বাড়ি শিক্ষাব্যবস্থা

ভাগ্যবিলম্বিত এক জাতির শিক্ষানীতির কথা

বাংলাদেশের শিক্ষা
বাংলাদেশের শিক্ষা

নাঈমুল হক লিখেছেন শিক্ষানীতির কথা নিয়ে

আমারা জাতি হিসেবে বিলম্বিত ভাগ্যের অধিকারী। পলাশীর প্রান্তরে হারানো স্বাধীনতা উপমহাদেশে প্রায় ১৯০ বছর পর ফিরে এলেও আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে আরও ২৩টি বছর। এর চেয়েও পরিতাপের বিষয় হলো, স্বাধীন দেশে একটি শিক্ষানীতি পেতে পেরিয়ে গেছে ৩৯টি বছর। এত চাওয়ার পর পাওয়া শিক্ষানীতির কথা নতুন করে বলতে হচ্ছে। আমাদের কী স্বপ্ন দেখাতে পারলো আর কী পারলো না সে হিসেব মেলাতে মন নহে মোর রাজি।

চাই শিক্ষানীতির বাস্তবায়ন। শিক্ষানীতি একটি কল্যাণমুখী দিকনির্দেশনামূলক জননীতি। লক্ষ্য ও উদ্দেশের আলোকে এর সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন নিদিষ্ট সময়সীমার মাঝে নাও হতে পারে; কিন্তু যুক্তিযুক্ত কৌশলগুলো সময়ের মধ্যে বাস্তবায়ন দাবি রাখে। যুক্তিযুক্ত কৌশল বলছি এ জন্য যে, শিক্ষানীতি ২০১০-এ শিক্ষার্থী কল্যাণ ও নির্দেশনায় প্রতিটি বিদ্যালয়ে ছেলে-মেয়েদের জন্য পৃথক ব্যায়ামাগারের সুপারিশ করা হয়েছে। তাই বলে অনেক বিদ্যালয়ে যেখানে খেলার মাঠই নেই, সেখানে এখনই প্রতিটি বিদ্যালয়ে ছেলে-মেয়েদের জন্য পৃথক ব্যায়ামাগার চাওয়ার মতো অবোধ আমরা নই। একটা কথা মনে রাখতে হবে, না বলে ভালো কাজ করা প্রশংশনীয় হলেও সুন্দর সুন্দর কথা বলে তার বাস্তবায়ন না করা একটি গর্হিত কাজ। দুই বছরে শিক্ষানীতির বাস্তবায়ন মূল্যায়নের যথার্থ সময় না হলেও শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে সরকারের আগ্রহ ও সদিচ্ছা মূল্যায়নের জন্য যথেষ্ট বলে মনে করি। বছরের শুরুতে দেশব্যাপী পাঠ্যবই উৎসব, সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মর্যাদা বৃদ্ধি প্রভৃতি উদ্যোগ আমাদের আশাবাদী করে তুললেও অন্যদিকে হতাশার পাল্লাটাও বেশ ভারি।

শিক্ষানীতির শিক্ষা প্রশাশন সংক্রান্ত অধায়ে শিক্ষানীতির বাস্তবায়নে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের পরামর্শদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে একটি স্থায়ী শিক্ষা কমিশনের প্রস্তাব করা হয়েছিল। আজ পর্যন্ত তার কোনো উদ্যোগ না নেয়া এই হতাশার সূত্রপাত করে।

