আবদুল্লাহ আল মামুন লিখেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা ও শিক্ষকতা নিয়ে

চার

বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের (যার ওপর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণার মান নির্ভরশীল) কথা উঠলেই সকল বিজ্ঞান শিক্ষার্থীর জানা একটি ইতিহাস মনে পড়ে যায়। বিজ্ঞানী থমসন সর্বপ্রথম অ্যাটম সম্পর্কে বলেন। অ্যাটম হলো একটি পজিটিভলি চার্জড গোলক যার মধ্যে ইলেক্ট্রন বিছানো রয়েছে। কিছুকাল পরে তাঁর ছাত্র, রাদারফোর্ড তাঁর বিখ্যাত আলফা-কণা পরীক্ষার মাধ্যমে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, তাঁর শিক্ষক (থমসন) যা বলেছেন তার মধ্যে একটু ত্রুটি রয়েছে। তা হলো, অ্যাটমের কেন্দ্রে রয়েছে পজিটিভলি চার্জড গোলক (নিউক্লিয়াস), আর বাইরের বিভিন্ন স্তরে রয়েছে ঘূর্ণায়মান এক বা একাধিক ইলেক্ট্রন। এরও কিছুকাল পরে আবার তাঁর ছাত্র বোর (Bohr) তাঁর শিক্ষকের (রাদারফোর্ডের) অ্যাটম মডেলে কিছু সীমাবদ্ধতা খুঁজে পান, এবং কোয়ান্টাম তত্ত্ব ব্যবহার করে এই সীমাবদ্ধতাগুলো দূর করে অনেকটাই সঠিক অ্যাটম মডেল প্রদান করেন। এখানে উল্লেখ্য যে, থমসন, রাদারফোর্ড এবং বোর তিনজনই (শিক্ষক, ছাত্র, এবং নাতী-ছাত্র) নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন।

রাদারফোর্ডের মতো ছাত্র পেতে চাইলে থমসনের মতো শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে এবং বোরের মতো ছাত্র পেতে চাইলে রাদারফোর্ডের মতো শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। … শিক্ষক যদি থমসন হন, তাঁর ছাত্রকে হতে হবে রাদারফোর্ড এবং শিক্ষক যদি রাদারফোর্ডের হন, তাঁর ছাত্রকে হতে হবে বোর।

এই ইতিহাস নিয়োগকর্তাদের এই শিক্ষাই দিচ্ছে যে, রাদারফোর্ডের মতো ছাত্র পেতে চাইলে থমসনের মতো শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে এবং বোরের মতো ছাত্র পেতে চাইলে রাদারফোর্ডের মতো শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। নিয়োগকর্তাদেরই ঠিক করতে হবে তাঁরা কাদের চান। এই ইতিহাস শুধু নিয়োগকর্তাদেরই শিক্ষা দেয় না, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক এবং গবেষণারত শিক্ষার্থীকেও স্বপ্ন দেখায়। শিক্ষক যদি থমসন হন, তাঁর ছাত্রকে হতে হবে রাদারফোর্ড এবং শিক্ষক যদি রাদারফোর্ডের হন, তাঁর ছাত্রকে হতে হবে বোর।

আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, একজন শিক্ষক তখনই একজন সত্যিকারের শিক্ষকে পরিণত হতে পরেন, যদি তিনি তাঁর গবেষণা ও শিক্ষকতা দুটোকেই পেশা থেকে নেশাতে পরিণত করতে পরেন। তাই সত্যিকারের একজন শিক্ষক বা গবেষক কখনোই, কোনোভাবেই অর্থ বা পদলোভী হতে পারেন না। ইসরাইলের প্রথম প্রেসিডেন্ট মৃত্যুর পর ওই দেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বিশ্ববরেণ্য বিজ্ঞানী আইনস্টাইনকে ইসরাইলের রাষ্ট্রপতির পদ গ্রহণ করার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। কিন্তু আইনস্টাইন একটি দেশের রাষ্ট্রপতির পদ গ্ৰহণ করতে অসম্মতি প্রকাশ করে লেখেন, “আমাদের ইসরাইল রাজ্যের আমন্ত্রণ আমার হৃদয়কে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছে, কিন্তু একইসঙ্গে আমি দুঃখিত ও লজ্জিত এই জন্যে যে, আমি এ আমন্ত্রণ গ্রহণ করতে পারিলাম না, কারণ আমার বাস্তব জীবনের কোনো অভিজ্ঞতাও নেই, আর মানবজাতির সাথে মেলামেশা করার দক্ষতাও নেই”। তাই বলে এই মহাবিজ্ঞানী কোনো অন্যায়, অবিচার, অশান্তি ইত্যাদি ঘটতে দেখে নীরব থাকেননি। এ প্রসঙ্গে এই মহাবিজ্ঞানী একটি প্রশ্ন রেখেছেন, “মৃত্যুর যন্ত্রণার চেয়ে আমরা যা বিশ্বাস করি না তা মেনে নেয়ার যন্ত্রণা বেশি নয় কি?” মহাবিজ্ঞানী আইনস্টাইনের এ প্রশ্নটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর বিবেকের কাছেও রইলো।

পাঁচ

গবেষণা কী এ প্রসঙ্গে অতি সংক্ষেপে কিছু কথা উপস্থাপন করছি:

  • গবেষণা হলো সত্য ও সুন্দরের সন্ধান যা একমাত্ৰ সত্য ও সুন্দর পথ ধরে পরিচালনা করা সম্ভব;
  • গবেষণা ও শিক্ষকতা মস্তিষ্ককে শাণিত করে ও সময়-উপযোগী জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে world class research করতে বা করাতে সহায়তা করে, এবং সেই সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সময় উপযোগী বিশ্বমানের পাঠদানে সহায়তা করে;
  • বিজ্ঞান বা শিল্পকলাভিত্তিক গবেষণা প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য ব্যাখ্যা প্রদানে সহায়তা করে;
  • বিজ্ঞান বা শিল্পকলাভিত্তিক গবেষণা অতীতে যা ঘটে গেছে, বর্তমানে যা ঘটছে এবং ভবিষ্যতে যা ঘটবে, তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা প্রদানে সহায়তা করে।
  • যে গবেষণা মস্তিষ্ককে শাণিত করে না বা সময় উপযোগী জ্ঞান অর্জনে সহায়তা করে না, তা গবেষণা নয় বরং অন্য উদ্দেশ্যে বা স্বার্থ উদ্ধারের নিমিত্তে কিছু লেখামাত্র।

গবেষণা কী অতি সহজভাবে বোঝানোর জন্য সকলের দেখা দুটি সাধারণ দৃশ্য নিচে দেয়া হলো। প্রথমে রয়েছে শব্দের বেগের চেয়ে বেশি বেগে চলমান একটি Aircraft-এর দৃশ্য, তারপর রয়েছে পানিতে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট ঢেউয়ের বেগের চেয়ে বেশি বেগে সাঁতার কাটা অবস্থায় একটি হাঁসের দৃশ্য।

বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা ক্ষেত্রে আমাদের মনে রাখতে হবে: এ বিশ্বে বড় বড় যতো আবিষ্কার হয়েছে, তার সিংহভাগই হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থী কর্তৃক।

এই চলমান Aircraft এবং হাঁসের পিছনে যে ত্রিমাত্রিক বা দ্বিমাত্রিক কোণ [যাকে Mach কোণ বলা হয়ে থাকে, যেহেতু বিজ্ঞানী Mach এই কোণের ধারণা প্রথম দিয়েছিলেন) তৈরি হয়েছে, তার যেমন রয়েছে শিল্প-কলাভিত্তিক বর্ণনা, তেমনি রয়েছে বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা। কারণ যে কঠিন, তরল গ্যাস বা প্লাজমা মাধ্যমে (বস্তু বা প্রাণী কর্তৃক) এই ত্রিমাত্রিক বা দ্বিমাত্রিক কোণের সৃষ্টি হয়, তা পরিমাপ করে সেই মাধ্যমের বেশ কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য নিরূপণ করা সম্ভব। ২০০৪ সনে আমেরিকান ফিজিক্যাল সোসাইটির একটি অতি উচ্চ ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর (৮.৮) জার্নালে প্রকাশিত আমাদেরই একটি বিজ্ঞানভিত্তিক প্রবন্ধ [Mamun et al.: Phys. Rev. Lett. 92, 095005 (2004)] একটি বিশেষ মাধ্যমের অজানা বেশ কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য নিরূপণ করে বিষয়টি প্রমাণ করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা ক্ষেত্রে আমাদের মনে রাখতে হবে: এ বিশ্বে বড় বড় যতো আবিষ্কার হয়েছে, তার সিংহভাগই হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থী কর্তৃক। গবেষণা ও শিক্ষকতা তাই পাশাপাশি চলে।

একজন নবীন শিক্ষক সৎ পথে থেকে ভালো গবেষণার পাশাপাশি, পাঠদান, সততা, আদর্শ, মানবতা, নিরপেক্ষতা ইত্যাদির মাধ্যমে তাঁর শিক্ষার্থীদের মুগ্ধ করে তাদের আইডল হয়ে উঠাই হওয়া উচিৎ তাঁর স্বপ্ন। শিক্ষার্থীদের মানবতাবোধ জাগ্রত করা, দেশের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা, এবং অর্থবহ জীবন গঠনের স্বপ্ন দেখানো শিক্ষকদেরই দায়িত্ব ও কর্তব্য বলে অন্তত আমি মনে করি। শিক্ষক নিজে যা লালন করেন না, তা শিক্ষার্থীদের লালন করার উপদেশ দেয়া ব্যর্থ প্রচেষ্টামাত্র। তাই আমাদের একটি কথা অবশ্যই মনে রাখা দরকার যে, একজন শিক্ষক তাই বলবেন, তিনি নিজে যা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন। এটি না করলে একজন শিক্ষক ও তথাকথিত রাজনীতিবিদকে আমি অভিন্ন মনে করি।

আবদুল্লাহ আল মামুন: অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

Sending
User Review
0 (0 votes)

লেখক সম্পর্কে

সম্পাদক বাংলাদেশের শিক্ষা

এই লেখাটি সম্পাদক কর্তৃক প্রকাশিত। মূল লেখার পরিচিত লেখার নিচে দেওয়া হয়েছে।

মন্তব্য লিখুন