মহামারীর কালে শিক্ষা নিয়ে প্রয়োজন ছিলো নানামুখী উদ্যোগ নেওয়ার। ছবিসূত্র: ইউরোপিয়ান কমিশন
মহামারীর কালে শিক্ষা নিয়ে প্রয়োজন ছিলো নানামুখী উদ্যোগ নেওয়ার। ছবিসূত্র: ইউরোপিয়ান কমিশন

২০১৯ সালের শেষের দিকে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হয় পৃথিবীব্যাপী। ২০২০ সালের মার্চ মাসের দিকে বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী সনাক্ত হয় এবং এরপর মার্চ মাসের ১৮ তারিখ থেকেই এদেশের যাবতীয় স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ রয়েছে। করোনাভাইরাসে সংক্রমণ যে বাংলাদেশে অবশ্যম্ভাবী ছিল সে ব্যাপারে কারো দ্বিমত থাকার কথা নয়। বিশেষ করে, এতো শ্রমজীবি প্রবাসী রয়েছেন যাঁদের দেশে ফিরে আসাটাই ছিলো একমাত্র পথ। সুতরাং, দ্বার বন্ধ করে এই সংক্রমণ রোখা যেতো না। প্রয়োজন ছিলো আগাম পরিকল্পনার। স্বাস্থ্যখাতে তো বটেই, মহামারির কালে শিক্ষা সেক্টরেও প্রয়োজন ছিল আগাম পরিকল্পনার।

কিন্তু, বিপদ আসন্ন জেনেও আমরা বসে রইলাম। মার্চ মাস অবধি আমরা বিশ্বাসই করতে চাইছিলাম না যে, করোনা এইদেশে সবকিছু স্থবির করে দিবে। আমরা যেন এক ধরনের ডিনায়ালের মধ্যে চলে গিয়েছিলাম। এই ডিনায়ালের কারণেই আমরা লকডাউনের মধ্যে কোনোরকম ব্রিফিং ছাড়াই ছুটি পেয়ে গেলাম। বন্ধের আগে আমাদের জরুরি অ্যাকাডেমিক মিটিংও হয়নি।

মহামারির কালে শিক্ষা নিয়ে এই লেখাটি কোনো গবেষণা নিবন্ধ নয়। এটি একেবারে ইআমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। পাঠদান ও মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে আমার দীর্ঘদিনের উপলব্ধির সঙ্গে আমার অভিজ্ঞতার একটি যোগসূত্র স্থাপনের ব্যক্তিগত প্রচেষ্টামাত্র।সম্ভবত আমার অভিজ্ঞতা আরও অনেকের সঙ্গেই মিলে যাবে।

বিনা আপদকালীন-পরিকল্পনায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ হয়ে গেলো। কাজেই, শিক্ষক হিসেবে এই লকডাউনে আমার করণীয় কি সেই বিষয়ে ধোঁয়াশা থেকে গেলো। এভাবে চললো কয়েকমাস। এরপর এলো নির্দেশনা, অনলাইনে ক্লাস নিতে হবে আপাতত। কিন্তু, সেই প্রযুক্তিগত সাপোর্ট নেই। জোড়াতালি দিয়ে শুরু হলো ক্লাস। তবে, মজার কথা হল, শিক্ষার্থীদের বেশ স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া পাওয়া গেল। তারা বিষয়টিতে আগ্রহ পেয়েছিল শুরুতে, অন্তত আমার তাই মনে হয়েছিলো।

যা হোক, কিছুদিনের মধ্যেই এলো কিছু প্রিমিয়াম সার্ভিস। অনলাইনে ক্লাসের ক্ষেত্রে কিছু বাধা অতিক্রম করা গেল। কিন্তু, তা শিক্ষকের এন্ডে, শিক্ষার্থীর এন্ডে যদিও স্টুডেন্ট প্যাকেজের সিম ও ইন্টারনেট সরবরাহ করা হলো, কিন্তু, তার কার্যকারিতা কতোটুকু ছিলো আমি জানি না।

