বাংলাদেশে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাব্যবস্থার নতুন শিক্ষাক্রমের আবশ্যিক বিষয় জীবন ও জীবিকার ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির পাঠ্য স্কিল কোর্স – ১: কুকিং নিয়ে যখন চারদিকে খুব আলোচনা-সমালোচনার ঝড় উঠেছে, সে সময়ে জাপানের স্কুলের শিশুদের একটি ছবি-পোস্ট ভাইরাল হয়েছে।
‘জাপানের কারিকুলাম। দেখুন, জাপানি শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে কী কী কাজ করছে!’— এরকম বিভিন্ন ক্যাপশন দিয়ে অনেককেই এই পোস্টটি শেয়ার দিতে দেখলাম। সেই পোস্টের ছবিগুলোতে দেখা যাচ্ছে, জাপানি শিশুরা কোনোটিতে রান্না করছে, কোনোটিতে ফসলের মাঠে কাজ করছে বা ফসল কেটে আটি বহন করছে, কোনোটিতে একটা নির্ণয়মান দালানে রাজমিস্ত্রীর মতো কাজ করছে।
কোনোটিতে বা রাস্তায় সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে বা রাস্তা পার হচ্ছে, কোনোটিতে ট্রেনে চড়ার জন্যে প্লাটফর্মে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে, কোনোটিতে খাবার নিজে প্লেট নিয়ে সংগ্রহ করছে, কোনোটিতে খাবারের আগে প্রার্থনা করছে, কোনোটিতে হাত সাবান দিয়ে ধুচ্ছে বা বেসিনে তিনজন হাত ধুচ্ছে আর তিনজন পেছনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে, কোনোটিতে শিশুরা ডাইনিং হলে খাবার টেবিলের চারদিকে সুশৃংখলভাবে বসে খাবার খাচ্ছে, কোনোটিতে শ্রেণিকক্ষ বা বিদ্যালয়ের করিডর শিশুরা পরিস্কার করছে।
ছবিগুলো দারুণ, আমার মতে অনুসরণীয়। কিন্তু, এসব কিছুকেই অনেকেই পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন জাপানি শিক্ষাব্যবস্থার শিক্ষাক্রম হিসেবে। তা আসলে কতোখানি সঠিক? বিশেষ করে, বিগত কয়েকদিনে এই ছবিগুলো এত বেশি করে প্রচার করার পেছনে আছে, বাংলাদেশের নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে যে সমালোচনার ঝড় বয়ে যাচ্ছে, অনেকটা সেটাকে প্রতিহত করতে।
অর্থাৎ, পরোক্ষে দাবিটা হচ্ছে, মাধ্যমিক পর্যায়ের এই নতুন শিক্ষাক্রমের মাধ্যমে জাপানের শিশুদের মতো করেই গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। আসলে সেটিই বা কতখানি সঠিক?
