বই পড়া একটি মননশীল কাজ। চোখ, নাক, কান, জিহ্বা ও ত্বক— এই পঞ্চইন্দ্রিয়ের কোনোটিই ব্যবহার না করে এক আশ্চর্য পদ্ধতিতে মানুষ বই পড়ে। একজন পাঠক সাদা কাগজের ওপর লেখা কিছু লিপির দিকে তাকিয়ে থাকে। সাথে সাথে তার মস্তিষ্কে ঘটতে থাকে নানা আলোড়ন।

বই পড়ার এ আনন্দ সবাই সমানভাবে অবশ্য পায় না। কোনো ইন্দ্রিয়ের ব্যবহার নেই, তাই বই পড়াটা অনেকের কাছেই বেশ কঠিন। বর্তমানে বই পড়ার অভ্যাসটাও নতুন প্রজন্মের মধ্যে কমে যাচ্ছে বেশ আশংকাজনকভাবে। এজন্য অত্যাধুনিক প্রযুক্তিও অনেকাংশে দায়ী। চমকপ্রদ একটি টিকটকের ভিডিও যেভাবে আমাদের মন ও ইন্দ্রিয়কে আচ্ছন্ন করে রাখতে পারে, বইয়ের মাধ্যমে এমন আচ্ছন্নতা আনা একটু কঠিনই বটে। তবে বই পড়ার আনন্দ একবার ধরে ফেলতে পারলে ভিন্ন কথা। যান্ত্রিক স্ক্রিনে কোনোকিছু দেখলে তা আমাদের মস্তিষ্কে কম সময় স্থায়ী থাকে। অথচ বইয়ের পাতায় যখন আমরা পড়ি তা মস্তিষ্কে বেশি স্থায়ী হয়।  

একটি ছোট্ট উদাহরণ দেয়া যাক বরং।

বাস্তবে গাছের রঙিন ফুল দেখে আমরা যতোটা উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়ি, ফুলের পাশে পাতাকে সেভাবে যেন লক্ষ্যই করা হয় না। ফুলের সৌন্দর্যের পাশে পাতা এতোই অবহেলিত যে, আর নজরে আসে না। কিন্তু বইয়ে যখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনুবাদে সেই বিখ্যাত হাইকুটি পড়ি,

“ফুলগুলি যেন কথা,

     পাতাগুলি যেন চারি দিকে তার

               পুঞ্জিত নীরবতা॥”

ফুলের পাশের পাতাগুলোও তখন মনের ভেতর যেন চুপচাপ কথা বলে ওঠে। মনছবিতে ফুল আর পাতা সবই এবার একত্রে ধরা দেয়। বই পড়ার সময়ে আমাদের মস্তিষ্ক এভাবেই আরো বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে। বইয়ের ভেতরে যে বাক্য ও শব্দ থাকে সেগুলো মস্তিষ্কের ভেতর মনছবি তৈরি করে। কল্পনাশক্তিকে আরো বাড়িয়ে তোলে। মনের ভেতর তৈরি হয় হাজার হাজার চোখ, কান, ঘ্রাণেন্দ্রিয়।

অথচ বর্তমান প্রজন্ম বিভিন্ন ধরনের যন্ত্র ব্যবহারে এতো বেশি ব্যস্ত যে, তাদের মস্তিষ্কের ভেতরে মনছবি তৈরি হওয়া বা এ ধরনের মনের ব্যায়াম করার ফুরসতই নেই। মস্তিষ্ক নিজে সক্রিয় হবার আগেই চোখের সামনে স্ক্রিনে সব কিছু দেখিয়ে দেয়া হচ্ছে। ফলে মস্তিষ্কের সক্রিয়তাও কমছে। একটি স্মার্ট ফোনও এখন মানুষের চেয়ে বেশি স্মার্ট হয়ে উঠছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন যন্ত্রের ওপর নির্ভরতা মানুষের আইকিউ কমিয়েও দিতে পারে— এ আশংকাও উড়িয়ে দেয়া যায় না।

