সুনাগরিক সৃষ্টিতে প্রয়োজন অসুস্থ প্রতিযোগিতা রোধ

একজন কোমলমতি শিশু, যার প্রথম বিদ্যালয়ে যাওয়ার গল্পটি শুরু হয় প্রহসন দিয়ে, তাকে নিয়েই আবার আমরা স্বপ্ন দেখি অসুস্থ প্রতিযোগিতা নিয়ে সমাজের রোল মডেল হওয়ার। এতো বিবেকের সাথে বেঈমানি ব্যতীত কিছু নয়! অভিভাবক হিসেবে শিশুর জন্য ভালো একটি বিদ্যালয় বেছে নেয়া দোষের কিছু নয়। এমনকি একটি ভালো বিদ্যালয়ের জন্য শিশুকে প্রস্তুত করাও অভিভাবকের কর্তব্য। উক্ত বিদ্যালয়ের জন্য টিউশন ফি প্রদানসহ নিরাপদে যাওয়া-আসা, প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণ কিনে দেয়া সবকিছুই যৌক্তিক।

জাতির বিবেক পরাজিত হচ্ছে একদল শিক্ষাবণিকদের কাছে। শিশুরা পিষ্ট হচ্ছে অভিভাবক, গৃহশিক্ষক, নীতি-নির্ধারক আর টেকনিক্যাল এক্সপার্টদের উচ্চাকাঙ্খার পদতলে। শিশুকে উন্নততর শিক্ষাদানের বদলে একটি অসুস্থ প্রতিযোগিতার মাঝে ঠেলে দিচ্ছি।

তবে জীবনের শুরুটা লটারির ওপর ছেড়ে দেয়াটা মেনে নেয়া যায় না। আবার বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা আইন যে দেশে বলবৎ, সেখানে প্রথম শ্রেণিতেই ভর্তি পরীক্ষা হবে সেটিও সংবিধানের পরিপন্থী। এ অবস্থায় বাংলাদেশের শিক্ষাবিদগণ নিশ্চুপ। তাঁরা শিশুদের ভাগ্য লটারির ওপর ছেড়ে দিয়েই কুম্ভনিদ্রা দিচ্ছেন। জাতির বিবেক পরাজিত হচ্ছে একদল শিক্ষাবণিকদের কাছে। শিশুরা পিষ্ট হচ্ছে অভিভাবক, গৃহশিক্ষক, নীতি-নির্ধারক আর টেকনিক্যাল এক্সপার্টদের উচ্চাকাঙ্খার পদতলে, অসুস্থ প্রতিযোগিতা তাদেরকে করছে নষ্ট। শিশুকে উন্নততর শিক্ষাদানের বদলে একটি অসুস্থ প্রতিযোগিতার মাঝে ঠেলে দিচ্ছি। শিশুরা তৈরি হচ্ছে স্বার্থপর, অসহযোগিতাপূর্ণ, অসামাজিক মানুষে।

অভিভাবকদের সামনে ভালো ফলাফলের মুলো ঝুলিয়ে, কথিত উচ্চমানসম্পন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মালিকেরা হাতিয়ে নিচ্ছে অধিকতর ভর্তি ফি। কোথাও কোথাও ডোনেশন, চড়া টিউশন ফি এবং বিদ্যালয়ের বিবিধ সেবার নামে নানারকম চাঁদা। এ-বিষয়ে একটি মজার কৌতুক রয়েছে। এসব বিদ্যালয়ের মনোবৃত্তি হলো, “বই, খাতা, কলম, পেন্সিল, ডায়েরি, টিফিন, ইউনিফর্ম সবকিছু বিদ্যালয় থেকেই নিতে হবে, তবে শিক্ষাটা চাইলে অভিভাবকগণ বাইরে থেকে নিতে পারবেন”।