এই শিক্ষানীতির অন্যতম সংস্কারমূলক পদক্ষেপ হিসেবে পরিচিত আট বছর মেয়াদি প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তনের সুপারিশ। বর্তমান পরিস্থিতিতে এ বিষয়ে সরকারের উদাসীনতা লক্ষ করছি। পাঁচ বছর মেয়াদি প্রাথমিক শিক্ষার ধারণাবিশিষ্ট ৩য় প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কার্যক্রমের মূল ধারনাপত্র ও বাস্তবায়ন কৌশল দেখে যেমন আশ্চর্য হয়েছি, তেমনি নতুন শিক্ষাক্রম প্রণেতাদের প্রণীত ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষাক্রম দেখে অবাক না হয়ে পারি না। আমাদের দেশে প্রায় ১০ বছরান্তে শিক্ষাক্রম প্রবর্তন বা পরিমার্জনের যে ধারা লক্ষ করে আসছি, তাতে এবারই যদি ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করা হতো, তবে নিঃসন্দেহে আট বছর মেয়াদি প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তনের গুণগত ভিত্তি রচিত হতো। যদিও কেউ কেউ বলেন, আট বছর মেয়াদি প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তিত হলে দ্রুতই এর পরিবর্তন করা সম্ভব হবে। তা হয়ত সম্ভব, কিন্তু প্রশ্ন হল আমাদের কি অপচয় করার মত অঢেল রাষ্ট্রীয় সম্পদ আছে যে এভাবে অপচয় করতে হবে? ৩য় প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কার্যক্রম, প্রাথমিক শিক্ষাক্রম-২০১২-এর মত ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাতেও আট বছর মেয়াদি প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নে সহায়ক নির্দেশনার এই অভাব লক্ষ্য করা যায়। ভয় হয়- সরকার আট বছর মেয়াদি প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন থেকে আবার পেছনে হটছে না তো? অনেকেই আট বছর মেয়াদি প্রাথমিক শিক্ষা বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে বাস্তবায়ন কঠিন বলে মন্তব্য করেন। এই বিবেচনায় যদি সরকার আট বছর মেয়াদি প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন থেকে আবার পেছনে হটতে উদ্বুদ্ধ হয়, তবে বলতে হবে জাতি হিসেবে আমরা কেবল ভাগ্যবিলম্বিতই নই; চরমমাত্রার অদূরদর্শী। কেননা ১৯৭৪ সালের বাংলাদেশ শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট সুপারিশের প্রায় ৩৫ বছর আলোচনার পর আমরা বুঝতে পারছি যে তা বাস্তবায়নযোগ্য নয়! অচিরেই তাই আট বছর মেয়াদি প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নে সরকারের অবস্থান পরিষ্কার করা দরকার।

ভাগ্যবিলম্বিত এই জাতির জীবনেও ক্ষণিকের সৌভাগ্য এসেছিল বেশ কয়েক বার। কখনো একুশের রক্তাক্ত দুপুরে, কখনো একাত্তরের নয় মাস। তাই আর কিছু পাই বা না পাই অন্তত একটা চাওয়া থেকেই যায়। ৩৯ বছর পর পাওয়া শিক্ষানীতিটিও যেন ক্ষণিকের পাওয়া শিক্ষানীতি হিসেবে হারিয়ে না যায়।

নাঈমুল হক: শিক্ষার্থী, প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগ, শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

3 মন্তব্য

  1. উনারা বলিতে পছন্দ করেন করিতে নয়। তাহাই যদি না হইবে তাহা হইলে অল্প বলিয়া সেটুকু করার চেষ্টা করিতেন। তাহারা বলিতে শুরু করিলে নিজের স্বামর্থের কথা বেমালুম ভুলিয়া বসেন। অথবা ধরিয়া নেন যে, বাস্তবায়ন করার যেহেতু প্রয়োজন নেই সেহেতু বলিতে কম করিব কেন?
    উনাদের মত অনেকটা এইরকম যে, আমরা যা বলিতেছি তাই তোমরা কর, আমরা যা করি তা কোরো না। কথায় বড় না হয়ে কাজে বড় হওয়া যে কষ্টের তাহা উনারা ভাল করিয়াই জানেন এবং বুঝেন। তাহা না হইলে আজ শিক্ষাব্যবস্থার এই হাল হইবে কেন?
    ভাল কাজের উদাহরণও একটা নীতি হিসেবে ব্যবহৃত হইতে পারে, সবসময় নীতি লিখিতআকারে দেয়ার প্রয়োজন পড়ে কি? দিনশেষে কাজই কথা বলে। একটা কথাই এখন মনে পড়ছে…………”কাজীর গরু কেতাবে আছে গোয়ালে নাই”।
    তারপরও একটা আহ্বান থাকিবে, “চলুন স্বপ্ন দেখি, চলুন পাগল হই”।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Exit mobile version