লিচু চুরি ঠেকাতে লিচু গাছের পাহারাদার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থীর হাত ভেঙে দিয়েছে। কয়েকজন শিক্ষার্থী দলবেঁধে লিচু খেতে গিয়েছিল। এটিই তাদের অপরাধ। সেই অপরাধ ঠেকানোর জন্য লাঠিসোটা নিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করে।

অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম যে, লিচু চুরি নিয়ে কোনো শিক্ষক কিংবা প্রশাসনের কেউ বক্তব্য দেননি। ভাবখানা এমন যে, পাহারাদাররা উপযুক্ত বিচার করে দেয়েছে! প্রশাসনের কাজটি তারাই করেছে। সুতরাং কিছু বলার দরকার আছে কি!

শিক্ষার্থীদের অনেকের মধ্যেও এ-নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। না থাকার অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে শিক্ষার্থীরা ছাত্রলীগের নেতাকর্মী। সুতরাং এতেও কিছু বলা যাবে না। একদম উচিত শিক্ষাটাই দিয়েছে।

আমি প্রশ্ন করতে চাই— কয়জন শিক্ষার্থী আছে যারা গাছের আম খায় না? লিচু চুরি করে না? আমের মৌসুমে আমি তো দেখি অধিকাংশ শিক্ষার্থীই গাছে ঢিল ছুঁড়ে। তাহলে আজ সবাই একেবারে সাধু হয়ে গেলো কী করে?

মনে রাখা দরকার, প্রথমত, তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। তারপরে তারা বিভিন্ন শিক্ষার্থী-সংগঠনের নেতাকর্মী। আমি আরও দেখেছি, যে শিক্ষার্থীটি পরীক্ষায় নকল করে সেও এই হামলাকে বৈধতা দিয়েছে। পরীক্ষায় নকল করা যে আরও ভয়াবহ রকমের চুরি সেটি বোঝার ক্ষমতাও তাদের নেই।

কোনো শিক্ষক পরীক্ষায় নকল ধরলে তার প্রতিবাদ করতে পারে, কিন্তু পাহারাদার শিক্ষার্থীর হাত ভেঙ্গে দিয়েছে তার প্রতিবাদ করা যাবে না! আমি অবশ্যই এভাবে লিচু চুরি করে খাওয়াকে অন্যায় বলেই অভিহিত করছি। কিন্তু সেই অন্যায় প্রতিরোধের উপায় কি হাত ভেঙে দেওয়া?


শিক্ষার্থীদের গায়ে হাত তোলা অবশ্যই শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এদের উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা প্রশাসনকে করতে হবে। যদি প্রশাসন শাস্তি না দিতে চায়, তাহলে আমি জিজ্ঞেস করতে চাই, শিক্ষার্থীদের শায়েস্তা করার ক্ষমতা কি পাহারাদারদের ওপর ন্যাস্ত করা হয়েছে?


পাহারাদারদের দায়িত্ব কি সংঘর্ষে জড়ানো? শিক্ষার্থীদের ওপর হাত তোলার কোনোপ্রকার অধিকার পাহারাদারদের নেই। তারা লিচু চুরি বিষয়ে প্রক্টোরিয়াল বডিকে জানাতে পারতো। ক্যাম্পাসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা প্রক্টোরিয়াল বডি কাজ করেন। অপরাধের বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার অধিকার ও ক্ষমতা একমাত্র প্রক্টোরিয়াল বডির। অন্য কারো নয়।

একটি অপরাধ ঠেকাতে গিয়ে তারা বড় ধরনের অপরাধ করেছে। শিক্ষার্থীদের গায়ে হাত তোলা অবশ্যই শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এদের উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা প্রশাসনকে করতে হবে। যদি প্রশাসন শাস্তি না দিতে চায়, তাহলে আমি জিজ্ঞেস করতে চাই, শিক্ষার্থীদের শায়েস্তা করার ক্ষমতা কি পাহারাদারদের ওপর ন্যাস্ত করা হয়েছে?

বিদ্যামান ব্যবস্থায় লিচু চুরি করা বা গাছের ফল খাওয়া অপরাধ হিসেবেই গণ্য হয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন মৌসুমী ফলের গাছ লিজ দিয়ে থাকেন এবং তা থেকে প্রাপ্ত অর্থ বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন কাজেই ব্যয় করেন।

প্রশ্ন হচ্ছে, এ থেকে কতো টাকা আয় করে বিশ্ববিদ্যালয়? ক্যাম্পাসের ফলের ওপর শিক্ষার্থীদের অধিকার আছে। একজন শিক্ষার্থী গাছের ছায়ায় গল্প করবে, আড্ডা দিবে, গাছের যত্ন নিবে, গাছের সাথে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলবে, পরিবেশ রক্ষায় ভূমিকা পালন করবে। গাছের ফল খেতে পারবে না— এ কেমন আইন?

এভাবে ফল বিক্রি করা নৈতিকভাবে সমর্থনযোগ্য নয়। আমার মতে, ফল পাকার সাথে সাথে প্রতিটি বিভাগে প্রশাসনের তদারকিতে পাঠিয়ে দেয়া যেতে পারে। বিভাগের সকল শিক্ষক-শিক্ষার্থী-কর্মকর্তা এবং কর্মচারী ফল উৎসবে মেতে উঠতে পারে। এতে পরষ্পরের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা বাড়বে।

এবার আসা যাক এ-ব্যাপারে শিক্ষকদের কথা না বলা প্রসঙ্গে। খুব অবাক হয়েছি যে, কোনো শিক্ষক এ-বিষয়ে কথা বলেননি। সত্য বলতে কি, প্রশাসনের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের কাছে শিক্ষকরা অনেকাংশেই জিম্মি।


এ থেকে কতো টাকা আয় করে বিশ্ববিদ্যালয়? ক্যাম্পাসের ফলের ওপর শিক্ষার্থীদের অধিকার আছে। একজন শিক্ষার্থী গাছের ছায়ায় গল্প করবে, আড্ডা দিবে, গাছের যত্ন নিবে, গাছের সাথে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলবে, পরিবেশ রক্ষায় ভূমিকা পালন করবে। গাছের ফল খেতে পারবে না— এ কেমন আইন?


আমার বিগত নয় বছরের শিক্ষকতার আলোকে বলতে পারি, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাছে শিক্ষকদেরকে নতজানু হয়ে চলতে হয়। এবং এর জন্য প্রশাসনই দায়ী। শুধু বর্তমান প্রশাসন নয়, বহু বছরের চর্চা থেকেই এমনটি হয়েছে।

একজন শিক্ষক ফাইলের কাজে যাবেন, কিন্তু বসার কোন চেয়ার নেই। প্রথম, দ্বিতীয় এমনকি তৃতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারীর টেবিলের কাছে গিয়ে অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। বসার কোনো চেয়ার নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন মনে করে না যে, সেবাগ্রহীতার বসার অধিকার আছে!

তাছাড়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অহেতুক মাথায় তোলা হয়েছে৷ উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, শিক্ষকদের ছুটির ফাইল স্বাক্ষরের জন্য তিনটি স্বাক্ষর লাগে। এই তিনটি স্বাক্ষরের জন্য একজন শিক্ষককে সতেরো থেকে আঠাবোবার বিভিন্ন টেবিলে দৌড়াদৌড়ি করতে হয়। বলা বাহুল্য, যদি ছুটি জরুরি হয় তাহলে সেই ফাইল শিক্ষককেই বহন করতে হবে। পিয়ন পাওয়া যাবে না।

অর্থাৎ, একজন শিক্ষক প্রায়শই একজন পিয়নের কাজটুকু করে থাকেন। অথচ, এ-কাজটি মাত্র পাঁচটি ধাপেই সম্ভব। এইভাবে শিক্ষকদের হাত-পা-বেঁধে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাছে নতজানু করে রাখা হয়েছে।

তবে মজার ব্যাপার হলো, প্রশাসনের উর্ধতন কেউ গেলে তারা এমন তোষামোদি আচরণ করে যে, তাঁরা ধরেই নেয় যে শিক্ষকের প্রতি শ্রেষ্ঠ সম্মান প্রদর্শন করা হয়েছে! একজন শিক্ষকদের সেবা পেতে যদি এই অবস্থা হয় তাহলে শিক্ষার্থীদের অবস্থাটা একবার ভাবুন, সেটি কোন পর্যায়ে আছে!

আরও কিছু কারণে শিক্ষকদেরকে প্রশাসনের কর্মকর্তারা পাত্তা দেয় না। কিছু শিক্ষকের সঙ্গে কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শিক্ষার্থীজীবন থেকেই বন্ধুত্ব। সেই বন্ধুত্বের খাতিরে শিক্ষক ক্লাবে এসে তারা গলায় গলা জড়িয়ে সিগারেট টানেন। এতে ওই কর্মকর্তা বা কর্মচারীর মনে বদ্ধমূল ধারণা জন্মে যে, শিক্ষক আবার কী জিনিস! দ্বিতীয়ত, দলীয় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের অতিস্নেহ।

প্রসঙ্গত, জুবেরী ক্লাবে শীতকালে ব্যাডমিন্টন খেলা হয়। এখানে শিক্ষক ও কর্মকর্তারাই খেলেন। মাঝে মাঝে প্রশাসনের অন্য স্তরের কর্মচারীরাও খেলা দেখতে আসে। একদিন এক তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী আসলেন। বেশ কয়েকজন সিনিয়র শিক্ষক ছিলেন। সেখানে আবার উপ-উপাচার্যও ছিলেন। তিনি অতিশয় বিনয়ের সাথে কর্মচারীকে বসতে বললেন। তিনি বসলেন।

এ ঘটনার পর তার ভাব এমন হয়েছে যে, শিক্ষক আবার কেমন জিনিস? উপ-উপাচার্য যেখানে আমাকে এতো স্নেহ করেন সেখানে এরা কারা! এই ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ এখনও চলছে। এছাড়াও শিক্ষক এবং কর্মকর্তাদের ক্লাব একসাথে হওয়াটাও এক প্রকার দায়ী বলে মনে করি। এজন্য তারা শিক্ষককে সম্মান করেন না। তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেন।

শুধু শিক্ষক কেন? শিক্ষার্থীরাও নানাবিধ কারণে নতজানু হয়ে থাকে। উল্লেখযোগ্য, কিছু কিছু শিক্ষার্থী অবাধে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের স্যার বলে ডাকে। তাদের দ্বারা প্ররোচিত হয়ে শিক্ষকদের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ায়।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনডোর স্টেডিয়ামে নিয়মিত ব্যাডমিন্টন খেলতে যেতাম। অবাক হয়ে লক্ষ্য করতাম, শিক্ষককে স্যার বলতে তাদের লজ্জা হতো। কিন্তু একজন প্রশাসনের কর্মকর্তাকে স্যার বলতো।

ব্যাডমিন্টন এবং বাস্কেটবল কখনও কখনও একসাথে হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে প্রভাবশালী এক কর্মকর্তা শিক্ষার্থীদের উস্কে দিয়ে শিক্ষকদের বসিয়ে রাখেন৷ ব্যাপারগুলো কয়েকবার উপ-উপাচার্য বরাবর জানিয়েও কোনো লাভ হয়নি। এমনকি এর প্রতিক্রিয়াস্বরূপ গার্ড দিয়ে গেটে তালা লাগিয়ে দেয়া হয়েছে যাতে শিক্ষকেরা খেলতে না পারে! পরে অবশ্য উপ-উপাচার্য স্বয়ং খেলতে যাওয়াই অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হয়েছিলো। এখন সেই আগের অবস্থাই বিরাজমান।

এবার কথা বলতে চাই, ছাত্র সংগঠনের কর্মকাণ্ড নিয়ে। প্রশ্ন হচ্ছে, ছাত্র সংগঠনের নেতা কর্মীদের কাজ কি চুরি করা? শিক্ষার্থীরা ফল খাবেই। এটি প্রতিরোধের কিছু নেই। তবে সেটি যদি চুরি এবং ডাকাতির মতো হয় তাহলে এটি অপরাধ।


ক্যাম্পাসের ফল খাওয়ার মধ্যে আলাদা এক আনন্দ বিরাজ করে। এই প্রবণতা বিশ্বব্যাপী৷ শুধু বাংলাদেশেই নয়। এভাবে ফল না খেয়ে ছাত্র সংগঠনগুলো বরং ফল বিক্রির বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারে। ক্যাম্পাসের ফল খাওয়া যে অপরাধ নয় বরং নৈতিক অধিকার তা নিয়ে জনমত গড়ে তুলতে পারে।


এর আগেও দেখেছি যে, ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা বস্তা ভরে আম ও লিচু চুরি করে বিক্রি করেছে৷ তারা কেন এগুলোতে জড়াবে? এতে তো নিজেদের লজ্জিত হওয়া উচিত। গাছের ফল খাওয়া আর চুরি করা দুটো দুই জিনিস।

ক্যাম্পাসের ফল খাওয়ার মধ্যে আলাদা এক আনন্দ বিরাজ করে। এই প্রবণতা বিশ্বব্যাপী৷ শুধু বাংলাদেশেই নয়। এভাবে ফল না খেয়ে ছাত্র সংগঠনগুলো বরং ফল বিক্রির বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারে। ক্যাম্পাসের ফল খাওয়া যে অপরাধ নয় বরং নৈতিক অধিকার তা নিয়ে জনমত গড়ে তুলতে পারে। নিজেদের অধিকার আদায়ে ভালো ভূমিকা রাখতে পারে।

শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার কথা লিখতে গিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সার্বিক দিক তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। কেউ বিচার চান বা না চান আমি এই হামলার বিচার চাই। যে সকল শিক্ষক বিভিন্ন দায়িত্বে আছেন, তাঁরা যদি মনে করেন ঘাস কাটা আর রাস্তা পরিষ্কার করাই একমাত্র মহান কাজ, তাতে কিছু বলার নেই। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক-শিক্ষার্থীর৷ কর্মকর্তা-কর্মচারী তাদের সেবায় নিয়োজিত মাত্র। পার্থক্যগুলো বুঝতে চেষ্টা করতে হবে।

আমার জানামতে বর্তমান উপাচার্য তড়িৎ গতিতে অনেক ভালো কাজ করছেম। তিনি সার্বিক বিষয়গুলো বিবেচনা করে দ্রুত সমস্যাগুলো সমাধান করবেন বলে প্রত্যাশা রাখি। শিক্ষার্থীর হাত ভেঙ্গে দেওয়ার প্রতিবাদ জানাচ্ছি। এর উপযুক্ত বিচার চাই। পাহারাদারদের চাকরি থেকে বরখাস্ত করুন।

তবে এটিও ঠিক যে, বিদ্যামান ব্যবস্থায় যেহেতু লিজ দেয়া গাছের ফল খাওয়া অন্যায় তাই এর বিচারও প্রশাসনের করা উচিত বলেই মনে করি। ক্যাম্পাসে চুরি বন্ধের ব্যবস্থা হোক। যেনো এই রকম ঘটনা আর না ঘটে। শিক্ষার্থীদেরও শুভ বুদ্ধির উদয় হোক।

Sending
User Review
0 (0 votes)

লেখক সম্পর্কে

মোঃ মাহবুব আলম প্রদীপ

মোঃ মাহবুব আলম প্রদীপ

মোঃ মাহবুব আলম প্রদীপ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। বর্তমানে তিনি অস্ট্রেলিয়ার নিউ ইংল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি অধ্যয়ন বিভাগে পিএইচডি গবেষক হিসেবে কর্মরত।

মন্তব্য লিখুন