আমরা চলতি সেমিস্টারের ক্লাস নিতে শুরু করলাম। কিন্তু, বিগত সেমিস্টারের পরীক্ষা তখনো বাকি। কবে হবে, কীভাবে হবে কেউ জানে না। অনার্সের থিসিস পেপারও বাকি। আমার অধীনে যারা ছিলেন তাদেরকে কেবল মনের জোর ধরে রেখে পেপারওয়ার্ক করে যাওয়া বলা ছাড়া আমার পক্ষে আসলে কিছুই বলার ছিলো না। সংক্রমণের ভয়ে ফিল্ডওয়ার্কের কোনো উপায় ছিল না; এখনো নাই। সুতরাং, পরিকল্পনাহীনতায় আমরা পুরোপুরি স্থির হয়ে গেল সবকিছু। আপদকালীন কিছু অস্থায়ী সিদ্ধান্ত নিয়ে কোনোমতে চলতে লাগলো পড়াশোনার কার্যক্রম।

আর কার কী অভিজ্ঞতা আমি জানি না, তবে, প্রথমবারের মতো আমি পড়াশোনার টেকনিকাল দিক নিয়ে এতোবড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়লাম। তাও, শিক্ষক হিসেবে। শিক্ষার্থী হিসেবে বিষয়টি কতোটা ফ্রাস্টেটিং হতে পারে আন্দাজ করতে পারলাম। সবচেয়ে বড় বোধ আমার বেলায় হলো এই যে, সনাতন লেকচার, মুখস্থ, পরীক্ষা – এই মডেলটি এখন একেবারেই অকেজো।

মহামারির কালে শিক্ষা নিয়ে এই অভিজ্ঞতা আমাকে বুঝিয়ে দিলো, এতোকালের পড়ানোর পদ্ধতি ও মূল্যায়ন ব্যবস্থায় আনতে হবে আমূল পরিবর্তন। শুধু তাই না, প্রযুক্তির ব্যবহারেও হতে হবে অত্যন্ত সতর্ক ও শিক্ষিত।আমাদের এতোদিনের যে পাঠদান সেখানে আসলে আমরা কিছুই শিখতে পারছিলাম না। এতোদিনের এইসব গাটফিলিং এবার হাড়েহাড়ে সত্য বলে মনে হলো। নতুন পরিস্থিতিতে চাই নতুন পরীক্ষা পদ্ধতি। ওপেন বুক পরীক্ষা ছাড়া গতি নাই। কিন্তু হায়! আমরা তো মুখস্থ করা ছাড়া আর কিছু শিখতে ও শিখাতে পারিনি! ওপেন বুক পরীক্ষা ভালোমতো অংশগ্রহণ করার আগে রিসার্চের বেসিক দক্ষতা তো থাকা চাই! কিন্তু, এতোদিন তো এসবের প্রয়োজনই হয়নি।

আমরা আন্ডারগ্রাড লেভেলে যখন পড়তাম, তখন আসলে এসাইনমেন্ট লিখতে জানতাম না। আমরা মনে করতাম, টুকে নিয়ে জড়ো করার নামই হল এসাইনমেন্ট। আর মূল এসাইনমেন্টের বিষয়বস্তুর চেয়ে আমরা মনোযোগ দিতাম কভার পৃষ্ঠার অঙ্গসজ্জায়, টিচারের নামের ডেজিগনেশন ইত্যাদিতে।

