ইতিহাস থেকে জানা যায়, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় চতুর্থ শতাব্দীর শেষের দিকে অথবা পঞ্চম শতাব্দীর শুরুর দিকে প্রতিষ্ঠিত হয়, যা ছিলো তক্ষশিলার পরেই বিশ্বের সর্বাধিক প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রথম আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়। গুপ্ত রাজবংশ কর্তৃক নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং গুপ্ত রাজবংশের প্রথম চন্দ্রগুপ্ত অথবা সমুদ্রগুপ্ত বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বলে মনে করা হয়।

নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ছিলো বর্তমান ভারতের বিহার প্রদেশের রাজগির-এ। নালন্দা ছিলো মূলত একটি গ্রামের নাম এবং নামকরণের অনেকগুলো ধারণার মধ্যে একটি ধারণা হলো, নালন্দা গ্রামের নাম অনুসারেই এর নামকরণ করা হয় নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়। নালন্দা শব্দের অর্থ ‘দানে অকৃপণ’। বিদ্যাদান ও বিস্তরণে নালন্দা সত্যিই অকৃপণ ছিলো।

মাঝামাঝি সময়ে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় বৌদ্ধ সম্রাট দ্বারা এবং শেষ পর্যায়ে পাল রাজাদের দ্বারা পরিচালিত হয়। জানা যায়, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরো কমপ্লেক্সটি লাল ইটের চওড়া এবং উঁচু দেয়াল দ্বারা সুরক্ষিত ছিলো। পুরো বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসটি ছিলো ১৫ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত এবং এর মধ্যে কেবল দশ শতাংশ খনন করা হয়েছে আর বাকি ধ্বংসাবশেষ এখনও মাটির নিচে রয়েছে।

নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ও গৌরবের ইতিহাস

নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময়টির কথা একবার একটু লক্ষ্য করুন। ৪২০-৩০ সালের দিকে যখন সারা পৃথিবীতে ধর্মশিক্ষা বা পারিবারিকভাবে শিক্ষালাভের বাইরে তেমনভাবে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার শুরুই হয়নি, ঠিক সেই সময়ে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় প্রায় দশ হাজার ছাত্র ও ২০০০ শিক্ষক নিয়ে সুপ্রতিষ্ঠিত। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বাধিক আলোচিত এবং চিত্তাকর্ষক ভবনটি ছিলো এর লাইব্রেরি। হাজার হাজার পবিত্র ও বিরল শাস্ত্রের জন্য গ্রন্থাগারটি নিজেই একটি বিশাল কমপ্লেক্স হিসাবে ব্যবহৃত হতো। একটি লাইব্রেরির ভবন নয়তলা উঁচু ছিলো।

ওই সময়েই বিশ্ববিদ্যালয়টিতে শব্দবিদ্যা, হেতুবিদ্যা, চিকিৎসাবিদ্যা, দর্শনশাস্ত্র, ধর্মশাস্ত্র, বৌদ্ধধর্ম, জ্যোতির্বিজ্ঞান, গণিত, শরীরতত্ববিদ্যা, সংগীত, চিত্রকলা এসব বিষয় পড়ানো হতো।  

পশ্চিমা বিশ্বের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তার বহুবছর পরে প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করেছে। কায়রোতে আল আজহার ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠিত হয় ৯৭২ সালে, যা নালন্দার প্রতিষ্ঠার পায় সাড়ে পাঁচশো বছর পর। তারপর ইতালির বোলোনিয়া ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১০৮৮ সালে এবং যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি ১০৯৬ সালে অস্তিত্বলাভ করে, যা ১১৬৭ সাল থেকে পূর্ণাঙ্গভাবে কাজ শুরু করে। বিখ্যাত কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি জন্ম নেয় ১২৩১ সালে ও আমেরিকার প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় ১৬১৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়।

চিনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙের বিবরণ থেকে জানা যায়, নালন্দার শিক্ষা ছিলো সম্পূর্ণ বিনামূল্যে। থাকা, খাওয়া, চিকিৎসা সবই ছিলো বিনামূল্যে। মূল ব্যয় বহন করতেন দেশের রাজা। জনসাধারণও স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে সন্ন্যাসী ও ছাত্রদের জন্যে খাদ্যদ্রব্য, বস্ত্র ইত্যাদি দান করতেন। এখানে মূলত স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষা প্রদান করা হতো। ভর্তি প্রক্রিয়া ছিলো অত্যন্ত প্রতিযোগিতাপূর্ণ কারণ দেশি-বিদেশি বহু শিক্ষার্থীর স্বপ্ন ছিলো নালন্দায় পড়াশোনা করার।

রাধা কুমুদ মুখার্জি তাঁর Ancient Indian Education গ্রন্থে হিউয়েন সাঙ-এর কথা লিখেছেন, “Foreign students came to the establshment to put an end to their doubts and then became celebrated.”

