সাবরিনা সুলতানা লিখেছেন শিক্ষাঙ্গনে বাধা, সঙ্গতিপূর্ণ বন্দোবন্ত ও প্রবেশগম্যতা নিয়ে
মস্তিস্ক পক্ষাঘাত প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী ছোট্ট অনয়। হুইলচেয়ার তার নিত্যসঙ্গী। ঢাকার সিদ্ধেশ্বরী বালক উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত নিচতলাতেই শ্রেণিকক্ষ ছিলো। প্রতিদিন হুইলচেয়ার নিয়ে শ্রেণিকক্ষে যেতে দু’জায়গায় দু’ধাপ সিঁড়ি পাহাড়সম মনে হতো যদিও, তবুও পড়ালেখা ছাড়লো না সে।
সিঁড়ির এই ধাপগুলো টানাহেঁচড়া করে পেরুতে বাবাকেই উদ্যোগী হতে হয়। এভাবেই পিএসসিতে ভালো রেজাল্ট করলো ছেলেটা। কিন্তু ষষ্ঠ শ্রেণিতে উঠে পড়ল বিপাকে। এবার শ্রেণিকক্ষ দোতালায়! হুইলচেয়ার নিয়ে প্রতিদিন দোতলায় কীভাবে উঠবে সে?
মাস্কুলার ডিস্ট্রফির সম্মুখীন তাসনিনের পথ চলাতেও হুইলচেয়ার প্রয়োজন। শিক্ষাঙ্গনে একই সমস্যায় জর্জরিত সে ও তার পরিবার। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যা হয়, তাসনিনের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হলো না। কোনো বিদ্যালয়ই তাদের অ-প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর সাথে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীকে ভর্তি করাতে রাজি নয়।
অ-প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর অভিভাবকগণের অভিযোগের সম্ভাবনা থাকতে পারে বলে মূলধারার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে অঙ্কুরেই ঝড়িয়ে দেওয়া হয় প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের। অনেকক্ষেত্রে কোনোপ্রকার অভিযোগ না পেলেও বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নিজ থেকেই প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের ভর্তি করাতে চান না।
অন্যান্য অ-প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর অভিভাবকগণের অভিযোগের সম্ভাবনা থাকতে পারে বলে মূলধারার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে অঙ্কুরেই ঝড়িয়ে দেওয়া হয় প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের। অনেকক্ষেত্রে কোনোপ্রকার অভিযোগ না পেলেও বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নিজ থেকেই প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের ভর্তি করাতে চান না।
কিন্তু নাছোড়বান্দা তাসনিনের বাবা-মা চট্টগ্রাম শহরের অসংখ্য বিদ্যালয়ের দ্বারে দ্বারে ঘুরে অবশেষে একটি বিদ্যালয়ে ভর্তি করাতে পেরেছেন তাদের কন্যাকে। কিন্তু বছর না ঘুরতেই দোতলায় হয়ে গেল সপ্তম শ্রেণিকক্ষ! এখন কী করবে তাসনিন? তার বিদ্যালয় কি শুধু তার জন্য বাড়তি বা আলাদা ব্যবস্থা নেবে?
বাবা-মায়ের আপ্রাণ চেষ্টায় বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সমস্যা বিবেচনায় সমাধানের চেষ্টা করতে উদ্যোগী হলেন। অবশেষে চট্টগ্রাম রেসিডেন্সিয়াল বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দারুণ এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন একজন হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী শিক্ষার্থীর জন্য সম্পূর্ণ শ্রেণিকক্ষ প্রতি বছরই নিচতলায় নামিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়ে।
তাসনিন নির্বিঘ্নেই নিচতলায় পাঠের সুযোগ পেল এবং কৃতিত্বের সাথে সপ্তম শ্রেণি থেকে মাধ্যমিক পাশ করে সরকারি কলেজে ভর্তি যোগ্যতা অর্জন করল। কিন্তু আবার বাধ সাধলো তাকে বহনকারী হুইলচেয়ারটি।
সরকারি কলেজগুলো তার জন্য নিচতলায় ক্লাস নিতে অপরাগতা প্রকাশ করে। খুঁজতে গিয়ে নাসিরাবাদ মহিলা কলেজের নিচতলায় শ্রেণিকক্ষের সন্ধান যদিও পাওয়া যায়, কিন্তু কলেজের শিক্ষক তাসনিনের হতভম্ব মাকে জানালেন, সরকারি আদেশের কারণে শুধু অটিস্টিক শিক্ষার্থীদের প্রাধান্য দেন তারা। তাসনিনের অটিজম হলে বিবেচনা করা হতো।
এবার বিভিন্ন বেসরকারি কলেজ ঘুরে নিচতলায় শ্রেণিকক্ষের সুবিধা পেয়ে সেখানেই ভর্তি হয়ে গেল। কিন্তু দ্বিতীয় বর্ষে উঠার পর শ্রেণিকক্ষটি আবার দোতলায়। একজনের জন্য সবাইকে নিয়ে নিচতলায় পাঠদানে রাজি নন কর্তৃপক্ষ। তাদের ভাষ্যমতে, দ্বিতীয় বর্ষে মাত্র দু-তিন মাস শিক্ষাকার্যক্রম চলে, তা না করলেও চলবে তাসনিনের!
