মুখস্থবিদ্যা মানেই খারাপ কিছু না, কোনোকিছু শিখতে মুখস্থবিদ্যারও গুরুত্ব আছে। ছবিসূত্র: PxHere.com
মুখস্থবিদ্যা মানেই খারাপ কিছু না, কোনোকিছু শিখতে মুখস্থবিদ্যারও গুরুত্ব আছে। ছবিসূত্র: PxHere.com

নতুন শিক্ষাক্রমের প্রবর্তকেরা এবং তার সমর্থকরা এর পক্ষে যুক্তি হিসেবে সবার আগে মুখস্থবিদ্যার ওপর নির্ভরশীল পুরাতন শিক্ষাক্রমের বদলে অভিজ্ঞতানির্ভর নতুন শিক্ষাক্রমকে সামনে তুলে ধরছেন।

“এই আধুনিক যুগে আগামির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে মুখস্থনির্ভর শিক্ষাপদ্ধতিতে পড়ে থাকলে চলবে না, সে কারণে নতুন শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করা আবশ্যক হয়ে গিয়েছিলো’ – নতুন শিক্ষাক্রমের পক্ষে যখন এমন যুক্তি ব্যাপকভাবে দেয়া হচ্ছে, তখন যারা এই শিক্ষাক্রম নিয়ে উদ্বিগ্ন, এই শিক্ষাক্রমের বাতিল চান, তাদের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রতিবাদী, বিক্ষুব্ধ জনগণ, তথা অনেক অভিভাভবক এই মুখস্থবিদ্যার পক্ষে দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন।

মুখস্থবিদ্যা মানেই খারাপ কিছু না, কোনোকিছু শিখতে মুখস্থবিদ্যারও গুরুত্ব আছে। সাধারণভাবে এই হচ্ছে তাদের বক্তব্য। কেউ কেউ বাড়তি জোর দিতে গিয়ে মুখস্থবিদ্যার গুরুত্ব, প্রয়োজনীয়তা, আবশ্যকতা, অপরিহার্যতা এবং ফজিলত পর্যন্ত বিবৃত করছেন।

অভিভাবকদের প্রতিবাদী সভার বক্তব্যের ভিডিও, বিভিন্ন মিডিয়ায় দেয়া সাক্ষাৎকারের ভিডিও কিংবা ফেসবুক-ইউটিউবের বিভিন্ন ভিডিও ব্লগ, অনেকের লিখিত পোস্ট প্রভৃতিতে মুখস্থবিদ্যার পক্ষে নানা কথাবার্তা ও যুক্তি চোখে এলো, এসবের অনেকগুলো আবার খুব ভাইরাল হয়েছে।

স্বভাবতই, এসব বক্তব্য ও যুক্তির সাথে একমত হওয়ার কোনো কারণ নেই, বরং নতুন শিক্ষাক্রাম বাতিলের দাবিতে আন্দোলন করা প্লাটফর্মগুলোর ফেসবুক পেজে সেগুলো শেয়ার হওয়া দেখে কিছুটা উদ্বিগ্ন ও হতাশই হয়েছি। পুরাতন শিক্ষাক্রমে বেড়ে ওঠা ও অভ্যস্ত অভিভাবকদের অনেকে এসব বক্তব্য দিতেই পারেন, কিন্তু যারা এই শিক্ষা আন্দোলন করছেন বা একটা শিক্ষা আন্দোলনের নেতৃত্ব পর্যায়ে রয়েছেন, এই শিক্ষা আন্দোলনকে সঠিক পথে রাখতে শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তাভাবনা খুবই জরুরি।

সেই জায়গাটিতে তাদেরকে বেশ দুর্বল বলে মনে হচ্ছে। কেননা নতুন শিক্ষাক্রমের বিরোধিতা করার জন্যে পুরাতন ত্রুটিযুক্ত শিক্ষাক্রমের পক্ষে দাঁড়ানোর কিছু নেই। সবসময় পুরাতন শিক্ষাক্রমেরও একইসাথে বিরোধিতা করার দরকার হয়তো নেই, কিন্তু অভিভাবকরা যখন পুরাতন শিক্ষাক্রমের ত্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থাই ফিরে পেতে চাচ্ছেন, সেগুলোর বিপরীতে একটি সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি, সঠিক চিন্তা সামনে আনার কাজটিও সমান গুরুত্বপূর্ণ ছিল বলে মনে করি।

যেসব ভিডিও চোখে এলো, তার মধ্যে বেশ কয়েকটিই চিকিৎসক পেশায় নিয়োজিত অভিভাবকের বক্তব্য। একজন অভিভাবকের বক্তব্য দেখলাম। তিনি নিজেকে পেশায় চিকিৎসক, পড়াশোনা ও পরীক্ষা বিষয়ে যার কোনো অলসতা নেই, জ্ঞান অর্জনের আকাঙ্ক্ষা যার চুড়ান্ত পর্যায়ের, এবং শিশুদের বিষয়ে যিনি ভীষণ সিরিয়াস বলে বক্তব্যের শুরুতে দাবি করেছেন। তিনি সেই বক্তব্যের একপর্যায়ে বলেছেন, “পড়াশুনার তত্ত্বীয় জ্ঞান মুখস্তবিদ্যা ছাড়া একটা মানুষ কীভাবে শিখবে? সে কি মাতৃগর্ভ থেকে শিখে আসবে? আমি যে এখন ডাক্তার, আমিও সকালবেলা প্রতিদিন আধাঘণ্টা হলেও পড়াশুনা করি। কারণ আমাকে চর্চা করতে হয়, নতুন নতুন জিনিস জানতে হয়। আমার চাইতে কেউ বেশি বলতে পারবে না যে, জীবনে মুখস্তের গুরুত্ব কতখানি”।

