প্রিডেটরি জার্নাল বা প্রিডেটরি প্রকাশনা সংস্থায় জার্নাল প্রবন্ধ, বই, বইয়ের অধ্যায় ইত্যাদি প্রকাশ করে অনেক গবেষক নিজেদের ক্যারিয়ারকে প্রশ্নের মুখোমুখি করে তুলছেন। প্রিডেটরি জার্নাল বা প্রকাশনা সংস্থা কেন একজন গবেষকের গন্তব্য হওয়া উচিত নয়— বিষয়টিকে কেন্দ্র করে ‘বাংলাদেশের শিক্ষা’-কে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন বাংলাদেশের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিটিক্যাল স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. নজরুল ইসলাম। সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন বাংলাদেশের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক গৌতম রায় ও অস্ট্রেলিয়ার মনাশ ইউনিভার্সিটির প্রভাষক ড. মাহবুব সরকার

প্রশ্ন: সম্প্রতি আপনি ফেইসবুকে প্রিডেটরি জার্নাল নিয়ে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন। সেখানে আপনি সরাসরি এসব জার্নাল বা প্রকাশনা সংস্থা থেকে সবাইকে, বিশেষত নবীন গবেষকদের দূরে থাকতে বলেছেন। কেন বলেছেন? প্রিডেটরি জার্নাল বা প্রকাশনা সংস্থা কী? এগুলো কেন গড়ে উঠছে? তাদের লক্ষ্য করা?

ড. মো. নজরুল ইসলাম: ধন্যবাদ। এই প্রশ্নের উত্তরটি একটু লম্বা হবে। প্রিডেটরি জার্নাল বা প্রকাশনা হছে এমনসব পাবলিশিং কোম্পানি যারা কোনো প্রকাশনার (বই, বইয়ের অধ্যায়, জার্নাল প্রবন্ধ প্রভৃতি) একাডেমিক গুণগত মান যাচাইবাচাই না করে কেবল অর্থের বিনিময়ে সেগুলো প্রকাশ করে। অর্থাৎ, একাডেমিক জগতে পিয়ার রিভিউ বলে পাবলিকেশনের যে চর্চাটি আছে, তা তারা অনুসরণ করেন না। এ-জাতীয় প্রিডেটরি জার্নালকে একাডেমিক ওয়ার্ল্ডে ‘প্রতারণামূলক প্রকাশনা’ও বলা হয়ে থাকে।

প্রিডেটরি জার্নাল বা প্রকাশনা সংস্থাগুলো গড়ে উঠেছে মূলত ব্যবসায়িক বা বাণিজ্যিক চিন্তাভাবনা থেকে। আপনারা জানেন যে, নয়াউদারনৈতিক এই অর্থনৈতিক যুগে পুঁজিবাদের প্রভাব থেকে কোনোকিছুই মুক্ত থাকছে না। বর্তমান কালের শিক্ষাব্যবস্থাও পুঁজিবাদী ছোবল থেকে মুক্ত নয়। আপনি দেখুন, প্রিডেটরি জার্নালের বাইরেও আন্তর্জাতিকভাবে একাডেমিক্যালি স্বীকৃত যে জার্নালগুলো আছে, তারাও একজন গবেষকের গবেষণাকর্ম ছাপিয়ে ব্যবসা করছে।

দু’ভাবে তারা ব্যবসাটা করছে। এক, কিছু কিছু জার্নাল আছে ওপেন এক্সেস জার্নাল। সেখানে একজন গবেষক তাঁর গবেষণা পেপার প্রকাশের জন্য খোদ গবেষককে আর্টিকেল প্রসেসিং চার্জ (এপিসি) নামে অর্থ দিতে হয়। দুই, যেসব জার্নাল পেইড এবং ওপেন এক্সেস উভয় প্রকৃতি রয়েছে, সেখানে ওপেন এক্সেস আর্টিকেল ছাপাতে গেলে গবেষকের পয়সা খরচ করা লাগে। এখন একজন গবেষক কষ্ট করে গবেষণা করেন। আবার তা ছাপানোর জন্য তাঁকে পয়সা খরচ করতে হয়। নিওলিবারেল ইকনোমি এখানটায় কাজ করে।

আপনি বলতে পারেন, গবেষক তো কখনো-কখনো গবেষণার ফান্ড নিয়ে গবেষণা করেন। এ-রকম অনেক গবেষণা প্রজেক্ট আছে যারা জার্নাল প্রবন্ধ প্রকাশ করার চার্জও বরাদ্দ করে। এটি ঠিক আছে। কিন্তু সব গবেষণার জন্য ফান্ড থাকে না। সেক্ষেত্রে গবেষকের পকেট থেকে অর্থ খরচ করে জার্নাল প্রবন্ধ ছাপাতে হয়।

আবার এও বলতে পারেন যে, জার্নালের প্রকাশনা খরচ তো আছে। এর উত্তরে আমি বলব, তা আছে। কিন্তু এই প্রকাশের কাজটি করে পুরো বাণিজ্যটি তাঁরা করেন। আবার বই প্রকাশ করার পরে লেখকদেরকে যে রয়্যালটি প্রকাশকরা দেয় তাও নেহায়েত নগণ্য। কেবল বাংলাদেশ নয়, পাশ্চাত্যের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং গ্রন্থলেখকদের কাছ থেকে এমন কথা শুনতে পাবেন। মোট কথা, এই জার্নাল প্রবন্ধ বা বই প্রকাশনার ক্ষেত্রে লেখকরা উল্লেখ করার মতো কোনো আর্থিক সুবিধা পান না। পুরো বাণিজ্যটি করে প্রকাশকরা। এটিই এখন দুনিয়ার নিয়ম হয়ে গেছে। নিওলিবারেল ক্যাপিটালিস্টিক ইকনোমি এর জন্য দায়ি— আমি বলবো।


