বাড়ির কাজ দেওয়াটা যেন আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিশুদের হোমওয়ার্ক আমরা কি আদৌ দিব, কিংবা দিলেও কতটা বাকী পরিমাণে দিব– এ নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক আছে। তবে এটি ঠিক, আমাদের অভিভাবকরা সেসব শিক্ষকদেরই বেশি পছন্দ করেন যারা বেশি বেশি বাড়ির কাজ দেন। আমার শিক্ষকতা জীবনে অনেক অভিভাবক বলতেন, “স্যার, ওদের বেশি বেশি হোমওয়ার্ক দিবেন। তাহলে ওরা চাপে থাকবে।” আমি বলতাম, “চাপে থাকলে তো শেখা হবে না এবং ওরা পড়াশুনার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। আর আমি ওদের মানসিকভাবে চাপে একেবারেই রাখতে চাই না। আমি চাই ওরা আনন্দ করবে, ক্লাসেই পড়া মোটামুটি শেষ করে ফেলবে, বাসায় হালকা একটু পড়বে”।
অনেক অভিভাবক এ কথায় সন্তুষ্ট হতেন না। তারা যে আমার কথাগুলো ভালোভাবে গ্রহণ করতে পারেননি তা তাদের চেহারা দেখেই বুঝতে পারতাম। শেষে আবার বলতেন, “স্যার, যা কিছুই বলেন, হোমওয়ার্ক কিন্তু ওদের দিবেনই”। অভিভাবকরা যখন চান, তখন শিক্ষকরা হোমওয়ার্ক তো দিবেনই। কোনো কোনো শিক্ষক শিক্ষার্থীদের প্রচুর হোমওয়ার্ক দিতেন এবং পরবর্তী দিনে হোমওয়ার্ক না দেখে খাতাগুলোতে শুধু স্বাক্ষর করতেন। তাতেই ক্লাসের সময় পার। না পড়ানোর চমৎকার টেকনিক! তবে অভিভাবকরা তো খুশি। তাদের মধ্যে এসব শিক্ষকদের জনপ্রিয়তাও বেশি। অভিভাবকরা আরও বলতেন, “স্যার, আপনি আরেকটু কড়া হন।ওদের কড়া শাসনে রাখেন।এভাবে ঢিলে দিলে চলবে না”। আমি বলতাম, “ছাত্রশিক্ষক সম্পর্ক হবে বন্ধুর মতো। ওরা হাসতে হাসতে শিখবে। ছাত্রশিক্ষকের মাঝে খুব একটা দূরত্ব রাখা যাবে না”। এ কথাও তাদের কাছে ভালো ঠেকতো না। আমি শিক্ষকতার একটি বিরাট অংশ কাটিয়েছি ক্যাডেট কলেজে যেখানে হোমওয়ার্কের বালাই নেই। পড়াশুনা ক্লাসেই সম্পন্ন হয়ে থাকে। যে অভিজ্ঞতাগুলো বললাম সেগুলো ঢাকার একটি কলেজে পাঁচ বছর শিক্ষক থাকাকালীন।
নোবেল বিজয়ী ড. অমর্ত্য সেন হোমওয়ার্ক সম্পর্কে বলেন, “পিছিয়ে পড়া পরিবারের শিক্ষার্থীদের হোমওয়ার্ক দিলে তা তাদের বাবা-মায়ের জন্য কষ্টের কারণ হয়ে দাড়ায়; কারণ অনেক শিক্ষার্থীই প্রথম জেনারেশন শিক্ষার্থী। তাদের বাবা-মায়ের পক্ষে হোমওয়ার্ক করতে সহায়তা করা সম্ভব নয়, তারা হাউজ টিউটর রাখতেও অপারগ। ফলে হোমওয়ার্ক তাদের জন্য এক ধরনের বোঝা এবং কষ্টকর বিষয়ে পরিণত হয়।” আসলেই তাই, শিশুরা অনেকক্ষেত্রে হোমওয়ার্কের ভয়ে বিদ্যালয়ে স্কুলে যাওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। হোমওয়ার্ক না করার জন্য তাদের শুধু বকাঝকা নয়; শারীরিক শাস্তিও সহ্য করতে হয় অনেক বিদ্যালয়ে, অপমানিত হতে হয় সহপাঠীদের সামনে। অনেক শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবক মনে করেন যে, শিক্ষার্থীরা সারাদিন স্কুলে যা শিখেছে, বিকেলবেলা তা ভুলে যায়। তাই হোমওয়াকের্র প্রয়োজন আছে। হোমওয়ার্ক করলে তারা বিদ্যালয়ে যা যা শিখেছে তা পুনরায় স্মরণ করতে পারে।