আরেকজন চিকিৎসক ডা. আরিফ মুর্শেদ খান (এমবিবিএস (ডিএমসি), বিসিএস (হেলথ), এফআরসিএস (ইএনটি)) তাঁর ফেসবুক ভিডিও বক্তব্যে জানাচ্ছেন, “মুখস্থবিদ্যা বাদ দেয়ার তো কিছু নেই। আমাদের মুখস্থবিদ্যা আর বুঝে পড়ার মাঝে কোনো সংঘর্ষ নেই, দুটো আলাদাভাবে কাজ করবে, দুটো একে অপরের পরিপূরক। আপনাকে বুঝার ক্ষমতা দিয়ে বুঝে নিতে হবে, কিন্তু যে জিনিসটা মুখস্থ করার সেটা মুখস্থ করতে হবে”।

এরপর তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেছেন, “এখন আমার ছেলেকে যদি বলি, এখন নভেম্বর মাস, ফেব্রুয়ারি মাসে তোমাকে ওখানে নিয়ে যাবো। তাকে তো জানতে হবে, নভেম্বর মাসটা কোথায়, ফেব্রুয়ারি মাস কোথায়। নভেম্বরের পরে ডিসেম্বর, ডিসেম্বরের পরে জানুয়ারি, তারপরে ফেব্রুয়ারি এটা জানতে হবে। তার মানে তাকে কিন্তু ১২টা মাসের নাম মেমোরাইজ করতে হবে। এবং তাকে সিরিয়ালি মুখস্থ রাখতে হবে কোন মাসের পরে কোন মাস আসবে। ঘটনা হচ্ছে, আপনাকে প্রচুর জিনিস মনে রাখতে হবে (মেমোরাইজ করতে হবে), এমনকি সেই বিষয়ে যথাযথভাবে বুঝার আগেই”।

আরেকটি উদাহরণে তিনি বলেছেন, “আপনি আপনার বাচ্চাকে বললেন, দোকান থেকে ঐ জিনিসটা নিয়ে আসো, ৩০ টাকা দিয়ে পাঠালেন এবং ঐ পণ্যের মূল্য ধরেন ২৪ টাকা। এখন দোকানদার যে তাকে ৬ টাকা ফেরত দিবে, তাকে তো জানতে হবে ৬ যোগ ৪ সমান সমান ১০। এটি অংক করে বের করার কিছু নাই, কারণ ১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৭, ৮, ৯, ১০ – এটা মুখস্থ করার বিষয়”।

এছাড়াও তিনি তার ডাক্তারি পেশার উদাহরণ টেনে বলেছেন, “একজন রোগীকে দেখে সমস্যা বুঝার জন্যে রোগের সিম্পটমস জানতে হবে, মেমোরাইজ করতে হবে। আপনার সার্জারি করতে গেলে মানব শরীরের এনাটমি জানতে হবে, তার জন্যে পড়তে হবে, মেমোরাইজ করতে হবে”।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ রসায়ন ও অনুপ্রাণ বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ রেজওয়ানুল হক ফেসবুক পোস্টে তার মেয়ে বাংলা পরীক্ষার আগে দিয়ে “বেশ কয়েকটি রচনা, ভাব সম্প্রসারণ, দরখাস্ত, চিঠি, কবিতা, ছোট প্রশ্ন, বড় প্রশ্ন, শব্দার্থ, বাক্য রচনা, ব্যাকরণসহ অসংখ্য জিনিস শিখেছে, অনেক কিছু মুখস্থ করেছে” উল্লেখ করে বলেছেন, “এই সিস্টেমের এমন কি দোষ ছিলো যে, হুট করে বাদ দিতে হলো? আমি ঠিক জানি না। আসলেই জানি না। এই সিস্টেমেই তো আমরা, আপনারা একটা লেভেলে এসেছি, এসেছেন”।

এরপরেই তিনি মুখস্থবিদ্যার পক্ষে অবস্থান নিয়ে জানিয়েছেন, “মুখস্থবিদ্যাকে একেবারে হেসে উড়িয়ে দেয়ার কিছু নেই। মুখস্থ না করে একজন ডাক্তার কি গুগল দেখে দেখে ট্রিটমেন্ট করবেন? একজন ইন্জিনিয়ার কি তার ক্লায়েন্টের সাথে গুগল করে করে কনসাল্টেন্সি করবেন? ক্লাসে স্টুডেন্টরা প্রশ্ন করলে আমি কি গুগল করে করে উত্তর দিবো? মুখস্থ না থাকলে নামাজে দোয়া দরুদ কীভাবে পড়বো?”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক “শিক্ষার মেরামত” শীর্ষক গ্রন্থের রচয়িতা এবং নতুন শিক্ষাক্রমের বিরুদ্ধে চলমান আন্দোলনে অত্যন্ত উচ্চকিত অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুনও তাঁর ফেসবুক পোস্টে নতুন শিক্ষাক্রমকে জাস্টিফাই করতে গিয়ে যারা মুখস্থবিদ্যানির্ভর পুরাতন শিক্ষাক্রমে কালিমালেপন করছেন, তার জবাব দিতে গিয়ে শুরুতে দারুণভাবেই বলেছেন, কেন শিক্ষার্থীরা মুখস্থ করে। সেখানে তিনি শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকদের মান, তাদের বেতনকাঠামোর সমস্যাকে সামনে এনেছেন।

কিন্তু, এরপরে তিনি একভাবে মুখস্থবিদ্যার পক্ষে এবং মুখস্থবিদ্যাকে গালি দেয়ার বিপক্ষেই অবস্থান নিয়ে বলেছেন, “শ্রেণীকক্ষে ভালো না বুঝাতে পারা ও মান সম্মত প্রশ্ন করতে না পাড়ার কারণে মুখস্থ বিদ্যার বিকল্প নেই। আর কথায় কথায় মুখস্থ বিদ্যাকে গালি হিসাবে ব্যবহার করাও ঠিক না। লেখাপড়া করতে হলে কিছু জিনিস স্মরণে রাখার জন্য মুখস্থ করতে হয়। এই জন্যই মানুষের ব্রেইনে সেরিবেলামের কাজ হল পদ্ধতিগত স্মৃতি প্রক্রিয়া করা আর হিপ্পোক্যাম্পাস নামক আরেকটি স্থান আছে যেখানে নতুন স্মৃতি এনকোড করা হয়। কম্পিউটারেরও একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হলো মেমরি। মনে রাখতে পারা এইটা মানুষ নামক প্রাণীর একটা বিশেষ গুণ”।

এই ধরনের আলোচনা ও যুক্তিমালার সমস্যা কী? ভুলটাই বা ঠিক কোথায়?

