শিক্ষার মূল লক্ষ্য হলো শিক্ষার্থীর সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ সাধন এবং সেই সাথে শিক্ষার্থীকে ভবিষ্যৎ সমাজের জন্য দক্ষ ও যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা। শিক্ষার মূল উপাদান প্রধানত দুটি- শিক্ষার্থী ও শিক্ষক। এছাড়া অন্যান্য উপাদানের মধ্যে রয়েছে- বিদ্যালয়, শিক্ষাক্রম, পাঠ্যপুস্তক, শিক্ষা উপকরণ ইত্যাদি। কিন্তু বর্তমানে আরও কিছু উপাদান এর সাথে যুক্ত হয়েছে, এমনকি অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেগুলো হলো- গাইড বই, কোচিং সেন্টার, হাউজ টিউটর, সাজেশন্স ইত্যাদি। কিন্তু এসব মিলিয়েও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থা থেকে উত্তীর্ণ অনেক শিক্ষার্থীকে সমাজ তার প্রয়োজনের তুলনায় অনুপযোগী বিবেচনা করছে। স্পষ্টতই, সমাজের চাহিদা দ্রুত বদলে যাচ্ছে এবং শিক্ষাব্যবস্থা তার সাথে তাল রেখে চলতে পারছে না। তাহলে বিদ্যমান সমস্যা কোথায়? আসুন একটু খতিয়ে দেখা যাক।
প্রত্যেক শ্রেণির জন্য শিক্ষাক্রম অনুযায়ী কিছু অবশ্যপাঠ্য পাঠ্যপুস্তক থাকে। আবার এসব পাঠ্যপুস্তক বহুবিধ বিষয়বস্তু দিয়ে ঠাসা থাকে। যারা এগুলো নির্বাচন করেন, তারা মনে করেন বর্তমান সময়ে এগুলো শিক্ষার্থীদের শেখা উচিত। কিন্তু বিষয়গুলো শেখা বাস্তব পরিপ্রেক্ষিতে কতটা সম্ভব ও যৌক্তিক? পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা, তাদের অভিভাবকবৃন্দ ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিগণ কী মনে করেন? বর্তমানে বাংলাদেশে প্রচলিত শিক্ষাক্রম ও শিখন-শেখানো কৌশল কি সমন্বিতভাবে শিক্ষার্থীদের ওপর কেবল মানসিক চাপই সৃষ্টি করছে? কেনই বা এই সকল বিষয়বস্তু পড়ে, কাঙ্ক্ষিত শিখনফল অর্জন করেও শিক্ষার্থীরা শ্রমবাজারে বিদ্যমান চাহিদা মেটাতে গিয়ে অসহায়বোধ করছে? শ্রমবাজারের চাহিদার তুলনায় বিষয়বস্তুসমূহ প্রকৃত অর্থেই কতটা যৌক্তিক?
এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে বইগুলো যদি একটু ভালো করে খতিয়ে দেখেন তবে হয়ত খেয়াল করবেন যে- আমাদের পাঠ্যপুস্তকে অবশ্যপাঠ্যবিষয়সমূহের বেশিরভাগই ঠিক বাস্তবজীবনের কর্মচাহিদাভিত্তিক নয়, বরং অনেকটাই একটি উদার আদর্শিকভিত্তি সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে উপযোগী। আমাদের প্রথম-দ্বিতীয়-তৃতীয় শ্রেণিতেই যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগসম্পর্কিত প্রায় সকল নিয়মকানুন শিক্ষার্থীদের শেখানো হয় যা অনেক উন্নত দেশের কারিকুলামে পঞ্চম-ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত শেখায়। গভীরে না গিয়ে দেখলে হয়ত মনে হবে- ‘এটা তো ভালো, সবাই আগে আগে শিখে যাচ্ছে’। কিন্তু সার্বিকভাবে ভেবে দেখলে বোঝা যায়- এই অতিরিক্ত চাপ নিতে গিয়েই কিন্তু অধিকাংশ শিক্ষার্থীর গণিতের প্রতি আজীবন ভীতি তৈরি হয়। শুধু গণিত না, অন্য যে কোনো বিষয়ের ক্ষেত্রেই এরূপ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ পাওয়া যাবে। এ কারণে হয়ত আমাদের দেশে যারা প্রথম সারির শিক্ষার্থী তারা একেবারে বইয়ের জগতে ডুবে গিয়ে বাস্তবতাবিবর্জিত মানসিকতায় নিমজ্জিত হয়ে তাত্ত্বিক বুলি আওড়ায় আর পেছনের সারির শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা থেকে বহুদূর সরে গিয়ে প্রায় বখে যায়।
