আলোচনা করেন, বিনিময় করেন, তখন শিক্ষার্থীদের জানার জগত উন্মুক্ত ও কার্যকর হয়। সহযোগিতা মানে হচ্ছে, উদ্দেশ্যমূলকভাবে আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্ক তৈরি করা এবং একে অপরের ওপর ভারসাম্যপূর্ণ নির্ভরতা তৈরি করা। অর্থাৎ, একটি বিষয় একজন শিক্ষক ভালোভাবে নাও বুঝতে পারেন, তার প্রয়োজন অন্য একজন শিক্ষকের পরামর্শ ও সহযোগিতা। প্রয়োজনের সময়ে সেই সহযোগিতা যদি করা হয় তাহলে একে অপরের পেশাগত উন্নয়নে যেমন অবদান রাখতে পারেন, তেমনি সহকর্মীদের মধ্যে একটি নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এটি প্রতিষ্ঠানের জন্যও উৎসাহব্যঞ্জক এবং মঙ্গলজনক।
এই কাজটি যখন সহকর্মীদের মধ্যে অবাধে গড়ে ওঠে, সেটি একটি কাযর্করী ক্ষেত্র। গ্লোবাল স্টেট অফ ডিজিটাল লার্নিং সার্ভের রিপোর্ট অনুযায়ী, ৩০ শতাংশের অধিক শিক্ষক এবং প্রায় ৫০ শতাংশ শিক্ষা প্রশাসকগণ মনে করেন যে, শিক্ষকদের সহযোগিতা একটি সর্বাধিক গুরুত্বের বিষয়। তবে এও জানা গেলে যে, ৩০ শতাংশ প্রশাসক মনে করেন যে, শিক্ষকদের সহযোগিতার ক্ষেত্র একটি বিরাট চ্যালেঞ্জের জায়গা। শিক্ষাক্ষেত্রে সত্যিকারের প্রফেশনাল লার্নিং কমিউনিটি একটি শক্তিশালী অস্ত্র। প্রফেশনাল লার্নিং কমিউনিটি ছাড়া শিক্ষক সহযোগিতা হতে পারে জোরপূর্বক একটি প্রচেষ্ট এবং চ্যালেঞ্জ।
অনেক শিক্ষক ও প্রশাসক মনে করেন যে, শিক্ষক সহযোগিতার জন্য যে অতিরিক্ত সময় ব্যয় করা প্রয়োজন, সেই সময় শিক্ষকদের নেই। শিক্ষকদের সময় সব রুটিনে বাধা। দ্বিতীয়ত, তাঁদের ব্যক্তিগত সময়ও প্রয়োজন, এসব সময়ের বাইরে গিয়ে সহযোগিতা করার ক্ষেত্রটি একেবারেই ক্ষীণ। তাছাড়া এখানে আরও দুটো বিষয় কাজ করে: এর একটি হচ্ছে ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দের কারণে একে অপরকে সহযোগিতা করতে চান না। অপরটি হচ্ছে: একজন শিক্ষকের গুণগত মান যাচাই বা বিচার করা বলে অনেকে মনে করেন। নিজের ব্যক্তিগত দোষত্রুটি প্রকাশিত হয়ে পড়বে, নিজেকে এক্সপোজ করতে গেলে সেই ভয়েও অনেকে সহযোগিতার বিষয়টি এড়িয়ে যান।
এটি একটি সংস্কৃতি ও বাস্তবতা। আধুনিক যুগের শিক্ষকদের এই অভ্যাস পরিহার করতে হবে। আধুনিক শিক্ষক সহযোগিতার ক্ষেত্রে প্রযুক্তি একটি প্রধানতম ভূমিকা পালন করে। পেশাগত শিক্ষার যে নেটওয়ার্ক রয়েছে সামাজিক নেটওয়ার্কে, সেখানে বলিষ্ঠভাবে যোগদানের মাধ্যমে একজন শিক্ষককে জ্ঞান, দক্ষতা ও শিক্ষাবিদদের অর্জনের সম্পদের রাজ্যে প্রবেশাধিকার পায় যা, সাধারণ পেশাগত বৃত্তের মধ্যে পড়ে না অর্থাৎ তার বাইরে।