কখনো কখনো শিশুকে ভালো বিদ্যালয়ে চান্স পাওয়ানোর জন্য শিশুর বয়স ৩-৪ বছর পর্যন্ত কমিয়ে দেখানো হচ্ছে। মজার বিষয় হচ্ছে, এখন সকল অভিভাবক একই কাজ করছে। ফলে প্রায় সব শিশুর বয়স প্রায় একইরকম। অর্থাৎ প্রতিযোগিতায় আমার সন্তানটির একচেটিয়াভাবে জয়লাভের আর কোনো সুযোগ রইলো না। মধ্যদিয়ে জীবন থেকে হারিয়ে গেলো সকল শিশুর ২/৩টি বছর; যা আর ফিরে পাওয়া যাবে না কোনোদিন। জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে আমার সন্তানটি অধিকারবঞ্চিত হতে থাকবে; মৃত্যুটি কিন্তু যথাসময়েই হবে।

ডোনেশন দিয়ে কিংবা পরীক্ষার প্রশ্ন আউট করে অসুস্থ প্রতিযোগিতা করে আমি যে আমার অযোগ্য সন্তানটিকে ভর্তি করাতে গিয়ে আরেকটি যোগ্য শিশুর অধিকার হরণ করলাম, সেই অপরাধের দায়ভার কে নিবে? আমার কৃত অপকর্মের দ্বারা কমপক্ষে তিনটি অপরাধ সংঘটিত হলো। এক. ঘুষ/ডোনেশন দিয়ে আমি অপরাধ করলাম, দুই. ঘুষ/ডোনেশন দিয়ে অপরকে অপরাধ সংঘটনে উৎসাহিত করলাম, তিন. অন্য একটি যোগ্য শিশুর অধিকার হরণ করলাম। এছাড়াও একটি নীতিহীন কাজের মধ্যদিয়ে আমার সন্তানটি নিশ্চয়ই কোনো ফেরেশতা বনে যাবে না বরং পিতা-মাতার এই খারাপ কাজের সাক্ষ্য হিসেবে সে হয়ে উঠবে অবাধ্য, অপ্রতিরোধ্য।

চড়া দামে প্রশ্ন ক্রয় করছে হয় অভিভাবক, নয় কোচিং সেন্টার, নয়তো কোনো শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান। সে-তো অসুস্থ প্রতিযোগিতার জন্যই; যেখানে প্রথম হওয়া মূল কথা, মানবিক গুণাবলী সম্পন্ন মানুষ তৈরি করা গৌণ বিষয়।

এত ত্যাগ-তিতিক্ষার পর নিজের সন্তানটিকে একটি নামিদামী বিদ্যালয়ে ভর্তি করালাম। ক্লাসে প্রথম না হলে চলবে কী করে? এ প্লাস তো তাকে পেতেই হবে! বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ভালো করেই জানেন আমি স্বচ্ছল, অপেক্ষাকৃত সচেতন এবং অনুকরণপ্রিয় একজন অভিভাবক যে কি-না সন্তানের ভালোর জন্য সবকিছুই করতে রাজি। প্রয়োজনে প্রতিটি বিষয়ের জন্য একজন করে গৃহশিক্ষক রাখতেও রাজি। কেননা ফলাফল হতে হবে সবার সেরা। কারণ সন্তানের সফলতা আমার কাছে আভিজাত্যের প্রতীক! অতএব শিশু মনোবিদ্যায় সুদক্ষ শিক্ষকের প্রয়োজন অনুভব করি না আমি। বরং চাই ঠুশ-ঠাশ ইংলিশ বলা স্যুটেড-বুটেড একজন সুদর্শন শিক্ষক, যাকে দেখিয়ে বলতে পারবো সবাইকে, “দ্যাখো, আমার সন্তানের শিক্ষক কতো স্মার্ট”!

পরীক্ষায় প্রশ্ন আউট হয় কেনো? প্রশ্ন আউট করলে লাভ হয় কার? প্রশ্ন আউট করলে ক্ষতির স্বীকার হয় কারা? যদি আউট হওয়া প্রশ্নের চাহিদা না থাকতো, তাহলে কি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কেউ প্রশ্ন আউট করতো? চড়া দামে প্রশ্ন ক্রয় করছে হয় অভিভাবক, নয় কোচিং সেন্টার, নয়তো কোনো শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান। সে-তো অসুস্থ প্রতিযোগিতার জন্যই; যেখানে প্রথম হওয়া মূল কথা, মানবিক গুণাবলী সম্পন্ন মানুষ তৈরি করা গৌণ বিষয়।

