আর রাজী লিখেছেন প্রয়োজনভিত্তিক শিক্ষা ও শিক্ষাদর্শন প্রসঙ্গে
এই পৃথিবীর মানুষ কেবল নিজেদের জীবনটাই বিষিয়ে তুলেনি। তারা আর সব প্রাণ-প্রকৃতিরও প্রায় বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। পৃথিবীর এই প্রায় বিপর্যস্ত দশার একটি বড় কারণ— মানুষ যেভাবে জীবন ও জগৎকে দেখছে, তার অযথার্থতা। আর অযথার্থভাবে জীবন ও জগৎকে দেখার এই চোখ তৈরি করেছে মূলত স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটিগুলোর শিক্ষা। যে শিক্ষা মানুষকে করে তুলেছে বা তুলতে চেয়েছে জীবিকা আহরণের এক যন্ত্রমাত্র।
উন্নত বিশ্বের মানুষ বলে আমরা যাদের জানছি, তারা বেশ নিষ্ঠার সাথে গ্রহণ করে চলেছে ‘প্রয়োজনভিত্তিক শিক্ষা’। প্রশ্ন হচ্ছে, এই ‘প্রয়োজন’ কার প্রয়োজন? গুটিকতক মানুষের আরও আরও ভোগের আয়োজনের যোগান দেওয়ার প্রয়োজন, তাই তো? কিছু মানুষের ভোগ-বিলাসের প্রয়োজন পূরণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো অধিকাংশ মানুষকে করে তুলেছে জীবিকামুখী। ছোট্ট বালক-বালিকাদের কানেও এই প্রয়োজনভিত্তিক শিক্ষা যত্ন করে, বড় করে তুলে দেয় তার জীবিকার প্রশ্নটি। যদি এই এই বিষয় তুমি না পড়, তুমি এই এই বিষয়ে না শেখ, তুমি এই ছাঁচে নিজেকে না গড়ো তাহলে তোমার জীবিকা কী হবে? আর তুমি জীবননির্বাহই বা কী করে করবে?
এই একই কথা অসংখ্যবার শুনতে শুনতে সে চোখ-কান-নাক-মুখ বন্ধ করে জীবিকা অর্জনের এক ইঁদুর দৌঁড়ে নেমে পড়ে। জীবিকা হয়তো তার জোটে, কিন্তু জীবন হারিয়ে যায়। জীবন যাপন না করে সর্বক্ষণ উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা নিয়ে সে কেবল জীবিকাযাপন করতে থাকে। কেবল একটি স্বপ্নই তার টিকে থাকে— কোনো একদিন, কোনো একদিন সে ধনী হবে, তারপর মনপ্রাণভরে জীবন উপভোগ করবে! কিন্তু জীবনকে উপভোগ করার যে চর্চা, যে অনুশীলন তা না থাকায় সুযোগ মিললেও তার কখনই জীবনযাপন করা আর হয়ে ওঠে না। জীবন শুকায়ে যায়। করুণাধারা বর্ষিত হয় না। অথচ জীবজগতে জীবিকা অর্জন জীবের সহজাত সক্ষমতার অংশ। মানুষের জন্যও তাই ছিলো বা আছে। কিন্তু মানুষকে অস্বাভাবিক এক প্রয়োজনের গল্প শুনিয়ে শুনিয়ে যন্ত্রে পরিণত করা হয়েছে।
যদি প্রয়োজনভিত্তিক শিক্ষা নিয়ে কথা ওঠে, তাহলে সবার আগে সেই শিক্ষা প্রয়োজন যা মানুষে মানুষে, মানুষে প্রকৃতিতে, মানুষে অন্য প্রাণীতে বৈষম্য অবসানের শিক্ষা নিশ্চিত করে, এই দুনিয়ায় যা কিছু সহায়-সম্পদ আছে তার সুষ্ঠু বণ্টন করতে শেখায়। তার পরে প্রয়োজন— প্রতিযোগিতার নামে, র্যাঙ্কিংয়ের নামে কোনো ইঁদুরদৌড়ে লিপ্ত না হওয়ার শিক্ষা। কারণ, যারা ইঁদুরদৌড়ে জয়ী হয়, তারা শেষ পর্যন্ত ইঁদুরই রয়ে যায়।
শত শত বছর ধরে তথাকথিত প্রয়োজনভিত্তিক শিক্ষার দর্শন মানুষকে মনুষ্যতর করে ফেলেছে। মানুষ হয়ে দাঁড়িয়েছে নিজের নয়, অন্য কারও প্রয়োজন পুরণের হাতিয়ারমাত্র। শিক্ষিত-বাঙালী গত আড়াই শ বছর ধরে এই শিক্ষাদর্শনের আলোকেই এই দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সাজাতে চেয়েছে। কিন্তু কী এক বিচিত্র কারণে তাদের সেই অভিলাষ আজও পুরোটা পুরণ হয়নি। এই ক্ষণে তারা বেশ কোমর বেঁধে নেমেছে, জাতিকে শিক্ষা তারা দেবেই, এবার দেবে প্রয়োজনভিত্তিক শিক্ষা।
এখনও খোলাসা করে কিছু জানা-বুঝা যাচ্ছে না, তারা কার প্রয়োজনের কথা বলছেন? যদি হয় তথাকথিত উন্নত বিশ্বে শ্রমশক্তি সরবরাহের শিক্ষা, তাহলে বলতে হয় এ জন্য শিক্ষালয় নয়, দীক্ষালয় খুলুন। নানা কাজে দক্ষ লোক দীক্ষালয়ে তৈরি হয়, যাকে আমরা আজ কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নামে ডাকি। আর যদি এমন হয়, প্রয়োজনটা দেশের মানুষের, এই সমাজের মানুষের, তাহলে ভাবনাটা একেবারেই ভিন্ন খাতে চালিত হওয়া দরকার। মনে রাখা দরকার, মানুষের কেবল ভৌত জিনিসপত্রাদিই প্রয়োজন হয় না, মানুষের সবচে বড় প্রয়োজন তার আত্মার খোরাক। ক্ষীণ দৃষ্টিতে অপ্রয়োজনীয়, এই আত্মার খোরাক জোগান দেওয়াই সবচে বড় প্রয়োজন আজ। এই আত্মার খোরাকের জোগান দিতে পারছে না বলেই বিশ্ব আজ এতো অস্থির, মানুষের ভৌতসম্পদের এতো ক্ষুধা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে টুকটাক আত্মহনন শুরু হয়েছে, আত্মার যথাযথ খোরাক যদি না যোগান দিতে পারা যায় এই দেশ অচিরেই গণআত্মহত্যা দেখবে, মনে রাখবেন।
বাংলাদেশে অসংখ্য বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রয়োজনভিত্তিক শিক্ষা-দর্শনের নিরিখেই নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় খোলা হয়েছে, নতুন নতুন বিষয়ে সেখানে বিদ্যাচর্চার আয়োজন হচ্ছে। কিন্তু অপ্রয়োজনের যে প্রয়োজন, তার আয়োজন থেমে আছে যুগ যুগ ধরে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে কম্পিউটার বিজ্ঞান, হিসাব বিজ্ঞান, বাজারবিজ্ঞান, দর্জিবিজ্ঞান ইত্যাদিতে যতো সংখ্যক আসন তৈরি হয়েছে, তার সমান্তরালে ইতিহাস-দর্শন-শিল্প-কলা-সংস্কৃতি-সাহিত্য-ধর্মতত্ত্ব ইত্যাদির আসন সংখ্যা বৃদ্ধি পায়নি। সহজ কথায়, প্রয়োজনভিত্তিক যে শিক্ষা, তার বিস্তার ঘটে চলেছে সব ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়েই। র্যাঙ্কিংয়ের নামে, এক্সিলেন্সের নামে নতুন করে তা আরও জোরদার করার কথা উঠেছে। দুঃখজনক হচ্ছে, রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত দেশের সবচে পুরানো, মোড়ল বিশ্ববিদ্যালয়ও প্রয়োজনভিত্তিক শিক্ষা নিয়ে গল্প ফেঁদে তলোয়ার তুলতে চলেছে আত্মার খোরাক যারা যোগান দেয়, সেই সব বিষয়ের ওপর।
বাংলাদেশে যে পরিমাণে অন্যান্য বিদ্যাচর্চার সুযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আসন বৃদ্ধি পেয়েছে, তার তুলনায় কলা, মানববিদ্যা, সমাজবিদ্যার আসন বৃদ্ধি তো পায়ইনি; বরং অনুপাতের বিবেচনায় এক মহাভারসাম্যহীনতার তৈরি হয়েছে। আমাদের অনুকরণপ্রিয় শিক্ষিত-বাঙালী এই বিবেচনা সম্ভবত হারিয়ে ফেলেছে যে, মানুষ ডলার-টাকা খেয়ে বাঁচে না। মানুষের মাথার মাপে মাপে তার ঘর তৈরি স্বাস্থ্যকর নয়, ঘরের বেশি ভাগটা অপ্রয়োজনে ফাঁকা রাখাই প্রাণীর জন্য স্বাস্থ্যকর। একটা সমাজ রাষ্ট্র কেবল প্রয়োজনভিত্তিক শিক্ষায় বাঁচে না, প্রয়োজনের সাথে যথাযথ অনুপাতে অপ্রয়োজনের মিশেল না দিলে সমাজ রাষ্ট্র টেকেই না।
বাংলাদেশ না কি ধনী হচ্ছে! ধনীর বাড়ির চেয়ে বাগান বড় হয়, প্রয়োজনের সাথে সাথে তার অপ্রয়োজনের আয়োজন বড় করে নজর কাড়ে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ‘অপ্রয়োজনের আয়োজন’ সীমিত করা কি সেই সাক্ষ্য দেয়?
আবারও রবি ঠাকুরকে স্মরণ করে বলা যায়, আমের আঁটি আমের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়, কিন্তু তার সবটাই আঁটি হলে আমের বংশ নির্বংশ হবে নিশ্চিত। উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রের ভৌত প্রয়োজনে গড়ে ওঠে না, বাজারে চাকুরিজীবী সরবরাহ করা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান কাজ হতে পারে না। জীবিকার মতো সামান্য বিষয়কে অসামান্যভাবে তুচ্ছ করতে পারাই উচ্চশিক্ষার সার কথা। জীবনকে বিকশিত করা, জীবনকে যাপন করার, জীবনকে জীবনের প্রয়োজনে ব্যয় করার শিক্ষাই উচ্চশিক্ষা।
নিচুস্তরের শিক্ষাদর্শন নিয়ে উচ্চশিক্ষার বিষয়ে যারা পথ দেখাচ্ছেন, তারা এই সমাজ এই রাষ্ট্রকে আরও ভয়ানক বিপদগ্রস্ত করে তুলতে চলেছেন। কথাটা ভেবে দেখবেন।
লেখক পরিচিতি
সম্পাদক বাংলাদেশের শিক্ষা
এই লেখাটি সম্পাদক কর্তৃক প্রকাশিত। মূল লেখার পরিচিত লেখার নিচে দেওয়া হয়েছে।