তাসনিনের এই লড়াই চালিয়ে নেওয়ার মনোবল কতদিন থাকবে তা ভবিষ্যতের হাতে তুলে দিয়ে আসুন জানি নারায়ণগঞ্জ হোমিওপ্যাথি কলেজের এক শিক্ষার্থীকে। কলেজটির প্রধান শিক্ষকের নেতিবাচক মনোভাবের কারণে শিক্ষার্থী সুমাইয়ার হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন ধূলিসাৎ!
শুধু শারীরিক প্রতিবন্ধিতার অভিযোগে সুমাইয়া হোমিওপ্যাথ বিষয়ে পড়তে অযোগ্য জানিয়ে তাকে ভর্তি নিলেন না তিনি। হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী মানুষের সহায়ক গণপরিবহন আজও এদেশে স্বপ্ন! যাতায়াত সমস্যার কারণে দূরবর্তী হোমিওপ্যাথি কলেজে পড়ে স্বপ্নপূরণের ভাবনা স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি সে। বাসার কাছের হোমিওপ্যাথি কলেজে ভর্তি হতে না পেরে আপাতত ঘরবন্দী সুমাইয়া হতাশায় দিন অতিবাহিত করছে।
আমাদের সমাজের সর্বস্তরে প্রতিবন্ধী মানুষের স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণের জন্য প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সর্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করতে Inclusive Education বা একীভূত শিক্ষানীতি ২০১০ রয়েছে।
জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এর প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে, মানসম্পন্ন প্রাথমিক শিক্ষা প্রদানের জন্য জাতিসত্ত্বা, আর্থ-সামাজিক ও শারীরিক সীমাবদ্ধতার কারণে সকল শিশুর জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করা হবে।
অথচ নয় বছর গড়িয়েছে। আজ অবধি এর পুরোপুরি প্রচলন শুরু হয়নি। প্রতিবন্ধী ব্যক্তি অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩ অনুযায়ী, প্রতিবন্ধী শিশুদেরকে বিদ্যালয়গামী করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের বিষয়ে কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে সরকার।
একীভূত শিক্ষা বাস্তবায়নের তাগিদে প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে (পিইডিপি) মোটা অংকের অর্থও বরাদ্দ পেয়েছে। পিইডিপি বাস্তবায়ন হলে চাহিদাভিত্তিক অবকাঠামো উন্নয়নসহ সরকারি বিদ্যালয়গুলোতে সব ধরনের প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের অধিকার সুরক্ষার্থে প্রয়োজন অনুযায়ী শিক্ষা ও সহায়ক উপকরণসহ শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও থাকার কথা।
এদিকে বাংলাদেশ অনুস্বাক্ষরিত জাতিসংঘ প্রতিবন্ধী ব্যক্তি অধিকার সনদ সিআরপিডি-এর ধারা ৯ অনুযায়ী প্রবেশগম্যতা নিশ্চিতে সরকারের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এছাড়া সিআরপিডি-এর ধারা ২৪ এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তি অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩ তেও প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর শিক্ষা নিশ্চিত করতে ভর্তির ক্ষেত্রে বৈষম্য করা তো যাবেই না; উপরন্তু তাদের জন্য প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত নতুবা সঙ্গতিপূর্ণ বন্দোবস্তের (reasonable accommodation) উল্লেখ রয়েছে।