আদিম মানুষ একসময় লিপি আবিষ্কার করে লিখতে ও পড়তে শেখে। সে সময় হাতের গঠনে পরিবর্তন ঘটার কারণেই এভাবে হাতিয়ার তৈরির পাশাপাশি লিপি আবিষ্কার করতে পেরেছিলো মানুষ। হাতের সাথে সাথে মস্তিষ্কের গঠনেও পরিবর্তন আসে। চোয়াল ছোট হতে থাকে আর বড় হতে থাকে মস্তিষ্কের আকার। ফলে মানুষের চিন্তাশক্তিও বৃদ্ধি পায়।

নিজের মনের ভাব ও তথ্য বিনিময় করতে গিয়েই লিপি আবিষ্কার করে মানুষ। এভাবেই বিবর্তিত হতে হতে মানুষ আজকের চেহারা ও গঠন পেয়েছে। যে মানুষ একসময় তার মস্তিষ্ক ব্যবহার করে লিপি আবিষ্কার করেছিলো, সে মানুষই আজ তার মস্তিষ্কের ব্যবহার কমিয়ে দিচ্ছে। অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও যন্ত্রের মধ্যে এসে মানুষকে আর নিজের মস্তিষ্ক ব্যবহারই করতে হচ্ছে না। এতো বেশি যন্ত্রের মধ্যে বুঁদ হয়ে থাকে যে, চারপাশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ভার্চুয়াল জগতেই আচ্ছন্ন হয়ে থাকে অনেক মানুষ। এ মানুষের আজ মস্তিষ্ক থেকেও যেন নেই! কান থেকেও যেন নেই, কারণ, চারপাশের শব্দ তার কানে যায় না। চোখের ক্ষমতাও কমছে দিন দিন। এভাবে বিবর্তিত হতে হতে হাজার বছর পরের ভবিষ্যত মানুষের মস্তিষ্কের গঠন কেমন হবে, ভাবতে গেলেও অসহায় লাগে।

আমরা বারবার বই পড়ার গুরুত্ব নিয়ে কথা বলি। কিন্তু বর্তমান প্রজন্মের শিশু-কিশোরদের বইমুখী করতে পারছি না। মনোবিজ্ঞানী হাওয়ার্ড গার্ডনার শিশুদের বিভিন্ন ধরনের বুদ্ধিমত্তার মধ্যে ভাষাসংক্রান্ত যে বুদ্ধিমত্তা চিহ্নিত করেছেন, তাতে দেখা যায়, এই বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন শিশু-কিশোরেরা বই পড়তে অনেক ভালোবাসে। আর এদিকে শিক্ষাব্যবস্থার এমনই হাল, অভিভাবকেরা তাদের সন্তানদের স্রেফ এ প্লাস পাওয়ার একটি যন্ত্র হিসেবে গড়ে তুলছেন।

ফলে ক্লাস, পরীক্ষার চাপে পড়ে পাঠ্যবইয়ের বাইরে আরো যে কতো বৈচিত্র্যময়, রঙিন এক পৃথিবী নিয়ে হাজার হাজার বই চুপচাপ পড়ে আছে, সেগুলোর কাছে যাবার এতোটুকু ফুরসত ওরা আর পাচ্ছে না। বই পড়ার চর্চা পরিবার বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও তেমন দেখা যায় না। চর্চা হচ্ছে না ভাষাসংক্রান্ত বুদ্ধিমত্তার। বছর বছর সাফল্যের সাথে প্রচুর এ প্লাস পাওয়া শিক্ষার্থীই শুধু আমরা পাচ্ছি। কিন্তু মননশীল, সৃষ্টিশীল, নতুন সময়ের নতুন মানুষ তো আর পাচ্ছি না! এটি খুবই হতাশাজনক।

শিশুরা অনুকরণপ্রবন। বড়রা যা করে তারা তাই করে। তাই তাদের মধ্যে বই পড়ার অভ্যাস তৈরি করতে হলে প্রথমে বাবা-মায়েরও বই পড়ার চর্চা থাকা জরুরি। বই পড়ার কথা উঠলেই বেশিরভাগ বাবা-মা কারণ দেখান— সময় কোথায় এত বই পড়ার? এমনকি শিক্ষকদের মধ্যেও বৈচিত্র্যময় বই পড়ার চর্চা বলতে গেলে নেই। অথচ ইচ্ছে থাকলে প্রতিদিন অন্তত এক পাতা বই চাইলেই পড়া যায়, যেখানে প্রতিদিন ফেসবুকে ঠিকই অনেকটা সময় আমরা অনায়াসে খরচ করে ফেলতে পারি মনেরই অজান্তে।

অনেকে অবশ্য যুগের দাবিতে যান্ত্রিক বই পড়ে থাকেন। তবুও কাগজের বই পড়ার অনুভূতি সম্পূর্ণ আলাদা। এছাড়া এটি স্বাস্থ্যকরও বটে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতেও শিক্ষার্থীদের মধ্যে বইপড়ার চর্চা তৈরি করতে সহশিক্ষা কার্যক্রমে পাঠচক্র চালু করতে পারে। এমন কার্যক্রম চালাতে হলে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠাগারও থাকা দরকার। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠাগার থাকলেও এত বেশি ক্লাস ও পরীক্ষার ব্যস্ততার মধ্যে শিক্ষার্থীদের ডুবিয়ে রাখা হয় যে, পাঠাগারে উঁকি দেবার সময়টুকুও তাদের থাকে না। তাদের বইপড়ার ইচ্ছেগুলোকে মেরে ফেলা হয়।  

অথচ বই পড়া ক্লাস ও পরীক্ষার চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। ক্লাস ও পরীক্ষার রুটিনের ব্যস্ততার মধ্যেও শিক্ষার্থীদের একটুখানি অক্সিজেনের প্রয়োজন। মস্তিষ্কের জন্য খাদ্য প্রয়োজন। এজন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সপ্তাহে বইপড়ার একটি সময় রাখা যায়। ওই সময়ে শিক্ষার্থীরা পাঠাগারে এসে বই পড়বে। এমনকি, পাঠাগারের বইগুলো গুছিয়ে রাখার দায়িত্বও তাদেরকে দেয়া যেতে পারে। মাঝে মধ্যে প্রতিষ্ঠানগুলো বইমেলার আয়োজন করতে পারে। এ আয়োজনগুলো ফেব্রুয়ারি মাস ছাড়াও বছরের যেকোনো সময়েই করা যায়। 

বই পড়াকে কেন্দ্র করে প্রতিষ্ঠানগুলো উৎসব করতে পারে। এসব উৎসবে লেখকদেরকে আমন্ত্রণ জানানো যেতে পারে। বিখ্যাত লেখকদের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা যেতে পারে। এছাড়াও দেশের বিখ্যাত ও বড় পাঠাগারগুলোতে শিক্ষার্থীদের সফরে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে। এ-রকম ছোট ছোট কিছু উদ্যোগ যদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সত্যিই শুরু করে, তবেই শিক্ষার্থীদের মধ্যে বইপড়ার চর্চা আরো বাড়বে বলে আশা করা যায়।

Sending
User Review
4.5 (2 votes)

লেখক সম্পর্কে

তানিয়া কামরুন নাহার

তানিয়া কামরুন নাহার

তানিয়া কামরুন নাহার পেশায় শিক্ষক হলেও নেশায় লেখক ও পর্যটক। ২০১৩ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম বই 'ভালো আদর মন্দ আদর'। প্যারেন্টিং, পারিবারিক বন্ধন, মানবিক সম্পর্ক ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে মুক্তগদ্যের বই এটি।

মন্তব্য লিখুন