নালন্দায় পড়াশোনা অনেক বেশি শ্রুতিনির্ভর ছিল এবং শিক্ষার্থীদের চিন্তার জগৎকে প্রসারিত করাই ছিলো তার উদ্দেশ্য। বস্তগত প্রাপ্তি এই শিক্ষার উদ্দেশ্য ছিলো না, বরং শিক্ষালাভের মূল উদ্দেশ্য ছিলো “knowledge for knowledge sake”। অনেক বেশি আলোচনা, যুক্তি-পাল্টাযুক্তির আশ্রয়ে অধ্যয়ন চলতো।

হিউয়েন সাঙ আরও লিখেছেন (Mookerji, 2016), “There eminent and accomplished men assemble in crowds, discuss possible and impossible doctrines, and after having been assured of the excellence of their opinions by wise men, become far famed for their wisdom.”

এবার ভাবুন, তৎকালীন ভারতবর্ষ কতটা এগিয়ে ছিলো, কতটা এগিয়ে ছিলো আমাদের বঙ্গদেশ। ভারতের বিহার, মানে যেখানে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো, তা আমাদের বাংলা অঞ্চল থেকে খুব ‍দূরে তো ছিলোই না বরং আমাদের সাথে ওতোপ্রোতোভাবে সংযুক্ত ছিলো। সাধে কি আর বলা হতো, “What Bengal thinks today, India will think tomorrow and the rest of the world will think the day after tomorrow”- যদিও এই কথাটির জন্ম অনেক পরে ঊনিশের দশকে।

ঐতিহাসিক নিহাররঞ্জন রায় তাঁর বিখ্যাত “বাঙালির ইতিহাস (আদি পর্ব)” গ্রন্থে লিখেছেন, “নালন্দার মহাবিহারের সঙ্গে ষষ্ঠ-সপ্তম শতকীয় বাংলার জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিক্ষাদীক্ষার ঘনিষ্ঠ যোগাযাগ ছিল এবং বাংলার শিক্ষার্থী, আচার্য, রাজবংশ নালন্দা-মহাবিহারের সংবর্ধনের যে প্রয়াশ করিয়াছেন তাহা তুচ্ছ করিবার মতো নয়। এই মহাবিহারের মহাচার্য বিশ্রুতকীর্তি শীলভদ্র ছিলেন সমতটের ব্রাহ্মণ্য রাজবংশের অন্যতম সন্তান এবং তিনিই ছিলেন হিউয়েন সাঙ-এর গুরু।”

একই গ্রন্থে ঐতিহাসিক নিহাররঞ্জন রায় আরও উল্লেখ করেছেন, “বিক্রমশীলা বিহারের প্রতিষ্ঠাতাই তো ছিলেন পাল-রাজ ধর্মপাল স্বয়ং এবং ওদন্তপুরী ও নালন্দায় এ পর্বের বিদ্যার্থী ও আচার্যদের অধিকাংশই বাঙালি।”

নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র এই শীলভদ্রই সমস্ত শাস্ত্র ও সূত্রে সুপণ্ডিত ছিলেন। এই বৌদ্ধ সন্ন্যাসী ও দার্শনিকের জন্ম ৫২৯ সালে এবং তিনি হিউয়েন সাঙ-এর গুরু হিসেবেই সবচেয়ে বেশি পরিচিত। তাঁর গুরু ছিলেন ধর্মপাল।

হিউয়েন সাঙ-এর বিবরণী থেকেই জানা যায়, শীলভদ্র ৩০ বছর বয়সে একটি ধর্মীয় বিতর্কে দক্ষিণ ভারতের একজন ব্রাহ্মণকে পরাজিত করার পর রাজা তাঁকে পুরস্কার হিসেবে একটি নগরীর রাজস্ব গ্রহণ করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, যা তিনি গ্রহণ করেননি। পরে তিনি সেখানে শীলভদ্র বিহার নামে একটি মঠ স্থাপন করেছিলেন এবং সেই নগরীর রাজস্ব দিয়ে এটি পরিচালনা করা হতো। পরে তিনি নালন্দায় চলে আসেন এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এখানেই অধ্যাপনা করেন।

শীলভদ্রের কথা উল্লেখ করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও। তাঁর শিক্ষা গ্রন্থের ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপ’ প্রবন্ধে লিখেছেন, “তিনি বাংলাদেশের কোনো এক স্থানের রাজা ছিলেন, রাজ্য ত্যাগ করে বেরিয়ে আসেন। এই সঙ্গে যাঁরা শিক্ষাদান করতেন তাঁদের সকলের মধ্যে একলা কেবল ইনিই সমস্ত শাস্ত্র, সমস্ত সূত্র ব্যাখ্যা করতে পারতেন।”

শীলভদ্রের কথা বলতে গিয়ে একই প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ আরও বলছেন, “সেকালে বৌদ্ধভারতে সঙ্ঘ ছিল নানা স্থানে। সেই সকল সঙ্ঘে সাধকেরা শাস্ত্রজ্ঞেরা তত্ত্বজ্ঞানীরা শিষ্যেরা সমবেত হয়ে জ্ঞানের আালোক জ্বালিয়ে রাখতেন, বিদ্যার পুষ্টিসাধন করতেন। নালন্দা বিক্রমশীলা তাদেরই বিশ্বরূপ, তাদেরই স্বাভাবিক পরিণতি।”

একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মান কেমন তা অনেকখানি বোঝা যায় সেখান থেকে কেমন মানের শিক্ষার্থী বের হন এবং পরবর্তী জীবনে কতটা তার ছাপ রাখেন তা দিয়ে। এবার দেখি নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে মহাচার্য শীলভদ্র ছাড়া বিখ্যাত আর কারা এই বিদ্যাপীঠে অধ্যয়ন ও অধ্যাপনা করেছেন।

ধর্মপাল: হিউয়েন সাঙ-এর বিবরণী অনুসারে, ধর্মপালের জন্ম ৪৯০ সালে ভারতের তামিলনাড়ুর কাঞ্চিপুরমে। তিনি একজন উচ্চপদস্থ আধিকারিকের পুত্র এবং রাজার কন্যার সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন, কিন্তু বিবাহের উৎসবের প্রাক্কালে পালিয়ে যান। তিনি নালন্দায় এসে আচার্য দিগনাগের ছাত্র হিসাবে পড়াশোনা করেছিলেন। তিনি যোগশাস্ত্রের পণ্ডিত ছিলেন এবং পরবর্তীতে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের আধ্যাত্মিক পদে স্থলাভিষিক্ত হোন এবং তিনি তাঁর শেষ বছরগুলি বোধি গাছের কাছে কাটিয়েছিলেন এবং সেখানেই দেহত্যাগ করেন। ধর্মপাল একটি তত্ত্ব উদ্ভাবন করেন এবং তা হলো, বাহ্যিক জিনিসের কোনো অস্তিত্ব নেই এবং চেতনাই কেবল অস্তিত্বশীল।

আর্যভট্ট: আর্যভট্ট ৪৭৬ সালে বর্তমান ভারতের বিহারের পাটনায় জন্মগ্রহণ করেন এবং ভারতীয় গণিত ও ভারতীয় জ্যোতির্বিদ্যার শাস্ত্রীয় যুগের প্রথম গণিতবিদ-জ্যোতির্বিদদের মধ্যে প্রথম ছিলেন। তিনি একসময় নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান হিসেবে দ্বায়িত্ব পালন করেন। তিনিই বিখ্যাত ‘আর্য-সিদ্ধান্ত’-এর প্রণেতা। সবকিছু ছাপিয়ে তাঁর সবচেয়ে বড় অবদান হলো তিনি শূন্য (০) আবিষ্কার করেন, যা পৃথিবীতে গণিতশাস্ত্রে একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার।

প্রাচীন ভারতীয় গণিতবিদ আর্যভট্টের এই কীর্তির কথা আমরা নিজেরা অনেকেই না জানলেও, পশ্চিমা বিশ্ব কিন্তু ঠিকই জানে। আমাদের এই না জানার অন্যতম বড় একটি কারণ হচ্ছে কলোনিয়াল হ্যাঙওভার, যে কারণে আমরা, বিশেষ করে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিতজনেরা মনে করি, বাঙালি তথা ভারতীয়রা বরাবর অশিক্ষিতই ছিলো আর ইংরেজরা এসে আমাদের শিক্ষিত হওয়ার সুযোগ করে দিয়ে গেছে। আমরা আরও মনে করি, ইংরেজরা আসার আগে আমাদের তৎকালীন ভারতে শিক্ষাব্যবস্থা বলতে কিছুই ছিলো না।

অতীশ দীপঙ্কর: আনুমানিক ৯৮০ সালে জন্মলাভ করা বাংলার বিক্রমপুরের মানুষ জ্ঞানতাপস অতীশ দীপঙ্কর ছিলেন নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক। ১২ বছর বয়সে নালন্দায় তিনি ভর্তি হন এবং আচার্য বোধিভদ্র তাঁকে শ্রমণ রূপে দীক্ষা দেন। দীক্ষা গ্রহণের পর তাঁর নাম হয় দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান। নালন্দা থেকে ১৮ বছর বয়সে তিনি সর্বশাস্ত্রে পাণ্ডিত্য অর্জন করেন।

নালন্দার শিক্ষকদের গভীর জ্ঞান চীন, কোরিয়া, জাপান, তিব্বত, মঙ্গোলিয়া, তুরস্ক, শ্রীলঙ্কা এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মতো দূরবর্তী স্থানের পণ্ডিতদের আকর্ষণ করেছিল। এই বিদ্বানগণ এই অনন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ, স্থাপত্যকলা এবং শেখার বিষয়ের নানা স্বাক্ষর রেখে গেছেন। সর্বাধিক বিস্তারিত বিবরণগুলি চিনা পণ্ডিতদের কাছ থেকে এসেছে এবং এদের মধ্যে সবচেয়ে ‍উল্লেখযোগ্য নাম হিউয়েন সাঙ, যাঁর বিবরণী থেকেই নালন্দা সম্পর্কে সবচেয়ে ভালো জানা যায়।

প্রাচীন ভারতে গুরুকুলে বা আশ্রমের শিক্ষায় একসময় শিক্ষালাভের অধিকার ছিলো কেবল ব্রাহ্মণ সন্তানদের। বৌদ্ধবিহার-কেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থায় সেই বাধা কেটে যায়। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে বিষয়টি চমৎকার ছিলো তা হলো এর সর্বজনীনতা।

ঐতিহাসিক রাধা কুমুদ মুখোাপাধ্যায় তাঁর Ancient Indian Education গ্রন্থে আরও লিখেছেন, “The monks at Nalanda were not a homogeneous community. They were drawn from different denominations of the Buddhist Church and carried into the University all the strife and discord of its different sects and schisms.” (page 571)

নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় বহির্বিশ্বে কতটা বিখ্যাত ছিলো তারও প্রমাণ যায় নানাভাবে। ঐতিহাসিক রাধা কুমুদ মুখোাপাধ্যায় তাঁর Ancient Indian Education গ্রন্থে আরও লিখেছেন, “The success of Nalanda as seat of learnng is singularly demonstrated by the demand of foreign countries for the services of its trained scholars in introducing to them the saving knowledge and wisdom of India, which they were so keenly seeking.” (page 575)

বিশ্ববিদ্যালয়টির ধ্বংসের ইতিহাস

জ্ঞানের আালোক জ্বালিয়ে রাখা, বিদ্যার পুষ্টিসাধন করা গৌরবময় নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ১১৯৭ সালে তার অস্তিত্ব হারিয়ে ফেললো যখন পশ্চিমা বিশ্বের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সবে প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করেছে। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস করার মাধ্যমে জ্ঞানের উৎপত্তি ও তার বিস্তরণও যেন পূর্ব থেকে পশ্চিমে স্থানান্তরিত হলো। এখন আমরাও তাই ভাবি—আমাদের যা কিছু শিক্ষা সব এসেছে পশ্চিম থেকে—আমাদের যেন কিছুই ছিলো না! আমরা যেন কিছুই শেখাইনি পশ্চিমাদেরকে!

কে, কীভাবে ধ্বংস করলো নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়? প্রথমেই দেখি, Encyclopaedia Britannica কী বলছে।  

Encyclopaedia Britannica লিখেছে, “Nalanda continued to flourish as a centre of learning under the Pala dynasty (8th–12th centuries), and it became a centre of religious sculpture in stone and bronze. Nalanda was probably sacked during Muslim raids in Bihar (c. 1200) and never recovered.

এবার তাহলে দেখা যাক বাংলাপিডিয়া কী বলছে। বাংলাপিডিয়া বলছে, “বারো শতকের দিকে নালন্দা তার গুরুত্ব হারায়। তেরো শতকের প্রথম দিকে যখন ধর্মস্বামী নালন্দা পরির্দশন করেন ততোদিনে এর অতীত গৌরব লুপ্ত এবং এর অনেকগুলি স্থাপনা তু্র্কিদের হাতে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।” বাংলাপিডিয়াতে এটি লিখেছেন অধ্যাপক আকসাদুল আলম, ইতিহাস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

বিষয়টি আরও পরিষ্কার করে বুঝতে এবার একটু ইতিহাসের আশ্রয় নেওয়া যাক। বিখ্যাত ঐতিহাসিক Story of Civilization গ্রন্থের রচয়িতা Will Durant তাঁর গ্রন্থের প্রথম ভলিউম Our Oriental Heritage (p. 558) লিখেছেন, “The Mohemmedans destroyed nearly all the monasteries, Buddhist or Hindu, in northern India. Nalanda was burned to the ground in 1197 and all its monks were slaughtered; we can never estimate the abundant life of ancient India from what these fanatics spared.”

পারসিয়ান ঐতিহাসিক Minhaj al-Siraj তাঁর Tabaqat-i-Nasiri গ্রন্থে লিখেছেন, “With its high wall, its large buildings, Nalanda seemed like a well-endowed fortress to Ikhtiyar-ud-din and his force. He advanced upon it with two hundred horsemen “and suddenly attacked the place”. The greater number of inhabitants of that place were Brahmans, and the whole of those Brahmans had their heads shaven, and they were all slain. There were a great number of books there; and when all these books came under the observation of the Musalmans, they summoned a number of Hindus that they might give them information respecting the import of those books; but the whole of the Hindus had been killed. On being acquainted (with the contents of the books), it was found that the whole of that fortress and city was a college, and in the Hindu tongue, they call a college, Bihar [vihara].”

তিনি আরও লিখেছেন, “When that victory was effected, Muhammad-i-Bakhtiyar returned with great booty, and came to the presence of the beneficent sultan, Qutb-ud-din I-bak, and received great honour and distinction…”

এবার তাহলে আমরা সরাসরি ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ-বিন-বখতিয়ার খিলজির নাম পাচ্ছি যার নেতৃত্বে ধ্বংস করা হয়েছিলো নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়।

বাঙালি ঐতিহাসিক দীনেশ চন্দ্র সেন তাঁর ইতিহাসের প্রামাণ্য দলিল ‘বৃহৎ বঙ্গ’ গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে (পৃষ্ঠা ৫২৭) লিখেছেন, “মহম্মদ বক্তিয়ার যেমনি কুৎসিতদর্শন ছিলেন, তেমনি খুব ক্রুর ও নির্ম্মম ছিলেন। বিহারে তিনি এরূপ নির্ব্বিচারে হিন্দুদিগকে হত্যা করিয়াছিলেন যে, সঙ্ঘারামের সম্বন্ধে মোটামুটি কয়েকটা প্রশ্ন করিয়া বিষয়টা জানিবার চেষ্টা করিয়া শুনিলেন নগরে একটিও হিন্দু নাই। একটা বিরাট সঙ্ঘারামকে তাহারা দূর্গ বলিয়া ভ্রম করিয়া আক্রমণ করিলেন। মুণ্ডিত-মস্তক নিরীহ বৌদ্ধাচার্যগণকে শত্রু-সেনাপতি মনে করিয়া অসহায় অবস্থায় ও অরক্ষিতে তাঁহাদের জীবন নষ্ট করিলেন, তখন পর্যন্তও খিলজি বুঝিতে পারেন নাই যে তিনি শত শত একান্ত নিরীহ, অধ্যয়নরত শ্রমণগণের প্রাণ নষ্ট করিয়াছেন। তাহার চক্ষু আসিয়া ঠেকিল বিহারের বিরাট পাঠাগারের প্রাচীরের নিকট।”

জানা যায়, কয়েক বছর পরে, কিছু সন্ন্যাসী সাইটে ফিরে আসার সাহস করেছিলেন। তবে এটি পুড়ে কালো হয়ে গিয়েছিলো এবং ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ-বিন-বখতিয়ার খিলজির সন্ত্রাসের হৃদয়হীন ক্রোধের কারণে চেষ্টা করা হলেও নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় তেমন আকর্ষণ অর্জন করতে পারেনি।

তাহলে তো আর সন্দেহের অবকাশ থাকে না, প্রাচীন ভারতের জ্ঞান-বিজ্ঞানের আধার নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়কে কারা কীভাবে ধ্বংস করেছিলো। যারা মনে করেন, বাঙালি তথা ভারতীয়রা চিরকাল অশিক্ষিতই ছিলো, আর ইংরেজরা এসে আমদের শিক্ষিত হওয়ার সুযোগ করে দিয়ে গেছে, এসব তথ্য তাদের জন্যে কাজের হতে পারে। যারা মনে করেন, ইংরেজরা আসার আগে আমাদের তৎকালীন ভারতে শিক্ষাব্যবস্থা বলতে কিছুই ছিলো না, এসব তথ্য তাদের চিন্তার খোরাক দিতে পারে। বিশ্বের ইতিহাসে আমরাই যে প্রথম আক্ষরিক অর্থেই একটি আন্তর্জাতিক মানের বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তুলেছিলাম তার প্রমাণ তো পাওয়া গেলো!

কে জানে, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় এবং এরকম আরো কিছু প্রাচীন ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস করা না হলে এবং দিনে দিনে তাদের শ্রীবৃদ্ধি ঘটলে জ্ঞান-বিজ্ঞানে বর্তমান বিশ্বে ভারতীয় উপমহাদেশই হয়তো নেতৃত্ব দিতো আজ। অথবা নেতৃত্ব দিতে না পারলেও পশ্চিমা শিক্ষাপণ্যের কেবল গ্রহীতা না হয়ে দান ও গ্রহণ দুইই করতে পারতো— রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ওই কথার মতোই, “দেবে আর নেবে, মিলাবে মিলিবে, যাবে না দূরে।”

নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে এই লেখাটির ভিডিও দেখতে পারেন এখানে:

Sending
User Review
5 (1 vote)

লেখক সম্পর্কে

সুদেব কুমার বিশ্বাস

সুদেব কুমার বিশ্বাস

সুদেব কুমার বিশ্বাস পেশায় একজন শিক্ষাজীবী এবং কাজ ক‌রেন এক‌টি আন্তর্জা‌তিক উন্নয়ন সংস্থায়।

মন্তব্য লিখুন

4 মন্তব্য

  • তাহলে তো আর সন্দেহের অবকাশ থাকে না নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়কে কারা কীভাবে ধ্বংস করেছিলো – আপনি কি মীন কোরেছেন তা কিনতু সবাই বোঝে। কিনতু আপনি আসোল ইতিহাস এড়ায়ে জাইয়া নকোল নিয়ে আছেন মশাই। নকোল কোইরা পাশ দিছেন তো বোঝা জাচ্ছে।

    • কি জ্ঞান আপনার! বিশ্বাস মানে নমশুদ্র,মানে শিডল( শিডিউল) কাস্ট! বাঃ বাঃ!
      আমরা চাইব, সুদেব কুমার বিশ্বাসের লেখা বইগুলো বিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তক হোক।
      প্রতিবাদ করার আগে পড়াশোনা করে বাংলা বানান গুলো ঠিক করতে হবে।

  • আর আপনি নিজে তো বিশ্বাস, মানে শিডল কাস্ট, মানে নমো শুদ্দুর। আপনের, মানে আপনার অতিত ব্রাহ্মনদের অত্যাচারে জর্জরিত হেইডা বিলকুল ভুইলে গেলেন মশাই???