তবে টুকে নিয়ে জড়ো কেমন করে করতে হয় সেটাও জানতাম না। দশটা বই কেমন করে দেখতে হয়, এমনকি একটা গবেষণা প্রবন্ধ কেমন করে পড়তে হয় তাও জানতাম না। ফোর্থ ইয়ারে রিসার্চ মেথডলজি পড়ার পরেও এসব জানতাম না। কারণ হল, আমরা লিটারেচার রিভিউ, রিসার্চ কোশ্চেন, রিসার্চ ডিজাইন এইসমস্ত জিনিসগুলোর কেবল তত্ত্বীয় দিকগুলো ‘মুখস্থ’ করতাম। আমরা অসকোলা স্টাইল সাইটেশন কেমন করে দিতে হয় তা বোঝার থেকে মস্তিষ্কে প্রচণ্ড চাপ নিয়ে স্টাইলগাইড মনে রাখার চেষ্টা করতাম। এই অহেতুক শক্তি খরচ এবং জটিল উপস্থাপন আমাদের মনে ভীতি তৈরি করেছিলো। ফলে আমরা কিছুই শিখতে পারিনি।

আপনারা জেনে আরও অবাক হবেন যে, এখনও আমার ছাত্র-ছাত্রীরাও পারে না এবং ভয় পায়। ভয় পায় দশটা বই সংগ্রহ করতে, আলস্য কাটিয়ে সেগুলো পড়ে দেখতে। আমি শিক্ষকতা পেশায় আসার পর বুঝতে পারলাম, আসলে শিক্ষক হিসেবে এসাইনমেন্ট দেওয়ার কাজটাও আমি ঠিকমতো জানি না। মানে, আমাদের এসাইনমেন্ট দেওয়াও হয় না। আমাদের এসাইনমেন্ট টপিক এসাইন করাতেও আছে ভুল। অথচ, সাহিত্য পর্যালোচনা এবং সেখান থেকে গ্যাপ চিহ্নিত করতে পারার কথা ছিল আমাদের। আমরা বারো ক্লাস মুখস্থ করেছি বলে একটা জিনিসকে ক্রিটিকালি কেমন করে দেখতে হয় সেই জিনিসটাই শিখি নাই আদৌ! ফলে, কোনো টেক্সট পড়ে সেখান থেকে গ্যাপ আবিষ্কার করা আমাদের জন্য অসম্ভব। মুখস্থ করার ফলে আমাদের ভাষাগত দখলও অত্যন্ত দুর্বল হয়ে থাকে। পদ্ধতিগতভাবে পড়ার নিয়মটাও আমাদের এই বারো ক্লাসে কেউ শেখায়নি, তাই এই অবস্থা।

কোভিডকালীন সময়টা এইসব গ্যাপগুলো ব্যক্তিগতভাবে আমাকে সাহায্য করেছে। কিন্তু, কি-ই বা করার আছে যদি সম্মিলিত কোনো সিদ্ধান্ত না হয়? করোনার যে পরিস্থিতি দেখাদিয়েছে, তাতে এই বছরও বিশ্ববিদ্যালয় খোলা যাবে কিনা আমার সন্দেহ আছে। এদিকে, চলতি সবগুলো সেমিস্টার শেষ। শিক্ষার্থীরা জানে না তাদের পরীক্ষা কবে হবে, কীভাবে হবে, তাদের ভবিষ্যত কী।

শুরুতে নতুন মাধ্যমে পড়াশোনা নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আগ্রহই দেখেছিলাম আমি। কিন্তু, সেই আগ্রহ বাহাত্তর ঘণ্টার বেশি টিকতে পারেনি। কারণ, সেই পুরাতন ক্লাস-সিস্টেমের প্রত্যাবর্তন। সঙ্গে, উদ্ভূত পরিস্থিতি, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, রোগ-শোক আর মানসিক অশান্তি এসব তো আছেই।

বিদ্যাশিক্ষার প্রতি শতবছরের রেজিস্টেন্সের সঙ্গে মহামারীর আতংক মিলেমিশে সবাইকে করে দিয়েছে বিপর্যস্ত। যদিও, আমার মনে হয় যথেষ্ট দেরি ইতিমধ্যেই হয়ে গেছে। তবুও, এখন থেকেই আমার মনে হয়, আটকে থাকা সব পরীক্ষা অনলাইনেই নেওয়ার উপায় নিয়ে চিন্তা করা উচিত। বিশেষ করে আমি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কথাই বলছি।