এই জার্নাল প্রবন্ধ বা বই প্রকাশনার ক্ষেত্রে লেখকরা উল্লেখ করার মতো কোনো আর্থিক সুবিধা পান না। পুরো বাণিজ্যটি করে প্রকাশকরা। এটিই এখন দুনিয়ার নিয়ম হয়ে গেছে। নিওলিবারেল ক্যাপিটালিস্টিক ইকনোমি এর জন্য দায়ি— আমি বলবো।


তবে এসব আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত জার্নাল ও বই প্রকাশনার সাথে প্রিডেটরি জার্নাল বা প্রকাশনার পার্থক্য হলো এই যে, প্রথম শ্রেণির প্রকাশনা কোনো জার্নাল প্রবন্ধ বা বই প্রকাশের ক্ষেত্রে গুরুত্ব দিয়ে একাডেমিক গুণগত মান বজায় রাখে। এক্ষেত্রে পিয়ার রিভিউ ছাড়া কোনো পাণ্ডুলিপি বা লেখা প্রকাশ হয় না। অর্থাৎ, একাডেমিক গুণগত মান বজায় রাখার ক্ষেত্রে তারা কোনো আপোষ করে না। কিন্তু দ্বিতীয় শ্রেণির বা প্রিডেটরি প্রকাশনা সংস্থা সাধারণত পিয়ার রিভিউ অনুসরণ করে না। অর্থের বিনিময়ে কোনোরকম মান নিশ্চিত না করে প্রকাশ করে দেয়।

এবার আসি আপনাদের আসল প্রশ্নে। প্রিডেটরি জার্নাল এই নিওলিবারেল ইকনোমির সুবিধাটি নিয়ে নিচ্ছে। আমি বলবো, একাডেমিক বা ইন্টেলেকচুয়াল কন্ট্রিবিউশনের জায়গা থেকে নয়, বরং কেবল বাণিজ্যিক স্বার্থে, মুনাফা অর্জনের জন্য প্রিডেটরি জার্নাল বা প্রকাশনা সংস্থাগুলো গড়ে উঠেছে। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে, আমাদের টাকা দাও, আমরা তোমার জার্নাল প্রবন্ধ ছাপিয়ে দিচ্ছি। প্রবন্ধের একাডেমিক মান নিয়ন্ত্রণের চিন্তা তারা খুব কমই করে। তাদের লক্ষ্য কারা তা তারা ভালো বলতে পারবে। তবে আমার মনে হয়, উদীয়মান কিংবা নতুন এবং নিম্ন ও মধ্যম সারির গবেষকরা তাদের প্রাথমিক লক্ষ্য।

মানুষ কেন এসব জার্নালে তাদের প্রবন্ধ প্রকাশে আগ্রহী হয় বা ওইসব জার্নালের কী বিষয় মানুষকে আকর্ষণ করে?

এর নানা কারণ থাকতে পারে।

এক, নতুন শিক্ষক ও গবেষকরা অনেক সময়ই বুঝে উঠতে পারেন না যে, কোন ধরনের জার্নালে তাঁদের প্রবন্ধ প্রকাশ করা উচিত। বিশেষ করে আমাদের মতো দেশে একাডেমিক প্রকাশনার ক্ষেত্রে নতুন ও উদীয়মান গবেষকরা এক্ষেত্রে যথাযথ প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ পান না। অনেক সময় না বুঝেই তাঁরা এসব জার্নালে প্রবন্ধ প্রকাশ করেন।

দুই, এই জাতীয় জার্নালগুলো তাদের টার্গেটের কাছে প্রতিনিয়ত হাজির হয়। সপ্তাহে সপ্তাহে ই-মেইল পাঠায়। হাতের কাছে এরকমভাবে ছাপানোর সুযোগ পেয়ে অনেকেই কখনো বুঝে বা কখনো না বুঝে রাতারাতি জার্নাল প্রবন্ধ ছাপানোর কাজ করে থাকেন। আমার কাছে ব্যক্তিগতভাবে কোনো কোনো তরুণ গবেষক স্বীকার করেছেন যে, না বুঝে তাঁরা এ-জাতীয় জার্নালে প্রবন্ধ ছাপিয়েছেন।

তিন, জার্নালের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ইন্ডেক্স ও এবস্ট্রাকশন সম্পর্কে ধারণা না থাকার কারণে কেউ কেউ অনেক সময় বুঝতে পারেন না যে, কোন জার্নালগুলো আন্তর্জাতিক মানের এবং একাডেমিক্যালি স্বীকৃত। অনেক সময় প্রিডেটরি জার্নালগুলি ফেক বা ভুয়া ইন্ডেক্স ব্যবহার করে। কেউ কেউ হয়ত এসব জার্নালের দাবীকৃত ইন্ডেক্স চেক করে নাও দেখতে পারে।

