বাড়ি উচ্চশিক্ষা নোংরা প্রতিযোগিতা ও শিক্ষা : বিপ্লব আবশ্যক

নোংরা প্রতিযোগিতা ও শিক্ষা : বিপ্লব আবশ্যক

শিক্ষায় নোংরা প্রতিযোগিতা পরিহার করা শ্রেয়
শিক্ষায় নোংরা প্রতিযোগিতা পরিহার করা শ্রেয়

এইচ এম শরীফুল ইসলাম তানজিল লিখেছেন শিক্ষায় নোংরা প্রতিযোগিতা নিয়ে

বিজ্ঞানের উৎকর্ষতা ও প্রযুক্তির এই যুগে পৃথিবীর নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যখন মহাকাশ বা তার চেয়েও বড় কিছু আবিষ্কার করার কথা ভাবছে, ঠিক তখনই আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থীদের অ্যাকাডেমিক বা চাকুরির বই মুখস্ত করতে তাড়িত করছে। চলছে নোংরা প্রতিযোগিতা। এর ফলে আমরা হয়ে উঠেছি অনেকটা প্রতিযোগিতা-নির্ভর আত্মকেন্দ্রিক ও মুখস্থনির্ভর জাতি। নিজেকে একজন নোংরা প্রতিযোগী হিসেবে গড়ে তোলতে আমরা এখন অনেকটাই মরিয়া। আজ পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা যখন চাঁদ বা মঙ্গল গ্রহ জয় করে আসছে, আমরা তখন স্বপ্নের বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আত্ম-অহমিকায় লাফাচ্ছি। জাতিসংঘ বা নাসার মতো প্রতিষ্ঠানে চাকুরি হয়তো আমাদের কাছে কিছুই না, কিন্তু বিসিএস! এ যেনো আমাদের জন্ম থেকেই লালিত স্বপ্ন।

এছাড়া দেশের প্রায় প্রতিটি সচেতন নাগরিকের কম করে হলেও একটি লালিত স্বপ্ন থাকে। আর তা হলো, সরকারি চাকুরি পাওয়া। আপনি যদি সুইজারল্যান্ডের নোবেল কমিটিতেও নিজেকে স্থান করে নিতে পারেন, নিশ্চিত আপনার পরিবার বা আপনার সমাজ আপনাকে নিয়ে সন্তুষ্ট হবে না। যদি বিসিএস দিয়ে পুলিশ বা প্রশাসনে আসেন, তবে আপনি আপনার পরিবার ও সমাজের কাছে হয়ে উঠবেন স্বর্ণের মতো দামি কোনো বস্তু। আপনার সব আত্মীয়স্বজন বা আপনার সমাজ কেবল আপনার প্রশংসাই সারাক্ষণ করবে, বিয়ের বাজারেও আপনার প্রচুর চাহিদা বাড়বে।


আপনি যদি সুইজারল্যান্ডের নোবেল কমিটিতেও নিজেকে স্থান করে নিতে পারেন, নিশ্চিত আপনার পরিবার বা আপনার সমাজ আপনাকে নিয়ে সন্তুষ্ট হবে না। যদি বিসিএস দিয়ে পুলিশ বা প্রশাসনে আসেন, তবে আপনি আপনার পরিবার ও সমাজের কাছে হয়ে উঠবেন স্বর্ণের মতো দামি কোনো বস্তু।


একবার চিন্তা করে দেখুন তো, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মূলত কাজ কী ছিলো? বর্তমানে কী কী কাজ করে যাচ্ছে? বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল উদ্দেশ্য থাকে গবেষণা করা বা নতুন গবেষক তৈরি করা। নতুন কিছু আবিষ্কার করাও কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম একটি কাজ। এছাড়া একটি দেশের মূল নেতৃত্ব তৈরি করার দায়িত্বও কিন্তু সেই দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর থাকে। উন্নত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলা উন্নত গবেষক তৈরি করছে, দেশের জন্য নতুন কিছু আবিষ্কার করছে, দেশ পরিচালনায় দক্ষ ও যোগ্য নেতৃত্ব তৈরি করছে। তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত শিক্ষকগণও গবেষণাধর্মী অগণিত পাবলিকেশন্স প্রকাশ করে যাছেন।