ঢাকা ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ২০০৮-এর পর জাতীয় ইমারত নির্মাণ বিধিমালা মন্ত্রীপরিষদে পাশ হয়েছে ২০১৭ সালে। এই বিধিমালায় সর্বজনীন প্রবেশগম্যতা বিষয়টি আগের চেয়েও বিস্তৃত পরিসরে এসেছে।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, তাসনিন এবং অনয়ের শিক্ষাজীবন মসৃণ রাখতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গৃহীত উদ্যোগই হচ্ছে সঙ্গতিপূর্ণ বন্দোবস্ত। যেকোনো প্রতিষ্ঠান প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত করতে না পারলেও প্রতিবন্ধী মানুষের উপযোগী সঙ্গতিপূর্ণ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। এতে বাধামুক্ত স্বাধীন জীবন পায় তারা।
প্রায় সকল বিদ্যালয়ে উপরতলায় শ্রেণিকক্ষ থাকার কারণে শারীরিক প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী বিশেষত যারা সহায়ক উপকরণের সাহায্যে চলাচল করেন, তারা শিক্ষার অধিকার বঞ্চিত হন।
কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখতে পাচ্ছি, প্রায় সকল বিদ্যালয়ে উপরতলায় শ্রেণিকক্ষ থাকার কারণে শারীরিক প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী বিশেষত যারা সহায়ক উপকরণের সাহায্যে চলাচল করেন, তারা শিক্ষার অধিকার বঞ্চিত হন।
অনয়, তাসনিন, সুমাইয়ার মতো ঘটনা সারাদেশের প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের সাথে অগুনতিবার ঘটছে এবং ঘটে যাচ্ছে, যার অনেক খবরই আমরা পাই না। যারা প্রতিকূলতা ডিঙ্গানোর শক্তি ধারণ বা লালন করেন, একমাত্র তারাই এ যুদ্ধে জয়ী হতে পারেন। বাকীরা পিছিয়ে পড়েন শিক্ষা, চাকরি, বিনোদনসহ মৌলিক অধিকারগুলো থেকে।
এক্ষেত্রে পারিবারিক তথা সামাজিক অ-সচেতনতা যেমন দায়ী, তেমনি শিক্ষাসহায়ক ব্যবস্থার পাশাপাশি সহায়ক যাতায়াত ব্যবস্থার অভাব এবং সর্বত্র প্রবেশগম্যতার অভাবও অনেকটা দায়ী।
আমাদের ভাবতে হবে, একজন শিক্ষার্থীকে দিনের বেশিরভাগ সময় বিদ্যালয়ে কাটাতে হয়, সেখানকার পরিবেশ তার অনুকূল হওয়াটাই বাঞ্চনীয়। কিন্তু প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময় তা হয় না।
এক্ষেত্রে বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীর শিক্ষা নিশ্চিত করতে তাদের উপযোগী ব্যবস্থা নেওয়া আবশ্যক। প্রয়োজনীয় উপকরণ এবং শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু বিদ্যালয়গুলো, বিশেষত শিক্ষক এবং সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবান্ধব করতে সরকারের নেওয়া উদ্যোগের বিষয়ে কতোটা সচেতন, তা নিয়ে ইতোমধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে।
একদিকে একীভূত শিক্ষা বাস্তবায়নের প্রত্যাশায় প্রহর গুনছেন প্রতিবন্ধী মানুষেরা। অন্যদিকে গুটিকয়েক শিক্ষার্থী যারা সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অংশগ্রহণ করছে, তারা সম্মুখীন হচ্ছে অবকাঠামোগত বাধার। শিক্ষক এবং কর্তৃপক্ষের অসহযোগিতা শিক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রে হচ্ছে প্রধান অন্তরায়। যেন প্রতিবন্ধিতাই একমাত্র অভিশাপ!
