বাড়ি উচ্চশিক্ষা

বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা ও গবেষণা: পর্ব ১

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আমার লেখালেখি যারা অনুসরণ করেন, তারা নিশ্চই অবগত যে আমি শিক্ষা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পেশাকে নিয়ে কী পরিমাণ আলোচনা-সমালোচনা করি। শুধু আমি নই, শিক্ষকতায় যারা আছেন তারা সবাই কমবেশি আলোচনা ও সমালোচনা করেন।

অনেক সময় সমালোচনাগুলো নিজেদের স্বার্থের বাইরেও যায় যা আবার বৃহত্তর কল্যাণ আনার সহায়ক হতে পারে। এনভেলপ মানির বিরুদ্ধে বলেছি, পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ন ও প্রশ্নপত্র প্রণয়নে টাকা পাওয়ার বিরুদ্ধে বলেছি, গবেষণার মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছি, জার্নালের মান নিয়ে, নিয়োগ পদ্ধতির সমালোচনা করে লিখেছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মান নিয়ে বলেছি। এরকম পাবেন অন্য কোনো পেশায়?


কীভাবে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে উন্নত করা যায়, কীভাবে নিয়োগ ও প্রমোশন নীতি আরো কঠিন থেকে কঠিনতর করা যায় ইত্যাদি নিয়ে নানা সময় অনেক কঠিন কথা বলেছি। আমার সহকর্মী শিক্ষকসমাজ তাই বলে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে আমাকে গালমন্দ করেননি। বরং তারাও নানা পরামর্শ দিয়ে আলোচনাকে আরো প্রাণবন্ত ও শাণিত করেছেন এবং করছেন।


কীভাবে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে উন্নত করা যায়, কীভাবে নিয়োগ ও প্রমোশন নীতি আরো কঠিন থেকে কঠিনতর করা যায় ইত্যাদি নিয়ে নানা সময় অনেক কঠিন কথা বলেছি। আমার সহকর্মী শিক্ষকসমাজ তাই বলে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে আমাকে গালমন্দ করেননি। বরং তারাও নানা পরামর্শ দিয়ে আলোচনাকে আরো প্রাণবন্ত ও শাণিত করেছেন এবং করছেন। আবার আমি কিছু লিখলে আমার সহকর্মীরা ঝাঁপিয়ে পড়ে বলেননি “জি স্যার”, “সহমত স্যার”, “ঠিক বলেছেন স্যার”। বরং উল্টোও ঘটছে। এমনি এমনি শিক্ষকতাকে মহান পেশা বলা হয় না। অনেক কারণের মধ্যে এটিও একটি বড় কারণ।

কয়েকদিন আগেও আমরা কিছু শিক্ষক মিলে “কেমন বিশ্ববিদ্যালয় চাই” শিরোনামে একটি কনভেনশন করেছি। সেখানে কেমন আলোচনা আর সমালোচনা হয়েছে সেটি কেউ কল্পনাও করতে পারবে না। নিজেরা নিজেদের সমালোচনা করে নিজেদের পেশাকে আরো উন্নত করতে চাই। নানা কারণে পারছি না; কিন্তু করতে পারার একটি আকাঙ্ক্ষা এই পেশায় সদা বিদ্যমান। ওই আলোচনা-সমালোচনা কোনো বদ্ধ ঘরে ছিল না। রীতিমতো খোলাখুলি। তারপর আবার সংবাদ সম্মেলন করে জানানোও হয়েছে।

শিক্ষকতা পেশা নিয়ে কি কেবল শিক্ষকরাই বলছেন? মোটেও না। সমাজের প্রায় সকল স্তরের মানুষ বলেন। এমনকি টক-শোতে গিয়েও বলেন। বক্তব্যগুলো অনেক সময় কটু ও বাঁকা হয়। তাতেও কিন্তু শিক্ষক সমাজ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে উত্তর দেন না। কারণ শিক্ষকরা জানেন, আলোচনা ও সমালোচনার মাধ্যমেই কেবল নতুন নতুন আইডিয়া বের হয়ে আসবে। সহমত ভাই, জি স্যার ইত্যাদি তোষামোদি শব্দের ব্যবহার খুব কমই এখানে হয়। এই খোলামনটাই তো বেশি করে চাই।

রাষ্ট্র এবং প্রতিষ্ঠানের কাজ প্রতিভা লালনের পরিবেশ দেওয়া

আমি যখন Abdus Salam International Center for Theoretical Physics-এ কনডেন্সড ম্যাটার ফিজিক্সে ডিপ্লোমা করি, তখন দক্ষিণ কোরিয়ার মেয়ে Hae-Young Kee ছিলো আমার সহপাঠী। আমরা দুজনেই একই সুপারভাইজরের সাথে থিসিস করেছি। সে ছিল আমার ক্লাসের সেরা। গত রাতে হঠাৎ করে জানতে ইচ্ছে করছিল সে কোথায় আছে এবং কেমন করছে। বর্তমানে সে কানাডার টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং একজন তুখোড় গবেষক। বর্তমানে তার ১৮২টি গবেষণা প্রবন্ধ বিশ্বখ্যাত বিভিন্ন জার্নালে যেমন PRL, PRB, PNAS, Nature, Nature Physics Nature Communications ইত্যাদিতে প্রকাশিত হয়েছে। ২০১৮-তে সেরা পদার্থবিদ হিসাবে নির্বাচিত হয়েছে। কানাডার বিভিন্ন জাতীয় বড়বড় কমিটির সদস্য।

আমাদের সময় হাই এনার্জি ফিজিক্সেও ডিপ্লোমা কোর্স চালু হয়েছিল। সেই কোর্সের সেরা ছাত্র ছিলো আমাদের বাংলাদেশের একজন। ও ওখানে সবাইকে চমক লাগিয়ে দিয়েছিলো। ও যেন সেখানে ছিলো একটি স্ফুলিঙ্গ। সেখান থেকে আমেরিকায় পিএইচডি, তারপর অক্সফোর্ডে পোস্টডক, তারপর ডেস্টিনেশন বাংলাদেশ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিতে গিয়ে প্রথম ধাক্কা— “তোমারতো মাস্টার্স নেই”! মাস্টার্স নেই কিন্তু মাস্টার্সের আব্বা ICTP-র ডিপ্লোমা, আমেরিকায় পিএইচডি, অক্সফোর্ডে পোস্ট-ডক আছে। তাতে কী? তোমার তো মাস্টার্স নেই?


আমি যে বলি এদেশ হলো ট্যালেন্টস-হন্তা। প্রাকৃতিকভাবে আমরা কিছু ট্যালেন্টেড ছেলেমেয়ে পেয়ে যাই কিন্তু তাদের প্রস্ফুটিত হওয়ার জন্য পরিবেশ দিতে পারি না।


সেই সময় আমাদের প্রাণপ্রিয় শিক্ষক হারুন স্যার না থাকলে হয়তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হতো না। ফিরে তাকালে মনে হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে না হলে কি খারাপ হতো, না ভালো হতো? কোরিয়ার ওই মেয়ে Hae-Young Kee যদি কানাডায় না গিয়ে কোরিয়ায় ফিরে যেতো? অথবা সে কোরিয়ার না হয়ে যদি বাংলাদেশের হতো এবং বাংলাদেশে ফিরে আসতো? এর উত্তর আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। আমি যে বলি এদেশ হলো ট্যালেন্টস-হন্তা। প্রাকৃতিকভাবে আমরা কিছু ট্যালেন্টেড ছেলেমেয়ে পেয়ে যাই কিন্তু তাদের প্রস্ফুটিত হওয়ার জন্য পরিবেশ দিতে পারি না।

শিক্ষক-মূল্যায়নের ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় একটি দিকে খুব গণতান্ত্রিক। সকল শিক্ষককে এককাতারে ফেলা। হীরা-সোনা-তামা-পিতল-লোহাকে আলাদা করতে জানতে হবে। ভালো শিক্ষককে মূল্যায়ন করতে হবে। এই মূল্যায়নের ব্যবস্থাই এখানে পুরোপুরি অনুপস্থিত। সারা পৃথিবীতে প্রতিবছর শিক্ষকদের সেরা শিক্ষক, সেরা গবেষক ইত্যাদি পুরস্কারে ভূষিত করার ব্যবস্থা করা হয়। ফলে অনেকেই ভালো করতে চায়। এই চাওয়াটাই সিস্টেমের মধ্যে একটি ড্রাইভিং ফোর্স তৈরি করে যা একটি প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ তৈরি করে।


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একসময় প্রমোশন পাওয়া অনেক কঠিন ছিলো। আজকাল নিয়োগ পাওয়া যেমন সহজ, প্রমোশন পাওয়াও তেমনি সহজ। নিয়োগ পেতে হলে ন্যূনতম যোগ্যতা থাকলে আর দলীয় আশির্বাদ থাকলেই হলো। আমরা যদি নিয়োগ আর প্রমোশনের ক্ষেত্রে ‘মেধা’কে একমাত্র বিবেচ্য বিষয় ধরতাম আর অন্যসব সংশ্লিষ্টতাকে থোড়াই কেয়ার করতাম, তাহলে আমরা অন্যরকম এক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গড়তে পারতাম।


এই পরিবেশ যেখানে অনুপস্থিত থাকে, সেখানে আবর্জনা জমবে। জমে একদিন পচে দুর্গন্ধ ছড়াবে। আমরা এখন সেই দশায় আছি। এখানে প্রমোশন দেওয়া হয় বয়স দিয়ে। এর চেয়ে অসভ্য নীতি বর্তমান বিশ্বে আর হয় না। এখানে অধ্যাপক হওয়ার জন্য ন্যূনতম ১২টি প্রবন্ধ প্রকাশের কথা বলা হয়েছে। এই সংখ্যা দিয়ে পশ্চিমা বিশ্বে এমনকি ভারতেও সহকারী অধ্যাপকও হতে পারবে না। আবার একবার অধ্যাপক হয়ে গেলে হয় অবসরের মতো জীবনযাপন করে কিংবা পুরোপুরি রাজনীতিই মনোনিবেশ করে। কারণ আর কিছু পাওয়ার রাখিনি। যদি এমন হতো এখানেও কেউ ভালো করলে অন্যকে ছাড়িয়ে সিনিয়র হতে পারতো তাহলেও অবস্থা ভিন্ন হতো।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একসময় প্রমোশন পাওয়া অনেক কঠিন ছিলো। আজকাল নিয়োগ পাওয়া যেমন সহজ, প্রমোশন পাওয়াও তেমনি সহজ। নিয়োগ পেতে হলে ন্যূনতম যোগ্যতা থাকলে আর দলীয় আশির্বাদ থাকলেই হলো। আমরা যদি নিয়োগ আর প্রমোশনের ক্ষেত্রে ‘মেধা’কে একমাত্র বিবেচ্য বিষয় ধরতাম আর অন্যসব সংশ্লিষ্টতাকে থোড়াই কেয়ার করতাম, তাহলে আমরা অন্যরকম এক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গড়তে পারতাম। সেরকম একটি বিশ্ববিদ্যালয় হলে দেশের চেহারা ১০ বছরের মধ্যে পাল্টে যেত। এর ছাপ পড়তো বাংলাদেশের সকল ক্ষেত্রে। একটি বিশ্ববিদ্যালয় যে কী করতে পারে সেটি ইংল্যান্ডের দিকে তাকালে বোঝা যায়, আমেরিকার দিকে তাকালে বোঝা যায়, এখন চীনের দিকে তাকালেও বোঝা যায়। যারা দলীয় স্বার্থ, স্বীয় স্বার্থ দেখে শিক্ষক নিয়োগ দেয় তারা দেশের শত্রু বলে মনে করি। (চলবে)

2 মন্তব্য

  1. As it is almost impossible to talk against government’s wrongdoings in this corrupted era tightly controlled by political powers, it is comparatively possible of raising voice against educational irregularities and improving this vital sector, which could also be resulted in positive changes in other sectors, we should be vocal vehemently.

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Exit mobile version