বিজ্ঞান শিক্ষা : পরিপ্রেক্ষিত বাংলাদেশ

মিহির হালদার লিখেছেন বিজ্ঞান শিক্ষা নিয়ে

আমরা বিজ্ঞানের যুগে বাস করছি। চারপাশে আমরা লক্ষ্য করলেই দেখতে পাবো শুধু বিজ্ঞানেরই জয়ধ্বনি। সুতরাং আমারা যদি বর্তমান বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে চাই, তবে বিজ্ঞান শিক্ষা ও তার বিস্তার হওয়া অতীব জরুরি। গেল বছরের দিকে একটু দৃষ্টি দিলে আমরা দেখতে পাব বেশ  চোখে পড়ার মতো নতুন কিছু বিষয়। যেমন আউটসোর্সিং ও সফটওয়ারের কলেবর বৃদ্ধিসহ বেশ অগ্রগতি হয়েছে, গত বছরের ডিসেম্বরের শেষ দিকে এসে চালু হয়েছে ই-পেমেন্ট গেটওয়ে; ই-কমার্সের ক্ষেত্রে এটি অবশ্যই একটা বড় অর্জন। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে বড় বড় ব্যাংক এতে যুক্ত হলে কাজ অনেক এগিয়ে যাবে এবং সহজ হবে পাশাপাশি বাড়বে অনলাইন লেনদেন।

এছাড়া দেশে প্রযুক্তির আরেকটি নতুন সংযোজন হলো মোবাইল ফোনে থ্রি-জি (থার্ড জেনারেশন) সেবা চালু। অর্থাৎ এখন থেকে চাইলে মোবাইলেই আমরা অনেক ধরনের সেবা পেতে পারি যা ভিডিও আকারে আমরা দেখব ও শুনতে পারব। স্বাস্থ্য ও কৃষিখাতে প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েছে। অথচ অন্যদিকে গত বছরে সরকারি কার্যক্রমে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার তেমনভাবে লক্ষ্য করা যায়নি, সঠিক তথ্যপ্রাপ্তিতে ও সুবিধা-সেবা পেতে তাই সাধারণ লোকের ভোগান্তির শেষ নেই। সব মিলিয়ে আমাদের বড় কিছু অর্জন না হলেও শক্ত একটা ভিত্তি গড়ে উঠেছে। এর ফল আগামীতে আমরা অবশ্যই পাব। আশা রাখি, জ্ঞানবিজ্ঞানের বৃহৎ তরী তরুণেরাই এগিয়ে নিয়ে যাবে, পালে হাওয়া যোগাবে তাদের ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা। তাই তরুণদেরকে দেখাতে হবে সঠিক দিকনির্দেশনা বা গাইডলাইন।

নায়েম (ন্যাশনাল একাডেমী অফ এডুকেশনাল ম্যনেজমেন্ট)-এর একটি গবেষণা মতে, দেশে বিজ্ঞান শিক্ষা ও শিক্ষার্থী কমে যাচ্ছে বেশ উল্লেখযোগ্যহারে; এর একটি প্রধান কারণ হিসাবে দেখানো হয়েছে শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের অভাব। এছাড়া প্রতিষ্ঠানগুলোতে দরকারি নানা বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির অভাব ও শিক্ষার্থীর অভিবাবকদের আর্থিক অসচ্ছলতাও কারণ হিসাবে দেখানো হয়েছে। বিশ্ব আজ মেতেছে মানুষের স্টেম সেল নিয়ে গবেষণায় অথবা ঈশ্বর কণা বা গডস পার্টিকেল আবিষ্কার করতে। সার্নের অনেক বিজ্ঞানীর তাই নাওয়া-খাওয়া নেই। যুক্তরাষ্ট্র যেখানে পানির নিচে নজরদারি পরিচালনায় বিশাল নেটওয়ার্ক ‘ওশান অবজারভেটরিস ইনিশিয়েটিভ’ তৈরি করতে এক মুহূর্ত ফুরসত পাচ্ছে না, বাংলাদেশ সেখানে প্রযুক্তি বিদ্যাকে খাতাকলমে লিপিবদ্ধ করে রেখেছে, প্র্যাকটিস করার সুব্যবস্থা নাই। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে আমরা বিজ্ঞান শিক্ষা নিয়ে শিশুকাল অতিবাহিত করেছি মাত্র, পাড়ি দিতে হবে অনেকদূর। তদুপরি আমাদের বুক গর্বে ভরে যায় যখন আমরা দেখি, যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত সালমান খানের খান একাডেমী বিশ্ব স্বীকৃতি পায়। ড. মাকসুদুল  আলম পাটের ছত্রাক আবিষ্কার করে বিখ্যাত হন। আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশের ছাত্ররা ভালো করছে ।

ড. জাফর ইকবাল বলেন, আমাদের বাচ্চারা অবশ্যই ট্যালেন্টেড কিন্তু তাদেরকে যোগ্য শিক্ষকের কাছে শিখতে পাঠাতে হবে, তবেই তাদের সুপ্তপ্রতিভা প্রকাশ পাবে। আমরা জানি, প্রত্যেক তরুণের নিজস্ব ভাবনা আছে দেশকে নিয়ে। তারা দেশের জন্য অনেক কিছু করতে চায়, অথচ আমরা নানাভাবে তাদের ইচ্ছাশক্তিকে অঙ্কুরে বিনষ্ট করছি। দেশের প্রত্যেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দরকার গবেষণা করার সুব্যবস্থা করা, শিক্ষক-শিক্ষার্থী সবাই মিলে সেটা নিশ্চিত করতে পারে। দরকার বিজ্ঞান শিক্ষা পর্যাপ্ত শিক্ষাবৃত্তির ব্যবস্থা করা এবং দরকার আত্মশক্তির উদ্বোধন। তাহলে শিক্ষার্থীরা ইচ্ছাকৃতভাবেই বিজ্ঞান শিক্ষায় মনোযোগী হবে। বিজ্ঞান পাঠের সুফল নিয়ে বিভিন্ন সেমিনারের আয়োজন করা যেতে পারে। এছাড়া বিভিন্ন বিজ্ঞান মেলার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের প্রতিভা অন্বেষণ করা যেতে পারে। যদিও এখন কিছু স্কুলে বিজ্ঞান মেলা হচ্ছে; তবে তা শহরের স্কুলগুলোতেই সীমাবদ্ধ। সব মিলিয়ে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।

বাংলাদেশের নতুন শিক্ষানীতি ২০১০-এ বিজ্ঞান শিক্ষা বিষয়ে বেশ কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। বর্তমানে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে যে পাঠ্যবই পড়ানো হচ্ছে, তাতে শিক্ষানীতির অনেক সফল বাস্তবায়ন হয়েছে। ২০১৩ সালে তরুণদেরকে অনেক নতুন চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে হবে, কারণ বিজ্ঞানীদের মতে, গত দশ বছরে বিজ্ঞানের যে অগ্রগতি তা আগামী পাঁচ বছরে দ্বিগুণ হারে বাড়বে। সারা বিশ্বের মতো তাই বিজ্ঞান শিক্ষায় আমাদের দেশকে ঢেলে সাজান দরকার। তৈরি হওয়া দরকার অনেক প্রযুক্তি ব্যবহারক্ষেত্র। সর্বোপরি দেশের বিজ্ঞান শিক্ষার উন্নতিকল্পে নিম্নোক্ত সুপারিশ রাখা হল:
ক) বিজ্ঞান শিক্ষার অবকাঠামোগত উন্নয়ন সাধন;
খ) পর্যাপ্ত বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা;
গ) শিক্ষক প্রশিক্ষণ;
ঘ) আগ্রহানুযায়ী শিক্ষার্থীদের মতের মূল্যায়ন;
ঙ) বিজ্ঞানমেলা শহরে ও গ্রামে;
চ) শিক্ষার্থীদের বাধ্যতামূলক জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘর ভ্রমণ;
ছ) শিক্ষাবৃত্তি বাড়ান;
জ) গবেষণার দ্বার উন্মোচন করা।

উপর্যুক্ত বিষয় ছাড়াও বিজ্ঞান শিক্ষার জন্য আরও অনেক বিবেচ্য বিষয় আছে তবে শেষোক্ত বিষয়গুলো আগে বাস্তবায়ন করা জরুরি। বিজ্ঞান শিক্ষার কারণে জনবহুল দেশ চীন-ভারত আজ বিশ্বের কাছে এক বিস্ময়। তাদের মতো বাংলাদেশের জনগণও তখন আর দেশের জন্য বোঝা হবে না যদি প্রকৃত বিজ্ঞান শিক্ষার সুপ্রয়োগের মাধ্যমে সুফল প্রতিটি জনগণ পায়।

মিহির হালদার: শিক্ষার্থী, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

জনপ্রিয় নিবন্ধ

প্রাথমিক স্তরে ভাষা শেখা : বিষয় – বাংলা

ভাষার দক্ষতা চারটি— শোনা, বলা, পড়া, লেখা। আর ভাষা...

আগে ইংরেজি গ্রামার শিখবো, নাকি ভাষা শিখবো?

কোন ভাষার গ্রামার হলো ঐ ভাষার গঠন প্রকৃতি যার...

শিক্ষাব্যবস্থার হালচাল

অর্থনীতিবিদদের মতে, শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ সবচেয়ে লাভজনক এবং নিরাপদ রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ। অর্থনীতিবিদ এডাম স্মিথ, ডেভিড রিকার্ডো এবং মার্শালের মতে, শিক্ষা এমন একটি খাত যার কাজ হলো দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলে পুঁজির সঞ্চালন ঘটানো। শিক্ষার অর্থনীতি নিয়ে মৌলিক গবেষণায় অর্থনীতিবদ আর্থার শুল্জ ও রবার্ট সলো দেখিয়েছেন যে, প্রাথমিক শিক্ষায় বিনিয়োগ করলে সম্পদের সুফল ফেরত আসে ৩৫ শতাংশ, মাধ্যমিক শিক্ষায় ২০ শতাংশ, এবং উচ্চ শিক্ষায় ১১ শতাংশ।

আমেরিকায় উচ্চশিক্ষা : পিএইচডির পর কী?

আমেরিকায় উচ্চশিক্ষা নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হয়, আমি নিজেও এ-নিয়ে...

ক্যাডেট কলেজে ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে কিছু কথা

ক্যাডেটসমূহ বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনে এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে।...

আরও কিছু লেখা

অধিক

    স্বায়ত্তশাসন নামক মৃতদেহের নখ এবং ইউজিসি কর্তৃক প্রস্তাবিত অভিন্ন নীতিমালা

    পরেশ চন্দ্র বর্মণ লিখেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন ও ইউজিসির প্রস্তাবিত...

    কীভাবে বাড়াবেন লেখার দক্ষতা

    বাস্তব জীবনে আমাদের অনেক কিছু লিখতে হয় অফিসিয়াল কারণে,...

    বাংলাদেশে শিক্ষাব্যবস্থায় বিদ্যমান সমস্যা সমাধানে প্রস্তাবনা

    আদর্শ শ্রেণিকক্ষে দক্ষ ও যোগ্য শিক্ষক যদি সময়ের চাহিদা পূরণে সক্ষম এমন বিষয়বস্তু সম্বলিত পাঠ্যপুস্তক অনুসরণ করে আধুনিক শিখন-শেখানো পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীকে শিক্ষালাভে সহায়তা করেন এবং যথাযথভাবে মূল্যায়ন করেন তবেই সম্ভব হবে আকাঙ্ক্ষিত মাত্রায় শিখনফল অর্জন। সার্থক হবে শিক্ষাব্যবস্থা, অর্জন করা সম্ভব হবে শিক্ষার প্রকৃত লক্ষ্য

    ডাচ শিক্ষাব্যবস্থা : ভবিষ্যতের পথরেখা

    ডাচ শিক্ষাব্যবস্থা বিদ্যালয়-কর্তৃপক্ষ অষ্টম শ্রেণিতে ওঠার পর সব শিক্ষার্থীকে...

    ইন্টার্নশিপ হতে পারে সমাজ বদলের হাতিয়ার

    আমি আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পারি যে, একজন শিক্ষার্থী যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করে তখন তার মাঝে দেশপ্রেমের নেশা প্রবল হয়ে দেখা দেয়। আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করি, তখন কতো চিন্তা মাথায় ভর করতো তার ইয়াত্তা নেই। মনে হতো এই এডুকেশন সিস্টেম পাল্টাতে হবে, এটা করতে হবে, ওটা করতে হবে। এরপর যখন প্র্যাকটিস টিচিং-এ গেলাম, তখন কত স্বপ্ন মাথায় ভর করতো। রাত জেগে জেগে শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ পরিকল্পনা করা, উপকরণ তৈরি করাতে মত্ত হয়ে পড়তাম। এটা-ওটা ঘেটে তাদের জন্য লেকচার তৈরি করতাম। আর সেই আমরাই যখন কর্মজীবনে প্রবেশ করি তখন হয়ত কাজের চাপে আর নানান চাপে এ কাজ আর করা হয় না। তখন দায়সারাভাবে ক্লাশ নিতে পারলেই বাঁচি।

    করোনায় নেদারল্যান্ডসের শিক্ষা

    করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সুইডেনের পরে ইউরোপে সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে...

    বিদ্যালয়ে ভর্তির কোটা: অপ্রয়োজনীয় ভাবনার প্রতিক্রিয়া

    সংসদ সদস্যদের জন্য কোটা রাখার ব্যবস্থাটি গ্রহণযোগ্য ও বাস্তবসম্মত কিনা, সেটা বুঝার জন্য খুব বেশি চিন্তার প্রয়োজন পড়ে না; কিন্তু তিনি কী কারণে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য পর্যন্ত মন্ত্রণালয়ের অপেক্ষা করতে হলো তা বুঝা গেল না। গ্রহণযোগ্য ও বাস্তবসম্মত হওয়ার বিষয়টি কি তাহলে শুধু প্রধানমন্ত্রীর উপরই নির্ভর করছে? একটি দেশের প্রধানমন্ত্রীকে বড় বড় অনেক কাজ করতে হয়, অনেক সিদ্ধান্ত নিতে হয়, নানা কিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়। এরকম একটি আপাত ছোট বিষয়কে 'গ্রহণযোগ্য ও বাস্তবসম্মত' করার জন্য প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত যেতে হলো কেন? দেশের তাবত সিদ্ধান্তের জন্য কি তাহলে প্রধানমন্ত্রীর মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে? অন্য মন্ত্রীরা তাহলে কী জন্য আছেন?

    প্রাসঙ্গিক নিবন্ধসমূহ

    নতুন লেখার খবর পান ইমেইলে
    বাংলাদেশের শিক্ষা প্রসঙ্গে নতুন লেখা প্রকাশিত হলে সেই খবর পৌঁছে যাবে আপনার ইমেইলে।