আমাদের দেশ থেকে যেসব ছাত্রছাত্রী ব্রিটেনে পড়াশুনা করতে যায় তারা মধ্যবিত্ত, উচ্চ-মধ্যবিত্ত ও বিত্তবান পরিবারের সন্তান। ব্রিটেনে যাওয়ার তাদের সাধারণত দুটি উদ্দেশ্য থাকে। একটি হচ্ছে স্থায়ীভাবে ব্রিটেন থেকে যাওয়া বা ইউরোপের অন্য কোনো দেশে বা আমেরিকায় পাড়ি জমানোর চেষ্টা করা ।

আমরা জানি, শিক্ষা ব্যবসায় ব্রিটেন অনেক উন্নত বিশ্বের চেয়ে অনেকদূর এগিয়ে আছে। ‘ও’ লেভেল, ’এ’ লেভেল পরীক্ষা পরিচালনা, ব্রিটিশ কাউন্সিলের মাধ্যমে বিভিন্ন কোর্স পরিচালনাসহ ব্রিটেনে বা যুক্তরাজ্যে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উন্নয়নশীল বিশ্বের ছাত্রছাত্রীদের ভর্তি করানোর মাধ্যমে তারা তাদের এই শিক্ষা ব্যবসা পরিচালনা করে থাকে। গতবছর হঠাৎ করে তাদের এ বাণিজ্যে কিছুটা ভাটা পড়ে। সরকার হঠাৎ করে বিদেশি ছাত্রছাত্রী ভর্তির ব্যাপারে কিছুটা কড়াকড়ি আরোপ করায় এ ঘটনা ঘটে। পরে সরকার তার সিদ্ধান্ত পাল্টায়।

যেকোন দেশের প্রকৃত, যোগ্য ও ইংরেজি ভাষায় দক্ষ শিক্ষার্থীরা ব্রিটেনে  পড়ালেখার সুযোগ পাবে- বলেছেন প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন।  ২৫ মার্চ অভিবাসন-বিষয়ক  গুরুত্বপূর্ণ এক বক্তৃতায় তিনি বলেছেন যে,  যুক্তরাজ্যে ন্যায়সঙ্গত ও ভারসাম্যপূর্ণ আন্তঃসরকার অভিবাসন পদ্ধতি নিশ্চিত করার মাধ্যমে পরিশ্রমী ও উন্নয়ন অভিপ্রায়ী মানুষকে সহযোগিতার বিষয় প্রাধান্য পাবে। যাদের অবদানে ব্রিটেন সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী সমাজে পরিবর্তিত হয়েছে, সেই অভিবাসী সম্প্রদায়গুলোকে গুরুত্বপূর্ণ বলে স্বীকার করেছেন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন।

বিখ্যাত বিজ্ঞানী, চিকিৎক ও চিকিৎসাসেবী, শিল্পী, বাদ্যযন্ত্রী, ক্রীড়া তারকা বা ব্যবসায়ী নেতা, উদ্যোক্তা এবং কঠোর পরিশ্রমী ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী নারী ও পুরুষ- এরকম  অনেক সফল ব্রাইটনের পারিবারিক ইতিহাস অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে তাঁরা অন্যান্য দেশ থেকে ব্রিটেনে এসে আবাস গড়েছিলেন। এই হচ্ছে ব্রিটেনের ইতিবৃত্ত।    ক্যামেরন বলেন, “আমরা উদার ও বৈচিত্র্যময় দিককে স্বাগত জানাতে উন্মুখ”। তিনি যুক্তরাজ্যের অর্থনীতিতে অভিবাসননীতির ইতিবাচক প্রভাব তুলে ধরেন। আমরা চাই, বিশ্বের সেরা মেধাবী  ও উজ্জ্বল শিক্ষার্থীরা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বেছে নিক। ফলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীসংখ্যা বেধে দেওয়ার দরকার পড়বে না। তিনি আরও বলেন, যাদের  কঠিন  শ্রম ও বিনিয়োগ ব্রিটেনে চাকরি  ও কাজের  সুযোগ  তৈরি করবে, তাদের ব্রিটেন স্বাগত জানাবে। কারণ আমরা আমাদের অর্থনীতির ভবিষ্যত নিয়ে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার মধ্যে রয়েছি। যথার্থ অভিবাসন ব্রিটেনের জন্য শুধু সুবিধার নয়, জরুরিও”।

২০১১-২০১২ সালে শেফিল্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ৯,৩৭০ জন বিদেশি শিক্ষার্থী পড়াশুনা করেছে। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর স্যার কেউথ কারনেট বলেছেন, “বিদেশি শিক্ষার্থীরা অর্থনৈতিক বেনিফিট নিয়ে আসে। বিদেশি মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সাফল্যের ক্ষেত্রে মারাত্মক অবদান রাখছে। ব্রিটেনের অর্থনীতিতে অবদান রাখার জন্য তারা ধন্যবাদ পাবার উপযুক্ত”। লিয়াম বার্নস, এনইউএস প্রেসিডেন্ট  বলেছেন, “আমাদের বিশ্ববিদ্যালগুলোতে বিদেশি শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ণ এবং বৃহত্তর অর্থনীতিতে তাদের অবদান সর্বজনস্বীকৃত। অতএব বিদেশি ছাত্রছাত্রীদের ব্রিটেনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আসার জন্য তাদের উৎসাহিত করতে হবে তাদের সাংস্কৃতিক অবদানের জন্য; আর অর্থনীতিতে অবদানের কথা তো বলাই বাহুল্য”।

অক্সফোর্ড ব্রুকস হচ্ছে অ্যাসোসিয়েশন অফ চার্টার্ড সার্টিফাইড অ্যাকউন্ট্যান্টস। এটি শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ ও বিভিন্ন ধরনের সহায়তা প্রদান করে থাক। হিসাব করে দেখা গেছে, তাদের ৪৪ শতাংশ শিক্ষার্থী বিদেশি। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪৫,৬৮০, ওপেন ইউনিভার্সিটিতে ৪২,৬৮৫ এবং ইউনিভার্সিটি অফ ওয়েলসে ১৬,২৫০জন শিক্ষার্থী বিদেশি। শেফিল্ডে যারা পড়াশুনা করে তার ওই সিটিতে ১২০ মিলিয়ন পাউন্ড অর্থনীতি নিয়ে নাড়াচাড়া করে। অক্সফোর্ড ইকোনমিক স্টাডির মতে, শিক্ষার্থীদের বেতন, থাকা, যাতায়াত ১৩৬ মিলিয়ন পাউন্ড, ভিসা নীতি পরিবর্তন করার ফলে গত ১৬ বছরের মধ্যে গতবার ২০১১-২০১২ সালে এক শতাংশ কমেছে। কিছু দেশ থেকে ২০১২ সালে গ্রেট ব্রিটেনে পড়াশুনার জন্য দরখাস্ত কম পড়েছে। তবে কর্তৃপক্ষ আশা করছে এটি ভবিষ্যতে ঠিক হয়ে যাবে। ব্রাজিল ও ইন্দোনেশিয়া থেকে বরাবরই ব্রিটেন কম শিক্ষার্থী পড়তে আসে।

ব্রিটেনের অনেক শিক্ষাবিদের মতামত হচ্ছে- আমরাদের দেশে বিদেশি শিক্ষার্থী আসা আমাদের জন্য মঙ্গলজনক; কারণ তারা প্রচুর অর্থ নিয়ে আসে। আমরা চাই, ভিসা নিয়ে কোনো ধরনের বিদেশিদের ঝামেলা যেন পোহাতে না হয়। সহজভাবে  ভিসা নিয়ে তারা গ্রেট ব্রিটেনে প্রবেশ করুক। আমাদের দেশের কোম্পানিগুলোতে বিশেষায়িত বিষয়ে লোক দরকার— প্রকৌশলী দরকার, উঁচু মানের ব্যাবস্থাপক দরকার । পল্লী টয়েনবি যথার্থই বলেছেন যে, সংস্কৃতি এবং শিক্ষা দুটোই গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সম্পদ। আমাদের গবেষণায় দেখা যায় যে, ইংরেজি ভাষা-ব্যবসা ও ট্যুরিজম মেধাবীদের আকৃষ্ট করার বড় হাতিয়ার।

ম্যালকম গিলস, লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর সরকারের এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন। ইউকে বর্ডার এজেন্সি গত সেপ্টেম্বর মাসে লন্ডন মেট্রাপলিটান বিশ্বাবদ্যালয়ের বিদেশি শিক্ষাথীদের ভিসা বাতিল করে দেয় এই অভিযোগ তুলে যে, তারা ভিসা সঠিকভাবে মনিটরিং করতে পারেনি। ফলে ইউরোপের বাইরের যেসব শিক্ষার্থী ছিল, তাদেরকে মাত্র ৬০ দিন সময় দেওয়া হয় অন্য প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়ার নতুবা ব্রিটেন ছেড়ে দেওয়ার। প্রফেসর গিালিস বলেন, প্রতিবছর এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪০০০ বিদেশি শিক্ষার্থী পড়াশুনা করতে আসে। কিন্তু গতবছরের ওই ঘটনার পর মাত্র ১০০০ শিক্ষার্থী  ভর্তি হয়। ফলে ২০মিলিয়ন পাউন্ড আয় কমে যায়। কমে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে শিক্ষার সুযোগ-সুবিধা কমে যাওয়া এবং কর্মীসংখ্যা কমানো।

তিনি আরও বলেন, ইউকেবিএও কার্যক্রমের ফলাফল শুধু লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় নয়, তার বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে এবং সর্বত্র এই সংবাদ ছড়িয়ে পড়ায় এই বার্তা বহন করে যে, ব্রিটেন বিদেশি শিক্ষার্থীদেরকে আর আমন্ত্রন জানাবে না। বিশ্বব্যাপী মানহানিকর ব্যাপারও ঘটেছে। যদিও লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়কে  উদাহরনস্বরুপ বলা হয় বা ধরা হয়েছিলো কিন্তু ক্ষতিটা হয়েছে সর্বত্র। বিশ্ববিদ্যালয় এখনও ইউকেবিএ এবং হোম অফিসে এর বিরুদ্ধে আইনি লড়াই  চালিয়ে যাচ্ছে তাদের সিদ্ধান্তের বৈধতা  নিয়ে। পরবর্তী শুনানি অক্টোবর মাসে হওয়ার কথা।

ক্যামেরনের ঘোষণার পর লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় ২০১৩ সেপ্টেম্বর ভর্তির জন্য ৫০০০ শিক্ষার্থী ইতোমধ্যে দরখাস্ত করেছে এবং লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় এ নিয়ে ২৫টি দেশের সাথে কাজ করছে। কেইথ ভাস, লেবার এমপি এবং চেয়ারম্যান অফ কমনস হোম অ্যাফেয়ার্স কমিটি বলেন, “ইইএকেবির সিদ্ধান্ত ছিল দ্রুত। এটি খুব খারাপভাবে ব্যবহ্রত হয়েছিলো এবং ব্রিটেনে বিদেশি শিক্ষার্থী আসার ক্ষেত্রে ইউকেএর সুনাম মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে। এটি পুনরুদ্ধার করতে হবে”।

আমাদের দেশ থেকে যেসব ছাত্রছাত্রী ব্রিটেনে পড়াশুনা করতে যায় তারা মধ্যবিত্ত, উচ্চ-মধ্যবিত্ত ও বিত্তবান পরিবারের সন্তান। ব্রিটেনে যাওয়ার তাদের সাধারণত দুটি উদ্দেশ্য থাকে। একটি হচ্ছে স্থায়ীভাবে ব্রিটেন থেকে যাওয়া বা ইউরোপের অন্য কোনো দেশে বা আমেরিকায় পাড়ি জমানোর চেষ্টা করা । আর তা সম্ভব না হলে পড়াশুনার পাশাপাশি অবসর সময়ে কাজ করে অর্থ জমিয়ে দেশে এসে কিছু একটা করা। ব্রিটেনের যে কোনো বিশ্বাবিদ্যালয় কিংবা কলেজ থেকে একটি সার্টিফিকেট নিয়ে আসতে পারলে দেশে তার মূল্য দেশীয় কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা ছাত্রছাত্রীদের চেয়ে একটু বেশি তো হবেই। অন্তত ভাষাগত যোগ্যতা তো তাদের অনেক বেশি থাকবে। কিন্তু আমাদের দেশের মধ্যবিত্ত ও উচচমধ্যবিত্তের ছেলেমেয়েরা যদি দেশে পড়াশুনা করতো, তাহলে দেশে থেকে যেতো অনেক দেশীয় মুদ্রা, আমাদের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আরও চাঞ্চল্য ফিরে পেতো। দেশকে তারা সেবা দিতে পারতেন বিভিন্নভাবে। কিন্তু দেশের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অরাজকতাই তাদেরকে বাধ্য করে ব্রিটেনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ভর্তি হতে। সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে গভীরভাবে ভেবে দেখতে হবে বিষয়টি এবং সিদ্ধান্ত নিতে হবে বাস্তবতার নিরিখে এবং দেশের স্বার্থে।

Sending
User Review
0 (0 votes)

লেখক সম্পর্কে

মাছুম বিল্লাহ

মাছুম বিল্লাহ

মাছুম বিল্লাহ ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত রয়েছেন। তিনি সাবেক ক্যাডেট কলেজ, রাজউক কলেজ ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। বর্তমানে তিনি ইংলিশ টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইট্যাব)-এর প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

মন্তব্য লিখুন