বাড়ি শিখন-শিক্ষণ প্রক্রিয়া প্রফেশনাল লার্নিং কমিউনিটি কী এবং কেন

প্রফেশনাল লার্নিং কমিউনিটি কী এবং কেন

প্রফেশনাল লার্নিং কমিউনিটি শিক্ষকের দক্ষতার উন্নয়নে সহায়তা করে; ছবিসূত্র: Medium
প্রফেশনাল লার্নিং কমিউনিটি শিক্ষকের দক্ষতার উন্নয়নে সহায়তা করে; ছবিসূত্র: Medium

একজন শিক্ষক ক্লাসে বললেন, “আমি চাচ্ছি তোমরা সবাই স্বাধীনভাবে কাজ করবে, সৃজনশীল হবে এবং জটিল চিন্তন ক্ষমতার অধিকারী হবে- আমি যেভাবে বলছি ঠিক সেভাবে”। এটি কি আসলে স্বাধীন ও সৃজনশীল হওয়ার পথ? না, এটি আসলে একটি বিপরীতমুখী উক্তি। শিক্ষক বলছেন তার শিক্ষার্থী স্বাধীন, সৃজনশীল হবে এবং জটিল চিন্তন ক্ষমতার অধিকারী হবে; অথচ শিক্ষক ঠিক যেভাবে করতে বলছেন সেভাবেই করতে হবে, শিক্ষার্থীরা নিজেদের মতো করতে পারবে না। একজন আধুনিক শিক্ষক যদি প্রফেশনাল লার্নিং কমিউনিটি সম্পর্কে ধারণা রাখেন, তাহলে তিনি কখনোই এই বিপরীতধর্মী কাজ শিক্ষার্থীদের করতে বলবেন না।

প্রফেশনাল লার্নিং কমিউনিটি একটি শক্তিশালী কর্মী উন্নয়ন পদ্ধতি যা প্রতিষ্ঠান পরিবর্তন এবং উন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল। এটি শিক্ষা জগতে এখন বহুল প্রচলিত এবং পরিচিত বিষয়। এ হচ্ছে কমিউনিটিকে বিদ্যালয়ের উন্নয়নে সম্পৃক্ত করা, শিখন-শেখানো পদ্ধতিতে সম্পৃক্ত করা এবং শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও প্রশাসনকে শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টিতে যৌথভাবে সম্পৃক্ত করার কৌশল বা পদ্ধতি। প্রফেশনাল লার্নিং কমিউনিটির প্রধান বিষয়গুলো হচ্ছে- ক. সমান্তরাল ভূমিকা পালন, খ. সুস্থ ও সহযোগিতামূলক সম্পর্ক স্থাপন।

শিক্ষককে ক্লাসে নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে যাতে শিক্ষার্থীরা প্রশ্ন করতে ভয় না পায় এবং তাদের মনের চাহিদা মেটাতে পারে। তাদের যাতে সহপাঠীদের হাসির কারণে প্রশ্ন করার ও জানার আগ্রহ দমে না যায়। প্রশ্ন না করলে জানা তো অপূর্ণই থেকে যায়। হাসিঠাট্টা যাতে শিক্ষার্থীর প্রশ্ন করার ইচ্ছা অবদমিত না করে সেদিকে একজন শিক্ষককে দৃষ্টি রাখতে হবে।প্রফেশনাল লার্নিং কমিউনিটি পাঁচটি গুণাবলীর ওপর গুরুত্ব আরোপ করে। সেগুলো হচ্ছে, ১. সহায়ক ও বণ্টিত নেতৃত্ব, ২. সম্মিলিত সৃজনশীলতা, ৩. বণ্টিত ও আলোচিত মূল্যবোধ এবং দৃষ্টিভঙ্গি, ৪. সহায়তামূলক শর্তসমূহ এবং ৫. ব্যক্তিগত অনুশীলন যা অন্যের সাথে আলোচনার মাধ্যমে ভাগাভাগি করে নেয়া। একটি বিদ্যালয়ে লার্নিং কমিউনিটি এমন একটি শক্তিশালী বিষয় যেখানে শিক্ষক এবং প্রশাসন কোনো সিদ্ধান্ত যৌথভাবে গ্রহণ করে, তাদের কার্যাবলীতে একে অপরকে সহায়তা প্রদান করে এবং  তাদের দক্ষতাসমূহ আরও শাণিত ও ধারালো করে যাতে শিক্ষার্থীরা প্রকৃত অর্থেই যথাযথ শিক্ষাগ্রহণ করতে পারে।