চার, প্রিডেটরি জার্নালগুলো খুব স্বল্প সময়ে এমনকি প্রতি মাসে একবার করে এক-একটি ইস্যু প্রকাশ করে। অথচ, একটি স্বীকৃত জার্নালে পিয়ার রিভিউ প্রসেস সমাপ্ত করে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করতে কমপক্ষে ছয় মাস থেকে এক বছর লেগে যায়। কখনো কখনো তা দুই থেকে আড়াই বছর পর্যন্ত লাগতে পারে। খুব ওয়েল রিটেন এবং ওয়েল ফার্নিশড প্রবন্ধ হলে হয়ত তিন বা চার মাসে তা সম্ভব। অনেক সময় শিক্ষক গবেষকদের পদোন্নতি কিংবা অন্য কোনো একাডেমিক প্রয়োজনের কারণে রাতারাতি ছাপানোর জন্য তাঁরা প্রিডেটরি জার্নালের ওপর নির্ভর করে।

পাঁচ, সবশেষে বলতে পারি, কোনো কোনো শিক্ষক বা গবেষক আন্তর্জাতিক মানের স্বীকৃত একটি জার্নালে রিগোরাস পিয়ার রিভিউ প্রসেসের মধ্য দিয়ে গিয়ে একটি পেপার ছাপানোর ঝক্কিঝামেলা হয়তো নিতে চান না। কম পরিশ্রমী লোকদের কাছে তার চেয়ে বরং তড়িৎ টাকা দিয়ে দ্রুত জার্নাল প্রবন্ধ ছাপানোর কাজটি অধিকতর সহজ মনে হতে পারে। এর বাইরে কেউ কেউ এমনও থাকতে পারে যে, আন্তর্জাতিক মানের জার্নালে প্রকাশ করার মতো আত্মবিশ্বাস তাঁদের থাকে না। অনেক সময় যোগ্যতা থাকার পরও কনফিডেন্সের অভাবে তাঁরা এই কাজটি করেন। এজন্য একজন ব্যক্তি কিংবা গবেষকের নিজ যোগ্যতা ও দক্ষতা সম্পর্কে ভাল এবং স্পষ্ট ধারণা থাকাটাও অতীব জরুরি।         


কোনো কোনো শিক্ষক বা গবেষক আন্তর্জাতিক মানের স্বীকৃত একটি জার্নালে রিগোরাস পিয়ার রিভিউ প্রসেসের মধ্য দিয়ে গিয়ে একটি পেপার ছাপানোর ঝক্কিঝামেলা হয়তো নিতে চান না। কম পরিশ্রমী লোকদের কাছে তার চেয়ে বরং তড়িৎ টাকা দিয়ে দ্রুত জার্নাল প্রবন্ধ ছাপানোর কাজটি অধিকতর সহজ মনে হতে পারে।


একজন নবীন গবেষক কী দেখে একটি প্রিডেটরি জার্নাল চিহ্নিত করতে সক্ষম হবে?

প্রথমত, জার্নালের ইন্ডেক্স এবং এবস্ট্রাকশন। আন্তর্জাতিক স্বীকৃত যে ইন্ডেক্স সংস্থাগুলি রয়েছে, যেমন সাইন্স সাইটেশন ইন্ডেক্স, সোশ্যাল সাইন্স সাইটেশন ইন্ডেক্স, আর্টস এন্ড হিউম্যানিটিজ সাইটেশন ইন্ডেক্স, আইএসআই/এমার্জিং সোর্সেস সাইটেশন ইনডেক্স, স্কোপাস প্রভৃতি। যেসব জার্নাল এগুলোর যেকোনো একটি ইন্ডেক্সভুক্ত, সেসব জার্নাল সত্যিকারের পিয়ার রিভিউড জার্নাল। যেসব জার্নালের এ-জাতীয় ইন্ডেক্স বা এবস্ট্রাকশন নেই, সেসব জার্নাল প্রিডেটরি জার্নালের তালিকাভুক্ত হতে পারে।

আমি কেবল কয়েকটির নাম উল্লেখ করলাম। বিষয়ভেদে এর পার্থক্য হতে পারে। প্রকাশকের কথা বললে, বেশ কিছু নামকরা জার্নাল এবং বই প্রকাশক আছে যারা আন্তর্জাতিক মানের। যেমন, টেলর এন্ড ফ্রান্সিস/রাউটলেজ, সেজ, স্প্রিঙ্গার/পলগ্রেভ ম্যাকমিলান, উইলি এন্ড সন্স, এলসেভিয়ার, এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস।

আবার, ইম্প্যাক্ট ফ্যাক্টর (আইএফ) একটি মানদণ্ড হতে পারে। তবে এক্ষেত্রেও খেয়াল রাখা দরকার যে, প্রিডেটরি জার্নালগুলো অনেক সময় ফেইক বা ভুয়া আইএফ উল্লেখ করে থাকে। কখনো কখনো তারা ভুয়া ইন্ডেক্স ব্যবহার করে থাকে। এসবের ক্ষেত্রে একটু চোখকান খোলা রেখে অগ্রসর হওয়াই উত্তম।

দ্বিতীয়ত, প্রায় সব প্রিডেটরি জার্নাল খুব দ্রুত এমনকি কখনো কখনো পেপার জমাদানের মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে প্রকাশ করে দেয়। যেসব জার্নাল এতো দ্রুত একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করে, তারা নিশ্চিতভাবে পিয়ার রিভিউ পদ্ধতি অনুসরণ করে না। এগুলো নিশ্চিতভাবে প্রিডেটরি জার্নাল।

তৃতীয়ত, সব প্রিডেটরি জার্নাল ওপেন এক্সেস এবং টাকার বিনিময়ে জার্নাল প্রবন্ধ প্রকাশ করে। আগেই বলেছি, বহু স্বীকৃত জার্নালও আছে যারা টাকা নিয়ে ওপেন এক্সেস প্রবন্ধ প্রকাশ করে। তবে তাঁরা অবশ্যই পিয়ার রিভিউ প্রক্রিয়া সমাপ্ত করেই যখন রিভিউয়াররা ইতিবাচক মত দেন, কেবল তখনই পাবলিশ করে। প্রিডেটরি জার্নাল পিয়ার রিভিউর কথা বললেও তা আদতে অনুসরণ করে না।

চতুর্থত, প্রিডেটরি জার্নালগুলো লেখক, গবেষকদের কাছে প্রতিনিয়ত ই-মেইল পাঠায় প্রবন্ধ জমাদানের অনুরোধ করে। যেসব জার্নাল এভাবে ই-মেইল করে প্রবন্ধ জমাদানের অনুরোধ জানায়, সেসব জার্নাল ধরে নিতে হবে প্রিডেটরি জার্নাল। কারণ, কোনো স্বীকৃত জার্নাল সাধারণত এভাবে প্রবন্ধ জমাদানের অনুরোধ বা আহ্বান জানিয়ে কারো কাছে ই-মেইল পাঠায় না বা যোগাযোগ করে না।

পঞ্চমত, সর্বোপরি, আপনারা জানেন যে, আমেরিকার কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জেফ্রি বেলের (Jeffrey Beall) প্রিডেটরি জার্নাল ও প্রকাশনার একটি তালিকা আছে, যা Beall’s List of Predatory Journals and Publishers নামে পরিচিত। এই তালিকাটি নিয়ে নানা কথা থাকলেও আন্তর্জাতিকভাবে এটিকে এক্ষেত্রে বেশ গুরুত্ব দেয়া হয়। এই তালিকাটি চেক করা যেতে পারে। এ ছাড়াও, সহকর্মী, গবেষক, কিংবা দূরের পরিচিত স্কলার/রিসার্চারের সাথে এ-বিষয়ে পরামর্শ/আলোচনা করা যেতে পারে। মনে রাখা দরকার, ভালো কাজ করতে গেলে একটু বেশি পরিশ্রম করা লাগবে।

প্রিডেটরি জার্নালে প্রকাশিত হলেও একজন গবেষকের তো নতুন একটি জার্নাল প্রবন্ধ প্রকাশিত হচ্ছে। এতে কি কোনোভাবেই মানুষ উপকৃত হচ্ছে না? আসলে এই ধরনের জার্নালে লেখা প্রকাশের কি কোনোই লাভ নেই?

হ্যাঁ, কেউ না কেউ তো উপকৃত হচ্ছেই। এই ধরুন, এই প্রকাশকরা উপকৃত হচ্ছে। তারা ভালো ব্যবসা করতে পারছে। আবার, যেসব গবেষক এসব জার্নালে প্রবন্ধ ছাপান, খুব সহজে তাঁরা কাজটি করতে পারেন। এতে তাঁদের প্রবন্ধের সংখ্যা বাড়ছে। অনেকে খুব তাড়াতাড়ি প্রকাশ করে সহজে প্রমোশন বা আপগ্রেডেশন পেয়ে যাচ্ছেন। এগুলো তো হচ্ছে।

কথা হলো, একাডেমিক গুণগত মানের জায়গায় আসলে বরং লাভের থেকে ক্ষতির ভাগটাই বেশি হবে। সংখ্যা এবং মান দুটোই আমাদের দরকার। আপনি যদি বেশি সংখ্যক প্রবন্ধ প্রকাশ করতে পারেন এবং এগুলো যদি মানসম্মত হয়, তবে তা উত্তম। কিন্তু মানের ক্ষেত্রে ছাড় দিয়ে সংখ্যা বাড়ানোয় একাডেমিক জগতে, আমি বলব, খুব লাভ হচ্ছে না।

একজন গবেষক গবেষণা করেন কেবল তাঁর পেশাগত স্বার্থ ও উপকার বা সুবিধার জন্যই না। একজন গবেষকের গবেষণা, সমাজের ও মানুষের কী কাজে আসছে, সমাজে এর কী প্রভাব থাকছে, সমাজের উন্নয়ন ও অগ্রসরতার ক্ষেত্রে কী অবদান রাখছে, সেই দিকটি অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। এখন এই চিন্তা করলে তো প্রকাশনার গুণগত মানের ওপর সবচেয়ে বেশি নজর দিতে হবে। একজন গবেষকের গবেষণার কারণ হিসেবে প্রাথমিকভাবে ব্যক্তিগত ও পেশাগত সুবিধার ব্যাপারটি থাকে না। বৃহত্তর সমাজের কল্যাণ ও মঙ্গল সাধনের জন্য জ্ঞানসৃষ্টির এই কাজটি করা হয়। আপনি বলতে পারেন, গবেষকের ব্যক্তিগত ও পেশাগত সুবিধাটি আসবে এক্ষেত্রে বাই প্রোডাক্ট হিসেবে।


একজন গবেষকের গবেষণা, সমাজের ও মানুষের কী কাজে আসছে, সমাজে এর কী প্রভাব থাকছে, সমাজের উন্নয়ন ও অগ্রসরতার ক্ষেত্রে কী অবদান রাখছে, সেই দিকটি অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। এখন এই চিন্তা করলে তো প্রকাশনার গুণগত মানের ওপর সবচেয়ে বেশি নজর দিতে হবে।


আবার, একটু সচেতন এবং এডভান্সড কোনো গবেষক এই জাতীয় প্রিডেটরি প্রকাশনা সাইট করতে অনীহা প্রকাশ করেন। এর একটি বড় কারণ হল, খ্যাতিমান কোনো লেখক বা গবেষক সাধারণত প্রিডেটরি প্রকাশনা সংস্থা থেকে জার্নাল প্রবন্ধ বা বই প্রকাশ করে না। একটি ভালো মানের জার্নাল প্রবন্ধ প্রকাশ করতে গেলে পর্যালোচকরা এটিও খেয়াল করেন যে, আপনি কাদেরকে সাইট করেছেন। অর্থাৎ, যে বিষয়ে আপনি কাজ করেছেন, সে সম্পর্কে আপনি সংশ্লিষ্ট ফিল্ডের যারা অথোরিটি তাঁদের কাজকে রিভিউ করেছেন কিনা, সাইট করেছেন কিনা, সেসব ইতোমধ্যে থাকা লিটারেচার সম্পর্কে আপনার জানাশোনা আছে কিনা, অর্থাৎ, বিশেষ করে সোশ্যাল সাইন্সের ক্ষেত্রে লিটারেচার রিভিউর যে ব্যাপারটি আছে, তা গুরুত্বপূর্ণ।

এখন কোনো ফিল্ডের যারা অথোরিটি তাঁরা কিন্তু এসব তুলনামুলকভাবে সস্তা দামের প্রিডেটরি জার্নালে পেপার ছাপান না। কাজেই এক্ষেত্রে আপনার পেপারের সাইটেশন হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। মোদ্দা কথা হল, প্রিডেটরি জার্নালে প্রবন্ধ ছাপা হলে লেখকের ব্যক্তিগত কিছু লাভ থাকলেও বৃহত্তর অর্থে গুণগত মানের প্রশ্নে ক্ষতির দিকটাই বেশি। একাডেমিক জগতে সংখ্যা ও পরিমাণের থেকে গুণের গুরুত্বটিই বেশি। একাডেমিক জগতে কোয়ালিটি ম্যাটারস, কোয়ালিটি ইম্প্যাক্টস।     

একটি অভিযোগ শোনা যায় যে, অনেকক্ষেত্রে পদোন্নতির জন্য এসব জার্নালে লেখা প্রকাশ করা হয়। যদি প্রিডেটরি জার্নালের প্রবন্ধকে পদোন্নতির জন্য সহায়ক ভাবা হয়, তাহলে মানুষ কেন এসব জার্নালে লেখা প্রকাশ থেকে বিরত থাকবে?

এই অভিযোগ ভিত্তিহীন নয়। আমি আগেই বলেছি, কম পরিশ্রম করে সহজ উপায়ে প্রকাশ করে অনেকেই পদোন্নতির সুবিধাটা নিতে পারেন। এটি সত্য। এগুলো আসলে হচ্ছেও। তবে সবাই যে তা করেন, তা নয়। কমিটমেন্টের একটি জায়গা আছে।

এখন আপনার যে প্রশ্ন, পদোন্নতির সহায়ক হলে মানুষ কেন এসব জার্নালে লেখা প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকবে— এর উত্তরে আমি বলব, বিরত থাকবে না, বিরত রাখতে হবে। এসব প্রিডেটরি জার্নালে লেখা প্রকাশ করে সহজে প্রমোশন বা আপগ্রেডেশন পাওয়ার রাস্তাটি বন্ধ করতে হবে। এজন্য দেখবেন, আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের ইউনিভার্সিটি গ্রান্টস কমিশন (ইউজিসি) শর্ত দিয়ে দিয়েছে কোনসব জার্নালের পেপার প্রমোশন বা আপগ্রেডেশনের ক্ষেত্রে বিবেচনায় নেয়া হবে। তারা এমনকি স্বীকৃত জার্নালের একটি তালিকা পর্যন্ত করে দিয়েছে। এর বাইরে আপনি প্রকাশ করলেও তা আমলে নেয়া হবে না। আপনি যে বিরত রাখার কথা বললেন, এভাবেই তারা বিরত রাখছে।

আমাদের দেশেও এ-জাতীয় আলাপ-আলোচনা কিন্তু আছে। আমাদের দেশের নেতৃস্থানীয় একাডেমিকস বা পণ্ডিতরা এ-নিয়ে বহুদিন যাবত কথা বলে আসছেন। আমি জানি না এখানকার কোনো বিশ্ববিদ্যালয় এ-জাতীয় কোনো শর্ত অনুসরণ করছে কিনা। দেখুন, যেখানে-সেখানে প্রকাশ করে আপনি রাতারাতি প্রফেসর হয়ে যাবেন, এটি কাম্য হতে পারে না। প্রফেসর হওয়াটা সস্তা অর্জন হতে পারে না। এক্ষেত্রে কোনো না কোনো জায়গা থেকে শুরু করতে হবে। পার্শ্ববর্তী ইন্ডিয়ার উদাহরণ আমি দিলাম। তাদের দিকে তাকান।

বলে রাখি, একটি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচিত হয় একাডেমিকদের পরিচয়ে, প্রফেসরদের পরিচয়ে। এটি চাট্টিখানি কথা না। হার্ভার্ড, এমআইটি, অক্সফোর্ড, ক্যামব্রিজ এই পর্যায়ে আসছে একাডেমিকদের কন্ট্রিবিউশনের মাধ্যমেই। কাজেই মান বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। শিক্ষক, গবেষকরা যাতে মানসম্পন্ন প্রকাশনা করতে বাধ্য হন সেই ব্যবস্থা থাকতে হবে। তাইলেই আপনি প্রিডেটরি প্রকাশনা থেকে বিরত রাখতে পারবেন। আমি আরেকটু বলি। এসব ব্যবস্থা না রেখে কোনো শিক্ষক বা গবেষককে দোষ দেয়া যায় না। আগে সিস্টেমটা দাড় করান, দেখবেন সকলেই এই সিস্টেমের সাথে খাপ খাইয়ে নিবে। আবার, এ-জাতীয় মানসম্পন্ন গবেষণা ও প্রকাশনার জন্য গবেষণা ফান্ড দিতে হবে। গবেষণা ফান্ড না দিলে গবেষণা হবে কীভাবে?     

অনেক সময় মাস্টার্স পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা গবেষণা শেষ করে পরবর্তীতে কোনো সহায়তা না পেয়ে নিজেরা কোনোমতে একটি প্রবন্ধ তৈরি করে এসব প্রিডেটরি জার্নালে প্রকাশ করে। তাদের গাইড বা সহায়তা করার মতো কেউ থাকে না, অনেক সময়। তাছাড়া জার্নাল প্রবন্ধ প্রকাশ করার একটি মোহও হয়তো কাজ করে। এক্ষেত্রে তাদেরকে আপনি কী পরামর্শ দেবেন?

এমনটা হতে পারে, হয়ত হয়ও। এক্ষেত্রে ছাত্রছাত্রীদের থিসিস সুপারভাইজাররা সহযোগিতা করতে পারেন। এমনকি ছাত্রছাত্রীদের সাথে শিক্ষকের যৌথ প্রকাশনাও হতে পারে। এই প্র্যাকটিস সারা দুনিয়ায় আছে। আমাদের দেশেও যে তা নেই, তা না। আমার জানামতে বহু ছাত্রছাত্রী দেখেছি যারা তাঁদের শিক্ষার্থী থাকাকালীন গবেষণাকর্ম শিক্ষকদের সাথে যৌথভাবে ছাপিয়েছেন ভালো ভালো জার্নালে। এই নজির তো খোদ আমাদের দেশেই আছে।

ছাত্রছাত্রীদের এক্ষেত্রে তাড়াহুড়া না করে সুপারভাইজার বা শিক্ষকদের পরামর্শ নিয়ে ভালো ভালো প্রকাশনা করা উচিত। দেখুন, বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য বিশেষ করে স্কলারশিপ পাওয়ার ক্ষেত্রে ছাত্রছাত্রীদের এসব প্রকাশনা খুব কাজে দেয়। আবার, কোনো সাবেক শিক্ষার্থীও যদি এক্ষেত্রে কোনো শিক্ষকের কাছে সহযোগিতা চান, আমার মনে হয় না যে, এমন কোনো শিক্ষক পাওয়া যাবে যে তিনি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবেন না। ছাত্রছাত্রীদের গবেষক হিসেবে গড়ে তোলাও শিক্ষকের কাজ। শিক্ষদেরকে এই গাইডের কাজটি করতেই হবে।

একজন মাস্টার্স বা পিএইচডি গবেষক যখন ইন্টারনেটে কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর প্রবন্ধ খুঁজেন দেন, তখন অনেক প্রিডেটরি জার্নালের প্রবন্ধও এই সার্চের তালিকায় চলে আসে। সেক্ষেত্রে কি তারা এগুলো ব্যবহার করবেন না? করলে কী কী সমস্যা হতে পারে?

মোটা দাগে বলা যায় না যে, ব্যবহার করবেন না। যতোটা সম্ভব না করাই ভালো। অনেক সময় এমন হতে পারে যে, একটি বিষয় যেখানে খুব বেশি গবেষণা হয়নি, বিশেষ করে সামাজিক বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যদি বলি, কেউ কেউ অল্পস্বল্প কাজ করেছেন এবং তা খুব ভালো মানের জার্নালে প্রকাশিত হয়নি, তখন তো করার কিছু নেই। এগুলো দেখতে হয় বা পড়তে হয়। এমনকি আপনি যদি তখন এই বিষয়ে ভালো গবেষণা করে ভালো প্রকাশনা করতে চান, তখন এই জাতীয় লিটারেচারগুলো সাইট করাও লাগে লিটারেচার রিভিউ হিসেবে। এটি হয়।

আরেকটা সীমাবদ্ধতা আছে। আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জার্নাল সাবস্ক্রিপশন একেবারেই হাতে গোনা। অর্থাৎ, যেসব জার্নাল আর্টিকেল অর্থের বিনিময়ে পড়তে বা ডাউনলোড করতে হয়, বিশ্ববিদ্যালয়গুলি সেইসব জার্নাল সাবস্ক্রাইব করে না। বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আন্তর্জাতিকভাবে মানসম্মত ও স্বীকৃত এমন কোনো জার্নাল নেই যে, তারা সাবস্ক্রাইব করে না। ফলে সেখানকার ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকরা খুব সহজে বিনা পয়সায় এসব জার্নাল এক্সেস পায়। কিন্তু আমাদের দেশে এই সুবিধাটি নেই। ফলে ছাত্রছাত্রী এবং শিক্ষক উভয়কেই আসলে ওপেন এক্সেস জার্নালের ওপর বহুলাংশে নির্ভর করতে হয়। কারণ, ওপেন এক্সেসবিহীন জার্নালের সাবস্ক্রিপশন চার্জ এত বেশি যে, আমাদের দেশের শিক্ষার্থী বা শিক্ষক কারোরই তার ব্যয়বহন করা সম্ভব হয় না। প্রিডেটরি জার্নাল যেহেতু ওপেন এক্সেস, ছাত্রছাত্রীরা সহজেই সেখানে প্রবেশাধিকার পায়।

প্রিডেটরি জার্নাল ব্যবহার করলে অনেক সময় সেখান থেকে পাওয়া কোনো তথ্যউপাত্তের অথেন্টিসিটি নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে। ভুল তথ্য-উপাত্ত কিংবা ত্রুটিপূর্ণ বিশ্লেষণ পাঠক বা গবেষকের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। প্রিডেটরি জার্নাল প্রবন্ধ যেহেতু পিয়ার রিভিউ হয় না, প্রবন্ধের বিষয়বস্তু ভিন্ন কোনো স্কলারের দ্বারা যাচাইবাচাই হয় না, তাই এক্ষেত্রে অথেন্টিসিটির প্রশ্ন থাকতে পারে। অতএব, যতোটা সম্ভব পারা যায়, স্বীকৃত জার্নালের প্রবন্ধ বেছে নেওয়াটিই সর্বোত্তম।


প্রিডেটরি জার্নাল ব্যবহার করলে অনেক সময় সেখান থেকে পাওয়া কোনো তথ্যউপাত্তের অথেন্টিসিটি নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে। ভুল তথ্য-উপাত্ত কিংবা ত্রুটিপূর্ণ বিশ্লেষণ পাঠক বা গবেষকের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। প্রিডেটরি জার্নাল প্রবন্ধ যেহেতু পিয়ার রিভিউ হয় না, প্রবন্ধের বিষয়বস্তু ভিন্ন কোনো স্কলারের দ্বারা যাচাইবাচাই হয় না, তাই এক্ষেত্রে অথেন্টিসিটির প্রশ্ন থাকতে পারে।


অনেক শিক্ষক বা গবেষক এসব প্রিডেটরি জার্নাল বা প্রকাশনার পর্যালোচনা বা সম্পাদনা কমিটিতে কাজ করেন। এটি কি তাঁদের দক্ষতা উন্নয়নে সহায়ক হয় নাকি নেতিবাচক প্রভাব ফেলে?

আমার ধারণায়, এটি গবেষক হিসেবে তাঁদের একাডেমিক ক্রেবিলিটি নষ্ট করে এবং ভাবমূর্তির ক্ষেত্রে একটি নেতিবাচক পয়েন্ট যোগ করে। আমি শুনেছি যে, প্রিডেটরি এমন অনেক জার্নাল আছে যারা রিভিউয়ার বা পর্যালোচক বা এডিটরিয়াল বোর্ডের সদস্যদের পারিশ্রমিক দিয়ে থাকে। এটি মূল ধারার একাডেমিক জগতে নজিরবিহীন। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কোনো জার্নালের রিভিউয়ার বা সম্পাদনা কমিটির কেউ কোনো পারিশ্রমিক পান না। এটি একান্তই স্বেচ্ছাসেবী কাজ। একাডেমিক জগতের এটিই চর্চা।

কোনো লেখক বা গবেষকের নাম যদি কোনো প্রিডেটরি জার্নালের পর্যালোচক কিংবা সম্পাদনা বোর্ডে থাকে, সেক্ষেত্রে তাঁর সম্পর্কে এবং তাঁর একাডেমিক মান সম্পর্কে একটি নিম্ন ধারণা তৈরি হয়। একাডেমিক জগতের খোঁজখবর যারা রাখেন, তাঁরা তখন এই ব্যক্তির একাডেমিক উচ্চতা সম্পর্কে খুব ভালো এবং উচ্চ অভিমত গঠন করেন না। আমি শুরুতেই বলেছিলাম, প্রিডেটরি প্রকাশনাকে ‘প্রতারণামূলক প্রকাশনা’ হিসেবে গণ্য করার একটি ব্যাপার আছে। কাজেই, যে সকল কাজের সাথে প্রতারণার ট্যাগ বা সম্পর্ক জড়িত থাকে, সেসব কাজে একজন শিক্ষক বা গবেষক নিজেকে জড়িত করাটা ভালো চর্চা হতে পারে না। আমি বলব, এতে দক্ষতা উন্নয়নের সহায়ক তো হয়ই না, বরং দক্ষতা যা থাকে তাও হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।    

বাংলাদেশে অনেক জার্নাল এখন অনলাইনে পাওয়া যায় না; কেবল ছাপা-কপি প্রকাশিত হয়। এসব জার্নালে লেখা প্রকাশ নিয়ে আপনার অভিমত কী?

হ্যাঁ, এটি ঠিক যে, বাংলাদেশের সম্ভবত অধিকাংশ জার্নালই কেবলমাত্র প্রিন্ট কপি প্রকাশ করে। এসব জার্নালের মধ্যে বেশ কিছু জার্নাল আছে যারা পিয়ার রিভিউর চর্চা করে। যেসব জার্নাল পিয়ার রিভিউ অনুসরণ করে, সেসব জার্নালে লেখা প্রকাশ করতে কোনো অসুবিধা দেখি না। তবে ব্লাইন্ড পিয়ার রিভিউ হলে সবচেয়ে ভালো। ব্লাইন্ড পিয়ার রিভিউ প্রসেস না থাকলে অনেক সময় নানারকম সম্পর্কের হিসেবনিকেশ জার্নাল প্রবন্ধ প্রকাশের ক্ষেত্রে কাজ করতে পারে। কোন কোন জার্নাল পিয়ার রিভিউ কিংবা ব্লাইন্ড পিয়ার রিভিউ প্রসেস অনুসরণ করে, সে সম্পর্কে একটি ধারণা অন্তত একাডেমিক ক্ষেত্রে যারা শিক্ষক ও গবেষক হিসেবে কাজ করেন, তাঁদের বোধ করি থাকে। কাজেই এসব জার্নালে প্রবন্ধ প্রকাশ করতে দোষ নেই।

কিন্তু যদি এমন কোনো জার্নাল হয় যে, পিয়ার রিভিউ ছাড়া বা কোন না কোন সম্পর্কের বিবেচনায় একজনের প্রবন্ধ প্রকাশ করা হয়, সেক্ষেত্রে প্রবন্ধের মান নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। এছাড়া কেবল প্রিন্ট জার্নালের একটি বড় সীমাবদ্ধতা হলো এই যে, জার্নালের পাঠক একেবারেই সীমিত থাকে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তো যেতেই পারে না, জাতীয়ভাবেও তা সীমিত আকারে কেবল যাদের কাছে এর কপিগুলো যায় তারাই পড়তে পারেন।


পিয়ার রিভিউ ছাড়া বা কোন না কোন সম্পর্কের বিবেচনায় একজনের প্রবন্ধ প্রকাশ করা হয়, সেক্ষেত্রে প্রবন্ধের মান নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। এছাড়া কেবল প্রিন্ট জার্নালের একটি বড় সীমাবদ্ধতা হলো এই যে, জার্নালের পাঠক একেবারেই সীমিত থাকে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তো যেতেই পারে না, জাতীয়ভাবেও তা সীমিত আকারে কেবল যাদের কাছে এর কপিগুলো যায় তারাই পড়তে পারেন।


আধুনিককালে ইলেক্ট্রনিক আর্কাইভিং হচ্ছে সবচেয়ে কার্যকর ও টেকসই পদ্ধতি। প্রিন্ট জার্নালগুলো ও এর প্রবন্ধসমূহ কয়েক বছর পর কেউ হয়ত খোঁজই রাখে না, পড়া তো দূরের কথা। এসব জার্নালে কী ছাপা হয়েছে তার খোঁজ কেউ রাখে না। ইলেক্ট্রনিকের এই যুগে মানুষ এখন ইন্টারনেটের ওপর অধিকতর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। কাজেই, আন্তর্জাতিক মানের জার্নালগুলো প্রায় সব ইলেক্ট্রনিক্যালি আর্কাইভ করে থাকে। এই দিকটায় বাংলাদেশের জার্নাল প্রকাশকদের নজর দেওয়া প্রয়োজন।   

আজ আমরা যেসব বিষয় নিয়ে কথা বললাম এই বিষয়ের ওপর নবীন গবেষকদের জন্য আপনার আর কি কোনো বক্তব্য আছে?

আমি শেষটায় বলবো, একাডেমিক জগৎটাই হল জ্ঞান সৃষ্টি, জ্ঞান বিতরণ ও জ্ঞান সংরক্ষণের জায়গা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রধানত এই কাজ করে থাকে। কষ্ট ছাড়া, পরিশ্রম ছাড়া জ্ঞানের এসব কাজ হয় না বা করা যায় না। কষ্ট করে গবেষণা করে, কষ্ট করে ভালো মানের স্বীকৃত জার্নালে প্রকাশ করতে পারলে শিক্ষা ও গবেষণার মানের ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। আপনাদেরকে ধন্যবাদ।

Sending
User Review
0 (0 votes)

লেখক সম্পর্কে

গৌতম রায়

গৌতম রায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।

লেখক সম্পর্কে

মাহবুব সরকার

মাহবুব সরকার

ড. মাহবুব সরকার অস্ট্রেলিয়ার মনাশ ইউনিভার্সিটিতে ফ্যাকাল্টি অব মেডিসিন, নার্সিং ও হেলথ সায়েন্সে প্রভাষক হিসেবে কর্মরত।

মন্তব্য লিখুন