বাড়ি পরীক্ষা ও মূল্যায়ন ব্যবস্থা

লেখাপড়া সমাচার: ব্যবহারিক রঙ্গ

ব্যবহারিক পরীক্ষা নিয়ে চলে বিশার দুর্নীতি; ছবিসূত্র: bd-journal.com
ব্যবহারিক পরীক্ষা নিয়ে চলে বিশার দুর্নীতি; ছবিসূত্র: bd-journal.com

অষ্টম শ্রেণি পেরিয়ে নবম শ্রেণীতে উঠেই আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা ‘প্র্যাকটিক্যাল’ বা ব্যবহারিক নামক পড়াশুনার একটা নতুন অংশ পেয়ে থাকে। তারা স্বাভাবিকভাবেই ধরে নেয়, এবার বুঝি হাতেকলমে শেখানো হবে। কাজেই তাদের ভিতরে এক ধরনের উত্তেজনা ও আগ্রহ দেখা দেয়। তারা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকে কবে হবে এই প্র্যাকটিক্যাল ক্লাশ।

বহু আকাঙ্ক্ষার পরে আসে সেই প্রত্যাশিত প্র্যাকটিক্যাল ক্লাশ। শিক্ষার্থীরা উত্তেজনায় প্রায় কাঁপতে কাঁপতে প্রবেশ করে ল্যাবরেটরিতে। তারা অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখে পরীক্ষাগারের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি কঙ্কাল, মিউজিয়াম স্পেসিমেন, স্লাইড, বিকার, রাসায়নিক উপাদান, সরল দোলক, স্লাইড ক্যালিপার্স ইত্যাদি। বলাই বাহুল্য, এসব জিনিসের বেশিরভাগ শিক্ষার্থী জীবনে দেখেনি; তাই পরিচিতও নয়। কিন্তু এদের সম্পর্কে গত আট বছরে কম-বেশি পড়াশুনা করা হয়ে গেছে তাদের। কাজেই সেই মুহূর্তে তাদের মধ্যে উত্তেজনার সাথে যোগ হয় এক নতুন মাত্রা। আর তা হলো, এতদিনের অজ্ঞতার ভয়। ব্যাপকভাবে পঠিত স্লাইড ক্যালিপার্সের ব্যবহার, বিকার-ফানেল আর মানব দেহের কঙ্কালতন্ত্র- সবই দুর্বোধ্য মনে হয় বেশীরভাগ শিক্ষার্থীর কাছে। কারণ, এতদিন তারা শুধু বইয়ের পাতাতেই পড়ে এসেছে (আসলে মুখস্থ করে এসেছে) এসব নাম। কখনো বাস্তবে দেখার সুযোগ হয়নি। আর বইয়ের পড়া আর বাস্তব জীবনে এসব যন্ত্রপাতির ব্যবহারের মধ্যে বিস্তর ফারাক তো রয়েছেই। এখন বাস্তবের সাথে মিলিয়ে দেখতে গিয়ে অনেক কিছুই তাদের কল্পনার সাথে মিলছে না। ফলে, তাদের কাছে ব্যাপারগুলো দুর্বোধ্য হয়ে ওঠে সহজেই।

ক্লাশ থ্রি থেকেই মোটামুটি বিজ্ঞানের অত্যন্ত প্রাথমিক কিছু বিষয় শেখানো হয় এবং ধীরে ধীরে তার ব্যাপ্তি ক্লাশ অনুযায়ী বাড়তে থাকে। কিন্তু, এই দীর্ঘ ছয়টি বছরে বাংলাদেশের সাধারণ বিদ্যালয়গুলোর পাঠ্যক্রমে কোনো প্র্যাকটিক্যাল ক্লাশের ব্যবস্থা থাকে না। ফলে শিক্ষার্থীরা দীর্ঘ কয়েক বছর কেবল অনুমানের উপরেই পড়াশুনা করে যায়। ফলে, তাদের হয়তো তাত্ত্বিক জ্ঞান ঠিকই বৃদ্ধি পায়, কিন্তু ব্যবহারিক জ্ঞান থেকে যায় একেবারেই শূন্যের কোঠায়। যখন তারা ক্লাশ নাইন-টেনে ওঠার পর এই ব্যবহারিক ক্লাশ নিয়ে ব্যাপক আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকে, তখনই আবিষ্কার করে এটি তাদের কাছে দুর্বোধ্য একটি বিষয়। তবে বিষয়টির সঙ্গে দ্রুত খাপ খাইয়ে নিতে পারে সেরকম শিক্ষার্থীর সংখ্যা খুব বেশি হয় না। যেহেতু, এখানে সাধারণের কথাই বলা হবে, তাই অতি মেধাবী শিক্ষার্থীদের খাপ খাইয়ে নেওয়ার সেই গুণটির কথা বিবেচ্য হবে না। তারা যখন এই ব্যবহারিক সমস্যায় হাবুডুবু খাচ্ছে, সেই সময় থেকেই শুরু হয় আসল রঙ্গ। শিক্ষার্থীরা প্রথমদিকে বেশ গুরুত্বসহকারে ব্যবহারিক ক্লাশ করতে শুরু করে। কিন্তু, কয়েকদিনের মধ্যেই তারা বুঝতে পারে যে এটি আসলে একটি তামাশা ছাড়া আর কিছুই নয়। অর্থাৎ, ব্যবহারিক ক্লাশ করার নিয়ম আছে তাই বাধ্য হয়ে করতে হচ্ছে; আসলে এটিকে গুরুত্বসহকারে নেওয়ার কিছু নেই। কারণ, স্কুল/কলেজের শিক্ষকেরাই তাদের বোঝায় যে, ব্যবহারিক পরীক্ষা তেমন কোনো বিষয় নয়। ওটার মার্ক নিয়ে তোমাদের ভাবতে হবে না। অপেক্ষাকৃত নামকরা স্কুল/কলেজের শিক্ষকরা অনেকটা জোড় করেই এসএসসি/এইচএসসির ব্যবহারিক পরীক্ষার নম্বর নেয়ার ব্যবস্থা করে বা দিতে বাধ্য করে। এতে নাকি স্কুল/কলেজের নামের ব্যাপার জড়িয়ে আছে।

এই ব্যবহারিক নিয়েও আবার আছে বিশাল দুর্নীতি এবং চক্রান্ত। প্রাইভেটে পড়তে ডাকার এক মোক্ষম হাতিয়ার হলো এই ব্যবহারিক পরীক্ষার খাতা সই করার হ্যাপা আর মূল্যবান ২৫টি নম্বর। কাজেই, স্কুলের শিক্ষার্থীরা বছরের শুরুতেই নতুন ক্লাশে উঠে খোঁজ করতে থাকে এবার প্র্যাকটিক্যাল ক্লাশের দায়িত্বে আছেন কোন কোন স্যার। স্যারেরাও ওঁৎ পেতে বসে থাকেন শিক্ষার্থী ধরার আশায়। অতঃপর, সেইসব ভাগ্যবান শিক্ষকদের বাড়িতে যেন মা লক্ষীর কৃপা ঝর্ণাধারার মত বর্ষণ হতে থাকে। মৌসুমী পাঠদান ব্যবসায় শিক্ষকেরা দুহাতে কিছু রোজগার করে নেন আর ছাত্র-ছাত্রীদের ব্যবহারিক পরীক্ষায় উতরে দেবার ব্যবস্থাটিও তিনিই করেন। কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা খুঁজতে থাকে তাদের এইচএসসি পরীক্ষার কেন্দ্র কোন কলেজে হবে। তারপর তারা সেই কলেজের শিক্ষকদের কাছে গিয়ে প্রাইভেট পড়তে আরম্ভ করে। এখানেও ওই একই ব্যাপার কাজ করে। আর, তা হলো- ব্যবহারিক পরীক্ষায় নিরাপদে ২৫টি নম্বর নিশ্চিত করা।

এবার আসি, ব্যবহারিক বিষয়ের পরীক্ষার হলে। অধিকাংশ স্কুল/কলেজে বিভিন্ন সাময়িক পরীক্ষায় ব্যবহারিক পরীক্ষার তেমন মূল্য দেওয়া হয় না। অনেক সময় তো তা নেওয়াই হয় না। ব্যবহারিক ক্লাশগুলো এমন দায়সাড়াভাবে হয় যে, তা আদতেও কোনো কাজে আসে না। এইরকম ফাঁকি দিয়ে পড়ানোর একটা সিস্টেম দাঁড় করানো হয়েছে। যাতে শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী, উভয়েরই মনোভাব থাকে- পালাই পালাই। অর্থাৎ, যত কম আয়াসে ব্যবহারিক করা যায় সেই চেষ্টা। ফলে, শিক্ষার্থীরাও ধৈর্য ধরে ক্লাশগুলো করে না এবং শিক্ষকেরাও ধৈর্য সহকারে ক্লাশ নিতে চান না।

ব্যবহারিক পরীক্ষার হল তো আরেক রঙ্গমঞ্চ। অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, এর মত প্রহসন আর কোথাও নেই। পরীক্ষার হলে বই নিয়ে গিয়ে দলবেঁধে সবাই দেখে দেখে লিখছে। পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন শিক্ষক। তিনি দেখেও যেন না দেখার ভান করছেন। এরপর আসে ভাইভা পরীক্ষা। সেখানে সময় বাঁচানোর জন্য কয়েকটি দায়সাড়া গোছের প্রশ্ন করে ছেড়ে দেওয়া হয়। অনেক সময় তো, ‘তোমার প্রিয় খেলা কী?’ বা ‘বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের ক্যাপ্টেনের নাম কী?’-এই জাতীয় প্রশ্নও করা হয় পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, জীববিজ্ঞান বা গণিতের ব্যবহারিক পরীক্ষার হলে। এরচে বড় তামাশা আর কী হতে পারে? নামকরা স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা অনেকটা নামের জোড়েই ২৩-২৫ নম্বর জোগাড় করে। আর, অপেক্ষাকৃত দুর্বল বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা হয় বলির পাঁঠা। এইরকম বৈষম্য প্রতিবারই হয়ে থাকে, কিন্তু তা দেখেও কেউ দেখে না।

ব্যবহারিক ক্লাশ এবং পরীক্ষার মূল উদ্দেশ্য হল শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানের বিষয়গুলোকে হাতে-কলমে শেখানো। কিন্তু, উপরের ঘটনাগুলো পড়ার পর কী এখনও আমাদের তাই মনে হয়?

লেখক পরিচিতি

ইয়ামিন রহমান খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।

1 মন্তব্য

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Exit mobile version