আমাদের দেশের প্রাথমিক শিক্ষায় ঝড়ে পড়া, শিক্ষার গুণগত মান, শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করতে না পারা এবং নিরানন্দ পরিবেশে শিক্ষাদান- ইত্যাদি বিষয় বিদ্যমান এবং প্রাথমিক শিক্ষার অগ্রগতির ক্ষেত্রে এগুলো বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ প্রাথমিক শিক্ষাই সকল শিক্ষার ভিত্তি। আমরা যদি এই ভিত্তিকে মজবুত করে গড়ে তুলতে না পারি, তাহলে উচ্চ শিক্ষা এবং দেশ পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় নাগরিক ও নেতা তৈরি করা সম্ভব হবে না। প্রাথমিক শিক্ষার সমস্যাবলীর জন্য আমরা জাতীয় ক্ষেত্রে যে অনেক পিছিয়ে আছি, তা আর নতুন করে প্রমাণ করার প্রয়োজন নেই।
প্রাথমিক শিক্ষায় ঝড়ে পড়ার চিত্র আশাব্যঞ্জক তো নয়ই, বরং হতাশাজনক। একটি জাতীয় দৈনিকের এক প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ২০০৮ সালে ৩৭ লাখেরও বেশি শিশু প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছিলো। তাদের মধ্যে ২৬ লাখের কিছু বেশি শিক্ষার্থী চলতি বছর পঞ্চম শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার জন্য নিবন্ধন করেছে অর্থাৎ পঞ্চম শ্রেণীতে আসা পর্যন্ত সাড়ে এগার লাখ শিক্ষার্থী ঝড়ে পড়েছে। কিছু শিক্ষার্থী অন্য ধারায় হয়ত চলে গেছে, কেউ হয়ত ফেল করার কারণে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত আসতে পারে নি; তারপরেও প্রকৃত ঝড়ে পড়ার হার আঁতকে ওঠার মতো। অপুষ্টি, দারিদ্র্য, পাঠ্যপুস্তক পাঠদান চিত্তাকর্ষক নয়, ভর্তির পর স্কুল পরিবর্তন, অভিভাবকদের অসচেতনতা ইত্যাদি কারণগুলোকে দায়ী করেছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাবৃন্দ। ২০০৯ সালে দ্বিতীয় শ্রেণীতে ওঠার পর্যায়ে তাদের মধ্যে ৬ লাখেরও বেশি শিক্ষার্থী ঝড়ে পড়েছে। ২০১০ সালে তৃতীয়, ২০১১ সালে চতুর্থ পর্যায় পেরিয়ে ২০১২ সালে এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৬ লাখ ৩৮ হাজার ৪৫৪ জন। যদিও ভর্তি হয়েছিলো ৩৭ লাখ ৭৯ হাজার ২১১ জন অর্থাৎ ঝড়ে পড়েছে ১১ লাখ ৫০ হাজার ৭৫৭ জন (কালের কণ্ঠ, ২৪.০৮.২০১২)। এবার প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা হতে যাচ্ছে ২১ নভেম্বর।
প্রাথমিক শিক্ষায় ঝড়ে পড়া রোধ করতে হলে বহু ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন; আর এই পদক্ষেপ সরকারের একার পক্ষে নেওয়া সম্ভব নয় তবে বিশাল দায়িত্বটি সরকারকেই বহন করতে হবে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদপ্তরের মহপরিচালক শ্যামল কান্তি বলেন, ঝড়ে পড়া রোধ কল্পে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে উপবৃত্তি বাড়ানো হয়েছে, স্কুলে বিস্কুট দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এই পদক্ষেপগুলো কী পরিমাণে কোথায় কার্যকরী হচ্ছে এবং যেসব এলাকায় এগুলো বেশি দরকার সেসব এলাকায় ঠিকভাবে হচ্ছে কিনা, তার সঠিক কোনো পর্যবেক্ষণ বা গবেষণা নেই। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব এম এম নিয়াজ বলেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অধিকাংশ শিক্ষার্থী আসে দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে। তাদের মধ্যে ৫৫ শতাংশ গুরুতর অপুষ্টির শিকার, ৫৬ শতাংশ প্রয়োজনের তুলনায় কম ওজনের। ফলে দীর্ঘক্ষণ ক্লাসে থাকা এবং পড়াশোনায় মনোযোগ দেওয়া তাদের জন্য সম্ভব হয় না। এটি একটি বিরাট সমস্যা প্রাথমিক শিক্ষাক্ষেত্রে। সরকারের একার পক্ষে এই বিশাল সমস্যা মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয়, বেসরকারি এবং কমিউনিটির যৌথ প্রয়াস ও উদ্যোগ প্রয়োজন। তবে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে পুরো বিষয়টি সমন্বয় করার জন্য। প্রতিটি খাতেই সরকার বিশাল পরিমাণ লোকসান গুণছে, সেগুলোর লোকশান কমিয়ে আনতে পারলে এখানে বরাদ্দ বাড়ানো যেত। পুরো দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকে এমনভাবে ভাগ করতে হবে যাতে সরকার, বেসরকারি সংস্থা এবং অন্যান্য (কমিউনিটি, বিদেশি কোনো সংস্থা ইত্যাদি) বডি প্রাথমিক শিক্ষার দেখভাল সুনির্দিষ্টভাবে করতে পারে। কোনো কোনো এলাকায় সরকারি প্রচেষ্টা পৌঁছাবে না, সেখানে এনজিওগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া। যেখানে এনজিওর খুব একটা গ্রহণযোগ্যতা নেই বা প্রয়োজনীয়তা নেই, সরকারও সাফল্যজনকভাবে এগুতে পারছে না অথচ শিশুরা বঞ্চিত হচ্ছে তাদের অধিকার প্রাথমিক শিক্ষা থেকে- সেখানে কমিউনিটিকে কিভাবে সহায়তা দিলে অবস্থার উন্নতি হবে, সে বিষয়গুলো সরকারকেই বের করতে হবে।
সাম্প্রতিক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে বড় ধরনের এক জটিলতা তৈরি হয়েছে। গত জুলাই মাসে ১২ হাজার প্রার্থীকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার কথা ছিল কিন্তু এ নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ না হতেই নিয়োগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থীদের নিয়ে শূন্য পদে নিয়োগ দেওয়ার পাশাপাশি আরো ২০ হাজার জনকে নিয়ে শিক্ষক পুল গঠন করার সিদ্ধান্ত হয়। এই পুল গঠনের উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে গিয়ে নিয়োগ প্রক্রিয়া বিলম্বিত হচ্ছে বলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আদেশে বলা হয়েছে যে, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থীদের সমন্বয়ে ২০ হাজার জনের পুল গঠন করা হবে। পুলের শিক্ষকরা মাসোহারা ভিত্তিতে ছয়মাসের জন্য নিয়োগ পাবেন। প্রকৃত দায়িত্বে নিয়োগ হলে পুলের শিক্ষকরা ১০ শতাংশ লিভ রিজার্ভ কোটায় নিয়মিত চাকরি পাবেন। যেসব জেলায় এই লিভ রিজার্ভ কোটা পূরণ হয়ে যাবে সেসব জেলায় পুলে বিলুপ্তি ঘটবে।
প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগে শিক্ষক পুল গঠন করা একটি প্রশংসনীয় পদক্ষেপ কারণ বিভিন্ন কারণে শিক্ষকরা নিয়মিত ক্লাস পরিচালনা করতে পারেন না। প্রশিক্ষণ ও মাতৃকালীন ছুটির কারণে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শূন্যতা তৈরি হয়। আর প্রশিক্ষণ একটি অতি প্রয়োজনীয় ব্যাপার শিক্ষার ক্ষেত্রে; কিন্তু প্রতিষ্ঠান শিক্ষকদের প্রশিক্ষণে পাঠাতে অনাগ্রহ প্রকাশ করে কারণ দুই-একজন শিক্ষক প্রশিক্ষণে থাকলে প্রতিষ্ঠান ঠিকমত ক্লাস ম্যানেজ করতে পারে না। তাছাড়া শিক্ষকদের মাতৃত্বজনিত ছুটি, বিশেষ ছুটি, অসুস্থতাজনিত ছুটি ইত্যাদি কারণে শিক্ষক স্বল্পতাহেতু অনেক ক্লাস বাদ যায়। এইসব ক্লাস পরিচালনার জন্য পুলের শিক্ষকদের কাজে লাগানো হবে। এটি ছয় মাসের জন্য প্রযোজ্য হবে। ছয় মাস পর কি শিক্ষকদের ঘাটতি থাকবে না? তখন কীভাবে শূন্যপদ পূরণ করা হবে? আদেশে বলা হয়েছে, পুলের শিক্ষকদের মধ্যে প্রকৃত দায়িত্বে নিয়োজিতরা চাকুরীতে নিয়মিত হবেন। কিন্তু পদ শূন্য না থাকলে কীভাবে তাদের নিয়মিত করা হবে? পুলের