আমাদের মনে রাখতে হবে, একজন শিক্ষার্থীকে শুধু বাংলা বা ইংরেজি কিংবা শুধু গণিতের ক্লাস করতে হয় না; তাকে প্রতিদিন সাত-আটটি বিষয়ে ক্লাস করতে হয়। প্রতিটি বিষয়ের শিক্ষকই যদি গাদাগাদা হোমওয়ার্ক দেন, তাহলে শিক্ষার্থীর কী অবস্থা দাড়ায় তা কি আমরা কখনও চিন্তা করে দেখেছি? আমাদের তথাকথিত নামিদামি স্কুল-কলেজগুলোতে গাদাগাদা হোমওয়ার্ক দেওয়া হয় এবং বলা হয় এটিই আমাদের ও অন্যান্য বিদ্যালয়ের মধ্যে তফাৎ। আমরা যদি একটু চিন্তা করে দেখি– একজন শিক্ষার্থী সেই সকালে বিদ্যালয়ে আসে। তারপর একটির পর একটি ক্লাস করতে থাকে বিকেল চারটা বা পাঁচটা পর্যন্ত। সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে আবার সেই হোমওয়ার্কের অবহনযোগ্য বোঝা মাথায় নিয়ে। রাত জেগে সব শিক্ষকের পড়া তৈরি করতে হয়। এই হোমওয়ার্ক কি শিক্ষার্থীর কাছে বিষের মতো মনে হবে না? আবার তো সেই সকাল বেলা উঠেই স্কুলে যাওয়া। তার জীবন তো এই চক্করের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে গেল। কোথায় আনন্দ? কোথায় মুক্ত শিক্ষা?
শিক্ষকের কথায়ও আসি। স্কুল লেভেলে এখনও একজন শিক্ষককে প্রতিদিন চার থেকে ছয়টি, এমনকি কোনো কোনো স্কুলে সাতটি ক্লাসও করাতে হয়। এখন শিক্ষক যদি প্রতিটি ক্লাসেই হোমওয়ার্ক দেন তাহলে তিনি কি প্রতিটি খাতা পরীক্ষা করতে পারবেন? অবশ্যই পারবেন না। তারও তো একটু সময় দরকার, পরদিন ক্লাসের প্রস্তুতির সময় দরকার, পারিবারিক ও সামাজিক কাজ আছে যেগুলো প্রতিদিনই কিছু না কিছু করতে হয়। তিনি যখন হোমওয়ার্ক ভালোভাবে চেক করে সংশোধন করা, মতামত লেখার সময় যখন পান না, শুধু সই করেন; তখন শিক্ষার্থীরাও ব্যাপারটিকে একইভাবে নেয় অর্থাৎ হোমওয়ার্ক করে শুধু জমা দেওয়ার জন্য। আসল উদ্দেশ্য থেকে দূরেই থেকে যায়।
কিছুদিন আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপিকা বলছিলেন, তার ছেলে তাকে বলছে, মা, আমি তো সবই বাসায় কম্পিউটারের স্ক্রিনে দেখতে পাচ্ছি ইন্টারনেট সার্চ করে। আমি তাহলে স্কুলে যাব কেন? বরং এখানে আরও ভালোভাবে, নিজের মতো করে দেখতে পাচ্ছি, জানতে পারছি, প্রশ্ন লিখে দিলে উত্তর পাচ্ছি। শিক্ষিকা বললেন, আমি তাকে সদুত্তর দিতে পারিনি। কথা ঠিকই। শিশুরা স্কুলে কেন যাবে? এখনকার শিশুরা অনেক প্রশ্নের উত্তর ইন্টারনেট থেকেনিতে পারছে যা তাদের শিক্ষকরা দিতে পারছে না। বিদ্যালয়ে যে সামাজিককরনের সুযোগ সৃষ্টি হয় অন্যান্য সহপাঠীদের সাথে মিশে, সেটিও কি ঠিকমতো হচ্ছে? শিশুরা তো ব্যস্ত পাঠ তৈরিতে, পড়া দিতে, হোমওয়ার্ক নিতে, করা হোমওয়ার্কের ওপর বকাঝাকা শুনতে। কখন এবং কীভাবে সোসালাইজেশন হবে?
আমি রাজউক কলেজে থাকাকালীন দেখতাম সব শিক্ষার্থীই ক্লাস ছুটির পড়ে শিক্ষকদের বাসায় দৌড়াতো। পড়াশুনায় ভালো এক শিক্ষার্থী পুরনো ঢাকা থেকে এ কলেজে আসতো। একদিন ক্লাসে জিজ্ঞেস করলামসে গোসল করে ক্লাসে আসতে পারে কিনা। বলল, ‘না স্যার, গোসল কখন করব, রাতে বাসায় গিয়ে গোসল করি।’ সেই খুব সকালে কলেজে চলে আসে, ক্লাস করে, ক্লাসের পরে একের পর এক শিক্ষকদের বাসায়, তারপর জ্যাম ঠেলে বাসায় যাওয়া সেই রাতে। তারপর খাওয়া-গোসল। তাহলে আর কখন পড়া, পড়া তৈরি করা এবং হোমওয়ার্ক করা? আমরা এগুলো কি কখনও ভেবে দেখেছি? নাকি শুধু আবেগে এবং সস্তা জনপ্রিয়তার জন্য হোমওয়ার্কের কথা বলছি?
