স্বাধীনতার পূর্বে থেকেই এটি প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, কোনো শ্রেণি-পেশার মানুষের ন্যায্য কিংবা অন্যায্য দাবি আদায়ের জন্য রাজপথে নেমে আসতে হবে। এ শ্রেণি-পেশার মানুষেরা যাদের অধীনে কাজ করেন, তাদেরকে বলা হয় শাসকগোষ্ঠী এবং এই শাসকগোষ্ঠীর অধীনে যারা কাজ করেন তাদেরকে বলা হয় শ্রমজীবি মানুষ। এই শ্রমজীবি মানুষদেরকে সাধারণত শ্রমিক বলা হয়ে থাকে। এটি দৃশ্যমান যে, শ্রমিকরা এই সমাজে সবসময়ই নিগৃহীত এবং তাদের শ্রমের সঠিক মূল্য তাদেরকে দেয়া হয় না। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক কি শ্রমিক?
প্রথমেই জানতে হবে, একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিজেকে কীভাবে দেখেন? আমার উত্তর হবে, শিক্ষকরাও এক ধরনের শ্রমিক। এতে হয়তো অনেকেরই দ্বিমত থাকতে পারে। এই শিক্ষক শ্রেণিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়: প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক, মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক, কলেজ শিক্ষক এবং বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক। এই ভাগগুলোর মধ্যে বৈষম্যও কিন্তু অনেক।
যেমন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরকে যে বেতন দেয়া হয়, সেটি দিয়ে তাদের কোনোমতে বেঁচে থাকাই যেন তাদের জীবনের জন্য সবচেয়ে বড় পরীক্ষা। জেনে রাখুন, “একজন সরকারি প্রাথমিক প্রধান শিক্ষকের মূল বেতন ১২৫০০ টাকা আর অন্যান্য ভাতা মিলিয়ে সর্বমোট ১৯৮০০ টাকা। সহকারী শিক্ষকের মূল বেতন ৯৭০০ টাকা এবং অন্যান্য ভাতা মিলিয়ে সর্বমোট ১৬২৫০ টাকা।” (তথ্য: ক্যারিয়ারকি/প্রাথমিক শিক্ষক, ১৫ এপ্রিল, ২০১৯)
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরকে যে বেতন দেয়া হয়, সেটি দিয়ে তাদের কোনোমতে বেঁচে থাকাই যেন তাদের জীবনের জন্য সবচেয়ে বড় পরীক্ষা।
এই শ্রমজীবি শিক্ষকদের দিকে তাকান, কথা বলুন। দেখবেন কতোটা সহজ আর সাধারণ এই মানুষগুলো। তাদের প্রজ্ঞা আর মেধায় কোনো ঘাটতি নেই। শিক্ষক নিয়োগে কিছু ভুল তো সব জায়গাতেই হচ্ছে; তার অর্থ এই নয় যে, ঢালাওভাবে শিক্ষকদের খারাপ বলতে হবে। বরং, শিক্ষক সমাজকে যদি আর্থিক নিরাপত্তা না দেয়া হয় তাহলে আমরা কখনোই মানসম্পন্ন শিক্ষা পাবো না। এই কথাটি কিন্তু অকপটে স্বীকার করে নিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মণি (তথ্য: বাংলাদেশ জার্নাল, ২৭ অক্টোবর ২০১৯)।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক যে শুধু শিক্ষকতাই করেন, বিষয়টি কিন্তু তেমন নয়। তাঁদের শিক্ষকতার পাশাপাশি অন্য কাজও করতে হয়। উদাহরণস্বরূপ, জরিপের কাজ করা, ভর্তি কার্যক্রম পরিচালনা করা, বিভিন্ন ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা আয়োজন করা, বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা, নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করা, বিভিন্ন ধরনের শুমারিতে সহযোগিতা করা, মেরামত এবং সংস্কার কাজ দেখাশুনা করা, বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ এবং আরো অনেক কাজ আছে যা তাদেরকে করতে হয়।
২০১৭ সালের ‘অ্যানুয়েল প্রাইমারি স্কুল সেনসাস (এপিএসসি)’ প্রতিবেদন অনুসারে, দেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৬৪,১২২টি। যেখানে প্রতিটি বিদ্যালয়ে অন্তত ছয় জন করে শিক্ষক থাকা দরকার। এর মধ্যে ৩৮,৮৫৬টি বিদ্যালয়ে আছেন ছয়জনের চেয়ে কম শিক্ষক, ৭৭৬৫টি বিদ্যালয়ে পাঁচজন করে, ২২৫২৭টি বিদ্যালয়ে আছেন চারজন করে শিক্ষক, ৮৫৬৪টি বিদ্যালয়ে তিনজন করে শিক্ষক আছেন (তথ্য: নয়া দিগন্ত, ১৫ জুলাই ২০১৮)। এ থেকে এটিই প্রতীয়মান হয় যে, প্রাথমিক শিক্ষকের সংখ্যা যেমন বাড়াতে হবে, ঠিক তেমনি তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের জন্য আর্থিক নিরাপত্তা দিতে হবে।
আমাদের শিশুদের জীবনের প্রথম যে শিক্ষাটি দেয়া হয়, সেটি এই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিকট থেকেই আসে। তাঁরাই আমাদের শিশুদেরকে নিজের সন্তানের মতো করে আদর, স্নেহে নৈতিকতার শিক্ষা দেন। তাঁরা অক্লান্ত পরিশ্রম এবং সীমিত সুযোগ দিয়ে ভবিষ্যতের একজন পরিপূর্ণ মানুষ হবার ভিত্তি গড়ে দেন। এই জন্যই তাঁদেরকে বলা হয় মানুষ গড়ার কারিগর বা শিক্ষাগুরু।
তাঁরা চাইলেই অন্য যে কোনো পেশা বেছে নিতে পারতেন এবং সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারতেন। কিন্তু তাঁরা শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে যে পেশায় তাদের সাথে প্রায়ই পশুর মতো আচরণ করা হয়। একজন শিক্ষকের প্রাপ্য সম্মানটুকু আজ আমরা দিতে ভুলে গেছি। আমরা ভুলে যাই, যারা শিক্ষকতাকে পেশা হিসাবে বেছে নেন, তাদের কাছে এটি শুধুই একটি পেশা নয়, বরং তাদের কাছে এটা একটি ভালোবাসার জায়গা।
প্রাথমিক শিক্ষকদেরকে দাবি আদায়ের জন্য যখন রাস্তায় নামতে হয়, তখন তাদেরকে লাঠিপেটা করা হয়। পুলিশ বিক্ষোভ সমাবেশ দমনে এমপিওভুক্তির দাবিতে আন্দোলনরত প্রাথমিক শিক্ষকদের ওপর ‘পিপার স্প্রে’ (মরিচের স্প্রে) ব্যবহার করেছে (সূত্র: বিডি নিউজ ২৪.কম, ১৭ জানুয়ারী ২০১৩)।
একজন শিক্ষক ইংরেজি ভালো বলতে পারেন না দেখে ডেপুটি কমিশনার অভিভাবকদের বলেন, আপনারা লাঠি দিয়ে পিটিয়ে ‘মাস্টারগুলোকে’ বাইরে বের করে দেন। নারায়ণগঞ্জে একজন সংসদ সদস্য তার ইচ্ছেমতো শিক্ষককে কানে ধরিয়ে উঠবস করান (তথ্য: প্রথম আলো, ৭ মে ২০১৬)। পটুয়াখালীতে ম্যাজিস্ট্রেট কলেজ শিক্ষককে পা ধরতে বাধ্য করেন কিংবা একজন ছাত্রনেতা শহীদ বুলবুল কলেজের শিক্ষককে নকল ধরার অপরাধে পিঠে লাথি মারতে পারেন (তথ্য: সমকাল, ১৫ মে ২০১৯)।
প্রাথমিক শিক্ষকদের সমাবেশে পুলিশ লাঠিচার্জ করে (তথ্য: যুগান্তর রিপোর্ট ২৩ অক্টোবর ২০১৯), রাজশাহী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ ফরিদ উদ্দীন আহম্মেদকে টেনে-হিঁচড়ে পুকুরে ফেলে দিয়েছে ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী (তথ্য: প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী, ০২ নভেম্বর ২০১৯)। পঞ্চগড়ে ‘জেএসসি পরীক্ষায় মেয়েকে বাড়তি সময় না দেওয়ায়’ এক স্থানীয় নেতার স্ত্রী পরীক্ষাকেন্দ্রে ঢুকে এক শিক্ষককে মারধর করেছেন (তথ্য: পঞ্চগড় প্রতিনিধি, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম, ৪ নভেম্বর, ২০১৯)। এরকম অসংখ্য ঘটনা আছে যেটি এই সমাজকে একটি বার্তা দিচ্ছে যে এখন এদেশে প্রাথমিক শিক্ষকদের শিক্ষা এবং যোগ্যতা নেই।
এই যে অপমানগুলো শিক্ষকদের করা হচ্ছে, এর মাধ্যমে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের এই পেশায় আসতে অনুৎসাহিত করা হচ্ছে। কিন্তু যে শিক্ষকরা এতো ত্যাগ স্বীকার করে এই পেশায় কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে কাজ করে যাচ্ছেন, তাদেরকে অপমান আর অবহেলায় কি ভুল বার্তা পৌঁছে দেয়া হচ্ছে না?
এই যে অপমানগুলো শিক্ষকদের করা হচ্ছে, এর মাধ্যমে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের এই পেশায় আসতে অনুৎসাহিত করা হচ্ছে। কিন্তু যে শিক্ষকরা এতো ত্যাগ স্বীকার করে এই পেশায় কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে কাজ করে যাচ্ছেন, তাদেরকে অপমান আর অবহেলায় কি ভুল বার্তা পৌঁছে দেয়া হচ্ছে না? প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককে দ্বিতীয় শ্রেণির আর সাধারণ শিক্ষকদেরকে তৃতীয় শ্রেণির মর্যাদা দিয়ে কি আমরা একটি অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে নিজেদের এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি না?
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দেবার এখন সময় হয়েছে। এই শিক্ষাব্যবস্থাকে আমরা যদি উন্নত দেশের শিক্ষাব্যবস্থার মতো করে গড়ে তুলতে চাই, তাহলে আমাদের শুরু করতে হবে প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর মধ্যে দিয়ে।
আমাদের প্রাথমিক শিক্ষকদের আর্থিক নিরাপত্তা এবং সৎ ও নিষ্ঠার সাথে কাজ করার জন্য সামাজিক নিরাপত্তা দিতে হবে। মানসম্মত শ্রেণিকক্ষ থাকতে হবে, শিশুদের জন্য খেলার মাঠ থাকতে হবে, শ্রেণিকক্ষে পর্যাপ্ত শিক্ষা উপকরণ থাকতে হবে, এবং শিক্ষকদের যুগোপযোগী শিক্ষাদান করার জন্য শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। মানসম্মত শিক্ষা শিশুরা পাচ্ছে কি না সেটি নির্দিষ্ট সময় পর পর তদারকি করতে হবে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে। সবশেষে, শিক্ষা খাতের উন্নতি না ঘটিয়ে আমরা একটি অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে যেন এগিয়ে না যাই এ-বিষয়ে আমাদের সবাইকে একসাথে কাজ করতে হবে।
লেখক পরিচিতি
ড. গৌতম সাহা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।