কিছুদিন আগের একটি ঘটনা বলি। আমি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছোট ভাইকে বিশেষ প্রয়োজনে ফোন করবো। অন্য একজনের কাছ থেকে তার ফোন নম্বর পাওয়া গেলো। তার সাথে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন সময়ে কোনো কথা হয়নি। মুখ চেনা ছিলো, এই যা! যাই হোক, আমি তাকে ফোন দিলাম আমি কোন ব্যাচের তা বলে, খুব অসচেতনভাবেই তাকে বলে ফেললাম তোমার সাথে আমার ফেইসবুকে অ্যাড করা আছে “… … …” নামে। সে তখন মনে করতে পারলো না, কিন্তু যেহেতু পরিচয় আগেই দিয়েছিলাম কাজের কথা হয়ে গেলো।
এরপর আমি যখন চিন্তা করলাম আমার পরিচয় দিতে গিয়ে বলা কথাগুলো নিয়ে, তখন অবাক হয়ে আবিষ্কার করলাম, আজকাল আমাদের পরিচয় প্রদানের ধরন কতোটা পাল্টে গেছে। নতুন কারো সাথে পরিচয় হলেই আজকাল আমরা ফোন নম্বরের চেয়ে তার ফেইসবুক আইডি সংগ্রহেই বেশি আগ্রহী হই। হয়তো এমন দিন সামনে আসবে যখন আমাদের পরিচয় হবে এইসব সামাজিক ওয়েবসাইটের আইডিগুলোই। এখন যেমন আমরা আমাদের যোগাযোগ করার মাধ্যম হিসেবে ফোন নম্বর দেই, তখন হয়তো দিবো আমাদের বিভিন্ন আইডি।
কথাগুলো বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর মতো শোনালেও এটিই হয়তো ভবিষ্যতের বাস্তবতা হয়ে দেখা দেবে। সবার সাথে পরিচয়ের সূত্রটা এখন ফেইসবুক, টুইটারের মতো সামাজিক যোগাযোগের সাইটগুলো। বন্ধু-বান্ধবদের সাথে এখন যত না ফোনে কথা হয় তারচেয়ে বেশি যোগাযোগ হয় ফেইসবুকে।
একটু পেছনে ফিরে তাকালেই ২০ বছর আগেও আমাদের সময়টা কেমন ছিলো তা দেখতে পাবো। ইন্টারনেট নেই, মোবাইল ফোনের ব্যাপক ব্যবহার নেই, হাতে গোনা যায় আশে-পাশে কম্পিউটারের সংখ্যা এমনই, গুগল নেই (গুগল এখন সবেমাত্র কৈশোরে পা দিয়েছে)। ফেইসবুক নেই, ইউটিউব নেই, ব্লগিং ওয়েবসাইট নেই, ডিজিটাল ক্যামেরা নেই, এমপিথ্রি নেই, নেই আরও অনেক প্রযুক্তি।
আর এখন এসব ছাড়া আমরা দৈনন্দিন জীবন চিন্তাও করতে পারি না। এভাবেই আমাদের অজান্তে প্রযুক্তি আমাদের পরিবর্তন করে দিচ্ছে। আর আমরাও এসব প্রযুক্তি গ্রহণ করছি এবং আমাদের মাধ্যমেই তা প্রসারিত হচ্ছে। আমি প্রথম শ্রেণীতে পড়ার সময় জানতামও না উইন্ডোজ, ম্যাক বা লিনাক্স কী। আর এখন আমার প্রথম শ্রেণীতে পড়ুয়া ছোট ভাই, এই তিন অপারেটিং সিস্টেম ব্যবহার করে স্বাচ্ছন্দে। পাঠ্যবইয়ের পাতা উল্টানোর মতোই তার কাছে কম্পিউটারে কাজ করা সহজ।
আজকের এই লেখা এই প্রযুক্তি আর শিক্ষার পরিপূরকতা নিয়ে। একেবারে ভিত্তি থেকে শুরু করে অর্থাৎ আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার ভিত্তি থেকে শুরু করে, তথ্য ও প্রযুক্তির নানা দিকে শিক্ষার বিভিন্ন তত্ত্ব-এর প্রয়োগ-প্রসার-প্রচার এ লেখার মূল উদ্দেশ্য। আমি চেষ্টা করবো কয়েকটি ভাগে ভাগ করে এই আলোচনাগুলো করতে। সময় আর সুযোগ পাবো কিনা তা বলতে পারছি না, লেখাগুলো নিয়মিত হবে কিনা তাও জানি না, তবে চেষ্টার অভাব এবং ক্রুটি থাকবে না।
আজকের লেখাটি Boolm’s-এর Taxonomy নিয়ে। শুরুতেই বলতে চাই Benjamin Bloom-কে নিয়ে। যারা শিক্ষার সাথে কোনো না কোনোভাবে জড়িত তারা এই নামের সাথে পরিচিত বা নামটি জানেন। Benjamin Bloom শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষা মনোবিজ্ঞানী ছিলেন। তিনি শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পরিমাপ করার জন্য তিনটি মূল ডোমেইন নির্ধারণ করেন, যা প্রকাশিত হয় ১৯৫০ সালে। এগুলো হলো –
1. Cognitive
2. Affective
3. Psychomotor
এই ডোমেইনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্ব পায় Cognitive ডোমেইন। আমাদের দেশ সহ বিশ্বের অনেক দেশেই শিখনফল (Learning Outcome) পরিমাপ করা হয় এই ডোমেইনের ওপর নির্ভর করে। এই ডোমেইনকে আবার ৬টি সাব-ডোমেইনে ভাগ করা যায়। আমাদের মনে রাখতে হবে এটি ১৯৫০ সালের কথা। অর্থাৎ আরও ৬২ বছর আগের কথা। এরপর ১৯৯০ সালে Bloom-এর প্রাক্তন ছাত্র, Lorin Anderson, David Krathwohl-কে সাথে নিয়ে Revised Bloom’s Taxonomy বের করেন যা প্রকাশিত হয় ২০০১ সালে। এই Revised Bloom’s Taxonomy-তে একটু অন্যভাবে higher order thinking (উচ্চ স্তরের দক্ষতা)-এর কথা বলা হয়। পরের Bloom’s Revised Taxonomy-তে Creating কে Evaluating-এর ওপরের স্তর হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। (সূত্র: Bloom’s Digital Taxonomy, Andrew Churches; www.edorigami.wikispaces.com)
এই Revised Bloom’s Taxonomy-এর প্রণয়ন করা হয়েছিলো যুগের চাহিদার সাথে তাল মিলিয়ে। নতুন নতুন প্রযুক্তি ও নতুন নতুন শিক্ষা উপকরণ শিক্ষায় ব্যবহৃত হওয়ার কারণে এই পরিবর্তনটি করা হয়েছিলো। তা আজ থেকে আরও ১১ বছর অর্থাৎ প্রায় এক দশক আগের কথা। এই এক দশকে আমরা যুগান্তকারী নানা আবিষ্কারকে আমাদের সামনে পেয়েছি, সেগুলো ব্যবহার করছি, আর সেগুলো ব্যবহার করার কারণে আমাদের জীবনযাত্রায় এসেছে নানা পরিবর্তন। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ smart phone। এই পরিবর্তনের আলোকে Bloom’s Taxonomy আবার পরিবর্তিত হয়েছে। এই পরিবর্তিত Taxonomy-কে বলা হয়েছে Bloom’s Digital Taxonomy। যা Andrew Churches–এর Bloom’s Digital Taxonomy বই-এ বর্ণনা করেছেন।
Bloom’s Taxonomy-এর কথা এখানেই শেষ। বললে এর কথা শেষ হবে না। এবার আমরা গুগলের কথা একটু বলি।
গুগল, নাম শুনলেই আর কিছু বলতে হয়। যারা আমরা ইন্টারনেটে একেবারেই সাধারণ কাজ করি,তারাও জানি গুগল কী এবং কেন আমরা গুগল ব্যবহার করছি। আর নেটিজেন (Netizen) শব্দটি যাদের জন্য প্রযোজ্য তাদের কথা তো বাদ! তাদের চেয়ে ভালো করে কেউ বলতে পারে না গুগলের ব্যবহারযোগ্যতার কথা। আমার পুরানো এক সহকর্মীর কথা এই লেখাটি লেখার সময় খুব বেশি মনে পরছে। শুধু কম্পিউটার বা ইন্টারনেট বিষয়ে নয়, অন্য যে কোনো ব্যাপারে তাকে কিছু জিজ্ঞেস করলেই তিনি বলতেন, “প্লিজ দু’মিনিট সময় দিন, আমি গুগল মামাকে জিজ্ঞেস করে বলছি”।
খুব মজার কথা কিন্তু এটি এখন অনেক বড় সত্য। আমার কিছু জানার প্রয়োজন হলে, আমি যদি কম্পিউটার বা ল্যাপটপের সামনে থাকি আর আমার যদি ইন্টারনেটের সংযোগ থাকে তাহলে আমি প্রথমে গুগলে সেই বিষয়ে খোঁজ করি। খুব সাধারণভাবে বললে গুগল একটি ওয়েব সাইট। আর একটু বিশেষভাবে বললে গুগল হচ্ছে, সার্চ ইঞ্জিন। যার প্রধান কাজ সার্চ করা, মানে খুঁজে বের করা। আমরা তার কাছে যাই জানতে চাইবো সে তাই-ই লাখ লাখ ওয়েবসাইট থেকে খুঁজে বের করে আমাদের সামনে এনে হাজির করবে। গুগল অবিশ্বাস্য দ্রুততার সাথে এই কাজটি করে আসছে। আর এর সাথে সাথেই সে যুক্ত করেছে নানা ধরনের কার্যক্রম। যেমন- ব্লগিং, অডিও-ভিডিও চ্যাট, গুগল ডক্স, গুগল রিডার ইত্যাদি। এক জিমেইল আইডি দিয়ে ইন্টারনেটে করা যায় না এমন কাজ নেই।
গুগল তার আইডি দিয়ে আমাদের নানা কিছু করার সুযোগ দিচ্ছে। যেমন- ইমেইল ব্যবহারের সুযোগ (gmail), ভিডিও-অডিও চ্যাটিং-এর সুযোগ (gtalk), ব্লগিং-এর সুযোগ (blogger/blogspot), ফ্রি ওয়েব সাইট তৈরির সুযোগ (sites.google.com), বই-পড়ার সুযোগ (google reader), ভিডিও দেখার-শেয়ার করার সুযোগ (youtube), গ্রুপ তৈরির সুযোগ (groups.google), ক্লাউড কম্পিউটিং-এর সুযোগ (google drive), সামাজিক যোগাযোগের সুযোগ (google plus) ইত্যাদি। এখন বলা যেতে পারে, এইসব সুযোগ হয়তো আরও অনেকেই দিয়ে থাকে কিন্তু গুগলের মতো দ্রুততার সাথে, সামঞ্জস্য বজায় রেখে এইসব সবগুলো সুবিধা দিতে পারে এমন কোনো সেবার কথা আমার জানা নেই। গুগুল প্রতি নিয়ত তার এইসব অ্যাপ্লিকেশন ও সেবায় পরিবর্তন আনছে। তাই এর বিষয়ে আমার কৌতুহল অনেক বেশি। এই পরিবর্তন আনয়নের কাজগুলো করার সময় যে তারা বিভিন্ন গবেষণা করে তাও প্রতিষ্ঠিত সত্য। এর প্রমাণ পাওয়া যায় http://googleresearch.blogspot.com/. গুগুলের এই বিভিন্ন সুবিধাগুলো আমরা প্রতিনিয়তই ব্যবহার করছি, কেউ প্রয়োজনে জেনে, কেউ অপ্রয়োজনে না জেনে।
শিক্ষাবিষয়ক বিভিন্ন লেখা পড়ার অভ্যাসের কারণে, কাজের সংশ্লিষ্টতার কারণে দেশি-বিদেশি নানা ব্লগে, ওয়েবসাইটে, ফোরামে, বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা প্রকল্পগুলোতে প্রতিনিয়তই খোঁজ করা হয়। সেইভাবে খোঁজ করতে গিয়ে-ই Kathy Schrock এর এই চমৎকার গবেষণার ফলাফলটি চোখে পড়ে। অনেকদিন থেকেই ইচ্ছে ছিলো গুগলের শিক্ষামূলক বিভিন্ন অ্যাপ্স নিয়ে লেখার। সেই অ্যাপ্সগুলো কতভাবে আমাদের শিক্ষায় সাহায্য করতে পারে কিন্তু সময় আর আলসেমির জন্য তা করা হয়ে ওঠে নি। এই ছবিটি Kathy Schrock–এর Bloom’s Apps projects এর ছবি। এই ছবির মাধ্যমে দেখানো হয়েছে Bloom’s Revised Taxonomy–এর বিভিন্ন স্তর কীভাবে পূরণ করা যাচ্ছে গুগলের অ্যাপ্স-এর সাহায্যে।
আমাদের শিক্ষকরা এবং একই সাথে শিক্ষার্থীরাও এই সুবিধাগুলো নানানভাবে কাজে লাগাতে পারে। Bloom’s Revised Taxonomy অনুসারে গুগলের এই সুবিধাগুলোর শ্রেণিকরণ আমরা এই চিত্রে দেখতে পারছি। এর (গুগল) প্রতিটি কার্যক্রম আলোচনার মাধ্যমেও দেখানো সম্ভব কীভাবে তা আমাদের Taxonomy-র বিভিন্ন ডোমেইনের আলোকে learning order পরিমাপ করতে সাহায্য করতে পারে। তবে সেটি অন্য আরেকটি লেখায় আলোচনা করার আশা রইলো।
আলোচনার শেষ করার আগে বলতে চাই, এই লেখার উদ্দেশ্য গুগলের বন্দনা করা নয়। গুগল আমার কাজ অনেক সহজ করে তুলেছে, আমি তার প্রতি অবশ্যই কৃতজ্ঞ। তবে এখন শুধু গুগল নয়, ওয়েব ২ অ্যাপ্স এবং ম্যাকের আইপড বা আইফোনের অ্যাপ্স সবগুলোই কোনো না কোনো learning order পূরণ করছে। অর্থাৎ আমাদের প্রযুক্তির বিকাশও হচ্ছে শিক্ষাবিজ্ঞানের মূল তাত্ত্বিক দিকগুলোকে কেন্দ্র করে। প্রযুক্তি আর শিক্ষা তাই একে অন্যের পরিপূরক, এটি যে কোন প্রযুক্তি বিকাশের ক্ষেত্রেই আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন।
লেখক পরিচিতি
আকলিমা শরমিন
আকলিমা শরমিন বাংলাদেশের শিক্ষা ওয়েবসাইটে সহ-সম্পাদক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।