‘শিক্ষিত মা এক সুরভিত ফুল, প্রতিটি ঘর হবে একটি স্কুল’ প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে সারা দেশে ১৪ জানুয়ারি শুরু হয়েছে ‘প্রাথমিক শিক্ষা সপ্তাহ ২০১৫’ পালন। বিভিন্ন স্থানে সভা, সমাবেশ, র্যালি ও আলোচনা সভা হয়েছে কিন্তু উপেক্ষিত হচ্ছে এসব মূল আলোচনা। শিশুদের আমরা কীভাবে স্কুলমুখী করব, হোমওয়ার্ক দিব কিনা, দিলেও কতটা দিব, সব শিক্ষকই কি একদিনে সব হোমওয়ার্ক দিব নাকি রুটিন করে একটি, দুটি বা তিনটি বিষয়ে হোমওয়ার্ক দিব ইত্যাদি আলোচনায় আসা উচিত। শিক্ষার্থীরা আস্তে আস্তে ঢুকে যাচ্ছে কম্পিউটার, ইন্টারনেট, টুইটার আর ফেসবুকে; তারা বইয়ের পাতায় নেই। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তারা ব্যস্ত এগুলো নিয়ে। হোমওয়ার্ক তাদের পড়ার প্রতি আগ্রহটা নষ্ট করে দিচ্ছে। শহরের কিছু তথাকথিত নামকরা বিদ্যালয় আছে যেখানে শিক্ষার্থীদের এক অর্থে বন্দী করে রাখা হচ্ছে। তারা ক্লাসে না থাকলে শারীরিক, মানসিক ও অর্থনৈতিক শাস্তি দেওয়া হয়। ক্লাসে না আসলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকা, বকাঝকা করা, পাবলিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে না দেওয়া এবং জরিমানা ইত্যাদি চলছেই। এসব শাস্তির ব্যবস্থা না থাকলে কতজন শিক্ষার্থী ক্লাসে থাকত? অভিভাবকরাও আসল জায়গায় হাত না গিয়ে বাহবা দেন ওইসব স্কুল-কলেজকে যারা জোরজবরদস্তি করে শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে ধরে রাখছে। কেউ কিন্তু তলিয়ে দেখছি না আসল রোগ কোথায় এবং এর প্রকৃত ওষুধ কী?
আমাদের দেশে শিক্ষক-প্রতিভা চিহ্নিত করার প্রয়াস আজও পরিলক্ষিত হয়নি। আমরা অনেকেই স্ব-ইচ্ছায় শিক্ষকতায় আসিনি। ঠেকে এসেছি; কারণ এ পেশা অনেককেই আকৃষ্ট করে না এবং আকৃষ্ট করার লক্ষণও পরিলক্ষিত হচ্ছে না। এই পেশাটি অত্যন্ত সৃজনশীল আর যখন সৃজনশীলতায় বাঁধা আসে, তখন মেধাবী এবং সৃজনশীলরা কেন থাকবে এখানে? ব্যতিক্রম ছাড়া পেশার প্রতি নিরাসক্ত একটি বিশাল গোষ্ঠী এই গুরুদায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। বর্তমান যুগের চাহিদা, শিক্ষার্থীদের মনমানসিকতা অনুযায়ী শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হবে। শিক্ষার্থীদের প্রকৃত অর্থে সৃজনশীলতার চর্চা করাতে হবে, হোমওয়ার্কের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে নয়। আর সে জন্য চাই সৃজনশীল শিক্ষক।
লেখক পরিচিতি
মাছুম বিল্লাহ বাংলাদেশে ইংলিশ টিচার্স অ্যাসেসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইট্যাব)-এর সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি পূর্বে ক্যাডেট কলেজ ও রাজউক কলেজের শিক্ষক হিসেবে কাজ করেছেন। কাজ করেছেন ব্র্যাকের শিক্ষা কর্মসূচিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে। তিনি ভাব বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর হিসেবেও কর্মরত রয়েছেন। তিনি নিয়মিত শিক্ষাবিষয়ে নানা প্রবন্ধ লিখছেন।
hgdswkkhcda
Visitor Rating: 5 Stars
Visitor Rating: 5 Stars
Visitor Rating: 4 Stars
Visitor Rating: 5 Stars