মূল বিষয় হচ্ছে, এগুলোর কোনোটিই জাপানের শিক্ষাব্যবস্থা বা শিক্ষাক্রমের অংশ না, বরং সংস্কৃতির অংশ। মানে, খাওয়ার জন্যে প্লেট হাতে দাঁড়িয়ে খাবার সংগ্রহ করা বা একসাথে খাওয়া, হাত ধোওয়া, শ্রেণিকক্ষ বা বারান্দা পরিস্কার করা, লাইন ধরে রাস্তা পার হওয়া, পাবলিক ট্রান্সপার্টের জন্যে অপেক্ষা করা, এসবের জন্যে কোনো পাঠ্যবই নেই। এগুলো ক্লাসের ব্যবহারিকের অংশও নয় এবং এসবের ওপরে কোনো নম্বর বা গ্রেড নেই।
এই ছবিগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটি আছে, যেগুলোর সাথে সাথে বিদ্যালয়ের কোনো সংস্পর্শই নেই। খাবার সময়কার একটি সাধারণ ছবি, একটি ছেলে ও মেয়ে খাওয়ার আগে প্রার্থনার ভঙ্গি করে আছে— সেটি সম্ভবত পারিবারিক ছবি। জাপানের অসংখ্য পরিবার খাবারের আগে এমন প্রার্থনা করেও না। সেই পরিবারের শিশুদেরও এমনটা করার কথা না।
বা, আরেক ছবিতে একজন শিশু অগ্নিনির্বাপনের পাইপ ধরে আছে, এবং আরেকজন (শিক্ষক বা অভিভাবক বা অন্য কেউ) এর সাথে ধরে আছে, সেই ছবিও আছে। সেটিও একটা র্যাণ্ডম ছবি। ছবি তোলার জন্যেই এমনটা করতে পারে, কিংবা হতে পারে শিশুদের নিয়ে হয়তো অগ্নিনির্বাপনের কোন ড্রিল হচ্ছিলো।
বা, ট্রেনে ওঠার সময়ে একটি লাইনে বিদ্যালয়ের ড্রেস পরা কয়েকজন লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা ছবিটার পাশে একটু দূরেই দেখা যাচ্ছে, অন্যরাও সেভাবে লাইনে দাড়িয়েই অপেক্ষা করছে। মানে, ওখানকার রীতি বা সংস্কৃতিটাই হচ্ছে, সবাই লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে। এর সাথে বিদ্যালয় বা শিক্ষাক্রমের কোনো সম্পর্কই তো নেই।
আরেক ছবিতে ডাইনিং হলে একটি টেবিলের চারদিকে যে শিশুরা বসে খাচ্ছে, তাদের বয়স আর বিদ্যালয়ের ড্রেস না দেখে ধারণা করি, সেটি সম্ভবত কোনো ডে-কেয়ার সেন্টারের। বাংলাদেশেও আবাসিক ছাত্রাবাসের শিক্ষার্থীদের মাঝে এরকম কিছু শৃঙ্খলার জায়গা পাওয়া যাবে, বা বাবামায়ের ওপরে নির্ভরশীলতা কমিয়ে নিজের কাজ নিজে করার বিষয়টি পাওয়া যাবে।
জাপানসহ উন্নত দেশসমূহে বাবামা উভয়েই কর্মজীবী হলে শিশুদের এরকম ডে-কেয়ার সেন্টারে পাঠায়। খুবই অল্প বয়স থেকে শিশুরা ডে-কেয়ার সেন্টারে যায়। সেগুলোতেও এরকম শৃঙ্খলা শেখে, স্বাবলম্বী হতে শেখে। সেগুলোকেই শিক্ষাক্রম হিসেবে চালিয়ে দেয়া হচ্ছে! কোনোটাই বস্তুত শিক্ষাক্রমের বিষয় নয়, বরং খুব বেশি সাংস্কৃতিক।
আমি যেহেতু জাপানে থাকিনি, জাপানে কখনো যাইওনি, তাই এখানে আমার বর্তমান আবাসস্থল নেদারল্যাণ্ডসের অভিজ্ঞতা শেয়ার করি। কেনোনা, এসব ছবির অনেকগুলোই নেদারল্যাণ্ডসের শিশুদের ক্ষেত্রেও একইরকমভাবে পাওয়া যাবে।
আমার দুই ছেলেমেয়ে নেদারল্যাণ্ডসে প্রাথমিক বিদ্যালয় সম্পন্ন করে এখন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে। নেদারল্যাণ্ডসে আমার সন্তানেরা সেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম ক্লাস থেকেই দুই সপ্তাহ পর পর শ্রেণিকক্ষ পরিস্কার করে। প্রতিটি ছেলেমেয়েই করে, যেদিন যার শিডিউল থাকে সেই করে।
এটিও একটা রীতি বা সংস্কৃতির বিষয়। কেনোনা, পুরো বিদ্যালয়ে আসলে কোনো আয়া, বুয়া, পিয়ন, দারোয়ান এমন কোনো কর্মচারি নেই। শ্রেণিকক্ষ, টয়লেট এসবই শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা মিলেই পরিস্কার রাখে। প্রতিটি শ্রেণিকক্ষ প্রতিদিন ক্লাস শেষে শিক্ষার্থীরাই পরিস্কার করে। বিদ্যালয়ের আশেপাশে কোনো কাজের দরকার হলে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অভিভাবকদের চিঠি দেয়।
বেশ কয়েকজন আগ্রহী অভিভাবক ঠিকই পাওয়া যায়। তখন শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক মিলে কাজ করে ফেলে। তারপরে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে থাকা অবস্থাতেই বেশি কিছু সার্টিফিকেট প্রোগ্রাম থাকে।
যেমন, অভিভাবকরা নিজ নিজ সন্তানকে স্থানীয় সুইমিং পুলে নিয়ে গিয়ে সাঁতারের ডিপ্লোমা কোর্স করায়। তিনটি ডিপ্লোমা (এ, বি, সি) প্রতিটি শিশুকেই করতে হয়। বিদ্যালয়ের বাইরেই এটা হয়, তবে বিদ্যালয় থেকে অভিভাবকদের এটি নিয়ে তাগাদা দেয়, কারণ অনেক সময়ই বিদ্যালয় শিশুদের নিয়ে সুইমিং পুলে যায় বা কোনো একটি আউটিঙে গিয়েও সুইমিং-এর ব্যবস্থা থাকতে পারে।
ডিপ্লোমাগুলো না থাকলে, সেগুলোতে শিশুদের নিয়ে যাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ। বিদ্যালয় থেকে ট্রাফিক আইনের ওপরে কোর্স করায়। হাতে-কলমে শেখায়। সেসময়ে হয়তো দেখা যাবে দুজন প্রশিক্ষক (শিক্ষকও হতে পারে) শিশুদের রাস্তায় সারিবদ্ধভাবে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিয়ে যায়। তখন রাস্তা পার হওয়া, ট্রাফিক সিগনাল, বোর্ডগুলার কোনটার কী মানে, সব কিছু শিখে।
এসবের সাথে বিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচির সম্পর্ক নেই। এসব করলে গ্রেড মেলে না। তবে একেকটি কোর্স শেষ হলে শিশুরা সার্টিফিকেট পায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ফায়ার ফাইটিং ড্রিলও বিদ্যালয়ে শিশুদের করাতে পারে। সেখানেও অংশ নিলে সার্টিফিকেট মেলে।
বছরে এক বা দুইবার সেই প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকেই আউটিঙে নিয়ে যায়। কখনো বাসে করে যায়, আবার আশেপাশে হলে সাইকেলে করেও যায়। একটি ক্লাসের ২৫-৩০ জন শিশু রাস্তার একপাশ ধরে সারিবদ্ধভাবে সাইকেল চালায়। সামনে একজন আর সবার পেছনে একজন শিক্ষক থাকেন।
এমন আউটিংগুলোর মধ্যে মাঝেমধ্যে কৃষি ফার্ম এলাকাতেও নিয়ে যায়। সেখানে গিয়ে সেই ফার্মের কৃষি কাজ করে। বিদ্যালয় থেকেই এসব আয়োজন করে। কিন্তু, সবগুলোই সহ বা অতিরিক্ষ শিক্ষাকার্যক্রম। যেমন, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়, নাটক হয়, এগুলোও সহশিক্ষাক্রমিক কার্যক্রম। এসবের সাথে মূল পাঠ্যসূচির কোনো সম্পর্ক নেই। এসবের ওপরে কোনোরকম গ্রেডিং হয় না, বা এসব আয়োজনের কারণে মূল পাঠ্যসূচির বিষয়গুলোকে কোনোরকম ব্যাহত করা হয় না।
শিশুরা বিদ্যালয় ছাড়াও স্থানীয় কোনো একটি স্পোর্টস ক্লাবের সাথে সংযুক্ত থাকে। ফুটবল, ব্যাডমিন্টন, টেনিস, এরকম নানা স্পোর্টস ক্লাব প্রতিটি এলাকাতেই আছে। সেই ক্লাব বছরে একবার স্থানীয় জনগণের কাছ থেকে চাঁদা তুলে আয় করে। এর বাইরে স্পন্সর, শিশু-বড় সদস্যদের কাছ থেকে বাৎসরিক ফি এসব থেকেও তাদের আয় হয়।
সেজন্য কখনো চকলেট বা ফুলের গাছের বীজ বা ছোট গাছ এসব বাসায় বাসায় গিয়ে বিক্রি করে। সেই কাজেও শিশুরা অংশ নেয়। এছাড়াও গ্রামে-শহরে শিশুদের জন্যেও আরো নানারকম কার্যক্রমের সার্টিফিকেশনের প্রোগ্রাম থাকে। মানে, শিশুদের জন্য বিদ্যালয় ও বিদ্যালয়ের বাইরে নানাবিধ সহশিক্ষা কার্যক্রমের ব্যবস্থা থাকে।
সেগুলো সবই সহশিক্ষা কার্যক্রম বা অতিরিক্ত শিক্ষার কার্যক্রম। মানে বিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষাক্রম, পড়াশোনা, গ্রেডিং সিস্টেম ইত্যাদির বাইরে এসব হয়। জ্ঞানজগতের আবশ্যিক বিষয় বাদ দিয়ে এগুলোকে বইয়ের পাঠ্য বানিয়ে তামাশা করে না।
অপরদিকে, বাংলাদেশের মাধ্যমিক পর্যায়ের এই নতুন শিক্ষাক্রমের নামে কী হচ্ছে? ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত শিশুদের ভূগোলের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় সাবজেক্ট তুলে দিয়ে জীবন ও জীবিকা ঢুকিয়েছে। পাঁচ বছর ধরে জীবন ও জীবিকা বিষয়ে কী শিখবে শিশুরা?
বাড়িঘর পরিস্কার করা, বিছানা গোছানো এসব ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বইয়ে সচিত্র শেখানোর ব্যবস্থা আছে। কাজের মধ্যে আনন্দ অধ্যায়ে বাসায় নিজে নিজে কী কাজ করা যায়/হয় এবং পরিবারের অন্যদের জন্যে কী কাজ করা যায়, সেগুলো শেখানো হয়েছে এবং বার ধরে কাজের তালিকার তালিকা করে দেয়া হয়েছে।
খুবই ভালো কথা। আমাদের সমাজে, সংস্কৃতিতে, পরিবারে এসব চল শিশুদের (বিশেষ করে ছেলেদের) শেখানোর চল যেহেতু নেই, বিদ্যালয় সেই দায়িত্বটি যেচে নিলে ভালো। কিন্তু এগুলো কোনোভাবেই কি মৌলিক বিষয়গুলোকে বাদ দিয়ে পাঠ্যসূচির অন্তর্ভূক্ত হতে পারে?
ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বাকি অধ্যায়গুলোর নাম হচ্ছে, পেশার রূপ বদল, আগামীর স্বপ্ন, আর্থিক ভাবনা, আমার জীবন, আমার লক্ষ্য, দশে মিলে করি কাজ। সেই সাথে আছে ষষ্ঠ শ্রেণিতে দুটি, সপ্তম শ্রেণিতে তিনটি ও অষ্টম শ্রেণিতে তিনটি দক্ষতার কোর্স। সেখানে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে রান্না, ষষ্ঠ ও অষ্টম শ্রেণিতে গ্রাফটিং, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণিতে কেয়ার গিভিং, সপ্তম শ্রেণিতে মুরগি পালন আর অষ্টম শ্রেণিতে ইকো ট্যুর গাইডিং হাতে কলমে শেখার কোর্স রেখেছে।
মানে, শিক্ষার্থীদের কেবল ঘটা করে রান্না করাই না, মুরগির বাচ্চা কিনে লালন-পালন করা, বা বয়স্কদের কেয়ার গিভিং, হাতে কলমে গাছে জোড়াকলম, এগুলো করতে হবে। সব জায়গায় সবার এসব আয়োজন করার মতো একই রকম পরিবেশ আছে কি? যেমন, ফ্লাটবাড়িতে মুরগির বাচ্চা লালন-পালন সম্ভব কি?
তারচেয়েও বড় প্রশ্ন, এগুলো অবশ্যপাঠ্য হিসেবে কতোখানি জরুরি? মাধ্যমিকের ষষ্ঠ থেকে দশম পর্যন্ত কেবল জীবন ও জীবিকা নামক বিষয় নয়, এরকম অপ্রয়োজনীয় বিষয় আরো আছে। স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা শিখাচ্ছে, যেখানে আসলে পাঁচ বছর ধরে শেখানোর কিছু নেই। অনেক কিছুই আছে যা একাধিক ক্লাসে একই জিনিসের পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। অনেক কিছুই আছে যা পারিবারিক ও সামাজিকভাবে সাংস্কৃতিক রীতি হিসেবেই শেখার কথা।
স্বাস্থ্য সুরক্ষার নামে মিডিয়া ব্যবহার থেকে শুরু করে অনেক বিষয় নিয়েই শিক্ষার্থীদের জ্ঞান দেয়ার চেস্টা করা হয়েছে। কিন্তু, যৌনস্বাস্থ্যের বিষয়টি আবার পুরোপুরি উপেক্ষা করে গিয়েছে। জীববিজ্ঞান বরং ভালোভাবে শিখিয়ে সেখানে মানব শরীর সম্পর্কে ভালোভাবে শেখানো যেতে পারতো। তারই অংশ হিসেবে স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং খাদ্য ও পুষ্টি বিষয়গুলো রাখতে পারতো।
বস্তুত, জীবন ও জীবিকা ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা দুটো বিষয়ই নির্দেশনামূলক। শিক্ষার্থীদের জীবন আচরণ সম্পর্কে একরকম প্রভাব তৈরির চেষ্টা করা হয়েছে। ষষ্ঠ শ্রেণি শেখাচ্ছে ডিজিটাল প্রযুক্তি। ষষ্ঠ শ্রেণির শিশুদের গণিত ও বিজ্ঞানের ভিত্তি পোক্ত না হতেই ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে ডিজিটাল প্রযুক্তি শেখানোরও কিছু নেই।
সবচেয়ে বড় কথা, ষষ্ঠ শ্রেণির শিশুদের হাতে স্মার্ট ফোন, ইন্টারনেট কানেকশন তুলে দেয়ার মতো সামর্থ্য কতজন অভিভাবকের আছে? কয়টি বিদ্যালয় মোবাইল ল্যাপটপ সরবরাহ করতে পারে যে, শিশুরা গুগল, ইয়াহু, বিং প্রভৃতিতে কীভাবে সার্চ করতে হয় বা কীভাবে ই-মেইল করে নেটওয়ার্কিং করতে হয় এসব শিখতে পারবে?
বা, সপ্তম শ্রেণিতে স্প্রেডশিট, পাওয়ারপয়েন্ট ইত্যাদি হাতেকলমে শেখার মতো ল্যাপটপ বা ট্যাব কি সব শিক্ষার্থীর রয়েছে? অষ্টম শ্রেণিতে সারাদেশের শিক্ষার্থীদের প্রোগ্রামিং শেখানো শুরু করে দিয়েছে (খুব গভীরে যদিও ঢুকেনি)। সাইবার নিরাপত্তা, হ্যাকিং, ফিশিং এই ধারণাগুলোও দেয়া হয়েছে।
সবার জন্যে এগুলো বুঝতে পারা সম্ভব হবে কি? বা, বিদ্যালয়গুলোতে কি পাঠদান করার মতো পর্যাপ্ত শিক্ষক রয়েছে? তার চাইতেও বড় কথা, সকল শিক্ষার্থীকে আবশ্যিকভাবে এগুলো শিখিয়ে কী লাভ হবে?
এছাড়া আরেকটি আবশ্যিক বিষয় হচ্ছে শিল্প ও সংস্কৃতি। শিক্ষার্থীদের শিল্প ও সংস্কৃতিতে আকৃষ্ট করে তোলা, শিক্ষার্থীর মনন গড়ে তোলা, তার কল্পনাশক্তিকে জাগিয়ে তোলা, এসবের জন্যে বিষয়টি খুবই দরকারি। নেদারল্যাণ্ডসের বিদ্যালয়গুলোতেও গুরুত্ব দিয়ে মিউজিক, আর্ট/ ড্রয়িং, শারীরিক কার্যক্রম শেখানো হয়। প্রতি সপ্তাহে এগুলোর ওপরে একাধিক করে ক্লাস হয়, সেগুলোতে বছর বছর গ্রেডিংও হয়। কিন্তু, শিক্ষার্থীরা সবাই জানে, এগুলোর কোনোটিই চূড়ান্ত পরীক্ষার বিষয় নয়।
মানে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে চূড়ান্ত যে মূল্যায়ন হয়, যার ওপর ভিত্তি করে শিক্ষার্থীরা তিন ধরনের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রবেশ করে, সেই মূল্যায়নের ক্ষেত্রে এই বিষয়গুলোর সাবজেক্টগুলোর কোনো ভূমিকা নেই। একইভাবে মাধ্যমিকেরও সমাপনী পরীক্ষাতেও (যার ফলের ওপরে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যায়) এই বিষয়গুলোর কোনো ভূমিকা নেই।
অন্যদিকে, আমাদের নতুন শিক্ষাক্রমে এসএসসি পরীক্ষার দশটি বিষয়ের অন্যতম হচ্ছে এই শিল্প সংস্কৃতি। শিল্প ও সংস্কৃতির জন্যে আবার আলাদা বই আছে। পাঁচ বছর ধরে কয়েকটি বই (নবম-দশম শ্রেণির জন্যে সম্ভবত একই বই) পড়ে শিক্ষার্থীরা শিল্প ও সংস্কৃতিতে পণ্ডিত হবে হয়তো, কিন্তু বাংলাদেশের কোনো বিদ্যালয়ে ছবি আঁকার শিক্ষক, মিউজিকের শিক্ষক আছে কি না সন্দেহ। কোথাও মিউজিক রুম উইথ মিউজিক ইন্সট্রুমেন্টস থাকার বিষয়টা অকল্পনীয়।
নেদারল্যাণ্ডসের বিদ্যালয়গুলোতে আলাদা মিউজিক রুম আছে। সেখানে মিউজিকের নানা ইন্সট্রুমেন্ট আছে। আমার ছেলে একটি ক্লাসে পিয়ানো, আরেকটা ক্লাসে গিটার বাজিয়েছে। সেটা মিউজিক শিক্ষক শিখিয়েছেন। গিটার সে আগেই স্থানীয় এক মিউজিক সেন্টারে শিখেছিলো, কিন্তু পিয়ানোটা বিদ্যালয়ে শেখানো হয়েছে। খুব বেশি না, একদম প্রারম্ভিক পর্যায়ের, কিন্তু এতটুকু বিদ্যালয় থেকে শেখানো হলে, অনেক শিক্ষার্থীই সেটা আরো শেখার জন্যে মিউজিক সেন্টারে যাবে।
এক ক্লাসের ফাইনাল প্রজেক্টে একবার তিন-চারজন মিলে ব্যাণ্ড মিউজিক করেছে। একেকজন একেক ইন্সট্রুমেন্ট বাজিয়েছে। আরেক বছরে দুজন মিলে একটা র্যাপ গান বানিয়েছে। প্রথমে একটা প্রচলিত মিউজিক/বিটস নামিয়ে নিয়েছে, তারপরে গানের কথা লেখা, সেই মিউজিকের তালে গানটি চূড়ান্ত করা— এগুলো করতে হয়েছে। তার আগে শিক্ষক পুরো প্রক্রিয়াটি শিখিয়েছেন।
অর্থাৎ, এখানে শেখানোর ব্যাপারটা সবই হাতে কলমে। ভিজুয়াল আর্টস আর ডিজাইন ক্লাসে ছবি আকা, রং করা, মাটি দিয়ে বা কাঠের স্কাল্পচার তৈরি করা, এছাড়াও বিভিন্ন উপকরণ দিয়ে নানা জিনিস তৈরি করা— এমন নানা কার্যক্রম থাকে।
এগুলো সবাই খুব মজা নিয়েই করে, কিন্তু এসবের কোনটিই চূড়ান্ত পরীক্ষার বা সমাপনী পরীক্ষার অংশ নয়। আর, বাংলাদেশে এমন ধরনের কার্যক্রমের বালাই নেই। শিল্প ও সংস্কৃতির ওপরে বই করে দিয়েছে, সেটি ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়বে। বই পড়ে পড়েই শিল্প ও সংস্কৃতির জ্ঞান অর্জন করবে? এবং, সেটি আবার আবশ্যিক দশটি বিষয়ের একটি হিসেবে পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভূক্ত!
অর্থাৎ, নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে এসএসসি পর্যন্ত পাঠ্যসূচির ১০টি বিষয়ের মধ্যে শিল্প ও সংস্কৃতি, জীবন ও জীবিকা, ডিজিটাল প্রযুক্তি, স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও ধর্ম— পাঁচটিই হচ্ছে একদম অপ্রয়োজনীয় বিষয়। এর তিনটিই হতে পারতো শিক্ষাক্রম-বহির্ভূত বিষয়।
ধর্ম বা জীবন ও জীবিকা এগুলো পরিবারে শেখার কথা। শিল্প ও সংস্কৃতিও বিদ্যালয়ে, পরিবারে ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান বা কেন্দ্রেও হাতেকলমে শিখতে পারতো। অন্যদিকে স্বাস্থ্য সুরক্ষা জীববিজ্ঞানের অংশ হিসেবে রাখা যেতো। আর ডিজিটাল প্রযুক্তি নবম শ্রেণিতে ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে আগ্রহী শিক্ষার্থীদের জন্যে রাখা যেতো।
দশটি আবশ্যিক বিষয়ের মধ্যে পাঁচটিই যদি এরকম অপ্রয়োজনীয় ও অকাজের বিষয় দিয়ে ভরিয়ে রাখা হয়, তার মানেই হচ্ছে মাত্র ৫টি মৌলিক বিষয় শিক্ষার্থীরা শিখছে। যারা আজকে জাপানের শিশুদের শিক্ষাক্রম-বহির্ভূত কর্মকাণ্ডের এতো ছবি দিচ্ছেন, তারা সেখানকার প্রকৃত শিক্ষাক্রম জ্ঞানজগতের মৌলিক বিষয়গুলো কী কী শেখানো হয়, সেগুলো কিন্তু বলছেন না।
আরেকটি বিষয়, জাপানে একদম শিশু বয়সেই, মানে ৫-৭ বছর বয়সেই শিক্ষার্থীরা এসব শিখছে— কী বিশাল এক ব্যাপার, এমন একটি ভাবও তুলেছেন কেউ কেউ। জাপান বা নেদারল্যাণ্ডসে এই রকমের সহশিক্ষাক্রমিক কার্যক্রম বস্তুত শিশু ক্লাসেই হয় অনেক অনেক বেশি।
নেদারল্যাণ্ডসের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশুনার চাপ থাকে একদমই কম। কোনো শিশুকে এমনকি বাসায় কোনো পাঠ্যবই দেয়া হয় না। বিদ্যালয়ের লাইব্রেরি থেকে গল্পের বই, কমিক বই এগুলো আনলে ভিন্ন কথা। বিদ্যালয়েও পড়ানো হয় খুব সামান্য জিনিস। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মূলত ভাষার ওপরে মূল জোর দেয়া হয়।
প্রাথমিকে যেহেতু ক্লাসের চাপ কম থাকে, ভাষাদক্ষতা বাড়ানোই মূল টার্গেট। এবং, সেটির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ অসংখ্য সহশিক্ষাক্রমিক কার্যক্রম সেখানে থাকে। কিন্তু, যখনই তারা মাধ্যমিকে যায়, পুরো ঠিক উল্টোচিত্র। পড়াশোনার বিশাল চাপ শুরু হয়ে যায়।
বিদ্যালয়ে শরীরচর্চা, সঙ্গীত, ভিজুয়াল আর্টস, ডিজাইন এসব বিষয় যেহেতু থাকে, এসবের বাইরে সহশিক্ষাক্রমিক কার্যক্রমের সময়ই পাওয়া মুশকিল। প্রতিটি শিশুই একাধিক ভাষা শেখে। মাধ্যমিকের প্রথম ক্লাস থেকেই ডাচ, ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ শিখেছে, দ্বিতীয় ক্লাসে এসে যুক্ত হয়েছে জার্মান। মানে, ভাষার বিষয়ই চারটি। যারা আরও উচ্চ পর্যায়ের শিক্ষার্থী, তারা এর সাথেও শেখে রোমান আর গ্রিক (পুরনো ভাষা, আমাদের সংস্কৃতর মতো)।
প্রথম ক্লাস থেকে গণিত আবশ্যিক বিষয় হিসেবে থাকে। প্রাথমিকে কেবল যোগ-বিয়োগ করা শিশুরা দ্রুত কঠিন কঠিন বিষয়ে চলে যায়। মাধ্যমিকের প্রথম ক্লাস থেকেই চলে জীববিজ্ঞান, দর্শন, ভূগোল ও ইতিহাস। দ্বিতীয় ক্লাসে যুক্ত হয় রসায়ন। তৃতীয় ক্লাসে তার সাথে যুক্ত হয় পদার্থবিদ্যা আর অর্থনীতি।
এতসব বিষয়ের ভীড়ে ওই রান্নাবান্না, বাইরে গিয়ে ফসলের মাঠে কাজ করা, ট্রাফিক নিয়ম মেনে চলাফেরা করা— এসব দলবেঁধে শেখানোর কোনো সুযোগই আসলে মাধ্যমিকে পাওয়ার উপায় নেই। ফলে, এগুলোর যা কিছু হয়, সবই একদম শিশু বয়সেই, মানে প্রাথমিকেই। সেই কারণে, ৫-৭ বছরের শিশুদেরকেই এসব করতে দেখা যাবে আর কি!
ফলে, যারা ষষ্ঠ, সপ্তম বা অষ্টম শ্রেণির শিশুদের মৌলিক বিষয়গুলো বাদ দিয়ে বা কমিয়ে ঘটা করে রান্না শেখানো, মুরগি পালন, ড্রাফটিং এসব শেখানোর তুলনা আনতে গিয়ে জাপানের ৫-৭ বছর বয়সী শিশুদের ছবি দিয়ে ভরিয়ে দিচ্ছেন, আগে ভেবে দেখুন জাপান বা বাইরের দেশের প্রাথমিকে মজার ছলে শেখানো বিষয়গুলো আমাদের ষষ্ঠ, সপ্তম বা অষ্টম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে ঢুকিয়ে কতটুকু কি অর্জিত হচ্ছে? আদৌ কোনো লাভ হচ্ছে কি? নাকি ভয়ানক ক্ষতির দিকে আমাদের শিশুদের ঠেলে দেয়া হচ্ছে?
লেখক পরিচিতি
অনুপম সৈকত শান্ত একজন লেখক ও প্রকৌশলী।