প্রথমত, মুখস্থবিদ্যার গুণকীর্তন করতে গিয়ে তারা মুখস্থ করা আর মনে রাখা তথা স্মৃতিতে বা স্মরণে তথ্য জমা করা, ইংরেজিতে যাকে বলে লার্ন বাই হার্ট বা মেমোরাইজ করা – এই দুইকে সমার্থক বানিয়ে ফেলেছেন।

দ্বিতীয়ত, ‘মুখস্থবিদ্যানির্ভর শিক্ষাপদ্ধতি’তে শিশুদের জানা, বুঝা ও শেখার ক্ষেত্রে যে বিভিন্ন আবশ্যক, অপরিহার্য ও কার্যকর উপায় ও পদ্ধতি আছে, সেগুলোর সবকিছু বাদ দিয়ে কেবল মুখস্থ করার মাধ্যমে তথ্য ইমিটেট করার একটি সুনির্দিষ্ট পদ্ধতির উপরে জোর দেয়া হয়, সেই বিষয়টিই তারা বিস্মৃত হয়েছেন, অথবা আড়াল করেছেন।

এবং, তৃতীয়ত, জ্ঞানবিদ্যার ক্ষেত্রে তথ্যাদি মনে রাখা বা মেমোরাইজ করা তথা বা স্মৃতিতে তথ্যাদি জমা রাখা (যেটিকে তারা ভুলভাবে মুখস্থ করার সমার্থক হিসেবে উল্লেখ করেছেন) শুধু একদম প্রাথমিক পর্যায়ের একটি ধাপ মাত্র, পরের ধাপগুলোতে এই তথ্যাদির সমাবেশ–বিন্যাস ঘটনা, থরে থরে সাজানো, যোজন-বিয়োজন করা, বিশ্লেষণ করা, প্রভৃতির মাধ্যমে নিত্য নতুন তথ্য তৈরি করতে পারার যে দক্ষতা তৈরির গুরুত্ব সেটিও তারা ভুলে পরবর্তী পর্যায়ের তথ্যগুলোও মনে রাখা বা মেমোরাইজ করা অর্থাৎ মুখস্থ করার পথকেই তারা আলিঙ্গন করে বসেছেন!

এই তিন সমস্যা একটু বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা যাক।

প্রথমত, বাংলাভাষায় থাকা মুখস্থ শব্দটি বলতে আমরা কী বুঝি? শব্দটি ভাঙ্গলে আমরা মুখ আর স্থ পাই, অর্থাৎ মুখে স্থিত বা মুখে অবস্থিত। আরেকটি শব্দ আছে, ঠোঁটস্থ, যার শব্দগত অর্থ হবে ঠোঁটে স্থিত বা অবস্থিত। এই শব্দ দুটি দিয়ে বুঝায়, কোনো তথ্য এমনভাবে আমার মনে আছে, যেটা এতটুকু চিন্তাও না করে না মাথা না চুলকিয়েই একদম গড়গড় করে বলে দিতে পারবো।

যেমন, ভূগোল বইয়ে থাকা ৫০ বা ১০০টি দেশের নাম, রাজধানী ও মুদ্রার নাম আমাদের অনেকের মুখস্থ ছিলো। যেকোন দেশের নাম বললেই আমরা তার রাজধানী আর মুদ্রার নাম বলে দিতে পারতাম। বা অমুক কবিতার সারাংশ  মুখস্থ, এতগুলো কবিতা–গান পুরোপুরি মুখস্থ, একদম লাইন বাই লাইন বলে দিতো পারবো।

আবার, অনেকে বলবে, দশের ঘরের নামতা আমার একদম ঠোঁটস্থ, ১২টি টেন্স-এর নাম আমার একদম ঠোঁটস্থ। এর মানে হচ্ছে, মুখস্থের চাইতেও বেশি মনে আছে, দশের ঘরের নামতা বা ১২টি টেন্স একদম ঠোঁটে অবস্থান করছে, জিজ্ঞেস করামাত্র বলে দিতে পারবো।

এই মুখস্থ করা, ঠোঁটস্থ রাখা সবই মাথাতে ঘটে, মেমোরি সেলেই তথ্যগুলো জমা থাকে, কিন্তু বাংলায় আমরা যখন মুখস্থ করা কথাটা বলি, সেটি একটা নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে তথ্যকে স্মৃতিতে জমা রাখাকে বুঝায়। কোনো তথ্য বারেবারে মুখে আউড়িয়ে (জোরে শব্দ করে হতে পারে, কিংবা বিরবির করেও হতে পারে) মনে রাখার চেষ্টা করার পদ্ধতিই হচ্ছে মুখস্থ করা।

প্রতিটি মানুষেরই যেহেতু ব্রেইনের সেরেব্রামে থাকা দুই হিপ্পোক্যাম্পি থাকে, যাদের কাজই হচ্ছে স্বল্পমেয়াদী স্মৃতিকে দীর্ঘমেয়াদী স্মৃতিতে রূপান্তরিত করা, ফলে মস্তিস্ক স্বাভাবিকভাবে কাজ করলে (আলজাইমার বা অন্যান্য ডেমেনশিয়া অসুখ না হলে) প্রতিটি মানুষই মনে রাখতে পারে।

মানুষ একদম শিশুকাল থেকেই তার পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে তারা চারপাশের যা যা কিছুর সংস্পর্শে আসে, সেগুলো মস্তিস্কে যায়। সেগুলো প্রথমে স্বল্পমেয়াদী স্মৃতিতে মেমোরিতে আসে। সেগুলোর কিছু হারিয়ে যায়, আরেকটি অংশ দীর্ঘমেয়াদী স্মৃতিতে গিয়ে জমা হতে থাকে। জন্মের পরে একজন অন্ধ শিশুও তার মায়ের কন্ঠ শুনে চিনতে পারে, গন্ধ পেয়ে টের পায়, অর্থাৎ তার স্মৃতিতে সেই তথ্য জমা হয় বলেই এই চিনতে পারে বা টের পায়। কিন্তু এর জন্যে কোনোকিছুই মুখস্থ করতে হয় না।

সে শব্দ শুনে, সেই শব্দ উচ্চারণ করার চেষ্টা করে, চারপাশের জিনিসের নাম শেখে। দেখে, শুনে ও বলে – এভাবেই শিখতে থাকে, এভাবে মাতৃভাষা আয়ত্ব করে। তার মানে হচ্ছে, তার মস্তিস্কের সেই দীর্ঘমেয়াদী স্মৃতিতে এসব তথ্য জমা হতে থাকে। চারপাশের জিনিসগুলোর নাম শেখে, এরপরে যা দেখা যায় না, ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না এমন অনেক কিছুর, যেমন আবেগ অনুভূতির নাম শিখে, বিভিন্ন কাজের নাম শিখে, সেগুলো সেই দীর্ঘমেয়াদী স্মৃতিতে জমা হতে থাকে।

এই নাম বা শব্দসংক্রান্ত তথ্যাদি মনে রাখা হচ্ছে একেবারে প্রাথমিক ধাপ। তারপরে সেই শব্দগুলো সারি সারি বসিয়ে বাক্য তৈরি করতে শেখে, অনেকগুলো বাক্য পাশাপাশি বসিয়ে পুরো একটা গল্প বা মনের ভাব প্রকাশ করা শেখে। এটি হচ্ছে পরের ধাপ। এই ধাপে বাক্য বা কোন অনুচ্ছেদ মেমোরিতে জমা হয় না, বরং এক বা একাধিক শব্দ কীভাবে, কোন শব্দের পরে কোন শব্দ বসে একটা বাক্য তৈরি হয়, সেই পদ্ধতি বা নিয়মটি মনে রাখে।

এখন, এই যে দীর্ঘমেয়াদী স্মৃতিতে কোনোকিছু জমা রাখা, যাকে আমরা বলছি মনে রাখা বা মেমোরাইজ করা, সেটা মানেই কিন্তু মুখস্থ করা না। প্রতিটি মানুষই চারপাশে যা কিছু ঘটছে, যার মধ্য দিয়ে সে অতিক্রম করছে, সেসবের কোনো না কোনো তথ্য সে মনে রাখে। আবার অনেক কিছু ভুলেও যায়।

আমাদের মধ্যে অনেক সময় এমন হয় যে, অনেক কষ্টের বা দুঃখের কোন ঘটনা বা স্মৃতি আমরা খুব ভুলতে চাই, ভুলে থাকার চেষ্টা করি, কিন্তু কোনোভাবেই ভুলতে পারি না, সেসব স্মৃতিকেও নিশ্চয়ই মুখস্থ বলে না। ফলে, মুখস্থের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে সম্পর্ক হচ্ছে সচেতন প্রয়াসের। অর্থাৎ, সচেতনভাবে কোনোকিছু মাথার মধ্যে গেঁথে নেয়ার একটি পদ্ধতি হচ্ছে মুখস্থ করা।

সচেতনভাবে কোনো তথ্য মনে রাখতে চাইলে, সেই তথ্য বারেবারে আউড়ানোর বা উচ্চারণ করার মাধ্যমে সেই তথ্যটি মনে রাখতে পারার পদ্ধতিই হচ্ছে মুখস্থ। কিন্তু, সচেতনভাবে মনে রাখার চেস্টা না থাকলেও মানুষ অনেক কিছু মনে রাখে। তার চারপাশের অভিজ্ঞতায় যে তথ্য তার সামনে বারেবারে আসে, কিংবা যে তথ্যটি তাকে কোনো কারণে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করে, ভাবায়, আবেগ-অনুভূতিতে নাড়া দেয়, সেগুলোও তার স্মৃতিতে সহজে জমা হয়। এমন তথ্য মনেও থাকে অনেক বেশিদিন। এভাবে মনে রাখাকে বলে অভিজ্ঞতাজাত বা অভিজ্ঞতা থেকে শিখে মনে রাখা।

দ্বিতীয়ত, যখন আমরা শিক্ষাব্যবস্থার কথা বলছি, মানে শিশুদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বা বাসায় কোনোকিছু শেখানোই যখন উদ্দেশ্য, সেখানে অবশ্যই পুরো বিষয়টিই সচেতন প্রয়াস। আবার, কোনোকিছু জানা ও শেখার মানে হচ্ছে সেই বিষয়টি সম্পর্কিত তথ্য মাথায় নেয়া ও মনে রাখা।

ফলে, জানা ও শেখার তথা মনে রাখার এই সচেতন প্রক্রিয়ায় মুখস্থ করা অবশ্যই একটি উপায়, তবে তা একমাত্র নয়। আমরা যেহেতু জানি, জন্মের পর থেকেই কোনোরকম সচেতন প্রয়াস বাদেই আমরা প্রতিনিয়ত চারপাশ থেকে অসংখ্য তথ্য, ঘটনা আমরা মনে রাখি। এভাবে মনে রাখার স্থায়িত্বও অনেক বেশি ঘটে। ফলে শিক্ষাব্যবস্থার সচেতন মনে রাখার ক্ষেত্রেও মুখস্থনির্ভরতার বদলে অভিজ্ঞতার ওপরে নির্ভর করার কার্যকারিতা অনেক বেশি হতে পারে। শিক্ষাক্ষেত্রে মনে রাখার উপায় হিসেবে এই মুখস্থনির্ভরতা আর অভিজ্ঞতানির্ভরতার বিষয়টি কিছু উদাহরণ দিয়ে বুঝানো যাক।

একটি শিশু প্রথম যখন শব্দ শেখে, কীভাবে শেখে? চারপাশের কাছের মানুষকে চিনতে শেখার পরে প্রথমে ডাকতে শিখে, তারপরে যা কিছু দেখে, সেগুলোর নাম শিখতে থাকে। এই ডাকতে শেখানো, বিভিন্ন জিনিসের নাম শেখানো, এই কাজটা প্রাথমিকভাবে মা-বাবা করে। তারপরে ভাই-বোন, দাদা-দাদি, নানা-নানি, চাচা-মামা, পাড়ার প্রতিবেশীদের কাছ থেকে, আরো বড় হয়ে বন্ধুবান্ধবদের নিত্যনতুন শব্দ শিখতে থাকে।

কখনো কখনো হয়তো বাবা-মা শিশুকে শেখানোর জন্যেই কোনো একটা জিনিস ধরে বারেবারে আউড়িয়ে মুখস্থের মতো করে একটি শব্দ শেখায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিশুরা চলতে ফিরতে ঘুরতে ঘুরতে অন্যদের মুখে শুনতে শুনতেই শব্দগুলো শিখতে থাকে। এই শব্দগুলো মনে রাখা বা মাথার ভেতরে গেঁথে যাওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অনুষঙ্গ হিসেবে কাজ করে, সেই শব্দগুলোর ব্যবহার।

মানে, নতুন শেখা শব্দগুলো যখন সে নিজের কথা বলার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা শুরু করে, সেই শব্দগুলো দিয়ে মনের ভাব প্রকাশ করে, বাক্য গঠন করে, গল্প করে, তখনই শব্দগুলো স্মৃতিতে ভালোভাবে গেঁথে যায়, সেগুলো সারাজীবন মনে থাকে।

ফলে, বিদ্যালয়ে বা শিক্ষাব্যবস্থাতেও নতুন নতুন বিষয় শেখার ক্ষেত্রেও এই দুই নিয়ম প্রযোজ্য। অর্থাৎ, নতুন শব্দমালা তথা নিত্যনতুন টার্ম, তাদের অর্থ বা সংজ্ঞা এসবের পরিচিতির ক্ষেত্রে সেগুলোকে যথাসম্ভব ভিজুয়ালাইজ করানো, উপলব্ধিতে নেয়া, বুঝতে পারা জরুরি। সেই শব্দ বা টার্মগুলোকে বাক্যে, বা অন্য কোনো আলোচনার অংশ হিসেবে নানাভাবে ব্যবহার করাও জরুরি।

যেমন, আমার ছেলে-মেয়ে বাংলাদেশে অরণি বিদ্যালয়ে প্রাক-প্রাথমিকে পড়েছিলো। এই বেসরকারি বিদ্যালয়টি বাংলাদেশের অনেক বিদ্যালয়ের চেয়ে বেশ ভালো। তারা আনন্দের সাথে, নানারকম শিক্ষা-উপকরণ সহকারে শেখায়। তারপরেও মনে আছে, কোনো এক ক্লাসে ছেলেকে বাড়ির কাজ দিয়েছিলো। দশটা করে ফল, মাছ, ফুল – প্রভৃতির নাম মুখস্থ করার।

বিদ্যালয়ে হয়তো বইয়ে ছবিসহ বিভিন্ন ফল, মাছ, ফুল, পাখি দেখে নাম শিখেছে (জানি না, ধারণা করছি)। বাসায় মুখস্থ করার জন্যে তার খাতায় দশটা ফুল, ফল, পাখি, মাছের নাম লিখে এনেছিলো। সেটি তারপরে মুখস্থ করতে হয়েছিলো।

নেদারল্যাণ্ডসের শিশুদেরকে এরকম পাঁচটি-দশটি ফুল, ফল, পাখির নাম মুখস্থ করানোর ব্যাপারটা অকল্পনীয়। প্রাথমিকে ডাচ ও ইংরেজি, মাধ্যমিকে সেই সাথে ফ্রেঞ্চ ও জার্মান ভাষা শেখানো হয়, চার ভাষাতেই অনেক শব্দ শিখতে হয়, কিন্তু শেখার পদ্ধতির মাঝে এই দশটি বা পাঁচটি ফুল, পাখির নাম মুখস্থ করার বিষয় নেই।

তাদের বইগুলোতে প্রচুর ছবি থাকে। প্রাণী, ফল, সবজি, এরকম শব্দ শেখানোর ক্ষেত্রে ছবির সাথে পরিচিত করে, তার পাশে সেই শব্দ থাকে। টানা দশটি-পাঁচটি ফলের নাম কেউ হরহর করে বলে যাওয়া বা বানান করে লেখার পরীক্ষা হয় না; বরং একেক ফলের ছবি দেখে তার নাম বলতে হয় বা, নিচে বানান করে ফলের নাম লেখতে হয়। সেই শব্দগুলো বাক্যে ব্যবহার করতে হয়।

অন্য ভাষা শেখার ক্ষেত্রে মাধ্যম থাকে ডাচ। ফলে সেক্ষেত্রে ছবির সাথে সাথে ডাচে ও অন্য ভাষাটিতে শব্দ দেয়া থাকে। সেটি আয়ত্বে নেয়ার ক্ষেত্রেও ডাচ থেকে সেই ভাষায় বা সেই ভাষা থেকে ডাচ ভাষায় অর্থ বলা বা লেখা, শূন্যস্থান, টিক চিহ্ন দেয়া, মাল্টিপল চয়েজ এরকম নানারকম প্রশ্নের জবাব দিয়ে দিয়ে শেখায়। আটকে গেলে, ভুলে গেলে, ভুল করলে আবার দেখে, পরের ধরনের প্রশ্নের জবাব দিতে হয়।