ডায়ালগ বা কথোপকথন পেশাগত শিক্ষার গভীরে নিয়ে যেতে পারে, কারণ অংশগ্রহণকারী শিক্ষক ও শিক্ষাবিদগণ এর মাধ্যমে শিক্ষাদানের নতুন ধারণা খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করেন। কথোপকথনের সময় অন্যের কথা শোনার একটি চমৎকার ক্ষেত্র তৈরি হয়, অন্যকে ভালোভাবে শুনতে হয় এবং তার প্রেক্ষিতে নিজের কিছু ধারণা অন্যের সাথে আলাপ করার, আলোচনা করার ইচ্ছে জাগে, ফলে যোগাযোগ দক্ষতা বৃদ্ধি পায়। তবে, ডায়ালগের সময় অনেক সময় আবার দ্বন্দ্বও সৃষ্টি হয়। অতএব দ্বন্দ্ব ব্যবস্থাপনার একটি পরিকল্পনা থাকা প্রয়োজন এবং নিজের আবেগুলোকে খেয়াল রাখা, যাতে তা কোনোক্রমেই পারদ অতিক্রম না করে। এক্ষেত্রে সবসময়ই পেশাগত বিচার বিবেচনার বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে।
অন্য যেকোনো দক্ষতার মতো সহযোগিতার বিষয়টিকে ধারালো করার জন্য, কার্যকর করার জন্য, উন্নত করার জন্য অনুশীলন করতে হয়। যেমন, একজন শিক্ষার্থীকে যদি আপন করে নেয়ার প্রশ্ন আসে, তাহলে শিক্ষককে সেভাবে, সেই অনুযায়ী সময় দিতে হবে। ভাসা ভাসা সম্পর্ক হলে শিক্ষার্থীদের মনের গভীরে প্রবেশ করা যায় না। একজন শিক্ষক তাঁর শিক্ষার্থীদের পেছনে রুটিনের বাইরে কতটুকু সময় দিতে পারেন, তার ওপর নির্ভর করে সহযোগিতার ক্ষেত্রটি, সম্পর্কের ক্ষেত্রটি।
যদি একদল শিক্ষক আসলেই চান যে, তাঁদের শিক্ষার্থীদের সাথে অবশ্যই সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে, তাঁদের শিক্ষাদানকে কার্যকরী করতে হবে, তাহলে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে হবে, পরিকল্পনা করতে হবে এবং সে অনুযায়ী পদ্ধতি গ্রহণ করে তার মূল্যায়ন করতে হবে। মূল্যায়নই বলে দিবে যে, বিষয়টি কাজ করছে কিনা, শিক্ষার্থীদের কাজে লেগেছে কিনা। সহযোগিতা মানে সম্পর্কোন্নয়ন। সেটি করতে হলে সময় ব্যয় করে একাজন সহকর্মীকে ব্যক্তিগতভাবে জানতে হবে। এতে একে অপরের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের বিষয়টি ঘটে, বিশ্বাস স্থাপন করা যায়।
সহযোগিতা শুধু শিক্ষকদের মধ্যে, শুধু সহকর্মীদের মধ্যে হলেই হবে না, এটি হতে হবে শিক্ষার্থীদের সাথেও। এমন কর্ম, এমন ক্লাস উপস্থাপন করতে হবে যেখানে শিক্ষার্থীরা একে-অপরকে সহযোগিতা করা শিখতে পারে। তারা এটি শিখবে না যে, একে অপরের প্রতিযোগী। এই সহযোগী মনোভাব তাদের মধ্যে উচ্চতর দক্ষতা অর্জনের জন্ম দেয়, তাদেরকে আত্মবিশ্বাসী ও স্ব-সম্মানের অধিকারী করে। তারা একে অপরের সাথে অর্থাৎ বিভিন্ন ধরনের শিক্ষার্থীদের সাথে কাজ করার সুযোগ পায়, ফলে তাদের মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলী তৈরি হয়। এটি এক ধরনের শক্তি যা পুরো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চেহারাই পাল্টে দিতে পারে।