পেশাগত সম্মান ও বিশ্বাস শিক্ষকদেরকে একসাথে কাজ করতে উৎসাহিত করে যার ফল হচ্ছে প্রতিষ্ঠানের সার্বিক উন্নয়ন। শিক্ষকরা নিজেরা নিজেদেরকে একটি টিম বা দলের সদস্য হিসেবে মনে করেন যারা একত্রে কাজ করে বিদ্যালয়ের চ্যালেঞ্জসমূহ মোকাবিলা করে। পেশাদারী শিক্ষক বিদ্যালয়ের ভেতরে এবং বাইরে যোগাযোগ রক্ষা করার গুরুত্ব সম্পর্কে জানেন। আনুষ্ঠানিক এবং অনানুষ্ঠানিক উভয় ধরনের যোগাযোগ সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এসব ক্ষেত্রে শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের বাড়ি বাড়ি গিয়েও তাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার কথা জানেন এবং বিদ্যালয় ও শিক্ষার্থীর পরিবারের সাথে নিবিড় সম্পর্ক রাখেন যা প্রকৃত শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

আত্ম-বিশ্লেষণের জন্য, মূল্যায়নের জন্য এবং শিক্ষার্থীদের অগ্রগতি অবলোকন করার জন্য তাদের যা যা করা দরকার, সেগুলো শিক্ষকরা তখনই যথাযথভাবে করে থাকেন যখন লার্নিং কমিউনিটি সম্পর্কে পুরো ধারণা অর্জন করেন। অবিরত শিক্ষা, নিজেদের প্রতি দায়বদ্ধতা, শিক্ষার্থীদের প্রতি দায়বদ্ধতা বিদ্যালয়ের রূপকল্প বাস্তবায়নে সহায়তা করে এবং শিক্ষকদের অন্য আরেক ধরনের পেশাগত উন্নয়ন অর্জিত হয়। আর এগুলোর মধ্যে দিয়েই এক ধরনের শক্তিশালী নেতৃত্ব তৈরি হয়। প্রফেশনাল লার্নিং কমিউনিটি হচ্ছে একদল শিক্ষক যারা নিয়মিত সাক্ষাত করেন, অভিজ্ঞতা বিনিময় করেন এবং সহযোগিতার মাধ্যমে শিক্ষাদানের দক্ষতা বৃদ্ধি করেন এবং শিক্ষার্থীদের পাঠসংক্রান্ত বিষয়াবলীর উন্নয়ন ঘটিয়ে থাকেন।

জাপানে প্রফেশনাল লার্নিং কমিউনিটিকে বলা হয় ‘লেসন স্টাডি’ বা লেসন রিসার্চ’। এটি বিভিন্নভাবে এবং বিভিন্ন উদ্দেশ্যে গঠিত হতে পারে কিন্তু আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে বর্তমান ও প্রচলিত অবস্থার পরিবর্তন ঘটানো।  সহযোগিতামূলক পড়াশুনা, গবেষণা, দক্ষতা বিনিময় এবং পেশাগত কথোপকথনের মাধ্যমে ‘এডুকেটরদের’ দক্ষতা ও জ্ঞানের উন্নয়ন ঘটানোর পদ্ধতিই হচ্ছে প্রফেশনাল লার্নিং কমিউনিটি। শিক্ষাগত উচ্চাশার অগ্রগতি, শিক্ষার্থীদের অর্জন, শক্তিশালী নেতৃত্ব তৈরি ইত্যাদি বিষয়গুলো এখানে অ্যাকশন রিসার্চের মতো কাজ করে। এখানে অবিরত প্রশ্ন, পূনর্মূল্যায়ন, শিক্ষাদানের কৌশল ও জ্ঞানের উন্নয়ন ঘটে থাকে আর এগুলো নিশ্চিত হয় প্রফেশনাল লার্নিং কমিউনিটির দ্বারা।