আজ পর্যন্ত নিজের সন্তানের জন্য আউটকৃত প্রশ্ন হাতে পেয়ে কেউ কি সেটি নিতে অস্বীকার করেছেন? নাকি প্রশ্ন আউটকারীকে পুলিশে ধরিয়ে দিয়েছেন? নিজে সর্বোচ্চ সুবিধাটি নিবেন (অসদুপায়ে হলেও)— এটিই মানুষের মনোভাব যা ক্রমশ একাধিক অপরাধের সুযোগ তৈরি করে চলেছে। যদি সকল অভিভাবক একযোগে শপথ নিতো যে, সন্তানের জন্য আমরা কোনো অসদুপায় অবলম্বন করবো না, অসুস্থ প্রতিযোগিতা করবো না, এমনকি যারা অসদুপায় অবলম্বন করবে তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাড়াবো, তাহলে শিক্ষাক্ষেত্রে আশিভাগ অপরাধ কমে আসতো।

অনেক অভিভাবক এখনো মনে করেন শিক্ষক, শিক্ষা-কর্তৃপক্ষ বা শিক্ষার সাথে জড়িতদের ভুল/অপরাধ চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখাতে গেলে নিজের সন্তান বিবিধ উপায়ে বঞ্চিত হবে। শিক্ষক বিদ্যালয়ে বেশি বেশি শাস্তি দিতে পারেন অথবা পরীক্ষায় নম্বর কমিয়ে দিতে পারেন। এটি অনেকটা শিশুর যৌন-নিপীড়নের প্রতিবাদ না করে লোকলজ্জার ভয়ে নিজেকে গুটিয়ে রাখার মতো। বিদ্যালয়ে যেকোনো অপরাধের বিরুদ্ধে শিশু এবং অভিভাবকের যৌক্তিক ও বস্তুনিষ্ঠ্ প্রতিবাদ থাকা জরুরি। বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষেরও উচিত মতামতের সুব্যবস্থা রাখা।

আজ যে বিদ্যালয়ের নকলের ডিজিটালাইজেশন হচ্ছে এগুলো অসুস্থ প্রতিযোগিতারই ফল! আজ এ-দেশে যতো অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে, শিশু ও যুব সম্প্রদায় যতো অধিকার বঞ্চিত হচ্ছে, তার প্রায় সবগুলোই হচ্ছে শিক্ষার অব্যবস্থাপনা, অদূরদর্শিতা, মনিটরিং শৈথিল্য এবং সংশ্লিষ্টদের আন্তরিকতার অভাবে।

শিক্ষাব্যবস্থায় অসুস্থ, অনিয়ন্ত্রিত এবং অপরিকল্পিত প্রতিযোগিতা রুখতে পারলে জাতি অচিরেই একটি শান্তিপূর্ণ জীবনের স্বাদ পাবে, ফিরে পাবে সত্যিকারের স্বাধীনতা। একটি সত্য লুকাতে অনেক মিথ্যের আশ্রয় নিতে হয়। তেমনি একটি অপরাধ ঢাকতে অনেকগুলো অপরাধ সংঘটিত করতে হয়। যুগে যুগে সমাজে অপরাধপ্রবণ ব্যক্তির অস্তিত্ব ছিলো এবং থাকবে। তবে যেখানে অধিকাংশ মানুষ সত্য ও সুন্দরের পক্ষে থাকবে, সেখানে সকল প্রহসনের অবসান ঘটবেই।

জনপ্রিয় নিবন্ধ

প্রাথমিক স্তরে ভাষা শেখা : বিষয় – বাংলা

ভাষার দক্ষতা চারটি— শোনা, বলা, পড়া, লেখা। আর ভাষা...

আগে ইংরেজি গ্রামার শিখবো, নাকি ভাষা শিখবো?

কোন ভাষার গ্রামার হলো ঐ ভাষার গঠন প্রকৃতি যার...

শিক্ষাব্যবস্থার হালচাল

অর্থনীতিবিদদের মতে, শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ সবচেয়ে লাভজনক এবং নিরাপদ রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ। অর্থনীতিবিদ এডাম স্মিথ, ডেভিড রিকার্ডো এবং মার্শালের মতে, শিক্ষা এমন একটি খাত যার কাজ হলো দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলে পুঁজির সঞ্চালন ঘটানো। শিক্ষার অর্থনীতি নিয়ে মৌলিক গবেষণায় অর্থনীতিবদ আর্থার শুল্জ ও রবার্ট সলো দেখিয়েছেন যে, প্রাথমিক শিক্ষায় বিনিয়োগ করলে সম্পদের সুফল ফেরত আসে ৩৫ শতাংশ, মাধ্যমিক শিক্ষায় ২০ শতাংশ, এবং উচ্চ শিক্ষায় ১১ শতাংশ।

আমেরিকায় উচ্চশিক্ষা : পিএইচডির পর কী?

আমেরিকায় উচ্চশিক্ষা নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হয়, আমি নিজেও এ-নিয়ে...

ক্যাডেট কলেজে ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে কিছু কথা

ক্যাডেটসমূহ বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনে এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে।...

আরও কিছু লেখা

অধিক

    রোগীর সামাজিক পরিবেশ ও আমাদের ডাক্তারি বিদ্যা

    আমার সচরাচর খুব একটা অসুখ হয় না। এদিক দিয়ে...

    শিক্ষক প্রশিক্ষণ বনাম শিক্ষক উন্নয়ন

    সালমা আখতার লিখেছেন শিক্ষক প্রশিক্ষণ নিয়ে সম্প্রতি Access 2 Information...

    অসি বনাম মসি: প্রসঙ্গ পরীক্ষা

    একজন ছাত্রনেতার এত ক্ষমতা! পরীক্ষা বন্ধের ক্ষমতা রাখেন তিনি। তার কাছে দায়িত্বরত শিক্ষক যে কত অসহায় সেটা বোঝা গেল এই প্রতিবেদন থেকেই। ওই শিক্ষক এ ঘটনায় কোনো অভিযোগ করেননি। এমনকি ১৪ তারিখ ঘটনাটি ঘটলেও তার প্রতিকার হয়েছে বলে কোনো সংবাদমাধ্যম খবর দেয়নি।

    মুখস্থনির্ভর শিক্ষা ও মেধার বিকাশ

    মুখস্থনির্ভর শিক্ষা ও স্মরণশক্তিকে মেধা বলে চালিয়ে দেওয়ার মানসিকতা...

    অরিত্রীরা কেন হারায়?

    রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কিংবা শেক্সপিয়র বড্ড আগে জন্মে গিয়ে বেঁচে...

    বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের অভিভাবক ও তাদের উদ্বিগ্নতার কারণ

    বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় আমাদের শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা যে কী সীমাহীন...

    উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়: ভুল নাকি ভাষাপুলিশদের খবরদারি?

    বাংলাদেশের প্রচুর বিদ্যালয়ের নামে এখনো ‘উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়' বা...

    যোগ্য শিক্ষার্থীরা ব্রিটেনে পড়ালেখার সুযোগ পাবে আবারও

    আমাদের দেশ থেকে যেসব ছাত্রছাত্রী ব্রিটেনে পড়াশুনা করতে যায় তারা মধ্যবিত্ত, উচ্চ-মধ্যবিত্ত ও বিত্তবান পরিবারের সন্তান। ব্রিটেনে যাওয়ার তাদের সাধারণত দুটি উদ্দেশ্য থাকে। একটি হচ্ছে স্থায়ীভাবে ব্রিটেন থেকে যাওয়া বা ইউরোপের অন্য কোনো দেশে বা আমেরিকায় পাড়ি জমানোর চেষ্টা করা ।

    প্রাসঙ্গিক নিবন্ধসমূহ

    নতুন লেখার খবর পান ইমেইলে
    বাংলাদেশের শিক্ষা প্রসঙ্গে নতুন লেখা প্রকাশিত হলে সেই খবর পৌঁছে যাবে আপনার ইমেইলে।