আর আমাদের দেশের সম্মানিত শিক্ষক মহোদয়গণ! তাঁরা তো কেউ কেউ আমাদের দেশের ভদ্রপল্লীর উন্নত বাসিন্দা। অনেক শিক্ষক আছেন যারা গবেষণা তো দূরের কথা, বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে ভালো করে তথ্যবহুল ক্লাসই নিতে জানেন না। রাজনৈতিক বিবেচনায় অনেক শিক্ষকই আছেন আমাদের দেশে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথাই একবার ভাবুন। একসময় এই বিশ্ববিদ্যালয় একটি দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছে। এই বিশ্ববিদ্যালয় বহু জ্ঞানী-বিজ্ঞানী, কবি-সাহিত্যিক ও অগণিত নেতৃত্বের জন্ম দিয়েছে। পদার্থবিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর মতো অনেক বিজ্ঞানীর জন্ম দিয়েছে। এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর মতো নেতৃত্ব তৈরি হয়েছে। আজ তার অবস্থান কোথায় নেমে এসেছে? অনেক সম্মানিত শিক্ষক আজ রাজনৈতিক আনুগত্যে নিজেকে সদা ব্যস্ত রাখছেন। অনেক সম্মানিত শিক্ষক আছেন যারা বাইরের চলমান প্রজেক্ট নিয়েই সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকেন। অনেক সময় শিডিউল ক্লাস মিস দিয়ে হলেও প্রজেক্ট চালিয়ে যান কিংবা মোটা অংকের টাকার লোভে প্রাইভেট কোনো বিশ্ববিদালয়ে ক্লাস নিতে যান।

কোনো কোনো ডিপার্টমেন্ট বাণিজ্যিক বিবেচনায় সান্ধ্যকালীন মাস্টার্স বা বিভিন্ন বাণিজ্যিক কোর্স খুলে বসেছে। যার ফলে নিয়মিত বা অনিয়মিত শিক্ষার্থীদের ওপর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার আসল প্রভাবই পড়ছে না। আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষাটি হয়ে উঠেছে কেবল বই, শিট বা পরীক্ষাকেন্দ্রিক। আসলে শিক্ষকরাই যেখানে গবেষণায় মনযোগী হচ্ছেন না, সেখানে শিক্ষার্থীদের উন্নতি তো আরও অনেক দূরের কথা; এতে বাড়ছে কেবল প্রতিযোগিতা।

বিশ্বের বড় বড় নামীদামী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যখন তার আশপাশের কলেজগুলোর শিক্ষার মান বাড়াতে অধিভুক্ত করে, ঠিক তখন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজেদের ক্ষমতার দাপট বাড়াতে এবং ব্যবসাকে পুঁজি করে অধিভুক্ত বাণিজ্য করে যাচ্ছে। ফলে আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান নিয়ে অনেক প্রশ্ন, সেশনজট বা বিলম্বিত রেজাল্ট এখনও চোখে পড়ে। এছাড়া রয়েছে শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন, ভর্তি জালিয়াতি নিয়ে প্রশ্ন এবং শিক্ষার্থীর আবাসন নিয়েও হাজারো সমস্যা।

আজ শেখ সাদীর একটা কথা মনে পড়ছে, “একজন ঘুমন্ত ব্যক্তি আরেকজন ঘুমন্ত ব্যক্তিকে জাগ্রত করতে পারে না।”

শিক্ষার্থীরা আজ আসল শিক্ষার চাইতে আত্ম-অহংকারের শিক্ষাটাই বেশি পাচ্ছে। বিদ্যালয়ের কথাও যদি চিন্তা করেন, সেখানেও নোংরা প্রতিযোগিতা বিরাজমান। কার ছেলে কোন বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে সেটি নিয়েও প্রতিযোগিতা চলে। কলেজ শিক্ষাতেও ব্যাপক নোংরা প্রতিযোগিতা। মূলত প্রতিযোগিতাটি আরম্ভ হয় নামকরা প্রতিষ্ঠান নিয়ে। একজনের সন্তান যখন একটি নামী কলেজে পড়ে গোল্ডেন এ প্লাস পায়, অহংকারে তখন তার পা মাটিতে পড়তে চায় না। সেজন্যেই হয়তো আহমদ ছফা বলেছিলেন, “বড় বড় নামকরা স্কুলে বাচ্চারা বিদ্যার চাইতে অহংকারটা বেশি শিক্ষা করে।”


আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা আসলে এক নোংরা সংস্কৃতির ভেতর দিয়ে যাচ্ছে, যা আমাদেরকে নোংরা প্রতিযোগী হিসেবে গড়ে তুলতে সাহায্য করছে। ফলে আপনি উদ্যোক্তা না হয়ে হচ্ছেন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার না হয়ে হচ্ছেন পুলিশ। আপনার পরিবারের সিদ্ধান্তেই আপনাকে বড় হতে হচ্ছে। তাদের পছন্দকে আপনার ওপর চাপিয়ে দিয়ে আপনাকে পড়াশোনা করতে একরকম বাধ্য করা হচ্ছে। ফলে আপনি হয়ে উঠছেন একজন নোংরা প্রতিযোগী।


এছাড়া জন্মের পর থেকেই শিশুদের মনে পড়াশোনা নিয়ে একরকম ভয় সৃষ্টি করে দেওয়া হয়। আসলে আমাদের দেশে শিশুদের পুলিশের ভয় দেখিয়ে যখন ঘুম পাড়ানো হয়, তখন তো তাদের মনে পড়াশোনার ভয় আসতেই পারে। শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক সেই জন্যেই হয়তো বলেছিলেন, “যে জাতি তার বাচ্চাদের বিড়ালের ভয় দেখিয়ে ঘুম পাড়ায়, তারা সিংহের সাথে লড়াই করা কিভাবে শিখাবে? যারা পানিতে ডুবে যাওয়ার ভয়ে তার সন্তানকে ডোবায় নামতে দেয় না, কিভাবে সে সন্তান আটলান্টিক পাড়ি দিবে?”

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা আসলে এক নোংরা সংস্কৃতির ভেতর দিয়ে যাচ্ছে, যা আমাদেরকে নোংরা প্রতিযোগী হিসেবে গড়ে তুলতে সাহায্য করছে। ফলে আপনি উদ্যোক্তা না হয়ে হচ্ছেন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার না হয়ে হচ্ছেন পুলিশ। আপনার পরিবারের সিদ্ধান্তেই আপনাকে বড় হতে হচ্ছে। তাদের পছন্দকে আপনার ওপর চাপিয়ে দিয়ে আপনাকে পড়াশোনা করতে একরকম বাধ্য করা হচ্ছে। ফলে আপনি হয়ে উঠছেন একজন নোংরা প্রতিযোগী। এমন দেশে একটি শিশু জন্ম নেওয়ার পর দাউদ হায়দারের সাথে তাল মিলিয়ে সে বলতেই পারে যে, “জন্মই আমার আজন্ম পাপ।”

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এখনও সময় আছে, শিকল টেনে ধরার। শুধু বিশ্ববিদ্যালয় না, শিক্ষার প্রাথমিক স্তর থেকেই বিপ্লব ঘটাতে হবে। মনে রাখতে হবে, একটি দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভালো হলেই কেবল সেই দেশ বা জাতির জন্য অনেক মঙ্গল বয়ে আনতে সক্ষম।

এইচ এম শরীফুল ইসলাম তানজিল: লেখক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের বর্তমান শিক্ষার্থী।

কোন মন্তব্য নেই

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Exit mobile version