অর্থাৎ নতুন ভাষার নতুন শব্দগুলোর অর্থ (ডাচ ভাষায়) একসাথে বার বার পড়ে মুখস্থ করার বদলে, এরকম নানা অনুশীলনের মধ্য দিয়ে শেখানোর ব্যবস্থা থাকে। সেগুলোর মধ্য দিয়ে শব্দগুলোর প্রাথমিক ধারণা তৈরি হয়। এরপর যখন শব্দগুলো দিয়ে যখন বারেবারে বাক্য তৈরি করতে হয়, শব্দগুলো ব্যবহার করে লেখা টেক্সট পড়তে হয়, বাক্য শেখা হলে কয়েকটি বাক্য মিলে যখন ছোটখাট প্যারা লেখতে হয়, তখন শব্দগুলো আরো ভালোভাবে স্মৃতিতে চলে আসে।

শব্দ শেখার ও মনে রাখার ক্ষেত্রে খুব জরুরি বিষয়ই হচ্ছে শব্দটির বারবার ব্যবহার। সেই শব্দ ব্যবহার করা কথা শুনতে হবে, বলতে হবে, টেক্সট পড়তে হবে, লিখতে হবে। যে শব্দের ব্যবহার খুব কম, সেই শব্দগুলো আমরা বেশিদিন মনে রাখতে পারি না, ভুলে যাই।

বিদ্যালয়ে আমরা গল্প–কবিতা পড়তে গিয়ে অনেক শব্দ শিখেছিলাম, যা প্রাত্যহিক জীবনে ব্যবহার না করতে করতে ভুলে গিয়েছি। গ্রামে নানাবাড়ি বা দাদাবাড়িতে বেড়াতে গিয়ে অনেক শব্দ, বিশেষ করে আঞ্চলিক ভাষায় অনেক কথা শিখে আসতাম, কিন্তু ব্যবহারের অভাবে ভুলতেও সময় লাগতো না।

পারিবারিকমণ্ডলে আমরা খুব সীমিত সংখ্যক শব্দই ব্যবহার করি। আমাদের এই শব্দভাণ্ডার প্রসারিত হয় বাইরের মানুষদের সাথে মিশতে গিয়ে বা বন্ধু বান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশীর সাথে মিশতে গিয়ে। আরো প্রসারিত হয় টেলিভশনে নাটক-সিনেমা–বিজ্ঞাপন-খবর দেখতে ও শুনতে শুনতে, রেডিও শুনতে শুনতে। এই শব্দভাণ্ডার আরো প্রসারিত হয় খবরের কাগজ, বইপত্র পড়তে পড়তে।

এটি কেবল ভাষা শেখার ক্ষেত্রেই নয়, জ্ঞানজগতের অন্য শাখাগুলোর জন্যেও প্রযোজ্য। রসায়নে আমাদের মৌলের নাম, প্রতীক ও যোজনী, মৌল, যৌগ ও মূলকের সংকেত শিখতে হয়েছে। এখানেও, পর্যায় সারণিতে ১০৫টি (আমাদের সময়ে ১০৫টি ছিলো) মৌলিক পদার্থের নাম ও প্রতীক থাকলেও বেশি মনে থাকে যেই মৌলিক পদার্থ দিয়ে যৌগগুলো তৈরি।

এরকম ৩০-৪০টি মৌলিক পদার্থের নাম, প্রতীক, যোজনী মুখস্থ করতে হয়েছিলো। কিন্তু সেগুলো দিয়ে তৈরি যৌগের সংকেত লিখতে গিয়ে বারেবারে সেই মৌল, তার প্রতীক আর যোজনী ব্যবহার করতে হয়। সেগুলো ব্যবহার করতে করতেই মাথায় গেঁথে যায় হাইড্রোজেন হচ্ছে এইচ আর যোজনী এক, অক্সিজেন হচ্ছে ও আর যোজনী ২, কার্বন হচ্ছে সি আর যোজনী ২ অথবা ৪, প্রভৃতি।

আবার, যৌগগুলো মনে থেকেছে যখন বিশেষ বিশেষ ধরনের যৌগ তৈরি করা শিখলাম। অর্থাৎ এসিড, ক্ষার, ক্ষারক, লবন, জৈব যৌগ প্রভৃতি শেখার বিষয়গুলো আরও পোক্ত হলো যখন রাসায়নিক সমীকরণ শিখেছি।

এখন, কারো যদি যৌগের সংকেত-সম্পর্কিত ধারণা তৈরি না হয়, বিভিন্ন রকম যৌগ গঠন না শেখানো হয়, রাসায়নিক সমীকরণ যদি যদি না লিখতে পারে, তাহলে মাত্র ১৫-২০টি মৌলিক পদার্থের প্রতীক আর যোজনী হাজারবার পড়িয়ে যতোই ঠোঁটস্থ করা হোক না কেন, মাস বা বছরখানেকের মধ্য সেগুলো ভুলে যাবে।

কিন্তু মৌলের প্রতীক, যোজনী শেখানোর পরপরই যদি যৌগের সংকেত লেখা শুরু করে, বিভিন্ন ধরনের যৌগ গঠন করা শিখতে থাকে, তাহলে সেই মৌলগুলোর নাম, প্রতীক, যোজনী একসাথে আলাদাভাবে বারবার পড়ে মুখস্থ করার দরকার হয় না। কেনোনা, যৌগগুলো ও যৌগের সংকেত লেখার সময়ে বারেবারে মৌলের প্রতীক আর যোজনী ব্যবহার করতে হয়!

তৃতীয়ত, জানা ও শেখার ক্ষেত্রে তথ্যাদি মনে রাখা বা স্মৃতিতে তথ্য জমা করে রাখা খুবই প্রাথমিক পর্যায়ের কাজ। মানুষের মস্তিস্ক যেমন স্বল্পমেয়াদী স্মৃতিকে দীর্ঘমেয়াদী স্মৃতিতে রূপান্তরিত করতে পারে, আরও অনেক প্রাণীর মস্তিস্কও এই কাজটি করতে সক্ষম। একটি কুকুর বিচ্ছেদের বেশ কয়েক বছর পরেও তার মনিবকে ঠিকই চিনতে পারে। অর্থাৎ, অনেক প্রাণীও এই মনে রাখার কাজটি পারে।

কিন্তু, মানব মস্তিস্কের মূল বিশেষত্ব হচ্ছে, এটি কেবল তথ্যাদি জমা করেই রাখে না, জমা থাকা যাবতীয় তথ্যকে প্রক্রিয়াজাত করতে পারে, মানে বাছাই করতে, অন্য তথ্যের সাথে তুলনা করতে, নানান বিন্যাস–সমাবেশে সজ্জিত করতে পারে, যোজন-বিয়োজন করতে পারে, সুনির্দিষ্ট নিয়মমাফিক থরে থরে সাজাতে পারে। অর্থাৎ, সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণ করতে পারে। এই ক্ষমতাটি বিশাল।

একটি শিশু চারপাশ দেখে অনেকগুলো শব্দ শেখে, সেই শব্দগুলো সে সেভাবেই মনে রাখে বা স্মৃতিতে জমা রাখে। কিন্তু সেই শব্দগুলো দিয়ে সে যখন বাক্য তৈরি করা শেখে, তখন আলাদা আলাদা বাক্য হিসেবে বাক্যগুলো মনে রাখে না, মনে রাখে বাক্য তৈরির নিয়ম। যে নিয়মগুলোকে ব্যকরণ বলা হয়।

মাতৃভাষা শেখার সময়ে শিশু আলাদাভাবে ব্যাকরণ শিখে না, কিন্তু সঠিকভাবে বাক্য গঠন করার নিয়মগুলো ঠিকই আয়ত্ব করে ফেলে। মানুষ ভাষা শেখার সময়ে এই যে বাক্য হিসেবে মনে রাখে না, মনে রাখে বাক্য তৈরির নিয়ম, সেটিই মানুষের ভাষাকে বিশালত্ব দান করে। কেননা, অল্প কিছু শব্দ দিয়েই অসংখ্য বাক্য তৈরি করা যায় বিধায় মানুষ একই ঘটনায় একাধিক উপায়ে মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে, মানুষের চিন্তাজগতের বিশাল বৈচিত্রের কারণও এটাই।

এই আলোচনার গুরুত্ব এইখানে যে, আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রেও, মনে রাখার সচেতন প্রয়াস চালানো দরকার, সেটি মুখস্থ করে হোক আর অভিজ্ঞতানির্ভর উপায়ে হোক। বাক্যের ক্ষেত্রে মনে রাখতে হয় বাক্য গঠনের নিয়ম। একটি অনুচ্ছেদ বলা বা লেখার ক্ষেত্রেও পুরো অনুচ্ছেদ লাইন বাই লাইন মনে রাখার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, সেই অনুচ্ছদের মূলভাবটি বুঝা ও সেই ভাবটি মনে রাখা। 

ঠিক এই জায়গাটিতেই মুখস্থবিদ্যা-নির্ভর শিক্ষাব্যবস্থার সবচেয়ে বড় বিপদ বা ক্ষতি। শব্দ বা বিভিন্ন জিনিস, বিষয়, আবেগ, অনুভূতি, কাজকর্মের নাম, বা বিভিন্ন টার্ম এসব কিছু মনে রাখার জন্যে মুখস্থ করলে ক্ষতি কেবল এতটুকুই যে, এগুলো বেশিদিন মনে থাকে না, যদি সেগুলো বাক্যে বা মনের ভাব প্রকাশে বারেবারে ব্যবহৃত না হয়। আর, বারবার ব্যবহার হলে সেই শব্দগুলো মনে রাখা সহজ হয়।

সেক্ষেত্রে মুখস্থ করার ক্ষতি হচ্ছে সময়ের অপচয়। কেনোনা, শব্দগুলো আলাদাভাবে সময় নষ্ট করে মুখস্থ না করলেও ব্যবহার করতে করতেই এমনিতেই আয়ত্বে চলে আসতো। ফলে, এক্ষেত্রে ক্ষতি অনেক সীমিত। কিন্তু, বাক্য বা অনুচ্ছেদ পর্যায়ের তথ্যাদি মুখস্থ করার ক্ষতি বা বিপদ ভয়ানক। শিক্ষার্থী বাক্য মুখস্থ করছে মানেই হচ্ছে, সে বাক্য তৈরির নিয়ম জানছে না, এবং মুখস্থ করা বাক্যও পরে ভুলে যাচ্ছে।

ফলে তার বাক্যগঠনের দক্ষতা সীমিত হয়ে পড়ছে। শিক্ষার্থী অনুচ্ছেদ মুখস্থ করছে মানেই হচ্ছে, তার কোনো বিষয়ে ভাবপ্রকাশের ক্ষমতাও সীমিত হয়ে যাচ্ছে। আর, এসবের সবচেয়ে বড় ক্ষতি হচ্ছে, এভাবে শিক্ষার্থীর চিন্তা করার সামর্থ্য লোপ পেয়ে যাচ্ছে।

ফলে, মুখস্থনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষার্থীর ভাষা দক্ষতাকে একদম নষ্ট করে দেয়। একইসাথে তার চিন্তাশক্তির পরিপূর্ণ বিকাশে বাঁধা প্রদান করে। একজন শিক্ষার্থী যখন একটি গল্প পড়া শেষে গল্পের ওপরে করা প্রশ্নের জবাব নিজের মতো করে দেয়ার আগেই সেই জবাবের নোট মুখস্থ করে, বা কবিতা পড়া শেষে কবিতার সারাংশ মুখস্থ করে, কিংবা একটি লাইনের ভাবসম্প্রসারণ নিজের মতো করে না করে মুখস্থ করে ফেলে, রচনা মুখস্থ করে, তখন চিন্তা করার সুযোগ পায় না।