শিক্ষকদের প্রকৃত দায়িত্বই বা কী- সে প্রশ্নেরও সঠিক উত্তর নেই। নিয়মিতকরণে কোন বিধি অনুসরণ করা হবে তারও কোনো উত্তর নেই। বলা হয়েছে ১০ শতাংশ লিভ রিজার্ভ নিয়োগে নিয়মিত করা হবে। তাহলে পুলের কী হবে? শিক্ষক পুল গঠনের কারণে শূন্য পদেই নিয়োগ শেষ করা যাচ্ছে না। এখন অবার পুল গঠন করা হবে। সব মিলিয়ে যে জটিলতা তৈরি হয়েছে, তা নিরসন করা সহজ হবে না। শিক্ষক পুল তৈরি বিষয়টি আসলে একটি কার্যকরী এবং সময়োপযোগী পদক্ষেপ। এলাকার শিক্ষিত বেকার যুবক ও ছাত্র-ছাত্রীদের এ পুলে অন্তর্ভুক্ত করা হলে সবার জন্যই মঙ্গলজনক হবে ।
তবে এতসব সমস্যার মধ্যেও খুশির সংবাদ হচ্ছে সরকার দেশের ২৬ হাজার ২৮৪টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় তিন ধাপে জাতীয়করণ করতে যাচ্ছে। প্রথম ধাপ শুরু হবে ২০১৩ সালের জানুয়ারি মাসে। তখন ১,০৫,৩৪৫ জন শিক্ষকের চাকুরি জাতীয়করণ করা হবে। এর ফলে ১৩০৮ কোটি টাকা খরচ হবে প্রতি বছর। প্রথম ধাপে ২২,৯৮১টি বিদ্যালয় জাতীয়করণ করা হবে। এ বিদ্যালয়গুলো ইতোমধ্যে মাসিক সরকারি অনুদান পাচ্ছে অর্থাৎ এমপিওভুক্ত বিদ্যালয়। যেসব বিদ্যালয় এমপিও তালিকায় নেই সেগুলো জাতীয়করণ করা হবে ১ জুলাই ২০১৩ এবং তৃতীয় পর্যায়ে বাকিগুলো জাতীয়করণ করা হবে ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসে। এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা সরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মতো মূল বেতন পান এবং ২০০ টাকা বাড়ি ভাড়া ও ২০০ টাকা মেডিকেল ভাতা পান। স্থায়ী বা সামায়িক নিবন্ধনভুক্ত স্কুল, কমিউনিটি স্কুল, সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত বেসরকারী সংস্থা পরিচালিত বিদ্যালয়সমূহ দ্বিতীয় পর্যায়ে জাতীয়করণ করা হবে। এদের সংখ্যা ২২৫২। বাকি ১০৫১ বিদ্যালয় যারা অনুমোদন পায় নি বা সরকারি অনুমোদনের অপেক্ষায়, তারা তৃতীয় পর্যায়ে জাতীয়করণের আওতায় আসবে।
১৯৭৩ সালে সরকার প্রথম দেশের ৩৬১৬৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করে। পরবর্তী বিভিন্ন পর্যায়ে আরও ১৫০৭টি বিদ্যালয় জাতীয়করণ করা হয়। দেশে বর্তমানে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে ৮৫০০০ প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে (ডেইলি সান, আগস্ট ১৭, ২০১২)। যে কোনো দেশের প্রাথমিক শিক্ষা হচ্ছে শিক্ষার প্রথম ধাপ। এই ধাপ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি হচ্ছে ভিত। এই ভিত মজবুত না হলে ভবিষ্যতে যে কোনো শিক্ষা প্রকৃত অর্থে কার্যকরী হয় না। আমাদের দেশের প্রাথমিক শিক্ষার মান আন্তর্জাতিক মান থেকে অনেক দূরে। প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মান এবং শিক্ষাদান আনন্দময় পরিবেশে নিশ্চিত করা ও ঝড়ে পড়ার হার রোধ করা নিশ্চিত করতে হবে জাতীয়করণের সাথে সাথে।
লেখক পরিচিতি
মাছুম বিল্লাহ বাংলাদেশে ইংলিশ টিচার্স অ্যাসেসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইট্যাব)-এর সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি পূর্বে ক্যাডেট কলেজ ও রাজউক কলেজের শিক্ষক হিসেবে কাজ করেছেন। কাজ করেছেন ব্র্যাকের শিক্ষা কর্মসূচিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে। তিনি ভাব বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর হিসেবেও কর্মরত রয়েছেন। তিনি নিয়মিত শিক্ষাবিষয়ে নানা প্রবন্ধ লিখছেন।