এই কমিউনিটিতে শিক্ষকরা সম্মিলিতভাবে লেসন প্লান কিংবা মূল্যায়ন নিয়ে কথা বলতে পারেন, একে অপরকে ফিডব্যাক দিতে পারেন এবং পেশাগত উন্নয়নের স্বার্থে এবং শিক্ষাদন আরও ফলপ্রসূ ও আনন্দময় করার জন্য একে অপরকে সুপারিশ করতে পারেন। এতে শিক্ষাদান পদ্ধতি আরও সংশোধিত ও পরিবর্তিত হওয়ার সুযোগ পায়। প্রফেশনাল লার্নিং কমিউনিটির সদস্যরা শিক্ষার্থীদের পারফরমেন্সের তথ্য বা তালিকা দেখে বিশ্লেষণ করতে পারেন যে কোন কোন শিক্ষার্থী পিছিয়ে পড়ছে, কারা পরীক্ষায় ভালো করছে না ইত্যাদি। সম্মিলিতভাবে তাদের  চাহিদা ও প্রয়োজন অনুযায়ীও অন্যভাবে শিক্ষাদান শুরু করতে পারেন শিক্ষকরা। অ্যাকাডেমিক্যালি যারা খুবই সমস্যার মধ্যে আছে, তাদের জন্য বিশেষ কৌশলও গ্রহণ করতে পারেন। বিশেষ শিক্ষাদান পদ্ধতি অবলম্বন  করতে কীভাবে ওই বিশেষ পাঠ বা বিশেষ বিষয়টি কোন কোন শিক্ষার্থীর নিকট কীভাবে ও কতটা আনন্দের  এবং বোধগম্য, তা বের করার সুযোগ পান শিক্ষকরা।

প্রফেশনাল লার্নিং কমিউনিটি বিদ্যালয় উন্নয়ন কৌশলে শিক্ষকদের আলাদা ও বিচ্ছিন্নভাবে চিন্তা করা ও কাজ করার প্রবণতা হ্রাস করে, বৃহত্তর পাঠক্রমিক সহযোগিতা গড়ে তোলে, শিক্ষকদের অভিজ্ঞতা বিভিন্নজনের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারে এবং বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সুপ্ত প্রতিভার প্রকাশ ঘটাতে সহায়তা করে। শিক্ষকরা সাধারণত নিজেই নিজের পাঠ বিচার করেন, স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন, সহকর্মীদের থেকে ফিডব্যাক নেন না। তার পড়ানোর ধরন, শিক্ষাগত যোগ্যতা, দর্শন এবং শিক্ষার প্রত্যাশা এক শ্রেণি থেকে আরেক শ্রেণিতে আলাদা হয়ে থাকে এবং ফিডব্যাকের মাধ্যমে এগুলো একটি উন্নত রূপ পরিগ্রহ করতে পারে।

প্রফেশনাল লার্নিং কমিউনিটি থেকে সংক্ষেপে বিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা নিম্নলিখিত ফল পেয়ে থাকে:

– শিক্ষকদের আলাদাভাবে এবং বিচ্ছিন্নভাবে কাজ করার প্রবণতা কমায়;

– লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে পৌছানোর জন্য কাজের প্রতি কমিটমেন্ট বেড়ে যায় এবং কাজ করার জন্য শক্তি, সাহস ও উদ্যম বেড়ে যায়;

– শিক্ষার্থীর সার্বিক উন্নয়নের জন্য শিক্ষকদের মধ্যে দায়িত্ব বণ্টন করা সুবিধজনক হয় এবং শিক্ষার্থীদের সাফল্যের জন্য সম্মিলিখিত দায়িত্ব পালন করা হয়;

– শ্রেণিকক্ষের পাঠদান অভ্যাস, শিক্ষা সম্পর্কে নতুন ধারনা ও বিশ্বাস জন্মায়। ফলে শক্তিশালী ও ফলপ্রসূ শিখন ঘটে থাকে;

– শিক্ষাথীরা তাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে।

যে প্রতিষ্ঠানে এই পদ্ধতি চালু আছে, সে প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা যেভাবে উপকৃত হয়-

– শিক্ষার্থী ড্রপআউট বা ঝড়ে পড়ে কমে যায়, শিক্ষার্থীদের ক্লাস ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা হ্রাস পায়;