আমাদের দেশে বিশেষ শিক্ষাপদ্ধতির কিছু বিশেষ বিদ্যালয় আছে শ্রবণ ও বাক প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী, দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী এবং বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ও অটিস্টিক শিশুদের জন্য।
কিন্তু শারীরিক প্রতিবন্ধী মানুষেরা না পারে বিশেষ বিদ্যালয়ে যেতে, না পারে সাধারণ বিদ্যালয়ে যেতে। অনেকটাই জনবিচ্ছিন্ন গুরুতর শারীরিক প্রতিবন্ধী মানুষের শিক্ষা গ্রহণের জন্য বিশেষ পদ্ধতির প্রয়োজন নেই; প্রয়োজন ভবনগুলোতে চাহিদা অনুযায়ী সহায়ক প্রবেশগম্যতা বা সঙ্গতিপূর্ণ বন্দোবস্ত গ্রহণের।
প্রবেশগম্যতার ব্যবস্থা শারীরিক প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি দৃষ্টি ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্যও প্রযোজ্য, যা আইন ও নীতিমালায় আবদ্ধ হয়ে থাকে কেবল। শুধু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নয়, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও যাতে র্যাম্প ও অন্যান্য সুবিধাদি বাড়ানো যায়, সে বিষয়ে যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।
এজন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রতিবন্ধী মানুষের চাহিদার ভিন্নতা অনুযায়ী সহায়ক ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। যেমন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য ব্রেইল পদ্ধতি, শ্রবণ ও বাক প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য বাংলা ইশারা ভাষা পদ্ধতি ইত্যাদি।
এজন্য প্রতিটি বিদ্যালয়ে ন্যূনতম একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক প্রয়োজন। সকল ধরনের প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী যদি সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাথে একই শ্রেণিকক্ষে পাঠগ্রহণ করে তবেই একীভূত শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত হওয়া সম্ভব।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় কর্তৃক পরিচালিত সারা দেশের ১২টি বিশেষায়িত বিদ্যালয় এবং মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত আরও বেশ কিছু বেসরকারি বিদ্যালয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতায় আসার কথা বহুদিন ধরে।
জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এর চূড়ান্ত খসড়াতে উল্লেখ করা আছে, বিশেষায়িত এই বিদ্যালয়গুলো প্রাথমিক শিক্ষা ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে হস্তান্তরের বিষয়ে। দেশের সকল শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকাটাই স্বাভাবিক। তবে বিশেষ শিক্ষাব্যবস্থার নামে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় আজও এর সকল কার্যক্রম ও সিদ্ধান্ত পরিচালিত হচ্ছে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে।
অপ্রতুল জনবল, পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের অভাবে এই বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষাব্যবস্থা প্রায় মুখ থুবড়ে রয়েছে। এদেশের শিক্ষাব্যবস্থা বিশেষায়িত হলেও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হওয়ার প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য জেনেও গড়িমসি হচ্ছে।
অপ্রতুল জনবল, পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের অভাবে এই বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষাব্যবস্থা প্রায় মুখ থুবড়ে রয়েছে। এদেশের শিক্ষাব্যবস্থা বিশেষায়িত হলেও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হওয়ার প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য জেনেও গড়িমসি হচ্ছে।
আমরা অনেকেই জানি, সমন্বিত দৃষ্টি শিক্ষাকার্যক্রম প্রকল্প বর্তমানে দেশের ৬৪টি জেলায় মূলধারার একটি করে সরকারি বিদ্যালয়ে পরিচালিত হচ্ছে। সমাজসেবা অধিদফতর কর্তৃক নির্ধারণকৃত এসব বিদ্যালয়ের সাথে একটি আলাদা রির্সোস কক্ষ নির্মাণ করে একজন রিসোর্স শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এখানে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষা উপযোগী উপকরণগুলো সংরক্ষণ করা হয়।
প্রতিটি বিদ্যালয়ে দশজন করে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীকে ব্রেইল পদ্ধতি, ওরিয়েন্টেশন মোবিলিটি, সামাজিক যোগাযোগ দক্ষতা, শ্রেণিকক্ষের সবার সাথে মিলেমিশে শিক্ষাগ্রহণের নানা কৌশল, দৈনন্দিন জীবন-যাপন প্রণালী এবং অন্যান্য বিষয়ে শিক্ষা প্রদান করা হয়।
