বোধ

মুক্তিপণ, ছবিসূত্র: কক্সবাংলা (coxbangla.com)

কেন এই নাম দিলাম ব্যাখ্যা করতে পারবো না। মূল্যবোধ বা নৈতিকতা-বোধ এসব তাত্ত্বিক কোনো কথা বলতে চাচ্ছি না। খুব সাধারণ কিছু অনুভূতির কথাই বোধ হিসেবে বোঝাতে চাচ্ছি গত ক’দিনের কিছু খবরের প্রতি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। যা আমার সাধারণ বোধ দিয়ে আমি মানতে পারছি না। মূল লেখার আগে নিচের তিনটি খবর পড়ি-

বোধ ১
বোধ ২

তিনটি খবরই আমাদের পড়া হয়ে গেছে খবরের কাগজের কল্যাণে। আমি জানি কারা কীভাবে খবরগুলো নিচ্ছেন। তবে ভালোভাবে বা ইতিবাচকভাবে কেউ নিচ্ছে না তা বলে দিতে পারি চোখ বন্ধ করে। আমি যখনই এই ধরনের খবরগুলো পড়ি বুকটা ধ্বক করে ওঠে, বাইরে থাকলে সাথে সাথে বাসায় ফোন দেই। আমার ঠিক এই বয়সী দুটি ছোট ভাই আছে। খবরের কাগজে যার কথাই পড়ি না কেন, মনে পরে যায় ওদের কথা। একটা ভয়াবহ আতঙ্ক মুহূর্তেই গিলে ফেলে আমাকে। হয়তো আমার মতো যাদের এই বয়সী ভাই-বোন বা ছেলে-মেয়ে আছে সবার মধ্যেই এই বোধ কাজ করে।

গত কয়েকদিনে এ ধরনের খবের হার অনেক বেড়েছে। আমি সঠিক পরিসংখ্যান হয়তো দিতে পারবো না, কিন্তু যারা নিয়মিত খবরের কাগজ পড়েন তারা আমার সাথে একমত হবেন। ঘটনাগুলো একরকম আতঙ্ক নিয়ে পড়া হয়। পড়ার পর বিশ্লেষণ করে দেখলাম- মূল মোটিভ বা উদ্দেশ্য যাই বলি না কেন, তাকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়।

এক: মুক্তিপণ আদায়। সোজা কথায় টাকা কেড়ে নেওয়া অভিভাবকদের কাছ থেকে।
দুই: নিজের পশুবৃত্তির বহিঃপ্রকাশ।

এটি গেলো ঘটনার একটা দিক। অন্য দিকটি হলো যারা ঘটনাগুলো ঘটাচ্ছে তারা কারা। তারা তো আমাদের সমাজেরই মানুষ। আমাদের মাঝেই বেঁচে আছে। আরও অদ্ভুত ব্যাপার হলো, এই ঘটনাগুলো ঘটাচ্ছে কলেজে পড়া বা কলেজ পাশ করা ঐ বয়সী ছেলেরাই। শুধু ছেলেরাই। তাদের সাথে হয়তো উদ্যোক্তা হিসেবে অন্য বয়সী কেউ থাকে। কিন্তু ধরা পড়ছে এই কিশোর বা কিশোর-উত্তীর্ণরা।

কেন এমন হচ্ছে? এই বয়সটা তো আনন্দে ভাসার বয়স, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়ার বয়স, খেলাধুলার বয়স, স্বপ্ন দেখার বয়স। তাদের কেন টাকার প্রয়োজন এতটাই বেশি হবে যে- টাকার জন্য তাদের শিশুহত্যার মতো জঘণ্য কাজে লিপ্ত হতে হবে? অথবা এই বয়সে কেন তাদের পাশবিকবৃত্তির দাসত্ব করতে হবে? সাদা চোখে আমার কাছে যে কারণগুলো মূল মনে হচ্ছে তা কিছু পয়েন্ট তুলে ধরলাম-

১. আমাদের মিডিয়া, আমাদের নাটক-সিনেমা-সিরিয়াল-গল্প-উপন্যাস যার কথাই বলি না কেন, পাশবিকবৃত্তির কোনো না কোনো ঘটনা সেখানে চলে আসে। হতে পারে এর ভালো দিকও আছে, এটা যে খারাপ তা বোঝানোর জন্যই হয়তো নাটক-সিনেমাতে তা দেখানো হচ্ছে। কিন্তু বিষয়টি কারা কীভাবে নিচ্ছে? খারাপ জিনিসটা দেখে যদি কোনো কিশোরের মনে হয় আমিও এই কাজটি করে দেখি কী হয়, তাহলে কি তাকে আমরা দোষ দিতে পারি? এই বয়সেই তো মানুষ অজানাকে জানার চেষ্টা করে।

২. স্ট্যাটাস বজায় রাখা- আজকাল দামি মোবাইল থাকা, আইপড বা আইফোন থাকা, ল্যাপটপ থাকা সবই হলো স্ট্যাটাসের বহিঃপ্রকাশ (সাম্প্রতিক খবর চীনে এক কিশোরের আইফোন কেনার জন্য কিডনি বিক্রি, এরকম আরও অনেক খবরই পাওয়া যাবে)। তাই এই জিনিসগুলো পাবার আকাঙ্ক্ষা কিশোরদের মনে জাগতেই পারে। আর সেজন্য অর্ত্থের জন্য তারা মরিয়া হয়ে অনেক অনর্থ ঘটাতে পারে। এটাকে কি আমার তার দোষ বলবো?

৩. আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা- আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার ত্রুটি। এই বিষয়টি একটু জটিল আমার আছে। যে কোনো সমাজের ভিত গড়ে ওঠে তার শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করে। তাই কোনো সমাজে যখন কোনো বিশেষ সমস্যা তৈরি হয় তখন স্বভাবতই আঙ্গুল চলে যায় শিক্ষার ব্যবস্থার দিকে। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা আমাদের শেখাতে পারছে না নিজেকে সংযত করতে, শেখাতে পারছে না লোভ থেকে দূরে থাকতে। গলদটা শিক্ষাব্যবস্থার কোথায়?

৪. পরিবার- পরিবারটা সবার পরে রাখলেও তার অবদান সবচেয়ে বেশি। কারণ পরিবার থেকেই সব কিছুর শুরু। পরিবার যদি সঠিকভাবে এই ইস্যুগুলো শেখাতে না পারে তাহলে আমরা কি এই কিশোরগুলো দোষ দিতে পারি?

এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আমি নিজেও জানি না। তবে এটি বলতে পারি, এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা না। এটা অনেকগুলো ঘটনার বা কারণের ফল এবং সেই ফলের বহিঃপ্রকাশ। আমাদের সবাইকে এই ব্যাপারগুলো নিয়ে এখনই সতর্ক হতে হবে, না হলে হয়তো পরিস্থিতি আমাদের আয়ত্তের বাইরে চলে যাবে, যা কারো কাম্য নয়।

লেখক পরিচিতি

আকলিমা শরমিন

আকলিমা শরমিন বাংলাদেশের শিক্ষা ওয়েবসাইটে সহ-সম্পাদক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।

1 মন্তব্য

  1. আমি ও আমার স্ত্রী এ জাতীয় ঘটনার কারণে আমাদের সন্তান জন্মের পরপরই একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। আমরা দুজনে যেকোন একজন সকল সময় আমাদের সন্তানের কাছে থাকবো। এসএসসি পরীক্ষা পাস করার আগ পর্যন্ত ওকে কখনোই একা থাকতে দিবো না, এতে আমাদের যত কষ্টই হোক না কেনো। আশে পাশের ভাড়াটিয়া, প্রতিবেশী, এমনকি ছেলের কাজিন (আমার ভাতিজা বা ভাগিনা) কারো কোন অনুরোধেও আমাদের ছেলেটিকে তাদের সাথে একা গিয়ে খেলা করতে দেই না। এতে আমাদের নিজের বিভিন্ন কাজে ব্যাঘাত ঘটে। যা আমরা ম্যানেজ করে নেই। আমরা বলি, হয় আমাদের সাথে নিয়ে যাও, আর নয়তো ভাগো, যা মনে করার করতে পারো। এবং আমরা দুজন একমত হয়েছি, যে কেউ এসে যদি বলে, আপনার স্বামী বা স্ত্রী আপনার ছেলেকে আমার সাথে দিতে বলেছেন, এই যে উনি চিঠি লিখে দিয়েছেন বা ফোন করে জেনে নিন। তাহলে সেই ব্যক্তিকে সোজা থানায় নিয়ে যাওয়া হবে। বাধ্য হয়েই অসামাজিক হতে হয়েছে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Exit mobile version