অভিন্ন প্রশ্নপত্রে পাবলিক পরীক্ষা গ্রহণের আলোচনা অনেক পুরনো; কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি পরীক্ষা বাতিলের পর আলোচনাটি নতুন করে শুরু হয়েছে। বাংলাদেশে এসএসসি ও এইচএসসি দুটো বড় পাবলিক পরীক্ষা গ্রহণ করা হয় আটটি শিক্ষাবোর্ডের মাধ্যমে, এছাড়া আলাদাভাবে মাদ্রাসা বোর্ড ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ড তো রয়েছেই। বোর্ডগুলো মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা বা পরামর্শ মোতাবেক প্রশ্নপত্র প্রণয়ন থেকে শুরু করে ফলাফল প্রকাশ- সব স্তরের কার্যক্রম আলাদাভাবে সম্পন্ন করে। একাধিক প্রশ্নপত্র ও ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতিতে মূল্যায়নের ফলে সারাদেশের শিক্ষার্থীদের একপাল্লায় মাপা হচ্ছে কিনা- সেরকম প্রশ্ন ওঠে মাঝেমাঝেই।

এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের একপাল্লায় মাপাটা জরুরি কারণ এ দুটো পরীক্ষার মাধ্যমে সারা দেশের শিক্ষার্থীদের তুলনামূলক অবস্থা মাপা হয়। বিশেষত এই দুটো পর্যায়ের পরীক্ষার ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার গুণগত মান কীরকম- তারও একটি ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করা হয় সরকারের পক্ষ থেকে। ফলে সব বোর্ডের শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের পদ্ধতি একই রকম না হলে তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ থেকে যায়। বিক্ষিপ্তভাবে এই বিষয়গুলো নানা সময়ে আলোচনায় এসেছে। সম্প্রতি মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি পরীক্ষা বাতিলের পর বলা হয় এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে ভর্তি করা হবে। সে সময়ে প্রশ্নটি আরও জোরালো হয়- যেখানে এসএসসি ও এইচএসসির মূল্যায়ন অভিন্ন নয়, তাহলে কোন মাপকাঠির ওপর ভিত্তি করে শিক্ষার্থীদেরকে ভর্তির জন্য নির্বাচন করা হবে?

আটটি শিক্ষাবোর্ড যে পদ্ধতিতে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার আয়োজন করে, সেগুলোর ধরন প্রায় একই হলেও মূল পার্থক্যটি সূচিত হয় প্রশ্নপত্র এবং খাতা দেখার প্রক্রিয়ায়। শিক্ষাবোর্ডগুলো আলাদাভাবে তাদের মতো করে প্রশ্নপত্র তৈরি করে। যে প্রশ্ন একটি শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষায় এসেছে, সেটি অন্য কোনো বোর্ডের প্রশ্নপত্রে আসতেও পারে, নাও আসতে পারে। প্রশ্নপত্রের এই কাঠিন্য প্রায়শই আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।

একটি শিক্ষাবোর্ডে কোনো পরীক্ষার পর হয়তো শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদেরকে প্রশ্নপত্র কঠিন হয়েছে বলে আলোচনা করতে শোনা যায়; ঠিক বিপরীত চিত্র দেখা যেতে পারে অন্য কোনো বোর্ডে। অর্থাৎ একই বিষয়ে পরীক্ষা দিয়ে এক শিক্ষাবোর্ডের শিক্ষার্থীরা যেখানে ‘সহজ’ পরীক্ষা হয়েছে বলতে পারে, সেখানে একই বিষয়ের পরীক্ষা অন্য শিক্ষাবোর্ডের শিক্ষার্থীদের কাছে ‘কঠিন’ হতে পারে। কাঠিন্যের মাত্রার এ বিষয়টি এতো বেশি আলোচিত যে, এ নিয়ে ভাবাটা জরুরি কাজের মধ্যে পড়ে।