– শিক্ষার্থীদের খুব কম সংখ্যকই ক্লাসে অনুপস্থিত থাকে;

– বিদ্যালয়ে লার্নি সমতা পরিলক্ষিত হয়;

– এর আসল উদ্দেশ্য শিক্ষার্থীদের পড়ানো কিংবা ক্লাস হয়েছে কিনা তা নিশ্চিত করা নয়, বরং যা পড়ানো হয়েছে বা যে বিষয়ে ক্লাস নেওয়া হয়েছে তা শিক্ষার্থীরা বুঝতে পেরেছে কিনা এবং বিষয়টি ভালোভাবে তারা আয়ত্ব করতে পেরেছে কিনা তা নিশ্চিত করা। আর এর গভীর প্রভাব রয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ওপর;

– শিখন প্রক্রিয়ায় একজন শিক্ষার্থী যখন সমস্যার সম্মুখীন হয় তখন শিক্ষকরা কীভাবে তাতে সাড়া দিবেন এবং সমাধান দিবেন তা তাদের জানা থাকে।

সাধারণত দেখা যায়, শিক্ষক প্রকৃত অর্থেই চিন্তা করছেন কীভাবে শিক্ষার্থীরা শিখতে পারে, জানতে পারে অর্থাৎ একজন শিক্ষক তাদেরকে সত্যিকার অর্থে সাহায্য করতে চান। অথচ সিলেবাস শেষ করার জন্য তাকে হয়তো ইচ্ছার বিরুদ্ধেই সামনে আগাতে হয়, শিক্ষার্থীরা আসলেই শিখেছে কিনা তা তিনি চিন্তা করতে পারছেন না। প্রফেশনাল লার্নিং কমিউনিটি পদ্ধতি যেসব বিদ্যালয়ে চালু আছে, সেসব বিদ্যালয়ে এরকম ঘটে না। এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা সচেতন থাকেন তাদের সকল শিক্ষার্থীর শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য। এখানে পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের নিকট থেকে বেশি সময় পায়। শিক্ষার্থীরা যখনই সমস্যায় পড়ে, তখনই সমাধানের চেষ্টা করেন শিক্ষকরা। শিক্ষার্থীরা কোনো বিষয়ে সঠিক ধারনা না পাওয়া পর্যন্ত শিক্ষকরা তাদের সময় দেন। এটি এক ধরনের ফলপ্রসূ বিনিময় কৌশল।

সহযোগিতার মাধ্যমে কাজ করলে যে ভালো ফল পাওয়া যায়, এর অনেক প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকই বিচ্ছিন্নভাবে আলাদা আলাদা কাজ করে থাকেন। অথচ ফলপ্রসূ শিক্ষাদান, ব্যাক্তিগত উন্নয়ন এবং বিশ্লেষণধর্মী হওয়ার জন্য শিক্ষকদের একত্রে কাজ করা প্রয়োজন। এতে শিক্ষার্থীদের উচ্চতর শিখন অর্জন করা সম্ভব হয়। এই পদ্ধতিতে শিক্ষক প্রতিটি শিক্ষার্থীর ‘ফরম্যাটিভ অ্যাসেসমেন্ট’ করে থাকেন শিক্ষার্থীর যথাযথ উন্নয়ন ও পরিবর্তন লক্ষ্য করার এবং পরিমাপ করার জন্য। ফলে শিক্ষার্থীদের সত্যিকারের উন্নয়ন ঘটে থাকে যা একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মূল লক্ষ্য।

লেখক পরিচিতি

মাছুম বিল্লাহ বাংলাদেশে ইংলিশ টিচার্স অ্যাসেসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইট্যাব)-এর সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি পূর্বে ক্যাডেট কলেজ ও রাজউক কলেজের শিক্ষক হিসেবে কাজ করেছেন। কাজ করেছেন ব্র্যাকের শিক্ষা কর্মসূচিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে। তিনি ভাব বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর হিসেবেও কর্মরত রয়েছেন। তিনি নিয়মিত শিক্ষাবিষয়ে নানা প্রবন্ধ লিখছেন।

কোন মন্তব্য নেই

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Exit mobile version