যেহেতু দেখা যাচ্ছে, একীভূত শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়ন একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা। সুতরাং সকল ধরনের শিক্ষার্থীদের জন্য সরকারের একীভূত শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়নের পাশাপাশি সমন্বিত দৃষ্টি শিক্ষা কার্যক্রমের উদ্যোগ যেভাবে নেয়া হয়েছে, সেভাবেই প্রতিটি সরকারি বিদ্যালয়ে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি সকল ধরনের প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্যও এমন কার্যক্রমের উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। নতুবা শ্রবণ ও শারীরিক প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা পিছিয়েই থাকবে।
শিক্ষা, চাকরি, সহায়ক যাতায়াত ব্যবস্থা ও সর্বত্র প্রবেশগম্যতা একটি অপরটির সাথে ভীষণভাবে সম্পৃক্ত। যেভাবেই হোক একজন মানুষের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া খুব প্রয়োজন। শিক্ষার সাথে চাকরির ব্যাপারটি অনেকাংশেই জড়িয়ে থাকে।
শিক্ষা, চাকরি, সহায়ক যাতায়াত ব্যবস্থা ও সর্বত্র প্রবেশগম্যতা একটি অপরটির সাথে ভীষণভাবে সম্পৃক্ত। যেভাবেই হোক একজন মানুষের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া খুব প্রয়োজন। শিক্ষার সাথে চাকরির ব্যাপারটি অনেকাংশেই জড়িয়ে থাকে। শিক্ষা এবং চাকরি কোনোটিই সম্ভব নয় যদি সহায়ক যাতায়াত ব্যবস্থা না থাকে।
আবার শিক্ষা, চাকরি, যাতায়াত এই তিনটি ব্যবস্থা থাকলেও কোথাও যদি ব্যক্তির চাহিদা অনুযায়ী প্রবেশের সুবিধা না থাকে, তাহলে প্রতিবন্ধী মানুষের সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে ওঠা অসম্ভব।
এবার সমাজ পরিবর্তনের একটি ইতিবাচক সফলতার গল্প বলা যাক। বাংলাদেশে এই প্রথম কোনো বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শারীরিক প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য সুলভমূল্যের ম্যানুয়াল লিফট এবং দুটি র্যাম্প নির্মাণের মাধ্যমে নিশ্চিত হয়েছে হুইলচেয়ার প্রবেশগম্যতা।
এখানে অভাবনীয় ব্যাপারটি হলো, এই ম্যানুয়াল লিফটটি নির্মাণ করেছেন আরেকজন হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী ব্যক্তি। অর্থাৎ একজন হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী মানুষের চলার পথকে বাধামুক্ত করলেন আরেক হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী ব্যক্তি।
একটি স্বেচ্ছাশ্রমধর্মী সংগঠনের উদ্যোগে এই ঐতিহাসিক ঘটনাটির শুভ সূচনা হয় প্রায় দু’বছর আগে। নানা বাধাবিপত্তি পেরিয়ে সিদ্ধেশ্বরী বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী অনয়ের শিক্ষার পথ মসৃণ রাখতে এই ম্যানুয়েল লিফট তৈরি করা এবং সে পর্যন্ত পৌঁছাতে দুই জায়গায় দুটি র্যাম্প নির্মাণ করতে কর্তৃপক্ষকে রাজি করানো সম্ভব হয়।
দুটো বছর লেগেছে শুধু সংশ্লিষ্ট মহলকে উদ্বুদ্ধ করতে, তাদের এই সহায়ক ব্যবস্থাটির প্রয়োজনীয়তা এবং গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করতে। কাজ শেষ হওয়ার পর ছোট্ট অনয়ের সাথে আমাদের প্রিয় লেখক ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবাল স্যার ফিতা কেটে উদ্বোধন করেছেন ম্যানুয়েল লিফট ও দু’টি র্যাম্পের।
শারীরিক প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর শিক্ষার পথ সুগম করতে নেওয়া এই উদ্যোগটি দেশের যে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই সম্ভব। এধরনের দৃষ্টান্ত যত বেশি স্থাপন হবে প্রতিকূলতা ততো বেশি কমবে।
তবে প্রবেশগম্যতার পাশাপাশি ধীরে ধীরে ব্রেইল ও বাংলা ইশারা ভাষা পদ্ধতিতে পাঠদানের বিষয়েও আমাদের ভাবতে হবে। ভাবতে হবে সম্পূর্ণরূপে একীভূত শিক্ষা ব্যবস্থা বাস্তবায়ন বিষয়ে। সরকারের পাশাপাশি সম্মিলিত উদ্যোগ এবং পারিবারিক ও সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধিতেই একমাত্র এর বাস্তবায়ন সম্ভব।
সবে তো শুরু। প্রত্যাশা— একদিন দেশের প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ধীরে ধীরে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবান্ধব হয়ে যাবে। প্রতিবন্ধী ও অ-প্রতিবন্ধী সকল শিশুর জন্য বিদ্যালয় হবে প্রবেশগম্য। সকলেই পাবে শিক্ষার সমঅধিকার। বাদ যাবে না একটি শিক্ষার্থীও।
সাবরিনা সুলতানা: বাংলাদেশের প্রতিবন্ধী মানুষের অধিকার অর্জনে লেখালেখির পাশাপাশি প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সংগঠন (ডিপিও) বাংলাদেশ সোসাইটি ফর দ্যা চেঞ্জ এ্যান্ড অ্যাডভোকেসি নেক্সাস (বি-স্ক্যান)-এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে কাজ করছেন। পাশাপাশি প্রতিবন্ধী মানুষের কন্ঠস্বর হিসেবে ত্রৈমাসিক অপরাজেয় নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করছে বি-স্ক্যান যেখানে প্রধান সম্পাদক হিসেবে কর্মরত।
লেখক পরিচিতি
সম্পাদক বাংলাদেশের শিক্ষা
এই লেখাটি সম্পাদক কর্তৃক প্রকাশিত। মূল লেখার পরিচিত লেখার নিচে দেওয়া হয়েছে।