শুধু প্রশ্নপত্র নয়; পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নও শিক্ষাবোর্ডভেদে ভিন্ন হয়। কোনো কোনো বোর্ডে বেশি সংখ্যক শিক্ষার্থীকে পাশ করিয়ে দেওয়া বা জিপিএ-এর হার বাড়ানোর জন্য ইচ্ছে করেই নম্বর বাড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। শিক্ষাবোর্ডগুলোর কাছ থেকে যখন পরীক্ষকরা খাতা নিতে যান, তখন কোন বিষয়ে শিক্ষার্থীদেরকে কীভাবে মূল্যায়ন করা হবে তার একটি নির্দেশনা দেওয়া হয়। লিখিত নির্দেশনার বাইরেও কিছু মৌখিক নির্দেশনা থাকে যেগুলো পালন না করা হলে পরীক্ষকরা পরবর্তী বছর থেকে খাতা দেখার দায়িত্ব পান না বলে নানা কথাবার্তা মানুষজনের মুখে শোনা যায়। এসব কথাবার্তার কোনো প্রমাণ না থাকলেও যা কিছু রটে তার কিছু ঘটে বলে অনেকে মনে করতে পারেন। সব মিলিয়ে শিক্ষাবোর্ডগুলো সত্যিকার অর্থে অভিন্ন কোনো মূল্যায়ন উপহার দিতে পারে না।

বেসরকারি সংস্থা গণসাক্ষরতা অভিযানের উদ্যোগে এডুকেশন ওয়াচ-এর নানা গবেষণায় দেখা গেছে, সিলেট বিভাগ বা বোর্ড দেশের অন্য শিক্ষাবোর্ডগুলোর তুলনায় শিক্ষার নানা সূচকে পিছিয়ে রয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিক এইচএসসি পরীক্ষায় সিলেট বিভাগের ফলাফল বেশ ভালো দেখা গেছে। হঠাৎ করে সিলেট বোর্ডের এই উন্নতিতে অনেকে নানা ধরনের প্রশ্ন করছেন। সত্যিকার অর্থেই সিলেট বোর্ডের শিক্ষার্থীরা যদি অন্য বোর্ডের তুলনায় এই ভালো ফলাফল করে থাকে, তাহলে তা সার্বিক অর্থেই তাদের এগিয়ে যাওয়ার লক্ষণ!

কিন্তু ফল প্রকাশের পর ফেসবুক কিংবা নানা সামাজিক নেটওয়ার্কিং সাইটে অনেকে যেসব মন্তব্য করেছেন, তাতে মনে হয় শিক্ষামন্ত্রী বা অর্থমন্ত্রীর বাড়ি সিলেট হওয়ার কারণে বুঝি তারা বাড়তি কোনো সুবিধা পেয়েছে। এসব অভিযোগ হয়তো সত্যি নয়; সত্যি বা মিথ্যে হলেও প্রমাণ বা অপ্রমাণ করার কোনো উপায় নেই। কিন্তু মানুষজনের এসব মন্তব্য একটি বোর্ডের ফলাফলের ওপর যে অনাস্থা সৃষ্টি করে তা ফেলনা নয়! এ ধরনের ছোটখাটো অনাস্থা পরবর্তী সময়ে বড় ধরনের সমস্যার সৃষ্টি করে এবং পরোক্ষভাবে হলেও শিক্ষার গুণগত মান ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

সারা দেশে পাবলিক পরীক্ষা একই প্রশ্নপত্র হলে এবং পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নে একই পদ্ধতি অনুসরণ করা হলে উল্লিখিত অনেক সমস্যা সহজেই দূর করা সম্ভব হবে। সবচেয়ে বড় কথা, পাবলিক পরীক্ষাকে কার্যকর ও উপযোগী করার মাধ্যমে শিক্ষার কিছু বাহ্যিক খরচ কমানোও সম্ভব হবে। সাম্প্রতিক বিতর্ক থেকে দেখা গেছে, মেডিক্যাল বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা বাতিলের পক্ষে নন অনেকেই। তারা মনে করেন পাবলিক পরীক্ষাগুলো সত্যিকার অর্থে মেধাবী এবং অমেধাবী শিক্ষার্থীকে আলাদা করতে সক্ষম নয়; যা ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে মাপা যায়। বিষয়টিতে সত্যতা রয়েছে অনেকখানিই।

যে হারে এখন হাজার হাজার শিক্ষার্থী জিপিএ পাচ্ছে, পাবলিক পরীক্ষার পদ্ধতি ঠিকঠাকমতো কাজ করলে সেরকমটি হওয়ার কথা নয়। পাবলিক পরীক্ষা শিক্ষার্থীদের মেধা যথাযথভাবে মাপতে পারলে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ভর্তির জন্য আলাদা কোনো পরীক্ষার প্রয়োজন পড়ে না। সুতরাং সব মিলিয়ে পাবলিক পরীক্ষাকে কার্যকর ও উপযোগী করার সময় এসেছে। একই কাজটি একবারে করা হয়তো সহজতর হবে না, কিন্তু চেষ্টাটুকু শুরু করা দরকার। সরকার সেরকম উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে বলে শোনা যাচ্ছে।

সারা দেশে একই প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা নেয়ার সফল উদাহরণও আমাদের দেশে রয়েছে। মাত্র বছর কয়েক আগে চালু হওয়া জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট বা জেএসসি পরীক্ষায় একই প্রশ্নপত্রে এবং একই পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা হয়। এতে পরীক্ষা নিতে বা পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করতে বড় কোনো সমস্যা হয়েছে বলে শোনা যায় নি। সবচেয়ে বড় কথা, এক্ষেত্রে মূল্যায়ন পদ্ধতির সুফল বা কুফল যাই হোক না কেন, সবাই তা ভোগ করবে সমানভাবে। এক বোর্ড সুবিধা পাবে, অন্য বোর্ড পাবে না- সেরকম হবে না অন্তত। যদিও জেএসসি পরীক্ষার সার্বিক আয়োজন এসএসসি বা এইচএসসির মতো এতো বৃহৎ পরিসরে হয় না, কিন্তু এই পরীক্ষা থেকে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতা এক্ষেত্রে কাজে লাগানো যেতে পারে সহজেই।

সারা দেশে একই প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা নেয়ার ক্ষেত্রে কিছু বাস্তব অসুবিধা দেখা দিতে পারে। প্রথমত, প্রশ্নপত্র ফাঁস। দেশের কোথাও কোনো কারণে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে গেলে সারা দেশে সেগুলো বদলে নতুন আরেক সেট প্রশ্নে পরীক্ষা নেয়ার বিষয়টি জটিল হতে পারে। কোনো বোর্ডে এরকম হলে তার বিকল্প ব্যবস্থা শুধু ওই বোর্ডে গ্রহণ করলেই হয়- সারা দেশে বিকল্প পদ্ধতি প্রয়োগ করা কঠিনই বটে। দ্বিতীয়ত, স্থানীয় পর্যায়ে হরতাল-অবরোধ ইত্যাদি আন্দোলন।

কোনো বোর্ডে পরীক্ষার সময় হরতাল হলে (যেটা নিকট অতীতে দেখা গেছে) প্রয়োজনে সেই বোর্ডে নির্দিষ্ট একটি বিষয়ের পরীক্ষা বন্ধ রাখা যায়, যা পরে সুযোগ-সুবিধামতো নেয়া সম্ভব। নানা ধরনের বিষয় বা সাবজেক্টের কারণে এবং বিশেষত প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষার কারণে এসএসসি কিংবা এইচএসসি পরীক্ষার বাস্তবায়ন-কাঠামো তৈরি অনেক জটিল। এসব অনাহুত ঘটনা সেসব জটিলতা বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। তবে অভিন্ন প্রশ্নপত্রে একীভূত পাবলিক পরীক্ষার উপকারিতা অনেক বেশি যে, সেগুলোর কথা বিবেচনা করেই হয়তো এসব ছোটখাটো সমস্যা সহজে দূর করার উপায় বের করা সম্ভব।

সুখের বিষয় যে, সরকার এই বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে চিন্তা করছে বলে জানা গেছে। শিক্ষাবোর্ডগুলোর প্রধানদের সাম্প্রতিক এক বৈঠকে আগামীতে পাবলিক পরীক্ষাগুলো এক প্রশ্নপত্রে নেয়া যায় কিনা, সে সম্পর্কে আলোচনা উঠে এসেছে। তবে যে সিদ্ধান্তই নেয়া হোক না কেন, তা যেন খুব ভেবেচিন্তে সমস্ত দিক বিচার-বিবেচনা করে নেয়া হয়। এদেশে অনেক গুরুত্বপূর্ণ এবং সঠিক সিদ্ধান্ত কেবল উপযুক্ত সময়ে না নেয়ার কারণে বিতর্কিত হয়েছে, বাতিল হয়েছে। সরকার নিজেদের কৃতিত্ব জাহির করতেও সময়-অসময় বিবেচনা করতে চায় না অনেকক্ষেত্রে। আশা করবো, এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দূরদর্শিতার পরিচয় দিবেন।

Sending
User Review
0 (0 votes)

লেখক সম্পর্কে

গৌতম রায়

গৌতম রায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।

মন্তব্য লিখুন