বাড়ি পরীক্ষা ও মূল্যায়ন ব্যবস্থা

সব শিক্ষার্থীর একসাথে পরীক্ষার ফল প্রকাশ: কতোটুকু নেতিবাচক?

পরীক্ষার ফল প্রকাশ

মোঃ শাকিব হাসান শুভ লিখেছেন পরীক্ষার ফল প্রকাশ প্রসঙ্গে

প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক এমনকি উচ্চশিক্ষায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে একটি ক্লাসের সব শিক্ষার্থীদের একই তালিকায় একসাথে পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এটি হয় একটি সামগ্রিক বা সামষ্টিক মূল্যায়নের ফলাফল। ফলে, যারা বেশি পেল অথবা কম পেল সবার অবস্থা একই তালিকার ফলাফলে প্রকাশ পায়।

এভাবে পরীক্ষার ফল প্রকাশ শিক্ষার্থীদের ওপর অনেকভাবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। কেনোনা, সামাজিক ধরন অনুযায়ী ফল অত্যন্ত ব্যক্তিগত বিষয়। যার ফল একটু খারাপ তাকে তার ফল সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা যেমন তার মনে আঘাত দিতে পারে, তেমনি অন্যের ভালো ফল অপেক্ষাকৃত খারাপ ফলের সাথে প্রকাশে তার নেতিবাচকভাবে একজন শিক্ষার্থীর মনে আঘাত দিতে পারে।

এবার আসি একসাথে সকলের ফল প্রকাশের কারণগুলোতে। প্রথমত, খাতা মূল্যায়নকে (যা ‘খাতা দেখা/কাটা’ নামে অধিক পরিচিত) আমাদের প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক স্তরের বেশিরভাগ শিক্ষক একটু ঝামেলার মনে করেন। তাদের কম সময়ে অধিক খাতা দেখার প্রবণতা এবং অনেক সময় ততোটা ভালোভাবে না দেখেই নম্বর দেওয়ার প্রবণতা দেখা যায়।

দীর্ঘ সময়ের এই গতানুগতিক প্রক্রিয়া শিক্ষকরা যেমন অনুসরণ করছেন, তেমনি অনুসরণ ও চর্চা করছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও। এটি একটা সামাজিক রীতিতে দাড়িয়েছে।

গলদটা এখানেই। আমরা একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সামষ্টিক জনসম্পদ তৈরি করতে চাচ্ছি। আমরা কাউকে সেরা, আবার কাউকে দুর্বল শিক্ষার্থী বলে প্রমাণ করতে চাই না।


আমরা একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সামষ্টিক জনসম্পদ তৈরি করতে চাচ্ছি। আমরা কাউকে সেরা, আবার কাউকে দুর্বল শিক্ষার্থী বলে প্রমাণ করতে চাই না।


একসাথে সবার পরীক্ষার ফল প্রকাশ করার নেতিবাচক দিকগুলো কোথায়? প্রথমত, একসাথে পরীক্ষার ফল প্রকাশ করার মানে হলো সবাইকে বা শিক্ষার্থীদের মাঝে তুলনার সুযোগ তৈরি করা অথবা একরকম তুলনার দিকে ঠেলে দেয়া। যে শিক্ষার্থী ১০০-তে ৮০ পেল, সে অখুশি; তার বন্ধু ৮৩ পেয়েছে এই কারণে। আবার যে ৬০ বা ৪৫ পেল, সে অন্যদের তুলনায় নিজেকে হীন মনে করে।

এই তুলনা শিক্ষার্থীদের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকে না। ছড়িয়ে পড়ে অভিভাবকদের মাঝেও। ভালো ফল করা অনেক অভিভাবক কম নম্বর পাওয়া শিক্ষার্থীর অভিভাবককে খোঁচা মেরে কথা বলেন।

শিক্ষার্থী যখন দেখে, তারই কারণে তার বাবা-মাকে বিভিন্ন নেতিবাচক শুনতে হচ্ছে, তখন তার মনোবল ভেঙ্গে যায় অনেকক্ষেত্রে। আবার অনেকসময় কম নম্বর পাওয়া শিক্ষার্থীর ওপর নেমে আসে মানসিক অথবা শারিরীক নির্যাতন। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায়, যেন শিক্ষার্থীটি ‘বাজির ঘোড়া’ আর অভিভাবকদের প্রত্যাশার চাপ তাদের ‘রেসের মাঠে’ (পরীক্ষায়) তাড়িয়ে বেড়ায়—কে কার চেয়ে সেরা তা প্রমাণের জন্য।

একদল শিক্ষার্থী মোটামুটি একই সমাজ থেকে আসে। তাই তাদের অভিভাবকরাও এই একত্রিত ফলের তালিকা থেকেই তাদের সন্তানের প্রতি মনোভাব পোষণ করেন।

কারো ফল যখন সবাই জানার সুযোগ পেয়ে যায়, তখন সেই শিক্ষার্থীর আর গোপনীয়তা থাকলো না। এই ফল নিয়ে তাকে অনেক সময় লজ্জার মধ্যে পড়তে হয় সহপাঠী, সহপাঠীদের অভিভাবক এবং অন্যান্যদের কাছে।

অপরদিকে একসাথে পরীক্ষার ফল প্রকাশ একটি শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মাঝে মনস্তাত্ত্বিক বিভাজন তৈরি করে। যারা কম পেল তাদের দুর্বল, যারা মধ্যম নম্বর পেল তারা মাঝারি এবং যারা বেশি পেলো তাদের ভালো শিক্ষার্থী হিসেবে প্রত্যেকের জন্য আলাদা আলাদা মনোভাব পোষণ করতে থাকে শিক্ষক ও সহপাঠীরা, এমনকি অভিভাবকরাও। একজন শিক্ষার্থী কম নম্বর পেলে যতোটা মানসিক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়, অনেকেই এই চ্যালেঞ্জে ভেঙ্গে পড়ে আত্নহননের দিকে অগ্রসর হন। ফলে, শেখার চেয়ে নম্বরপ্রাপ্তিতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেন শিক্ষার্থীরা। বৈধ বা অবৈধ যেকোনো উপায়ে তাকে নম্বর পেতে হবে, নয়তো মানসম্মান থাকবে না—এমন মনোভাব সবার।

এটি মনে রাখা উচিত, আমাদের একেকজনের শেখার ধরণ, ধারণক্ষমতা, বিষয়ভিত্তিক আগ্রহ ও চাহিদা একেক রকম। তাই কেউ বেশি নম্বর অথবা কেউ কম নম্বর পাবে এটিই স্বাভাবিক। আর এই নম্বরগুলো একসাথে প্রকাশ করে সবার মাঝে তুলনা আসলেই কি যৌক্তিক? এতে কি আদৌ সবার প্রকৃত জ্ঞান-দক্ষতা পরিমাপ করা যায়?

নাকি শুধুই শিক্ষার্থীদের মানসিক অশান্তি বৃদ্ধি করে এগুলো?


পরীক্ষার নম্বরই শুধু যোগ্যতার মাপকাঠি হতে পারে না। হতে পারে না সামাজিক মর্যাদারও নিয়ামক। অন্যদিকে এই একসাথে পরীক্ষার ফল প্রকাশ ও এর প্রতিক্রিয়ায় শ্রেণিকক্ষের সম্প্রীতিও অনেক সময় নষ্ট হয়। নষ্ট হয় সতীর্থদের মাঝে বন্ধুত্বও।


পরীক্ষার নম্বরই শুধু যোগ্যতার মাপকাঠি হতে পারে না। হতে পারে না সামাজিক মর্যাদারও নিয়ামক। অন্যদিকে এই একসাথে পরীক্ষার ফল প্রকাশ ও এর প্রতিক্রিয়ায় শ্রেণিকক্ষের সম্প্রীতিও অনেক সময় নষ্ট হয়। নষ্ট হয় সতীর্থদের মাঝে বন্ধুত্বও। কে বেশি পেল, কে কম পেল—তা দেখে নিজেদের মধ্যে মানসিক দ্বন্দ্বেরও সৃষ্টি হয়। ফলে দলীয় কাজ, দলগত শিখন-শিক্ষণ অনেক সময় অকার্যকর হয়। দলগত সমঅংশগ্রহণ ও স্বাভাবিক সহযোগিতার সম্পর্ক বিঘ্নিত হয় অনেক সময়। অনেকে দলগত কাজ বেশি নম্বর পাওয়া শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বের মাধ্যমে সম্পন্ন করে।

পরীক্ষায় অনেকের তুলনায় কম নম্বর পাওয়া অনেকের মাঝে অনাগ্রহ ও বিষণ্নতার সৃষ্টি করে। এই বিষণ্নতা ও অনাগ্রহ তাদের আজীবন বয়ে নিয়ে যেতে হয়।

আরেকটি বিষয়, অন্যের তুলনায় বেশি নম্বর পাওয়ার আগ্রহও মুখস্থবিদ্যাকে ব্যাপকভাবে উৎসাহিত করে। বাস্তবে দেখা যায়, যে মুখস্তবিদ্যায় ভালো সে পরীক্ষায় নম্বরপ্রাপ্তিতেও ভালো। তাই অনেকে অধিক নম্বরের জন্য অর্থ খরচ করেন, কিছু শেখার জন্য নয়! তাই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় প্রাথমিক, মাধ্যমিকে শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের থেকে সৃজনশীলতা বের করে আনার মতো করে পড়াতে চান না। সৃজনশীলতা মূল্যায়নের চেয়ে মুখস্থবিদ্যাই মুল্যায়ন করেন পারতপক্ষে।

সৃজনশীলতা পরিমাপ করা সহজ নয় এবং এর জন্য দক্ষতারও প্রয়োজন। তাই সহজ উপায়ে মুখস্থনির্ভর পদ্ধতিতে পড়াশোনা ও নম্বর প্রদানই চলে বেশি। শিক্ষার্থী-অভিভাবক সবাই চায় বেশি নম্বর, অন্যদের চেয়ে বেশি নম্বর। তাই যার সহজে মুখস্থ হয় না বা কম নম্বর পায়, তাকে আরো বেশি টিউটর বা আরো বেশি কোচিংয়ে দেয়া হয়।

আমাদের শিশু-কিশোররা আজকাল তাই বিকেলে খেলার সুযোগ পায় না। কারণ, বিকেলেও থাকে টিউটর অথবা কোচিং। কারো কারো রাত পর্যন্ত থাকে এসব। এভাবে আমরা তাদের নম্বর পাওয়ার প্রতিযোগিতায় ঠেলে দিয়ে তাদের খেলাধুলার সুযোগটুকুও কেড়ে নিচ্ছি। 

এই নম্বরপ্রাপ্তির প্রতিযোগিতাই বর্তমান সময়ের বেশিরভাগ সমস্যার মূল; যার সূত্রপাত হয় একত্রে সবার ফলাফল দেয়ার মাধ্যমে।

এর থেকে উত্তরণের উপায় নিয়েও আমাদের ভাবতে হবে। আমাদের মুল্যায়ন প্রক্রিয়া যেন শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রতিযোগিতার মনোভাব তৈরি না করে এবং তাদের মানসিক অশান্তি বৃদ্ধি না করে তা নিয়ে ভাবতে হবে।

তাহলে উত্তরণের উপায় কী হতে পারে? ফলাফল ডিজিটালাইজেশন করা এর একটি উপায় হতে পারে। একটি ডিজিটাল ড্যাশবোর্ডে রোল, ক্লাস আইডি সাবমিট করলে শুধু ওই শিক্ষার্থীকে ফল দেখাবে এমন হতে পারে। বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে ঢুকে নিজ নিজ আইডি বা রোল-ক্লাস দিয়ে দেখে নিবে ফল। অথবা শুধু রেজাল্টকার্ডের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীকে ফল দেওয়া হবে। একত্রে পরীক্ষার ফল প্রকাশ করার প্রয়োজন নেই।

পরিশেষে বলা যায়, শিক্ষা হলো জেনে-বুঝে চর্চা করে নিজের মধ্যে ধারণ করে কর্মজীবনে প্রয়োগ করা। এখানে অসুস্থ প্রতিযোগিতার সৃষ্টি  হলে তা সামষ্টিক জনসম্পদ তৈরির চেয়ে অল্প কিছু মেধাবী তৈরিতে ব্রতী হবে এবং সবাই না বুঝে নম্বরের পেছনে ছুটবে। তাই শিক্ষাব্যবস্থা থেকে অসুস্থ প্রতিযোগিতা বন্ধ করতে সবার আগে পরীক্ষার নম্বর বা ফল একত্রে প্রকাশ বন্ধ করতে হবে। বন্ধ করতে হবে নম্বর প্রাপ্তির অসুস্থ প্রতিযোগিতাও।

মোঃ শাকিব হাসান শুভ: শিক্ষার্থী, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

কোন মন্তব্য নেই

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Exit mobile version