আমাদের দেশে শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক, সকলেই সিলেবাস শেষ করার জন্য প্রকৃতির ডাকের মতো একটি তাড়া অনুভব করেন সবসময়। ফলে শ্রেণিতে শিক্ষক তাড়াহুড়া করেন এবং সামনের সারির কয়েকজন বুঝলেই মনে করেন সারা ক্লাস বুঝেছে। তবে প্রকৃত বাস্তবতা হলো- এই সামনের সারির শিক্ষার্থীরা শিক্ষক বোঝানোর আগে থেকেই বোঝে। শিক্ষকগণ একরকম তাড়াহুড়ার মধ্যদিয়েই সিলেবাস শেষ করে তৃপ্তির ঢেকুর তোলেন। কিন্তু তাতে সমস্যায় পড়ে ওই গুটিকয় শিক্ষার্থী ছাড়া বাকি সবাই। তারা মনে করে, যেহেতু বিষয়টি তারা বোঝেনি তার মানে এটা কঠিন বিষয় এবং এর জন্য তাকে কোচিংয়ে যেতে হবে, গাইড বই কিনতে হবে অথবা গৃহশিক্ষকের সহায়তা নিতে হবে। আমাদের সমাজে শিক্ষকের কোনো দোষ নেই, শিক্ষাক্রমের কোনো দোষ নেই, দোষ নেই পাঠ্যপুস্তকের। সকল দোষ গিয়ে পড়ে শিক্ষার্থীর ওপর। আর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ দোষ দেন শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক সবাইকে। শিক্ষাক্রম ঠিক আছে কিনা, পাঠ্যবইয়ের বিষয়বস্তু ঠিক আছে কিনা, মূল্যায়ন ব্যবস্থা ঠিক আছে কিনা তা তারা ভেবেও দেখেন না (বোধ হয় সময়ও নেই তাদের!)। অনেক সময় তাদের শুভবুদ্ধির উদয় হয়। তখন তারা সরকারের কাছ থেকে জনগণের টাকা নিয়ে বিদেশ ভ্রমণে বের হন, আসার সময় নিত্যনতুন কিছু পদ্ধতি নিয়ে হাজির হন যার অধিকাংশই এদেশীয় প্রেক্ষাপটে বাস্তবায়ন উপযোগী নয়।
এই অকারণ দোষারোপ আর টানা-হেঁচড়ায় সমস্যার গহীনে লুকানো প্রকৃত কারণ কিন্তু দৃষ্টির অগোচরেই রয়ে যায়। প্রশ্ন হলো শিক্ষার্থীরা কোচিং করে নাকি তাদের কোচিং করতে হয়? যদি কোচিং করতে হয় তাহলে কেন? সম্ভাব্য কিছু উত্তর হতে পারে এমন- শ্রেণিকক্ষে শিখন-শেখানো কার্যক্রম শিক্ষার্থীদের শিখনে সহায়ক নয়। অথবা শিক্ষক শিক্ষার্থীদের যথাযথ সহায়তা করতে পারছেন না। অথবা বিষয়বস্তুর ভারে শিক্ষকের পক্ষে শ্রেণিকক্ষে সম্পূর্ণ পাঠ্যপুস্তক সম্পন্ন করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। অথবা সকল শিক্ষার্থী শ্রেণিতে শিখনের ক্ষেত্রে সমান সুযোগ পাচ্ছে না। এরকম নানা ধরনের বাস্তবসম্মত কারণ থাকতে পারে। যথাযথ শিক্ষাক্রম তো সেটাই যা বিদ্যালয় চলাকালীন অর্থাৎ বিদ্যালয়ের মোট কর্মঘণ্টায় সম্পন্ন হবে। তাহলে কোচিং সেন্টার, গাইড বইয়ের চাহিদার কারণ হতে পারে শ্রেণিকক্ষ বা বিদ্যালয়ের মোট কর্মঘণ্টা শিক্ষার্থীর পুরো পাঠ্যপুস্তকের বিষয়বস্তু শেখার জন্য যথেষ্ট নয়। বিষয়বস্তুর পরিধি শিক্ষার্থীর জন্য বাড়তি চাপ তৈরি করে কিনা (এমনকি শিক্ষকের জন্যেও) সেটা ভেবে দেখার বিষয়।
সরকার নানা উদ্যোগ নিয়েও বন্ধ করতে পারছে না কোচিং সেন্টার, গাইড বই বিক্রয়। কারণ একটাই- শিক্ষার্থীদের এসবের প্রয়োজন আছে। আমাদের বিদ্যালয়, শিক্ষক, শিক্ষাক্রম, পাঠ্যপুস্তক শিক্ষার্থীদের কোচিং সেন্টার ও গাইড বইয়ের প্রয়োজন জিইয়ে রাখছে। অথবা শিক্ষার্থীদের চাহিদা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা মেটাতে পারছে না।
তাহলে এ সমস্যা থেকে উত্তরণের উপায় কী? আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে স্বভাবতই যেসকল প্রস্তাবনা বা সমাধানের দেখা পাওয়া যায় সেগুলো হলো-
প্রথমত, সময়ের বিবেচনায় এবং সমাজের চাহিদা মাথায় রেখে আমাদের শিক্ষাক্রমকে ঢেলে সাজাতে হবে। এক্ষেত্রে দূরদর্শী চিন্তাভাবনা করতে হবে। আগামী দশ বছরে সমাজে কী ধরনের দক্ষতা, যোগ্যতার প্রয়োজন হবে সে অনুযায়ী শিক্ষাক্রম সাজাতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে যেন দশ বছরে পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি পর্বেই পাঁচ-সাত বছর কেটে না যায়। সাথেসাথে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারের চাহিদা বিবেচনায় রাখতে হবে।