ওপেন বুক পরীক্ষা হতে পারে একটা উপায়। ওপেন বুক পরীক্ষার জন্য যেরকম প্রশ্ন করতে হয় সেরকম প্রশ্ন করার জন্য দরকারি প্রশিক্ষণ দিতে হবে শিক্ষকদের। মানসিকতাও তৈরি করতে হবে। শিক্ষার্থীদেরও প্রস্তুত করতে হবে। আমরা তো সারাজীবন মুখস্থবিদ্যার পরীক্ষা দিয়েছি। কিন্তু, ওপেন বুক পরীক্ষা হলে উত্তর লেখার প্যাটার্নও বদলে যাবে পুরোপুরি। খাতার মূল্যায়নও করতে হবে সেভাবেই। সেজন্য প্রস্তুতির দরকার আছে।

আমার একটা ছোট্ট অভিজ্ঞতার কথা এক্ষেত্রে শেয়ার করি। বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর সময় আমি একটি সেমিস্টারের ওপেন বুক ক্লাস টেস্ট নিয়েছিলাম। আমার প্রশ্নে একটা মামলার ফ্যাক্ট দেওয়া ছিলো। শিক্ষার্থীদেরকে সেই ফ্যাক্ট থেকে অতিসংক্ষিপ্ত করে মাত্র তিন লাইনে মামলাটির মূল কথাটুকু লিখতে হবে। মানে, ছোটবেলার সারাংশ লেখার মতো ব্যাপার। প্রশ্নের মান ১৫, প্রতি লাইনের জন্য ৫ মার্ক। তিন লাইনের বেশি লিখলে মার্ক কাটা যাবে। যেহেতু ওপেন বুক পরীক্ষা, তাই যেকোনো সোর্স দেখা যাবে, এমনকি বন্ধুদের সঙ্গে আলাপও করা যাবে। পরীক্ষার খাতা দেখতে বসার পর আমি একটি বিচিত্র জিনিস খেয়াল করলাম। বেশীরভাগই যৌগিক বাক্য দিয়ে একাধিক বাক্য জুড়ে একটি বাক্য তৈরি করেছে। ফলে, পুরো জিনিসটা তিনটা ফুলস্টপে শেষ হলেও ভিতরের বাক্য সংখ্যা অসংখ্য! আমি শিক্ষার্থীদের ইনোভেটিভ আইডিয়া দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম এবং একই সঙ্গে চিন্তায়ও পড়ে গেলাম যে, আসলে তারা বড় করে লেখা ছাড়া কিছুই ভাবতে পারছে না।

আরেকবার একই ক্লাসে আরেকটি ওপেন বুক পরীক্ষা নিলাম। সেখানে প্রশ্নে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কেমন ধরণের আইন হতে পারে তার একটি সংক্ষিপ্ত খসড়া দাঁড় করাতে বলা হলো। এই কাজগুলো এসাইনমেন্টেও দেওয়া যেত। কিন্তু, সেটির বিপদ হলো, একজন আরেকজনেরটা হুবহু তুলে দেয়। আমি আমার ছাত্রজীবনেও দেখেছি, আমাদের হাতে সময় থাকলেও আমরা একটু একটু করে কাজ করি না। আমরা চাপ নিয়ে কাজ করতে অভ্যস্থ এবং চাপ কুলাতে না পেরে অসদুপায় অবলম্বন করতেও অভ্যস্থ। তো, সেবারের ওপেন বুক পরীক্ষায় প্রথমবারের চেয়ে অপেক্ষাকৃত ভালো ফলাফল পাওয়া গেল।

