বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ক্যাম্পাসে ক্লাস নেয়া বন্ধ হয়ে গেছে মার্চ মাসেই। প্রায় দুই মাস হতে যাচ্ছে। সম্প্রতি খবরে দেখলাম, বাংলাদেশের সরকারী কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে ক্লাস শুরুর উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে এভাবে অনলাইনে ক্লাস শুরু হলেও পরে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বা ইউজিসি সেটি বন্ধ করে দেয়, হয়তো এখন অনুমতি মিলেছে সবার।
যে কারণে এই লেখা
আমি নিজে এই সেমিস্টারে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ক্লাসটি পড়াচ্ছিলাম, অত্যন্ত দ্রুততার সাথে এক সপ্তাহের নোটিশে সেই ক্লাসটিকে অনলাইনে নিয়ে আসতে হয়েছে। মাত্র সেটার ফাইনাল ও গ্রেডিং শেষ হলো। কাজেই এই পরিস্থিতিতে আমার অভিজ্ঞতার আলোকে বাংলাদেশের এই উদ্যোগ নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই।
শিক্ষার্থীরা বেকার বসে আছে, অনলাইনে ক্লাস নিয়ে তাদের শিক্ষাজীবনের এই অচলায়তনের কিছুটা হলেও অবসান ঘটানোর উদ্যোগটিকে আমি স্বাগত জানাচ্ছি শুরুতেই। আমি মনে করি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কর্তৃপক্ষ তাঁদের সদিচ্ছার জন্যই এটা করছেন। কিন্তু কিছু ব্যাপার ভেবে দেখতে হবে।
অনলাইনে ক্লাস : শিক্ষার্থীদের সমস্যাসমূহ
ডিভাইস বা কম্পিউটারের প্রাপ্যতা
সব শিক্ষার্থীর কি কম্পিউটার ল্যাপটপ কিংবা ট্যাবলেট আছে? আমার ধারণা, ঢাকা শহরবাসী শিক্ষার্থীদের সবার ক্ষেত্রেও এটি সত্য হবে না। এমতাবস্থায় কী করে অনলাইনে ক্লাস করবে তারা? স্মার্ট ফোনে ক্লাস করার পদ্ধতিটি ভুল ধারণা। স্মার্টফোনের ছোট্ট স্ক্রিনে ফেইসবুক অ্যাপ দেখা যেতে পারে, কিন্তু একটি একাডেমিক ক্লাসের ক্ষুদে লেখা দেখে ক্লাস করা সম্ভব নয়। কাজেই প্রশ্নটা থেকেই যাচ্ছে, অনলাইনে ক্লাস করার সুযোগ কি কেবলই মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত শিক্ষার্থীদের জন্য? বাকি ৯০% শিক্ষার্থী কী করবে?
ইন্টারনেট সংযোগ
ধরা যাক তর্কের খাতিরে যে, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাড়িতে যাবার সময়ে শিক্ষার্থীরা তাদের ল্যাপটপ বা ট্যাবলেট সাথে করে বাড়ি চলে গেছে। প্রশ্ন হলো, যে অনলাইনে ক্লাস করার কথা হচ্ছে, তার জন্য দ্রুতগতির নেটওয়ার্ক কানেকশন তো লাগবে। গ্রামেগঞ্জে অধিকাংশ জায়গাতেই নেটওয়ার্ক নেই। ইন্টারনেট চেক করার জন্য গাছের মগডালে উঠে ঘণ্টাখানেক বসে থাকলে লাইন পাওয়া যায়, এমন অভিযোগ শুনেছি প্রত্যন্ত অঞ্চলে থাকা অনেকের কাছেই। এরা কীভাবে ক্লাস করবে? আবার ক্লাস করার জন্য যদি বাড়ি থেকে বেরিয়ে শহরের কোথাও গিয়ে জড়ো হতে হয়, তাহলে সোশাল ডিস্টান্সিং-এর বারোটা বাজবে, তাই না?
ডেটার টাকা
ধরা যাক উপরের দুইটাই মানে ল্যাপটপও আছে, নেটও আছে। তাহলে বলুন, এই অনলাইনে ক্লাস করার জন্য যে ডেটা প্যাকেজ লাগবে, তার টাকা কে দিবে? প্রতিটি ১ ঘণ্টার ক্লাসের ভিডিওর জন্য অন্তত ৩০০ মেগাবাইট বা আরো বেশি ডেটা লাগে। একটি শিক্ষার্থী ৩টি ক্লাস করলে অন্তত ১ জিবি ডেটা লাগবে প্রতিদিন। তার টাকা আসবে কোথা থেকে?
অনলাইনে ক্লাস : শিক্ষকদের সমস্যাসমূহ
এ তো গেল শিক্ষার্থীদের সমস্যা। এবারে আসা যাক শিক্ষকদের ক্ষেত্রে।
প্রশিক্ষণ
অনলাইনে ক্লাস নেয়া আর ক্লাসে পড়ানোর মধ্যে বিস্তর ফারাক। আমি নিজে টের পেয়েছি, গণিতের মতো একটি কোর্স অনলাইনে পড়াতে গেলে কত বিস্তর ঝামেলা পোহাতে হয়। কিছু পাওয়ারপয়েন্ট স্লাইড একটার পর একটা পড়ে যাওয়াই অনলাইনে পড়ানো না। রীতিমত অনলাইন ক্লাস ডিজাইন করার ব্যাপার আছে, মান রক্ষার ব্যাপার আছে। এই ব্যাপারে শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন কি কেউ? আমি নিজে বহুকাল অনলাইনে শিক্ষামূলক ভিডিও বানাই বলে আমি জানি কী সফটওয়ার কীভাবে ব্যবহার করতে হয়। কিন্তু অধিকাংশ শিক্ষক বিশেষ করে কম্পিউটার বিজ্ঞানের বাইরের অনেকের জন্যই এগুলো একেবারেই নতুন ব্যাপার। তাঁদের প্রশিক্ষণ কে দিবে, কতদিনে দিবে?
যন্ত্রপাতি
শিক্ষকদের নিজেরও অনলাইন ডেটা কানেকশন লাগবে এবং ভিডিও রেকর্ড করার কম্পিউটার ও সফটওয়ার লাগবে। সেগুলো কি সবার কাছে দেয়া হয়েছে বা হবে?
মূল্যায়ন
অনলাইনে পরীক্ষা নেয়া বেশ কঠিন। মূল সমস্যা হলো, অসদুপায় বা নকল বন্ধ করা। যেহেতু শিক্ষক শিক্ষার্থীকে দেখতে পাচ্ছেন না, তাই সহজেই গুগল সার্চ, বই দেখে লেখা, অথবা বন্ধুবান্ধব একসাথে মিলে নকল করা সম্ভব। প্রথাগত পরীক্ষাকে অনলাইনে নিয়ে গেলে তাই কাজ হবে না। অনলাইনে পরীক্ষা ডিজাইনের ক্ষেত্রে হয় অনলাইন প্রক্টরিং-এর ব্যবস্থা করতে হবে। এটি আমেরিকাতে সম্ভব কিন্তু বাংলাদেশে সম্ভব হবে না বলে আমার ধারণা। অথবা টেইক হোম বা ওপেন বুক এক্সাম ডিজাইন করতে হবে যাতে যতো খুশি বই খুলে লেখার সুযোগ থাকে। কারণ পরীক্ষায় এমন প্রশ্ন দেয়া হয় না যার উত্তর সরাসরি বইতে থাকে।
আমার অভিজ্ঞতা
আমার অভিজ্ঞতা কিছু বলি। নানা ঝক্কিঝামেলা পেরিয়ে অনলাইনে ক্লাস নিয়েছি গত দেড় মাস। আমেরিকাতেও কিন্তু সব শিক্ষার্থীর কম্পিউটার থাকবে এটি ধরা ভুল। আলাবামার প্রচুর হতদরিদ্র শিক্ষার্থী আমার ক্লাসে পড়ে। তাদের অনেকেরই কিন্তু কম্পিউটার নেই। আমার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জরুরি ভিত্তিতে তাদের অনেককে কম্পিউটার ধার দেয়া হয়েছে, এর ফলেই তারা ক্লাস করতে পেরেছে।
তার পরেও কথা থাকে। কোর্সের শেষের দিকে এক শিক্ষার্থী, যাকে মাসখানেক ক্লাসে বা পরীক্ষায় দেখিনি, সে জানালো, লকডাউনের শুরুতেই তার চাকুরি চলে গেছে। তাই ইন্টারনেটের বিল দিতে না পারায় লাইন কাটা গেছে এবং সে কারণেই সে ক্লাসের ভিডিও বা অনলাইনে পরীক্ষা দিতে পারেনি। খোদ আমেরিকাতেই অনেক শিক্ষার্থীর যেখানে এমন দুর্দশা, বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের একজন শিক্ষার্থীর কী সমস্যা হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়।
প্রয়োজন ভাবনার
আমি প্রযুক্তিবিরোধী নই, তাই অনলাইনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস নেয়ার উদ্যোগের বিরোধী নই। কিন্তু এক্ষেত্রে চিন্তাভাবনা না করে তাড়াহুড়ো করে এগুলে খুব বড় সমস্যা হবে। শিক্ষার্থীদের উপকারের বদলে সমস্যা হবে। আর সবচেয়ে বড় সমস্যাটি হবে বৈষম্য। শিক্ষাক্ষেত্রে ধনী-গরীবের যে সমস্যা এখনই আছে, তা খুব বড় আকারে ধারণ করবে। শিক্ষা সবার অধিকার, তাই অনলাইনে শিক্ষাক্রম চালু করার সুপ্রয়াসের কুফল হিসাবে যেন দরিদ্র শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত না হয়, এই ব্যাপারটাই ভালো করে ভেবেচিন্তে দেখার জন্য বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ করছি।
লেখক পরিচিতি
ড. রাগিব হাসান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্যা ইউনিভার্সিটি অব অ্যালাবামা অ্যাট বার্মিংহাম-এ অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। তিনি বাংলাদেশের শিক্ষার নানা প্রসঙ্গ নিয়ে নিয়মিত লেখালেখি করছেন।