বর্তমান বিশ্বে সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং শিক্ষাক্ষেত্রে উন্নয়নের সূচক পরিবর্তনে বেসরকারী সংস্থাসমূহ বা এনজিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। উন্নয়নশীল বিশ্বে এনজিওগুলো দেশকে সামনে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি শক্তিশালী অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে। এ বিষয়গুলো মাথায় রেখে বিশ্বব্যাপী কর্মরত বেসরকারী সংস্থাগুলোর রেটিং-এর উদ্যোগ গ্রহণ করে ’গ্লোবাল জার্নাল’। এটি অবশ্যই একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ কারণ এ পর্যন্ত কোনো সংস্থাই এনজিওগুলোর রেটিং-এর ক্ষেত্রে তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সমাজ উন্নয়নের ক্ষেত্রে এনজিওগুলোর শক্তিশালী ভূমিকার কথা চিন্তায় রেখে ’গ্লোবাল জার্নাল’ পুরাতন রীতিনীতি এবং সংকীর্ণ ধারণার বাইরে গিয়ে এনজিওগুলো কী এবং সমাজ ও মানবিক উন্নয়নে তাদের ভূমিকা- এই বিষয়দুটোকে গুরুত্ব প্রদান করে র্যাংকিং এর কাজ শুরু করে। মানবিক সাহায্য থেকে শুরু করে পরিবেশ, জনস্বাস্থ্য, শিক্ষা, ক্ষুদ্রঋণ, বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ ইত্যাদি ক্ষেত্রে এনজিওগুলোর বিচরণ বিশ্বব্যাপী এবং লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনে দৃশ্যমান পরিবর্তন নিয়ে এসেছে।
আন্তর্জাতিক রেটিং-এর ক্ষেত্রে ’গ্লোবাল জার্নাল’ নিম্নলিখিত বিষয়গুলো বিবেচনা করেছে:
(১) বেসরকারী সংস্থাগুলোর কার্যকারিতা অর্থাৎ উদ্দেশ্য অর্জনের বিপরীতে কী ধরনের পদক্ষেপ তারা গ্রহণ করে এবং কিভাবে সেগুলো সম্পাদন করে;
(২) সমাজে তথা মানব জীবনে এনজিও কার্যাবলীর ফলাফল বা প্রভাব;
(৩) রিপোর্টিং-এর স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা;
(৪) নতুনত্ব এবং নব উদ্যোগ অর্থাৎ সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে এনজিওগুলো কী ধরনের পদ্ধতি অবলম্বন করে।
এ বিষয়গুলো নিঃসন্দেহে শিক্ষাবিদ, কুটনীতিক, রাজনীতিক, আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহ এবং বেসরকারী ক্ষেত্রসমূহকে বিশ্বের ১০০টি বেসরকারী সংস্থার অভ্যন্তরীন কাজের গতি এবং নবতর উদ্যোগ সম্পর্কে জানার এবং গবেষণা করার খোরাক যোগাবে। এ ছাড়াও বিষয়টি এনজিওসংশ্লিষ্ট সকলের দৃষ্টি আকৃষ্ট করবে এনজিওগুলোর নব নব সমস্যা সমাধানে কীভাবে এবং কী ধরনের কার্যাবলী বা পদ্ধতি অবলম্বন করা যায় সে বিষয়ে। ২০১২ সালের জানুয়ারী মাসে ’গ্লোবাল জার্নাল’ অভিনন্দন জানিয়েছে ’ উইকিপিডিয়া ফাউন্ডেশনকে’ বিশ্বের ১০০টি এনজিও-এর মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করার জন্য। এই সংস্থা বিশ্বের ৪৭৭ মিলিয়ন মানুষের কাছে প্রতিমাসে তথ্য পৌঁছে দিচ্ছে। পুরোপুরি স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে অতি দ্রুত এই সংস্থাটি বিশ্বের সর্ববৃহৎ জ্ঞান বিনিময়ের ভাণ্ডারে পরিণত হয়েছে। ’পার্টনারস ইন হেলথ’ দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছে। এটি একমাত্র হেইতিকে কাজ করছে। হেইতির মানুষের এইডস প্রতিরোধ এবং রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রাখছে। তৃতীয় স্থানে আছে ’অক্সফাম’। ’অক্সফাম’ মানবিক সাহায্য ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে আক্রান্তদের দ্রুত সহায়তা প্রদান করে থাকে। উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়নের মাধ্যমে দারিদ্রপীড়িত জনগোষ্ঠীকে দীর্ঘমেয়াদী এবং টেকসই অবস্থায় উন্নীত করে।
বাংলাদেশের জন্য এটি একটি বিশাল সম্মান যে বাংলাদেশের একটি বেসরকারী সংস্থা ’ ব্র্যাক’ এই র্যাংকিং-এ চতুর্থ স্থান অধিকার করেছে। বাংলাদেশের দুরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতা স্যার ফজলে হাসান আবেদ এটি প্রতিষ্ঠা করেন ১৯৭২ সালে। ব্র্যাক তার সুনাম এবং কার্যাবলী বাংলাদেশের বাইরে এশিয়া, আফ্রিকা এবং ক্যারিবীয় অঞ্চলের ১১টি দেশে ছড়িয়ে দিয়েছে এবং চৌদ্দ মিলিয়ন মানুষকে সেবা দিয়ে যাচ্ছে। মানব জীবনে প্রভাব বিস্তার করে এমন সবগুলো দিকেই ব্র্যাক কাজ করছে।
ব্র্যাকে ভিশন বা রুপকল্প হচেছ’ সকল ধরনের বঞ্চনা ও বৈষম্যমুক্ত পৃথিবী গড়ে তোলা যেখানে প্রত্যেকে তার নিজ নিজ প্রতিভা বিকাশের সুযোগ পাবে। ’ব্র্যাকের মিশন বা উদ্দেশ্য হচ্ছে’ দারিদ্র বিমোচন, রোগব্যাধি, নিরক্ষরতা ও সামাজিক অন্যায় দূরীকরণের মাধ্যমে জনসাধারণ ও কমিউনিটিকে শক্তিশালী করে অর্থনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে বিশাল ধনাত্মক পরিবর্তন নিয়ে আসা যেখানে নারী ও পুরুষ তাদের প্রতিভা বিকাশের সুযোগ পাবে। ব্র্যাক নতুনত্ব, সততা, সার্বজনীনতা ও কার্যকারিতা এই চারটি মূল্যবোধের ওপর প্রতিষ্ঠিত।
ব্র্যাকের পরপরই পঞ্চম স্থান অধিকার করেছে ’ আন্তর্জাতিক রেসকিউ কমিটি’ এবং ষষ্ঠ স্থান অধিকার করেছে ’পাথ” নামের একটি এনজিও। ’কেয়ার’ সপ্তম স্থানে আছে। ’মেডিসিন সানস ফ্যনট্রিয়ার্স’ অষ্টম, ‘ডেনিশ রিফিউজি কাউন্সিল’ নবম ও ’উষাহিদি’ নামের কেনিয়ায় জন্মলাভকারী এনজিও দশম স্থান অধিকার করেছে। ডেনিশ রিফিউজি কাউন্সিল বিশ্বের ৩০টি দেশে এক মিলিয়ন জনসংখ্যাকে সুবিধা দিয়ে থাকে। বিশেষ করে সোমালিয়, আফগানিস্তান, ইরাক ও চেচনিয়ার মধ্যে দ্বন্দ্বসংঘাত এলাকায় কাজ করে। ’মেডিসিন সানস’ বিশ্বের ৭০টি দেশে জরুরি চিকিৎসা প্রদান করে থাকে। অনুন্নত দেশগুলোতে বস্তি ও দুরবর্তী গ্রামে ওষুধপত্র, পানি এবং পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থায় কাজ করে এ সংস্থাটি।
’গ্লোবাল জার্নাল” জার্মানভিত্তিক একটি জার্নাল যা আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী নিয়ে আলোচনা করে। এবার র্যাংকিং-এ প্রতিষ্ঠানগুলোর ওয়েবসাইটের তথ্য থেকে নেয়া ডাটা, বাৎসরিক প্রতিবেদন, বাহ্যিক মূল্যায়ন, দাতা এবং উপকারভোগীদের সাথে সাক্ষাতকারের মাধ্যমে র্যাংকিং করা হয়েছে। জার্নালটি ফিডব্যাক নিয়েছে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে। প্রতিষ্ঠানটি এনজিও-র আকার না দেখে তার কাজ এবং কাজের মাধ্যমে কতটা প্রভাব ফেলতে পেরেছে তা বিবেচনা করেছে। অতএব অমারা বলতে পারি যে, তারা সঠিক তথ্যগুলোই সংগ্রহ করেছে। ’গ্লোবাল জার্নাল’ যেহেতু র্যাংকিয়ের কাজটি শুরু করেছে পরবর্তী সময়ে অন্য কোনো সংস্থাও এ কাজে এগিয়ে আসবে। এনজিওগুলোর গ্রেডিং বা র্যাংকিং একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কারণ এনজিও এখন বিশ্বব্যাপী মানুষের উন্নয়নের অংশীদার। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলছেন যে, ’বিল এবং মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন’ কেন এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়নি। এ সংস্থাগুলো ঠিক এনজিও-কে যে অর্থে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে তার মধ্যে পড়ে নি।
এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করার মতো, আর সেটি হচ্ছে- ১০০ প্রথমসারির এনজিওগুলোর অর্ধেকের বেশি দুটো দেশে অবস্থিত। ৩৭টি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ও ১৪টি যুক্তরাজ্যভিত্তিক। ভারত ও ব্রাজিলের মতো উদীয়মান দেশে ১০ শতাংশ এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ১৫ শতাংশ এনজিও-র অবস্থান। আরেকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে প্রথমসারির দশটির মধ্যে দুটোর অবস্থানই উন্নয়নশীল বিশ্বে। ব্র্যাকের জন্ম বাংলাদেশে যেটি চতুর্থ স্থান এবং উষাহিদির জন্ম কেনিয়ায় যেটি দশম স্থানে আছে। এর অর্থ দাড়ায়, উন্নয়নশীল বিশ্বই দারিদ্র, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং সচেতনতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কাজ করছে এবং মানব জীবনে পরিবর্তন নিয়ে এসেছে।
আন্তর্জাতিক বেসরকারী সংস্থার ইতিহাস ১৮৩৯ সাল থেকে। বলা হয়ে থাকে যে, ১৯১৪ সালে ১০৮৩ টি এনজিও ছিল পৃথিবীতে। এই এনজিওগুলো দাসপ্রথা বিলুপ্তি ও নারীর ভোটাধিকার প্রয়োগ নিয়ে কাজ করত এবং এগুলো পূর্ণতা পায় ‘ওয়ার্ল্ড ডিসআরমামেন্ট কনফারেন্সে’। ১৯৪৫ সালে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার পর বেসরকারী সংস্থার পরিবর্তে এনজিও নামটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। জাতিসংঘের বর্তমানে এনজিওগুলো যে কাজগুলো করছে, সেগুলো মূলত সরকারী সংস্থাগুলোই করতো বা করার কথা। সরকারের কলেবর বেড়ে যাওয়া এবং বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে দরিদ্র শ্রেণী এবং প্রান্তিক গোষ্ঠী রাষ্ট্রীয় সুযোগসুবিধা থেকে বঞ্চিত হতে থাকে। ফলে দাতাগণ এনজিওগুলোকে অর্থায়ন করতে উদ্যত হয়। তাছাড়া এনজিও-র কাজের পদ্ধতি যেহেতু অংশগ্রহণমূলক, অন্তত প্রোগ্রাম শুরুর পর্যায়ে, ফলে তারা টার্গেট গ্রুপকে সেবা প্রদান করতে পারছে সরকারী বা অন্য যে কোন সংস্থা থেকে আলাদাভাবে। আর এ কারণেই এনজিও-র প্রয়োজনীয়তা যেমন দারিদ্রপীড়িত অঞ্চলে তেমনি সেটির জনপ্রিয়তা উন্নয়নশীল এবং উন্নত বিশ্বে। উন্নয়নশীল বিশ্বে যেমন রয়েছে অর্থনৈতিক সমস্যা, উন্নত বিশ্বে বিরাজ করছে সামাজিক সমস্যা। আর জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা তো এখন সমভাবে গোটা বিশ্বে বিরাজ করছে। হুমকির মুখে ফেলেছে গোটা মানবজাতিকে। এ অবস্থায় শুধু সরকারী প্রচেষ্টা সফলতা নিয়ে আসতে পারছে না, প্রয়োজন পড়ছে বেসরকারী সংস্থাগুলোর প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ। আর তাই বেসরকারী সংস্থা তথা এনজিও এখন বিশ্বের দৃশ্যমান বাস্তবতা।
(লেখাটির ইংরেজি সংস্করণ পড়া যাবে এখান থেকে: http://www.bdeduarticle.com/others/35-uncatagorized/238-global-ranking-of-ngos)
লেখক পরিচিতি
মাছুম বিল্লাহ বাংলাদেশে ইংলিশ টিচার্স অ্যাসেসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইট্যাব)-এর সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি পূর্বে ক্যাডেট কলেজ ও রাজউক কলেজের শিক্ষক হিসেবে কাজ করেছেন। কাজ করেছেন ব্র্যাকের শিক্ষা কর্মসূচিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে। তিনি ভাব বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর হিসেবেও কর্মরত রয়েছেন। তিনি নিয়মিত শিক্ষাবিষয়ে নানা প্রবন্ধ লিখছেন।