একটি প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন এবং পারফরম্যান্স ভালো করার জন্য একজন শিক্ষক নেতা আলাদাভাবে কিছু করে থাকেন, গৎবাধা কিছু কাজ নয়। তিনি অন্যান্য সহকর্মীদের প্রেষণা দিয়ে কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করেন এবং তাঁদের নিজ নিজ কাজ সম্পর্কে আরও সচেতন এবং আরও ভালোভাবে করার অনুপ্রেরণা জুগিয়ে থাকেন। নবীন শিক্ষকদের মেন্টর হিসেবে কাজ করা শিক্ষক লিডারদের একটি সাধারণ দায়িত্ব। তাঁরা অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হিসেবে/রোল মডেল হিসেবে কাজ করেন। বিদ্যালযের নতুন পরিস্থিতি ও পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে সাহায্য করেন। নতুন শিক্ষকদের পরিচয় করিয়ে দেন কারিকুলামের সাথে, পদ্ধতির সাথে, বিদ্যালয়ের অনুশীলন ও কার্যাবলীর সাথে, শিক্ষাদানের সাথে। একজন মেন্টর হওয়া মানে প্রচুর সময় ব্যয় করা এবং একজন নতুন মানুষকে শিক্ষকতা পেশায় মনোনিবেশ করাতে যথেষ্ট অবদান রাখতে পারেন।
একজন শিক্ষকের নেতৃত্ব বিদ্যালয়ের পারফরম্যান্স উন্নয়নের লক্ষ্যে সকলের মেধা ও শক্তির সম্মিলন ঘটাতে সাহায্য করে এবং ঘটিয়ে থাকে। এই নেতৃত্ব বলতে প্রতিষ্ঠানের প্রধান হলেই হবে সেটি নয়। অধ্যক্ষ বা ভাইস-চ্যান্সেলর হলেই হবে তা ঠিক নয়। তারা তো পদ ও পদবীর কারণে কিছু কাজ করবেনই বা করেনই, যা সাধারণ শিক্ষকদের থেকে আলাদা। কিন্তু ওই পদ ও পদে না থেকেও যিনি শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মবিলাইজ করতে পারেন, তাঁদের নিয়ে কথা, সেটিই হচ্ছে নেতৃত্ব। শিক্ষক নেতৃত্বের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্টই হচ্ছে, জটিল কাজে অন্যদের নিয়োগের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের ও পেশার লক্ষ্য অর্জনে সাহায্য করা এবং লক্ষ্য অর্জনের জন্য বাধাবিপত্তির মুখোমুখি হওয়ার সাহস থাকা। শিক্ষক নেতৃত্ব প্রকাশিত হয় বহুভাবে। একজন শিক্ষক যিনি প্রকৃত অর্থেই শিক্ষক নেতা, তাকে নির্ধারিত কাজের বাইরে অনেক কিছু করতে হয়। তাঁর এ ধরনের কার্যাবলী শিক্ষার্থীদের জ্ঞান আহরণে উদ্ধুদ্ধ করে, সহকর্মীদের উৎসাহ প্রদান করে, নতুন কিছু জানতে ও করতে তাঁদের প্রভাবিত করে।
লেখক পরিচিতি
মাছুম বিল্লাহ বাংলাদেশে ইংলিশ টিচার্স অ্যাসেসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইট্যাব)-এর সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি পূর্বে ক্যাডেট কলেজ ও রাজউক কলেজের শিক্ষক হিসেবে কাজ করেছেন। কাজ করেছেন ব্র্যাকের শিক্ষা কর্মসূচিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে। তিনি ভাব বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর হিসেবেও কর্মরত রয়েছেন। তিনি নিয়মিত শিক্ষাবিষয়ে নানা প্রবন্ধ লিখছেন।
স্যার, এ জন্য সবার আগে লাগবে প্রফেশনাল কমিটমেন্ট, যা আমাদের খুব কমই আছে।স্যার,আমি মনে করি আমাদের সমাজ বা রাষ্ট্র কেমন চলবে তা শ্রেনিকক্ষ থেকে নির্রধারিত হবে,আর তার মূলে থাকবে আমাদের শিক্ষকগন।
Visitor Rating: 5 Stars