অপ্রয়োজনীয় বিষয় বাদ দিয়ে প্রয়োজনীয় বিষয়সমূহ অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে যেন কোনোভাবেই বিষয়বস্তুর ভার শিক্ষার্থীর জন্য অসহনীয় না হয়। প্রত্যেক শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক প্রণেতাকে মাথায় রাখতে হবে যে, শিক্ষার্থী শুধু একটি বিষয় পড়ে না, তাকে অন্যান্য বিষয়ও পড়তে হয়।
দ্বিতীয়ত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণের ক্ষেত্রে ক্যাচমেন্ট এরিয়ার পাশাপাশি জনসংখ্যার ঘনত্বের বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে। তা না হলে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত ঠিক থাকবে না। এক্ষেত্রে জনবহুল এলাকার স্কুলগুলোতে এই অনুপাত ঠিক রাখতে শিফট অনুযায়ী বিদ্যালয় পরিচালিত হতে পারে।
তৃতীয়ত, মূল্যায়ন ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হবে। আধুনিক মূল্যায়ন পদ্ধতিসমূহ ব্যবহার করতে হবে। পাঠ্যবইয়ের সাথে মিল রেখে অভীক্ষা তৈরি করতে হবে। তা হয় না বলেই শিক্ষার্থীরা অভীক্ষার প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার আশায় গাইড বইয়ের শরণাপন্ন হয়। খুঁজে ফেরে সাজেশন্স। আর বিদ্যমান মূল্যায়ন পদ্ধতিতে যারা মেধাবী হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছে তারা অন্যান্য প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় তাদের সাফল্য ধরে রাখতে পারছে না। অর্থাৎ অভীক্ষাগুলোর ভবিষ্যৎ সম্ভাবনামূলক যথার্থতা থাকছে না। এগুলো মূল্যায়ন ব্যবস্থার ত্রুটিসমূহই নির্দেশ করে।
চতুর্থত, আধুনিক শিখন-শেখানো পদ্ধতির প্রয়োগ, বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানের গভীরতা, শিক্ষার্থীর শিখনে সাহায্য করা, উপযুক্ত মূল্যায়ন কৌশলের প্রয়োগ সবকিছুর জন্য প্রয়োজন দক্ষ ও যোগ্য শিক্ষক। তার জন্য শিক্ষকতাকে একটা আকর্ষণীয় পেশা হিসেবে উপস্থাপন করতে হলে এ পেশায় সম্মান ও সম্মানী দুটোই বাড়াতে হবে। শিক্ষককে দক্ষ করে তুলতে শিক্ষক শিক্ষার ওপর জোর দিতে হবে। পাশাপাশি প্রচলিত শিক্ষক প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে তাত্ত্বিক জ্ঞানবিমূখী অথচ বাস্তব দক্ষতা ও তার প্রয়োগমুখী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
সবশেষে সারগ্রাহী ভাবনায় বলা চলে- আদর্শ শ্রেণিকক্ষে দক্ষ ও যোগ্য শিক্ষক যদি সময়ের চাহিদা পূরণে সক্ষম এমন বিষয়বস্তু সম্বলিত পাঠ্যপুস্তক অনুসরণ করে আধুনিক শিখন-শেখানো পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীকে শিক্ষালাভে সহায়তা করেন এবং যথাযথভাবে মূল্যায়ন করেন তবেই সম্ভব হবে আকাঙ্ক্ষিত মাত্রায় শিখনফল অর্জন। সার্থক হবে শিক্ষাব্যবস্থা, অর্জন করা সম্ভব হবে শিক্ষার প্রকৃত লক্ষ্য।
গ্রন্থপঞ্জী
Führ C. (1997), The German Education System Since 1945: Outlines and Problems, InterNationes, Bonn
H. Ertl and D. Phillips, The Enduring Nature of the Tripartite System of Secondary Schooling in Germany: Some Explanations,” British Journal of Educational Studies 4:394.
Shogo I. (1991), Distinctive Features of Japanese Education.
OECD (1971), Reviews of National Policies for Education: Japan, OECD
Kaoru O. (2001), Education of the Rising Sun 21: An Introduction to Education in Japan NFSE, Japan
Tetsuya K. (1976), Society, Schools and Progress in Japan, Pergamon Press
Benjamin D. (1986), The Japanese School, Praeger Publishers
Cummings W.K.(1980), Education and Equality in Japan, Princeton University Press
Japan International Cooperation Agency (2004), The History of Japan’s Educational Development, JICA