বাড়ি ভাষা শিক্ষা

শহীদ না শহিদ: বানান পরিবর্তনে করণীয়

শহিদ, নাকি শহীদ?
শহিদ, নাকি শহীদ?

২০১৫ সালে তৃতীয় শ্রেণির বই নিয়ে কাজ করতে গিয়ে একটি শব্দে খটকা লাগে—‘ভাষাশহিদের কথা’। কেন যেনো মনে হলো শব্দটি আগের মতো নেই। ছোটবেলায় দেখেছি শব্দটি ভাষা শহীদ, শহীদ দিবস বা এভাবেই আমরা অনেকবার দেখেছি। এবার তাই ভাষাশহিদ দেখে একটু খটকাই লাগলো। শব্দটি কি শহিদ হবে, নাকি শহীদ?

বইটির লেখকদের মাঝে একজনের সাথে পরিচয় ছিল। সেই সূত্র ধরে বইয়ের ওই অংশের ছবি তুলে তাঁকে ফেসবুকে মেসেজ দিলাম। বানানটি ঠিক আছে নাকি ছাপার ভুল তা জানতে। তিনি মেসেজের রিপ্লাই দিলেন বানানটি ঠিক আছে।

তখন জানলাম ভাষা শহীদ এখন থেকে ভাষাশহিদ লিখতে হবে। তারপর বছর দুয়েক চলে গেল। এতদিন বিষয়টি মাথায় ছিল না। ২০১৭ সালে এসে বাংলা একাডেমির বাংলা বানান অভিধান কিনে দেখলাম ওখানে লেখা শহিদ। আগের সংস্করণগুলোতে শহিদ, শহীদ দুটোই থাকলেও এ সংস্করণে দেখলাম শুধু শহিদ। এতদিনে বাংলা নিয়ে যারা কাজ করেন, বিশেষ করে এনসিটিবিতে তাঁদের অনেকের সাথে পরিচয় হয়েছে। তাদের কাছে জানলাম, এখন থেকে বাংলা একাডেমি চাচ্ছে যে বানানটা হবে শহিদ। বাংলা একাডেমি এর আগে ছিল বাংলা একাডেমী, এখন তারাও তাদের নামের বানান পরিবর্তন করে একাডেমি করেছে। যেটি অনেকের দাবি ছিল আরও আগে করার অর্থাৎ তাদের নিয়মানুযায়ী তাই হওয়ার কথা। এতোদিনে সেই দাবি পূরণ করা হয়েছে।

বাংলা ভাষার উৎকর্ষ সাধন ও আরও কিছু কাজের জন্য নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমির ২২টি কার্যাবলির মধ্যে—

১। জাতীয় আশা আকাঙ্খার সহিত সঙ্গতি রাখিয়া বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির উন্নয়ন, লালন ও প্রসার সাধন;

২। দ্রুত পরিবর্তনশীল ও প্রযুক্তির পরিবর্তন ও সম্প্রসারণের সহিত সঙ্গতি রক্ষা করিয়া এবং একই সঙ্গে, বাংলা ভাষার গৌরবময় ঐতিহ্য সমুন্নত রাখিয়া জীবনের সর্বস্তরে এবং জ্ঞানচর্চার সর্বক্ষেত্রে বাংলা ভাষার প্রচলন, ব্যবহার ও বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ ও সহায়তা প্রদান;

৩। বাংলা ভাষার প্রামাণ্য অভিধান, পরিভাষা ও ব্যাকরণ রচনা, রেফারেন্স গ্রন্থ, গ্রন্থপঞ্জি এবং বাংলা ভাষায় বিশ্বকোষ প্রণয়ন, প্রকাশন ও সহজলভ্যকরণ;

৫। বাংলা শব্দের প্রমিত বানান ও উচ্চারণ নির্ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ; (সূত্র: বাংলা একাডেমি আইন ২০১৩)

এই চারটি ( ১, ২, ৩ এবং ৫ নম্বরটি) বাংলা ভাষা নিয়ে। আর এর বলেই হয়ত তারা বাংলা ভাষায় পরিবর্তন করতে পারে।

আমি বাংলা বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নই। তাই ঠিক জানি না কেন ও কোন পরিপ্রেক্ষিতে বানান পরিবর্তন করা হয়। আমরা সাধারণ পাঠক বা ক্ষেত্রবিশেষে লেখার চেষ্টা করি মাত্র। এছাড়া প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা নিয়ে টুকটাক কাজ করতে হয়, তাই বাংলা বানানের সঠিক রূপ কোনটি তা জানা দরকার হয়। ভাষা প্রবাহমান, তাই এর পরিবর্তন হতেই পারে।

বাংলা একাডেমি যে শব্দগুলো পরিবর্তন করে তা পাওয়া যায় তাদের অভিধানে অথবা এনসিটিবি কর্তৃক প্রকাশিত পাঠ্যবইগুলোতে। যারা শিক্ষকতা বা টিউশনি করেন না এবং যাদের বাসায় স্কুলে পড়ুয়া শিক্ষার্থী নেই, তাদের জন্য এসব পরিবর্তন দেখার আরেকটি মাধ্যম হলো বাংলা একাডেমির অভিধান। প্রতিবছর এ অভিধান কেনা সবার জন্য সহজলভ্য নয়। আর যদি কেনাও হয়, তবে প্রতি পাতা পরীক্ষা করে জানা সম্ভব না কোন কোন শব্দে পরিবর্তন করা হয়েছে। যদিও কিছু কিছু পত্রিকা বাংলা একাডেমির বানান অনুসরণ করে, কিন্তু এ বছর দেখলাম তারাও শহিদ শব্দটিকে শহীদ-ই লিখছে। এমনকি যারা প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে কাজ করে, যেমন NAPE, তাদের ব্যানারেও দেখলাম ভাষা শহীদ। তাই বাংলা একাডেমির পরিবর্তিত বানান জানা সবার জন্য সহজ নয়।