খাতা দেখতে গিয়ে বোঝা গেল, শিক্ষার্থীদের মাথায় অনেক অনেক আইডিয়া গিজগিজ করছে। সুতরাং, এই ব্যাপারে আমি অন্তত আশাবাদী যে, যদি আমরা একটু আন্তরিক হয়ে, বুঝবান হয়ে পরীক্ষা ও মূল্যায়ন ব্যবস্থার সংস্কার করি এবং নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গীও সংস্কার করি, তাহলে, ওপেন বুক পরীক্ষা হতে পারে এই মহামারীর সময় এবং তদপরবর্তী সময়ের জন্য একটা মানানসই মূল্যায়ন ব্যবস্থা। কিন্তু, তার আগে প্রতিটা শিক্ষার্থীর বিশ্লেষণশক্তি, পড়ার অভ্যাস গড়া চাই। এই বিষয়টি চ্যালেঞ্জিং কিন্তু অসম্ভব নয়।

এরপর আসে দরকারি প্রযুক্তির বিষয়। এক্ষেত্রে কোনো এক বিচিত্র কারণে শিক্ষার্থীদের তরফ থেকেই আসবে প্রথম বাধা। এই বাধা হল, একঘেয়ে পড়াশোনা, পরীক্ষা আর চাপ এড়ানোর বাধা। এইটা এক ধরনের ডিনায়াল। এই সাইকোলজি থেকেই তারা দাবি করবে, ন্যূনতম প্রযুক্তি তাদের হাতে নাই। কিন্তু, আদতে, এইরকম প্রযুক্তি এফোর্ট করার সামর্থ্য খুব সামান্য কিছু শিক্ষার্থীর হাতে নাই। অবশ্যই আমি শিক্ষার্থীর আর্থিক অবস্থার ব্যাপারে ওয়াকিবহাল। আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, আমার চরম দরিদ্র শিক্ষার্থীও কোনোরকমে একটা ফোন ম্যানেজ করে, নেট ম্যানেজ করে সর্বোচ্চ ক্লাস করেছেন। আমার অভিজ্ঞতা এও বলে, ফাঁকিবাজিটাই কেমন করে যেন একধরনের স্মার্টনেসে পরিণত হয়েছে। আত্মপ্রতারিত হওয়াটার নাম চালাকি।

আমরা নিজেও ছাত্রজীবনে চাপ না পরলে গুছিয়ে কাজ করতে পারতাম না। দীর্ঘকালের এই অভ্যাসের উৎস হলো একঘেয়ে মুখস্থনির্ভর পড়াশোনা। এটি একদিনে দূর হবে না। সুতরাং, সেই জায়গায় একটা মজবুত পদক্ষেপ দরকার পরবে। বঞ্চিতদের প্রোভাইড করাই একমাত্র রাস্তা। তাই, বঞ্চিত শিক্ষার্থীদের সেই ন্যূনতম প্রযুক্তি প্রোভাইড করা সরকার-বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিক্ষার্থীর আন্তরিক ইচ্ছার উপরে নির্ভর করবে। দরকারি প্রযুক্তি ও প্রযুক্তির সহজলভ্যতা নিশ্চিত করার জন্য কাজ শুরু করে দেওয়া উচিত। এইক্ষেত্রে আমরা তরুণ উদ্যোক্তা ও উদ্ভাবকদের সাহায্য নিতেই পারি। ইচ্ছা থাকলে অবশ্যই উপায় হবে।

মহামারির কালে শিক্ষা নিয়ে এই অবস্থায় আমাদের করণীয় কী হতে পারে? এই অভিজ্ঞতার আলোকে আমার প্রস্তাব হলো:

১. পৃথিবীর অন্যান্য প্রান্তের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো মহামারির কালে শিক্ষা কীভাবে চালাচ্ছে সেটি বুঝতে হবে। তাদের অভিজ্ঞতা থেকে পথের দিশা পাওয়া যেতে পারে।

২. অনলাইনভিত্তিক পড়াশোনার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দরকারি প্রযুক্তি জরুরিভিত্তিতে সংগ্রহ করতে হবে।দরকারি সফটওয়্যারের ব্যবস্থা করতে হবে।

৩. ইন্টারনেট সহজলভ্য করার জন্য কিছু ব্যবস্থা ইতিমধ্যেই নেওয়া হয়েছে বলে জেনেছিলাম। সেগুলো আদৌ কতোটা ফলপ্রসূ হয়েছে তা খতিয়ে দেখতে হবে। দরকার হলে আরও সহজলভ্য ইন্টারনেট প্যাকেজের কথা চিন্তা করতে হবে।

৪. গ্রামাঞ্চলে সবজায়গায় নেটওয়ার্ক থাকে না। সেক্ষেত্রে নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় এমন স্থানে যদি অস্থায়ী ইন্টারনেট হাব তৈরি করা যায় এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে গ্রামাঞ্চলের শিক্ষার্থীদের সেখানে বসে অনলাইনে ক্লাস ও প্রয়োজনীয় কাজ করার পরিবেশ সৃষ্টি করা যায়, তাহলে অন্তত কিছুটা সুবিধা পাওয়া যাবে।

৫. খুব কমসংখ্যক শিক্ষার্থীরই স্মার্টফোন নাই। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় হিসাব করে কিছু ডিভাইস কিনে ফেলতে পারে। এরপর যথাযথ যত্ন ও ফেরত দেওয়ার শর্তসাপেক্ষে সেগুলো বঞ্চিত শিক্ষার্থীদের মাঝে বিতরণ করা যেতে পারে। এই ডিভাইসগুলো হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পত্তি। কাজশেষে এগুলো আবার বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বুঝে নিবে।

৬. ওপেন বুক পরীক্ষার জন্য শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের দরকারি প্রশিক্ষণ ও নির্দেশণা প্রদান করতে হবে। মোট কথা, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটা পরিকল্পনা থাকা উচিত। শিক্ষার্থীদেরও উচিত হবে এই দাবিগুলো তোলার।

মহামারির কালে শিক্ষা ছাড়াও অন্য সময়েও পড়াশোনার পদ্ধতিতে একটি স্থায়ী পরিবর্তন একেবারেই জরুরি। এই পরিবর্তন হতে হবে একদিকে যেমন গবেষণামুখী, অপরদিকে কর্মমুখীও। কর্ম ও বিশ্লেষণী ক্ষমতার মধ্যে কোনো বিরোধ নাই। বরং, ভালো বিশ্লেষণী ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষ তার কর্মজীবনেও দক্ষ হবেন। কিন্তু, আমরা গবেষণা ও কর্মকে কেমন করে যেন পরস্পরের বিপরীতে দাঁড় করাই।

একজন শিক্ষার্থী যদি বিশ্লেষণ করার গুণটিই রপ্ত করতে না পারেন, তবে তার কর্মদক্ষতা কেমন করে বৃদ্ধি পাবে? সুতরাং, একেবারে প্রাথমিক থেকেই পড়াশোনার পদ্ধতিতে একটা র‍্যাডিকাল পরিবর্তন এখন আবশ্যক। মুখস্থনির্ভর পড়াশোনা থেকে বের হতে হবে। এটার বিকল্প আবার তথাকথিত সৃজনশীল পদ্ধতিও নয়।

এর বিকল্প হল শিক্ষার্থীদের জন্য আরও বেশি বেশি রিসোর্স তৈরি করা, তাদের সৃজনশীলতা বাড়ানোর জন্য এসাইনমেন্টভিত্তিক পড়াশোনা, ওপেন বুক পরীক্ষার বন্দোবস্ত করা। এছাড়াও, অন্যান্য সৃজনশীল কর্ম যেমন: ছবি আঁকা, সংগীত শিক্ষা, ক্রাফটের কাজ কিংবা দাবা খেলা এসব বিষয় স্কুলগুলোতেই শেখানোর ব্যবস্থা করতে হবে। নয়তো হঠাৎ করে জাদুর কাঠি ছুঁইয়ে সবাইকে সৃজনশীল ও বিশ্লেষণী ক্ষমতার অধিকারী করে তোলা সম্ভব হবে না।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে