বাড়ি শিক্ষার নীতি

শিক্ষা দুর্নীতি: একটি পর্যালোচনা

বাংলাদেশের শিক্ষা
বাংলাদেশের শিক্ষা

মোহাম্মদ কাউছার ভূইয়া লিখেছেন শিক্ষা দুর্নীতি নিয়ে

১৯৭১ সালে বিশ্ব মানচিত্রে জায়গা করে নেয়া আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি ক্ষুধা, দারিদ্র্য আর দুর্যোগের সাথে সংগ্রাম করছে প্রতিনিয়ত, কিন্তু বর্তমানে যে ব্যাধিটি সংগ্রামের মাত্রা তীব্রতর করছে তা হল দুর্নীতি। দুর্নীতির মাত্রা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে রক্তের বিনিময়ে পাওয়া স্বাধীনতা আজ ভুলুন্ঠিত হচ্ছে। পরপর তিনবার নির্লজ্জ জাতি হিসেবে চ্যাম্পিয়ন হয়ে সর্বশেষ টিআই রিপোর্টে আমাদের অর্জন ত্রয়োদশ স্থান। বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে বিশ্ব প্রেক্ষাপটে আমাদের অবস্থান বদলে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। খুব সহজেই অনুমেয়, কর্মের ফলস্বরূপ আমাদের এই কীর্তি অর্জন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য- একটি দেশের কাণ্ডারির ভূমিকায় এদেরকেই অবতীর্ণ হতে হয়। শুধু দরকার যোগ্য, সৎ, দেশপ্রেমিক দক্ষ নেতা- যে জাদুর কাঠির ছোঁয়ায় (দক্ষ নেতৃত্ব) সকল কালিমা দূর করে দেশকে এনে দিবে থালা ভরা সম্মান। এছাড়াও আগামী প্রজন্মকে হতে হবে দক্ষ ও দেশপ্রেমিক। এক্ষেত্রে দরকার শুধু সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা।

একটি জাতির মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে শিক্ষার (সাক্ষরতা) হার উন্নত হতে হয় তা অনেক আগেই প্রমাণিত হয়েছে। এ প্রয়োজনীয়তা থেকে প্রত্যেকটি দেশ শিক্ষা খাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেবে এটিই স্বাভাবিক। আমাদের দেশেও এই ধারাটি প্রচলিত। ধারাটি প্রচলিত হলেও এর ফল কতটুকু তা নিয়ে আমাদের সন্দেহ থাকলেও একেবারেই যে উন্নতি হচ্ছে না তা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কতটুকু? দুর্নীতির মহোৎসব শিক্ষা খাতকে এমনভাবে আকড়ে ধরেছে যে দেশের দুর্নীতিগ্রস্ত খাতগুলোর মধ্যে শিক্ষা খাতের অবস্থান বিগত বছরগুলোতে প্রথম হলেও বর্তমানে তৃতীয়।

প্রতি বছর জাতীয় বাজেটের ১৫% বরাদ্দ থাকে শিক্ষা খাতে। যার প্রায় ৬০ শতাংশ পেয়ে থাকে প্রাথমিক শিক্ষা খাত। কারণ শিক্ষার ভিত মজবুত করতে প্রাথমিক শিক্ষা খাতই সর্বপ্রথম অগ্রাধিকারের দাবিদার। একটি শিশুর জন্মগত অধিকার হল শিক্ষা। এক্ষেত্রে প্রত্যেক দেশের সরকার সর্বজনীন, বাধ্যতামূলক, অবৈতনিক ও মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা প্রদানে জনগণের নিকট দায়বদ্ধ থাকলেও দেশের এখনও প্রায় শতকরা ৪০ ভাগ শিশু শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। ১৯৯০ সালের পর থেকে নিরক্ষর মুক্তির বিষয়টি রাজনৈতিক অঙ্গীকারে পরিণত হলেও বাস্তবে গত দেড় যুগেও দেশ নিরক্ষরমুক্ত হয় নি। অবাক করা বিষয় হল আজও দেশের ১৬,১৪২টি গ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই। অন্যদিকে দেশের ৮০,৩৯৭টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাত্র ৩৭,৬৭২টি। স্পষ্টতই বোঝা যায় সহস্রাব্দ উন্নয়নের লক্ষ্যে ২০১৫ সালের মধ্যে সরকার দেশকে নিরক্ষরমুক্ত করতে কীভাবে এগোচ্ছে। গত ৮ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবসের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল- সাক্ষরতা অর্জন, জনতার ক্ষমতায়ন, যা সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে সর্বজনীন বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার ওপর। কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষা খাতে দুর্নীতির মহোৎসব, অস্বচ্ছতা আর জবাবহীনতার কারণে শিক্ষাখাত আজও অন্ধকারাচ্ছন্ন।

নব্বই পরবর্তী সময়ে শিক্ষার বিনিময়ে খাদ্যসহ কয়েকটি প্রকল্প বা কর্মসূচী বাস্তবায়নের পূর্বে সরকারি হিসাব মতে সাক্ষরতার হার ছিল ৩৮-৪০ শতাংশ। এখন এই হার ৬২ শতাংশ। সরকারি হিসাব মতে ২২ শতাংশ বাড়লেও বেসরকারি হিসাবে এই হার বর্তমানে ৪১-৪২ শতাংশ। অর্থাৎ জনগণকে বিভ্রান্তমূলক তথ্য প্রদান করে সরকার নিজের অর্জন বড় করে দেখাচ্ছে। প্রশ্ন হল এটি কি একটি শিক্ষা দুর্নীতি নয়? বর্তমান সরকার ২০১৪ সালের মধ্যে নিরক্ষরতা মুক্তির অঙ্গীকার করেছে, সময়ই বলে দেবে এটি আবারো কি অঙ্গীকার হয়েই থাকবে নাকি আবারো জনগণ বিভ্রান্তমূলক তথ্য পেতে যাচ্ছে।

শিক্ষাখাতে মূলত তিনটি স্তরে দুর্নীতি হয়। ১. নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন স্তরে ২. মন্ত্রণালয়ে ৩. বিদ্যালয়ের প্রশাসনিক স্তরে। এই তিন স্তরের দুর্নীতির ফলস্বরূপ ১৫ শতাংশ বাজেটের প্রকৃত কাজে ব্যয় হয় মাত্র ৫ শতাংশ বাজেট। বাকি ১০ শতাংশই জনগণের চোখের আড়ালে ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে যায়। কিছু লোক হয়ে ওঠে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ। তাছাড়া প্রাথমিক শিক্ষা সবার জন্য বিনামূল্যে হলেও এর আওতায় আসা শিক্ষার্থীর ভর্তি ফি বাবদ ২০৯ টাকা দিতে হয়। প্রাথমিক শিক্ষা খাতের উপবৃত্তি পেতে ৩২.৪ শতাংশ শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে ৪০ টাকা করে দিতে হয়। এছাড়া বিদ্যালয়গুলো প্রাথমিক স্তরে ৫ শতাংশ ও মাধ্যমিক স্তরে ৩৮ শতাংশ ছাত্রীদের উপবৃত্তির টাকার এক-তৃতীয়াংশ কেটে রাখে। আবার ২০০১ সালের একটি রিপোর্টে দেখা যায়, খাদ্যের বিনিময়ে শিক্ষা কর্মসূচী বাস্তবায়নে ৬টি উপজেলাতেই ১২৪১ টন খাদ্য দুর্নীতি হয় যার আনুমানিক মূল্য ছিল ১২ মিলিয়ন টাকা। বিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে শিক্ষা উপকরণ, পরীক্ষার ফি বাবদ, পরিকল্না ইত্যাদি প্রতিটি ক্ষেত্রে দুর্নীতি হচ্ছে অহরহ। আবার উচ্চতর শিক্ষায় ভর্তি বাণিজ্য, সার্টিফিকেট বিক্রি এখন যেন নিতান্তই সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুর্নীতি এখন আর কোন স্থানীয় বিষয় নয়। বরং এটি একটি আন্তঃদেশীয় সমস্যা। পৃথিবীর এমন কোন দেশ নেই যেখানে দুর্নীতি হয় না। কিন্তু আমাদের দেশের দুর্নীতি আর উন্নত দেশসমূহের দুর্নীতির মধ্যে পার্থক্য আকাশ পাতাল। একদিকে দারিদ্র্য ও জনসংখ্যার ভারে ন্যুব্জ, অন্যদিকে দুর্নীতি থমকে দিয়েছে উন্নয়নের গতিকে। দুর্নীতি আর দুর্বিত্তায়নের ফলে আজ শিক্ষা ব্যবস্থা কলুষিত। ফলে তরুণ প্রজন্মের ভবিষ্যৎ হয়ে পড়েছে অনিশ্চিত। তাই এখনই দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। নিজেরা দুর্নীতি করবো না, অন্যকে করতে দেব না- এই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে সবাইকে। রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে সরকারকে। শিক্ষা খাত থেকে দুর্নীতির মূল উপড়ে ফেলে শিক্ষা খাতকে তথা শিক্ষা ব্যবস্থাকে করতে হবে পবিত্র। এর মাধ্যমেই তরুণ প্রজন্ম সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে এই প্রিয় মাতৃভূমিকে বিশ্বের বুকে এনে দেবে ডালা ভরা সম্মান আর সর্বোচ্চ মর্যাদা।

লেখক: শিক্ষার্থী, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা, বাংলাদেশ।

2 মন্তব্য

  1. বর্তমানে শিক্ষা ক্ষেত্রে চলে বানিজ্য। এখানে প্রাইভেট বানিজ্য, নিয়োগ বানিজ্য সব রকম চলে। আমরা কোথায় অবস্থান করছি। আমাদের সন্তানদের কি প্রকৃত শিক্ষা দিতে পারছি। যখন আমার সন্তান দেখে যে তার অধিকাংশ বন্ধু প্রাইভেট পড়ে তখণ তার মনে প্রশ্ন জাগে ওরা তো আমার চাইতে ভাল ছাত্র হবে। কারণ ওরা প্রাইভেট পড়ে। ক্লাসে ছাত্রদের ঠিকমতো পাঠদান করা হয় না। এ যেন হাসপাতালের মতো । ডাক্তার তার প্রাইভেট চেম্বারে খু ব আন্তরিকতা ও যত্ন সহকারে রোগী দেখেন। তারপর নিয়োগের সময় লক্ষ্য করা যেছে যে প্রার্থী বেশী টাকা দিতে পারবে অথচ তার গুনগত মান তেমন ভাল নেই। কিন্তু টাকার জোরে সে নিয়োগ পেয়ে যায়। পরবর্তীতে ঐ শিক্ষক মরিয়া হয়ে উঠে কি ভাবে তার বিনিয়োগকৃত টাকা সমন্বয় করবেন। অথচ সে একজন শিক্ষক মানুষ গড়ার কারিগর।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Exit mobile version