বানান পরিবর্তনে একটি বড় সমস্যা থেকেই যায়, আর সেটা হয়ে থাকে সঠিক প্রচারের অভাবে। যেমন—যে বছর শহিদ বা ভাষাশহিদ করা হলো তার আগের বছর যে শিক্ষার্থী তৃতীয় শ্রেণিতে ছিল; সে এখন চতুর্থ শ্রেণিতে। সে কিন্তু জানে ভাষা শহীদ। এবার সে ছোট ভাইবোনের খাতায় দেখলো ভাষাশহিদ, তখন সে ভাবতেও পারে শব্দটি ভুল। আবার যে শিক্ষক গতবার পড়িয়েছেন ভাষা শহীদ এবার ভাষাশহিদ দেখে ভাবতেও পারেন এটি ছাপার ভুল। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের কোনো শিক্ষক হয়ত এটিকে ছাপার ভুল হিসেবেই ধরে নিবেন, তিনি আর কাউকে জিজ্ঞাসা করবেন কি-না সন্দেহ।

যদি তিনি এটা জিজ্ঞেস না করেন, তাহলে তাঁর কাছে এটি (ভাষাশহিদ) ভুল হিসাবেই উপস্থাপন হবে। তিনি তাঁর শিক্ষার্থীদেরও শুদ্ধ করে ভাষা শহীদ-ই পড়াবেন। তখন কি বাংলা একাডেমির উদ্দেশ্য সফল হবে?

এক্ষেত্রে বাংলা একাডেমি যদি এ বছর কোন কোন শব্দের পরিবর্তন আনা হয়েছে, তার একটি তালিকা তৈরি করে এবং সরকার থেকে তা প্রতিটি বিদ্যালয়ে পৌঁছে দেয়া হয় অথবা পাঠ্য বইয়ের শেষে একটি তালিকা দেওয়া হয়, যেখানে আগে কী শব্দ ছিল এখন কী ব্যবহার করা হচ্ছে তার একটি তালিকা থাকে তাহলে খুব সহজেই আমরা সাধারণ যারা আছি তারা পরিবর্তনগুলো দেখতে পারবো এবং তখন আর এ সমস্যাগুলো থাকবে বলে মনে হয় না। যারা শিক্ষার সাথে জড়িত নয়, তাদের জন্য যদি বাংলা একাডেমি তাদের ওয়েব সাইটে যে যে বানান পরিবর্তন করা হয়েছে তার একটি তালিকা রাখে, তাহলে আমরা সহজেই তা ব্যবহার করতে পারব। তখন আর এরকম সমস্যা হবে বলে মনে হয় না।

পৃথিবীতে বাংলাই একমাত্র ভাষা যার জন্য ১৯৫২ সালে আমরা তাজা প্রাণ ঝরিয়েছি। সেই ভাষার প্রমিতকরণ ও তার উৎকর্ষ সাধন এবং বাংলা ভাষার অভিধান প্রণয়নের জন্য বাংলা একাডেমি মুখ্য প্রতিষ্ঠান হিসাবে গণ্য হবে (সূত্র: বাংলা একাডেমি আইন, ২০১৩)। আর তাদের কার্যাবলিতেও ভাষার প্রচলন, ব্যবহার নিয়ে বলা আছে। তাই আশা করতে পারি বাংলা একাডেমি যে বানানগুলো পরিবর্তন করে, তা সর্বসাধারণের কাছে অতিদ্রুত পৌঁছে দিয়ে তাদের উদ্দেশ্য সাধন করবে। তা না হলে, বাংলা বানান নিয়ে প্রতিনিয়ত নানান ধরনের তর্ক-বিতর্ক সৃষ্টি হয়ে ভাষার সৌন্দর্য নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। বাংলা একাডেমি যে বানান পরিবর্তন করেছে, তা যদি আমরা দ্রুত জানতে পারি তাহলে সেটা আত্মস্থ করে হয়তো জাতি হিসেবে ভাষার দিক থেকে সবাই একটি জায়গায় দাঁড়াতে পারবো।

3 মন্তব্য

  1. সত্যিই আজ আমরা যারা লেখকেরা বাংলা ভাষায় বিভিন্ন গল্প কবিতা ও উপন্যাস লিখছি তাহা পূর্বের বাংলা আভিধানিক বইটি লক্ষ্য করেই সেই কবিতা গল্প ও উপন্যাসের বাক্য ভাষার বানানটিও ওভাবই লিখে চলছি, কিন্তু পরে দেখা যায় সেই লেখাটিতে অনেকের মন্তব্য আসে বানানটি যেন ভুল হয়েছে৷
    সুন্দর উপায়ে উপস্থাপন করেছেন ভাই, আপনার প্রতি আন্তরিক শুভেচ্ছা সহ অনেক অনেক ধন্যবাদ রইলো৷

    • বাংলা বর্ণপরিচয়ে যদি উ ও ঊ-কার এর মধ্যে একটি কার ই ও ঈ-কার এর মধ্যে একটি কার , খ ও ক্ষ এর মধ্যে একটি খ,
      শ,স,ষ থেকে মাত্র একটি শ,
      ঞ ও য় এর মধ্যে একটি বর্ণ য়,
      জ ও য এর মধ্যে একটি জ, ণ ও ন এর মধ্যে একটি ন, থাকতো তাহলে বাংলাভাষা হতো সারা পৃথিবীর মানুষের মুখের ভাষা।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Exit mobile version