একটি গল্প পড়া শেষে গল্পের ওপরে করা প্রশ্নগুলো যদি তাকে ভাবিয়ে তুলতে পারতো, বা কবিতা পড়ার পর সারাংশ মুখস্থ করার আগে কবিতা পড়ে কি বুঝেছে, সেই সারাংশ নিজেই নিজেদের ভাষায় লেখতো, তাহলে কবিতার লাইন বাই লাইন ভালো করে পড়ে আরও ভালো করে বুঝার চেষ্টা করতে পারতো।

“অর্থই অনর্থের মূল” বা “বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃকোড়ে” বা “ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সকল শিশুর অন্তরে” ইত্যাদি বিষয়ে ভাবসম্প্রসারণ মুখস্থ করতে গেলে একটি সুনির্দিষ্ট ভাব বা চিন্তাই কেবল সে জানবে, যেটি হয়তো তার নিজস্ব চিন্তা বা মত থেকে ভিন্নও হতে পারতো। অর্থাৎ এভাবে মুখস্থ করার কারণে শিক্ষার্থী নিজে চিন্তা করতে পারছে না, নিজের চিন্তা বা মত প্রকাশও করতে পারছে না।

আর, এগুলো বা বিভিন্ন বিষয়ের উপরে রচনা লাইন বাই লাইন মুখস্থ করা, এমনকি একবার পড়ে, বুঝে সেটি নিজের ভাষাতে না লিখে যখন শিক্ষার্থীকে মুখস্থ করে হুবহু লিখতে বলা হচ্ছে, তার মাধ্যমে আসলে তার নিজের মতো করে বাক্য গঠনের দক্ষতাও নষ্ট হয়ে যায়, যা তার ভাষা দক্ষতাকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে।

একজন শিক্ষার্থী যখন বই কেনার জন্যে টাকা চেয়ে বাবার কাছে লেখা একটা চিঠি মুখস্থ করে, যে চিঠির বক্তব্যের সাথে তার বাস্তবতার কোনো মিল নেই (যেমন, একই পরিবারে একই বাসায় থাকার পরেও, হয়তো দেখা যায়, অন্য জেলায় থাকা বাবাকে লেখা চিঠি মুখস্থ করতে হচ্ছে), কিংবা ফুল ফ্রি স্টুডেন্টশিপের জন্যে প্রধান শিক্ষকের কাছে লেখা আবেদনপত্র মুখস্থ করে, যেখানে হয়তো ধনী ঘরের শিক্ষার্থীকে বলতে হয় আমার বাবা একজন দরিদ্র স্কুল শিক্ষক, এসব বাস্তবতা-বিবর্জিত চিঠি বা আবেদন পত্র মুখস্থ করিয়ে, একজন শিক্ষার্থীর স্বাধীনভাবে চিঠি বা দরখাস্ত লেখা দক্ষতা নষ্ট করে দেয়া হয়।

একদম শিশুকালে আমাদের মুখস্থ করতে হয়েছিলো গরুর রচনা, ইংরেজিতে দি কাউ। তারপরে প্রতি বছরই তিন পরীক্ষার আগে দুই তিনটি করে রচনা মুখস্থ করে, সেটির মধ্য থেকে একটা পরীক্ষা হলে খাতায় লিখে দিয়ে আসতাম, পরীক্ষার পরে ভুলেও যেতাম। এসবের কোনোকিছুই একজন শিক্ষার্থীর কোনো বিষয়ে মুক্তভাবে লেখার সক্ষমতা গড়ে তুলতে তো পারেই না, বরং নষ্ট করে দেয়।

অথচ হওয়া উচিৎ ছিলো, শিক্ষার্থীদের মুক্ত বা স্বাধীনভাবে রচনা লেখতে বলা। একটি গরু সামনে রেখে (হতে পারে গরুর ছবি বা ভিডিও) শিক্ষার্থীদের সেই গরু সম্পর্কে রচনা লেখতে বলা যেতে পারতো, কিংবা গরুর রচনা পড়তে দিয়ে, বলা যেতে পারতো, একইভাবে তোমার বাসায় বা এলাকায় থাকা অন্য কোনো একটি প্রাণীর উোপরে রচনা লিখে নিয়ে এসো। কেউ লিখতো মুরগী নিয়ে, কেউ ছাগল নিয়ে, কেউ কুকুর বা বিড়াল নিয়ে।

কোরবানী ঈদের পরে কোরবানী দেয়া পশুর ওপরেও রচনা লিখে আনতে বলতে পারতো। প্রথম দিনে কলেজে গিয়ে কী অভিজ্ঞতা হলো, কেমন লাগলো, কী কী করলাম, কত বন্ধু হলো না হলো, এই গল্প আমরা মুখে মুখে ঠিকই বলতে পারি। কিন্তু শিক্ষার্থীদের সেটাই লিখতে না বলে, একটা রচনা (যা আরেকজনের অভিজ্ঞতা) মুখস্থ করতে দিচ্ছি। ফলে, শিক্ষার্থীর কোনো বিষয় নিয়ে লেখার দক্ষতাই গড়ে উঠতে পারছে না।

মুখস্থবিদ্যানির্ভর শিক্ষাব্যবস্থায় তাই দেখা যায়, বেশিরভাগ শিক্ষার্থী কোনো বিষয় নিয়ে নিজের মতো করে লিখতে পারে না। হয়তো আড্ডার সময়ে, বন্ধুদের তর্ক-বিতর্কে সে ঠিকই অনেক কথা বলতে পারবে, কিন্তু যখন সেগুলোই লিখতে বলা হবে, সে কী লিখবে, আর খুঁজে পাবে না, মাথাটাই ফাঁকা ফাঁকা লাগতে থাকবে।

এই যে ভাষাদক্ষতার ঘাটতি নিয়ে বেড়ে ওঠে, তার কুফল ভোগ করতে হয় প্রতিটি বিষয়েই। কেননা, পরে যখন বিজ্ঞান পড়ে, সমাজ পড়ে, ভূগোল পড়ে, টপিকটা বুঝার পরেও নিজের ভাষায় লিখতে পারে না, মুখস্থ করা ছাড়া উপায় থাকে না। ফলে, চক্রটা চলতেই থাকে।

1 মন্তব্য

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে