পরীক্ষানির্ভর এই শিক্ষাব্যবস্থায় নভেম্বর মাসের শুরুতে অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের জন্য জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) এবং জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট (জেডিসি) পরীক্ষা শুরু হয়েছে। ঈদের পরপরই পরীক্ষাগুলো শেষ হবে। ঈদের পর শুরু হবে পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের জন্য সমাপনী পরীক্ষা। এই দুটো পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর বাকি শ্রেণীগুলোর বার্ষিক পরীক্ষা শুরু হবে। সমাপনী কিংবা জেএসসি/জেডিসি পরীক্ষার আগে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অনেকেই তাদের শিক্ষার্থীদের একাধিক মডেল টেস্টের আয়োজন করেছে যেন তারা মূল (!) পরীক্ষায় ভালো করতে পারে। এছাড়া বছরজুড়ে নানা ধরনের পরীক্ষা তো রয়েছেই যার মধ্যে প্রথম সাময়িক ও দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষাগুলো অন্যতম।

মূল আলোচনায় যাওয়ার আগে প্রাসঙ্গিক আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন। এই মুহূর্তে আমার হাতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর কর্তৃক প্রকাশিত সরকারি/রেজিস্টার্ড বেসরকারি/কমিউনিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছুটির তালিকাটি রয়েছে। এই তালিকা অনুসারে দেখা যাচ্ছে, প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর জন্য সরকারিভাবে ৭৫ দিন ছুটি নির্ধারণ করা আছে। এর বাইরে বৃহস্পতিবার অর্ধদিবস ছুটি এবং ৫২টি শুক্রবারের সাপ্তাহিক ছুটি তো আছেই। তাছাড়া প্রথম সাময়িক পরীক্ষার জন্য ১০ দিন, দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষার জন্য ১১ দিন, প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার জন্য ১১ দিন এবং বার্ষিক পরীক্ষার জন্য ৮ দিন অর্থাৎ প্রায় ৪০ দিন নানা ধরনের পরীক্ষার জন্য শিক্ষার্থীদের শ্রেণীকক্ষের পড়াশুনা বন্ধ থাকছে। অন্যদিকে ডিসেম্বরে ১৫ তারিখের পর থেকে পরবর্তী দিনগুলো স্বাভাবিকভাবেই বিদ্যালয়ের ছুটি থাকবে। যেসব বিদ্যালয়ে এসএসসি পরীক্ষার সেন্টার আছে, সেখানেও এই এসএসসি পরীক্ষার কারণে বেশ কিছুদিন ক্লাশ বন্ধ থাকে। অর্থাৎ সব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে, বিদ্যালয়ভেদে ৩৬৫ দিনের মধ্যে কমপক্ষে ১৭৫ দিন বিদ্যালয় বন্ধ থাকছে। আর অনাকাঙ্ক্ষিত ছুটি তো থাকছেই।

নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই যাদের জেএসসি বা জেডিসি পরীক্ষা শেষ হয়ে যাবে, ধরে নেওয়া যায় তাদের এ বছরের পড়ালেখার এখানেই ইতি। অর্থাৎ ১২ মাসের মধ্যে তাদের পড়ালেখার সমস্ত আয়োজন ১০ মাসে শেষ করতে হয়েছে। অভিজ্ঞতা বলে, খুব কম বিদ্যালয়ই হয়তো ফেব্রুয়ারি মাসের আগে ক্লাসের আয়োজন করতে পেরেছে। জানুয়ারি মাসের প্রথম দিন থেকেই পড়ালেখা শুরু করার বিষয়টি সাম্প্রতিক সময়ে কিছুটা আলোচনায় এসেছে; কিন্তু সব বিদ্যালয় যে ঠিকমতো এই কাজটি শুরু করতে পেরেছে তা বলা যাবে না। অনেক বিদ্যালয় জানুয়ারি মাসে ক্লাস শুরু করলেও নানা কারণে ঢিলেঢালাভাবে মাসটি পার করে দেয়। সেই হিসেবে বলা যায়, অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা প্রথম ও দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষাসহ মাত্র নয়টি মাস সময় পেয়েছে পড়ালেখার জন্য। অন্যদিকে যারা সমাপনী পরীক্ষা দিবে, তারা প্রায় মাসখানেকেরও বেশি আগে এ বছরের পড়ালেখার পাট চুকিয়ে ফেলবে। সব মিলিয়ে মানেটা দাড়াচ্ছে, পরীক্ষা ও অন্যান্য কারণে শিক্ষার্থীরা শেষের এক-দেড় মাস সময় পড়ালেখার বাইরে থেকে যাচ্ছে। যখন ক্লাশ হয়, তখনও কি ঠিকমতো ক্লাশ হয়? গবেষণা থেকে দেখা যায়, প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষকদের প্রায় ১২ শতাংশ বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থাকেন। যারা উপস্থিত থাকেন, তাদের প্রায় ৪২ শতাংশেরও বেশি নির্ধারিত সময়ের পর বিদ্যালয়ে উপস্থিত হন। এছাড়া প্রধান শিক্ষক নানা কারণে ক্লাশ নিতে পারেন না। ক্লাশ শুরু হয় ঠিকমতো, কিন্তু শেষ হয় নির্ধারিত সময়ের আগেই- এরকম উদাহরণও রয়েছে প্রচুর।

উপরের তথ্যগুলো মোটামুটি এই মেসেজটাই দিচ্ছে যে, আমাদের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা আসলে বিদ্যালয় পরিবেশে যে পরিমাণ সময় পড়ালেখার জন্য পাওয়ার কথা, তারা সেই সময়টুকু পাচ্ছে না এবং ছুটি এবং পরীক্ষা তাদের একটি বড় সময় খেয়ে নিচ্ছে। বিদ্যালয়ের অধিকাংশ ছুটিই মূলত ধর্মীয় কারণের সাথে সম্পর্কিত। উপরে যে ৭৫ দিন ছুটির কথা বলা হলো, এর মধ্যে ৫০ দিনই হচ্ছে ধর্মীয় কারণে ছুটি। আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে চিন্তা করলে এই ছুটিগুলো হয়তো বাদ দেয়া যাবে না। অন্যদিকে বার্ষিক সমাপনী পরীক্ষা কিংবা জেএসসি বা জেডিসি পরীক্ষার প্রভাব শুধু পরীক্ষার সময়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না। যেহেতু এই দুটো পরীক্ষার ফলাফলের সাথে বিদ্যালয়ের পারফরম্যান্স মূল্যায়নের বিষয়টি জড়িত, সুতরাং অধিকাংশ বিদ্যালয়ই বছরধরে সংশ্লিষ্ট শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের অতিরিক্ত কোচিং করানো কিংবা এ ধরনের কাজের সাথে যুক্ত থাকে। এর ফলে অন্য শ্রেণীর শিক্ষার্থীদেরও পড়ালেখা বেশ কিছুটা ব্যাহত হয়।

২.
লেখার শিরোনামে যে প্রশ্নটি রেখেছি- সেটিতেই ফিরে যাওয়া যাক। সাম্প্রতিক সময়ে সরকারি নানা উদ্যেগের ফলে বিদ্যালয়ে মূল্যায়ন ব্যবস্থায় বেশ কিছু পরিবর্তন এসেছে। আগেকার দিনে শিক্ষার্থীরা যেভাবে মূল্যায়িত হতো, তার চেয়ে বর্তমান সময়ের মূল্যায়ন ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন না আসলেও বেশ কিছু লক্ষ্যণীয় পরিবর্তন আমরা দেখতে পাই। তাছাড়া কিছুদিন আগেও দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর পারফরম্যান্স মাপা হতো না- যেটা এখন প্রতিবছরই হচ্ছে। এই দুটো কারণে যে ঘটনাটি ঘটছে তা হলো, বিদ্যালয়গুলোতে পরীক্ষার পরিমাণ বেড়ে গেছে লেখাপড়ার তুলনায়। পরীক্ষা বা মূল্যায়ন যদিও লেখাপড়ারই একটা অপরিহার্য অংশ হওয়া উচিত, কিন্তু বাস্তব কারণেই আমাদের দেশে পরীক্ষাকে লেখাপড়ার ফল হিসেবে দেখা হয়। লেখার প্রথম অংশের হিসাব থেকে দেখেছি সরকারি ও অন্যান্য ছুটির কারণে বিদ্যালয় একটা লম্বা সময় ছুটি থাকে। লেখাপড়ার আরেকটি বড় অংশ খেয়ে নেয় এই পরীক্ষা ব্যবস্থা। এই দুটো ঘটনার ফলে শিক্ষার্থীদের সারাবছর শ্রেণীকক্ষে যে পরিমাণ লেখাপড়া করার কথা, তারা সেই সময়টুকু পাচ্ছে না কিন্তু তাদের ঠিকই পুরো সিলেবাস বা কোর্সের ওপর পরীক্ষা দিতে হচ্ছে। একটি শ্রেণীর সিলেবাস ও পাঠ্যপুস্তক তৈরির সময় নানা বিষয় বিবেচনা করতে হয় যার একটি হচ্ছে শিক্ষার্থীর বয়স। অর্থাৎ এই বয়সের একজন শিক্ষার্থী সারা বছরে নির্দিষ্ট বইগুলো পড়ে শেষ করতে পারবে কিনা, পাঠ্যপুস্তক তৈরির সময় সেটি বেশ গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা হয়। এখন শিক্ষার্থীদের সেই বিষয়গুলো না পড়িয়ে কিংবা তাড়াহুড়ো করে পড়িয়ে তাদের পরীক্ষা নেয়া কতোটুকু যুক্তিসম্মত?

এক্ষেত্রে অবশ্য শিক্ষকদের করার কিছু নেই কারণ তাদেরকে কখন কীভাবে পরীক্ষা নিতে হবে সেই নির্দেশনা আসে কেন্দ্র থেকে। এখন কেন্দ্র যদি পরীক্ষার ওপর বেশি জোর দেয়, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষকরা তাদের শিক্ষার্থীদের পড়ালেখাকে পরীক্ষামুখী করার দিকে জোর দিবেন। বলা হয়, জুনিয়র লেভেলে শিক্ষার্থীদের এ ধরনের সমাপনী বা বছরশেষের পরীক্ষা যতো কম নেয়া হয়, ততোই ভালো। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে শুনেছি অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের কোনোরূপ পরীক্ষা যাতে না দিতে হয় সেখানকার রাজ্য সরকার সেই ব্যবস্থা করছে। অথচ আমাদের এখানে ঘটছে পুরোপুরি উল্টো ঘটনা। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীতে শিক্ষার্থীদের অটোপ্রমোশন হওয়ার কথা, কিন্তু তাদেরকে পরীক্ষা দিতে হচ্ছে। প্রাথমিক সমাপনী ও অষ্টম শ্রেণীর পর জেএসসি/জেডিসি পরীক্ষা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় নতুনভাবে যুক্ত হয়েছে। আমরা কি তাহলে দিনদিন পরীক্ষানির্ভর শিক্ষার দিকে ঝুঁকছি? যদি সেটা হয়, তাহলে তা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার জন্য ভালো কিছু বয়ে আনবে না। পরীক্ষা কিংবা মূল্যায়ন ব্যবস্থার ওপর আলাদাভাবে জোর না দিয়ে সেটিকে কীভাবে বিদ্যালয়ের লেখাপড়ারই একটি অপরিহার্য অংশ করা যায়- সেটির দিকে গুরুত্ব দেয়া উচিত।

Sending
User Review
0 (0 votes)

লেখক সম্পর্কে

গৌতম রায়

গৌতম রায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।

মন্তব্য লিখুন

2 মন্তব্য

  • আমরা আসলেই পরীক্ষানির্ভর শিক্ষার দিকে ঝুঁকছি। পড়াশোনার চেয়ে পরীক্ষা দেয়াটাই এখন অধিক গুরুত্বপূর্ণ।। স্কুলজীবন পার করে এসে নিজেকে মাঝে মাঝে ভাগ্যবান মনে হয় এই কারণে যে এখন আর গাদা পরীক্ষা দিতে হয় না, স্যারের বাসায়ও দৌড়াতে হয় না। শিশুকিশোরদেরকে আসলে আমরা একটি কন্টকময় শৈশব ও কৈশোর যাপন করতে বাধ্য করছি। প্রথমে শুনেছিলাম এসএসসি-এইচএসসি পরীক্ষা উঠিয়ে দিয়ে শুধু মাত্র অষ্টম শ্রেণী ও দ্বাদশ শ্রেনী শেষে জাতীয়ভাবে সমাপনী বা পাবলিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। এখন দেখছি পঞ্চম, অষ্টম, দশম, দ্বাদশ সব শ্রেনী শেষেই পাবলিক পরীক্ষা বিদ্যমান।